মনি হায়দার
চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে ব্যাপারটা শোনে মকবুল হোসেন। ভান্ডারিয়া এলাকাটা আধা শহর, আধা গ্রাম। মকবুল হোসেন ঢাকার একটি দৈনিকের মফস্বল সংবাদদাতা। স্থানীয় কলেজে ইংরেজি সাহিত্য পড়ায়। সুন্দর ছিমছাম জীবন। আর গল্প লেখে। মফস্বলে থেকে গল্পকার বা লেখক হওয়া যায় না জানে এবং বোঝেও। তারপরও সে ঢাকায় থাকতে চায় না। পত্রিকার সম্পাদক তাকে একটু আলাদা চোখে দেখে। কারণও আছেÑ মকবুলের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে স্বচ্ছ আর নির্মেদ। ভণিতা ব্যাপারটা ওর মধ্যে নেই। সেসব কারণে নিস্তরঙ্গ মফস্বল শহরে থেকেও গল্পকার কাম সাংবাদিক হিসাবে সারা দেশে একটা ইমেজ তৈরি করতে পেরেছে।
চায়ের দোকানে সে প্রতি বিকেলে বসে, নদীর ওপারে যাওয়ার আগে। নদীটা খুব বড় নয়। সম্প্রতি স্থানীয় সংসদ সদস্য সরকারি দলে যোগ দেওয়ার নদীটার ওপর ইস্পাতের পুল তৈরি হয়েছে। নদীর এপারে মকবুলের বাড়ি। ওপারে বাজার, থানাসহ সব সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালত। কলেজটাও ওপারে। মকবুল হোসেন নদীটাকে খুব ভালবাসে। পুল হওয়ার আগে, সেই শৈশব থেকে নদীটা পার হত খেয়ায়। খেয়া পারাপারটাই তার কাছে অসাধারণ লাগত। পুল হওয়ার সেই অসাধারণ সাধ থেকে সে বঞ্চিত। মাঝেমধ্যে এখনও সে নৌকায় ইচ্ছে করেই নদী পার হয়ে থাকে। সকালে কলেজে আসে। বিকেলে ঘরে ফিরে যায়। খাওয়া-দাওয়া সেরে বিকেলে একটা ঘুম। প্রায় সন্ধ্যায় ঘুম থেকে উঠে চলে আসে এই চায়ের দোকানে। চা খেয়ে পুলটা পার হয়ে চলে যায় ওপারে। নানা খবরের খোঁজ নেয়। কলেজের ছাত্রদের জানানো আছেÑ সংবাদ হওয়ার মতো কোনও সংবাদ থাকলে বা তৈরি হলে যেন তাকে জানায়। কেউ কেউ জানায়ও।
চায়ের দোকানের সামনে টানা লম্বা তৈরি বেঞ্চে বসে আছে আরও দু’একজন। আগে থেকেই সবাই পরিচিতি। একজন বর্তমান সরকারি দলের থানা কমিটির একশো এক নম্বর সদস্য। কিন্তু তার দাপট প্রায় একজন প্রতিমন্ত্রীর সমান। নাম সোহরাব হোসেন। অন্যজন খেয়ামাঝি শাহাবুদ্দিন। দোকানদার মকবুলকে দেখেই চা বানায়। মকবুল বেঞ্চে বসে।
ভাতিজা, খবর শুনেছো ? সোহরাবের গলায় উল্লাস এবং ক্রোধ সাপলুডু খেলে।
চায়ের কাপটা হাতে নিতে নিতে তাকায় মকবুলÑ কি সংবাদ ?
তুমি কিয়ের সাংবাদিকতা কারোÑ সোহরাবের কণ্ঠে কর্কশ উম্মাÑ ভারত থেকে এক লোক এসেছে ! মকবুল ধীরে ধীরে চায়ের কাপে ঠোঁট ছোঁয়ায়। আয়েশ করে চোখ বুজে চায়ে চুমুক দেয়। ভেতরে ভেতরে তেতে ওঠে সোহরাব নির্লিপ্ত মকবুলের উপর। এলাকায় একজন ভারতীয় নাগরিক এসেছেÑ এই ভয়ঙ্কর খবরটা দেওয়ার পরও সে কেন প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে না ?
দু’জনার ভেতরে ঢুকে পড়ে শাহাবুদ্দিনÑ লোকটাকে থানার পুলিশ গ্রেফতার করেছে।
চমকে ওঠে মকবুল। ছলাৎ শব্দে কিছুটা চা ছিটকে পড়ে শাদা শার্টে। সোহরাব অভিন্ন চোখে দেখে মকবুলের প্রতিক্রিয়া।
পুলিশ কেন তাকে গ্রেফতার করেছে ?
গ্রেফতার করবে না তো চুমু খাবে ? জামাই আদর করবে ? তেতে ওঠে সোহরাব তার এবং তার রাজনৈতিক ধারণার মুখোশটা খুলে দেয়।
মকবুল মকবুল হোসেনের চরিত্রে রাগ বিষয়টা নেই। বরং অন্যরা ক্রোধ প্রকাশ করলে সে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। যেমনÑ সে এখন সোহরাবের রাগটাকে নিয়ে খেলছে স্বাভাবসুলভ আঙ্গিকে।
লোকটা কি চুরি-চামারি করেছে? চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে কথাটা ডেলিভারি দেয় মকবুল। চোখ স্থির রাখে সোহরাবের ওপর।
সোহরাব এবার বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং যাত্রার সংয়ের মতো নাচতে থাকেÑ চুরি-চামারিতো সামান্য ব্যাপার ! তার চেয়েও অনেক বড় ব্যাপার !
চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপটা দোকানদারের হাতে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মকবুলÑ লোকটা কি চায় ?
লোকটার কত বড় সাহসÑসোহরাব তড়পাতে থাকেÑমোল্লা বাড়ি দখল করতে চায়।
কোন্ মোল্লা বাড়ি ?
কেরামত মোল্লা বাড়ি। বলে কিনাÑ এটা ওর বাপ-দাদার বাড়ি ছিলÑ
তাই নাকি ?
হ্যাঁÑ
মকবুল হোসেন আর কথা বাড়ায় না। কারণ যতক্ষণ তাদের সামনে থাকবেÑ তিলকে তাল বানাবে, আসল কথা থাকবে যোজন দূরে। তার চেয়ে থানায়ই যাওয়া যাকÑ ভাবতে ভাবতে সে হাঁটতে আরম্ভ করে। হাঁটতে হাঁটতে মকবুল পুলটার ওপরে ওঠেÑ ভাবছে সে। একটা লোক যে সত্যি সত্যি ভারত থেকে এসেছেÑ সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কন্তিু কেন এসেছে ? বাংলাদেশ দখল করবে ? কি আশ্চর্যÑ একজন মানুষের পক্ষে কি বাংলাদেশ দখল সম্ভব ? লোকটা পাগল নাকি ? সে জানেÑ সাতচল্লিশে ভারত ভাগের সময়ে আজকের মোল্লা বাড়ির পূর্ব পুরুষেরা ঐ বাড়িটা কোনও না কোনও উপায়ে নিজেদের অধিকারে নিয়েছিল। জন্মসূত্রে যারা বাস করে আসছিল তাদের কথা কেউ মনে রাখেনি। গল্প পরস্পরার মকবুলেরা জানেÑ ঐ বাড়িতে যারা ছিল তারা খুব বনেদী আর প্রভাবশালী ছিল। এখনও মোল্লা বাড়িতে পুরনোকালের বিশাল বিশাল আকারের ক্ষয়ে যাওয়া পরিত্যক্ত ইটের দেওয়াল বিভক্তকালের সাক্ষ্য দিচ্ছে। ভাবনার বিমূর্ত ইজেলে গল্পকার গল্পকার কাম সাংবাদিক, মকবুল হোসেন পোনা নদী পার হয়ে পৌঁছে যায় ওপারে। পুল পার হয়ে মিনিট পাঁচেক হঁাঁটলেই থানা। খানিকটা দূর থেকেই সে দেখতে পায়Ñ থানার সামনেÑ পরিচিত-অপরিচিত মানুষদের একটা জটলা। জটলাটাই তার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দেয়। মোল্লা বাড়ি মেঝো মোল্লা সালাউদ্দিন জমাটবদ্ধ লোকজনকে কি সব বলছেন। তাকে দেখে সালাউদ্দিন জমাটবদ্ধ লোকজন ফেলে দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসে মকবুলের কাছে। মকবুল থমকে দাঁড়ায়। সালাউদ্দিনের চোখে-মুখে শ্বাপদের ছায়া নাচেÑ মকবুল, তোমার পত্রিকায় খবরটা শীঘ্র পাঠাওÑ আমরা বললে তো বিশ্বস করবে না, এইবার নিজের চোখে দেখোÑ
কি হয়েছে ?
কি আর হবে ? আত্মহত্যা করতে হবেÑ বয়সকালে ছেলেমেয়ে সংসার নিয়ে কোথায় যাবো ? দুই-দুইবার দেশ স্বাধীন হলোÑ তারপরও নিজের দেশে, নিজের বাপ-দাদার ভিটায় থাকতে পারবো না ? কথা বলতে বলতে সালাউদ্দিনের কণ্ঠে নেমে আসে বর্ণনানীত শোক, হাহাকার। উপস্থিত লোকজনের মধ্যে সালাউদ্দিনের হাহাকার তীব্রভাবে সংক্রমিত হয়Ñ তাদের একজন, ক্ষমতাসীন জাতীয়তাবাদীদের এক কর্মী জলদগম্ভীর কণ্ঠে যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে ঘোষণা দেয়Ñ সালাউদ্দিন চাচা, আপনি কিছু ভাববেন না। ক্ষমতায় এখন আমাদের সরকার। আমরা নির্যাতিত কাশ্মীর নাÑ মকবুল হোসেন ব্যাপারটা ভালো করে বুঝবার আগেই কি করে যে নির্যাতিত কাশ্মীর চলে এলোÑ তার মাথায় ঢুকছে না। সে ঘটনাটা বুঝতে চায়। মানুষের জটলা অতিক্রম করে মকবুল থানার ভেতরে ঢোকে। থানার চারপাশে ইতোমধ্যে শক্ত পুলিশি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে সাংবাদিক এবং থানার সবাই তাকে চেনেÑ বিশেষ করে থানায় আসা নতুন তরুণ ওসি’র সঙ্গে বিশেষ সম্পর্কটা সবাই জানে, ঢুকতে সমস্যা হয়নি। ওসি পুলিশি চাকরিতে ঢোকার আগে তিনি সাহিত্য চর্চা করেছেন। কিন্তু চাকরির চাপে এখন আর সাহিত্য চর্চা করা হয়ে ওঠে না। তবে পাঠ আছে। পাঠ করতে করতে সে উদীয়মান মেধাবী গল্পকার মকবুল হোসেনের গল্পের সঙ্গেও পরিচিত। সাংবাদিকতার কারণে মকবুলকে থানার ওসি থেকে আরম্ভ করে সম্প্রতি গোপনে গড়ে ওঠা বেশ্যালয়ের মালিক কাম সর্দারনীদের কাছেও যেতে হয়। ওসি শামসুজ্জামান অফিসেই ছিল। মকবুলকে দেখে সাহায্য মন্তব্য করে সেÑ কি গন্ধ পেয়ে গেছেন ?
হাসতে হাসতে চেয়ার দখল করে মকবুলÑ গন্ধ খোঁজাই যে আমাদের কাজ।
কি করতে পারি আপনার জন্যÑ সিগারেট অফার করে জিজ্ঞেস করে শামসুজ্জামান।
সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে মকবুল জিজ্ঞেস করেÑ লোকটার নাম কি ?
কাশিরাম সমাদ্দার।
কি চায় সে ?
আমার ধারণা লোকটা পাগলÑ মকবুলের কথার উত্তর না দিয়ে শামসুজ্জামান ভিন্ন মন্তব্য করে। বিষয়টা মকবুলের দৃষ্টি এড়ায় না।
কিভাবে বুঝলেনÑ কাশিরাম সমাদ্দার পাগল ? তার শরীরে কি জামা-কাপড় নেই ? সে কি কাউকে কামড়ে দিয়েছে ?
থানার ওসি শামসুজ্জামান একটু ঝুঁকে আসে মকবুলের কাছেÑ মকবুল, আপনি গল্পকার। অভিজ্ঞতা কম নয়Ñ সব পাগল ন্যাংটো হয় না। কামড়েও দেয় না।
তাহলে ?
সেয়ান পাগল কাশিরাম সমাদ্দার।
তার পাসপোর্ট নেই ?
আছে।
তাহলে তাকে আটকে রেখেছেন কেন ?
রেখেছি দুটো কারণে। প্রথমত কারণÑ সে বিদেশি হোক বা পাগল অথবা ছাগল হোকÑ খুনটুন হলে দায়িত্ব এসে পড়বে আমার ঘাড়ে। দ্বিতীয়মত, মোল্লা বাড়ির একটা রাজনৈতিক প্রভাবতো আছেই।
কিন্তু লোকটা কি চায় ? সত্যি কি সে মোল্লা বাড়ি দখল করতে চায় ? সে ক্ষমতা তার আছে ?
ক্ষমতা থাক আর থাকÑ একটা মূল পরিকল্পনা নিয়ে যে এসেছে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিতÑ শামসুজ্জামান তার রায় ঘোষণা করেÑ শরীরটাকে চেয়ারে এলিয়ে দেয়।
কাশিরাম সমাদ্দারকে নিয়ে এখন কি করবেন ?
ডিসিকে জানিয়েছি। তিনি ঢাকায় যোগাযোগ চেষ্টা করছেনÑ ঢাকার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছিÑ
আমি কি কাশিরামের সঙ্গে কথা বলতে পারি ?
ব্যাপারটা খুব রিস্কি হয়ে যাবে।
কোন রিস্ক হবে নাÑ পত্রিকায় রিপোর্ট করার আগে তার সঙ্গে দু’একটি কথা বলা দরকার।
ঠিক আছেÑ সেল-এ যানÑ তবে বেশিক্ষণ কথা বলবেন না।
আচ্ছা।
মকবুল সেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সেলে পাঁচজন লোক। চারজনই লুঙ্গি পরা, ডাঙাবুড়া চেহারার চারজন চুপচাপ একসঙ্গে বসে আছে ঠা-া মেঝেতে। কেবল একজন নির্বাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা পাতলা গড়ন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল সাদা। চোখে পাওয়ারের চশমা। পাজামা-পাঞ্জাবি পরা। হাতে একটা পোঁটলা। অভিজ্ঞ দৃষ্টিপাতেই মকবুল বুঝতে পারেÑ এই লোকটাই কাশিরাম সমাদ্দার। অনুমানকে সুনির্দিষ্ট করার জন্য গলায় কাশি আনে মকবুল। ফিরে তাকায় লোকটা। মকবুল ইশারায় কাছে ডাকে। চলে আসে জানালা থেকে মকবুলের কাছে। মকবুল অনুমান করার চেষ্টা করেÑ কত বয়স হবে লোকটার ? পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশের মতো। দু’জন মানুষ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। একজন মুক্ত। অন্যজন বন্দী। ব্যবধান লোহার গরাদ।
আপনিই কাশিরামÑ
জ্বী।
আমি মকবুল হোসেন। এখানকার লোক। একটা কলেজে পড়াই আর ঢাকার একটি জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় সংবাদদাতাÑ
সাংবাদিক শুনেই কাশিরামের চোখে-মুখে উজ্জ্বল আভা ফুটে উঠে।Ñ ভাই, আমি সেই দুপুর থেকে একজন সাংবাদিক খুঁজছিলাম।
কেনো ?
কাশিরাম হাতের পোঁটলাটা নামিয়ে রেখে দুটো শিকের মাঝখান থেকে হাত বাড়ায় এবং দ্রুত মকবুলের একটা হাত আঁকড়ে ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে আকুতি জানায়Ñ ভাই, আমাকে বাঁচান। বিশ্বাস করুন আমি খুব সাধারণ মানুষ। জন্ম নিয়ে কলকাতার বাইরেও তেমন একটা যাইনি। এখানকার লোকজন যা বলছেÑ তা ঠিক নয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনও রাজনীতিও করি নাÑ অনেক কথা বলার পর সে থামে। ইতোমধ্যে মকবুলের ধরা হাত অনেকটা শিথিল হয়েছে। ডান হাত নিয়ে চোখের কোণের পানিয়ে মোছে সে।
ঠিক আছে, আপনার কোনও ভয় নেই। অভয় দেওয়ার চেষ্টা করে মকবুল। কিন্তু আপনি কেনো এসেছেন ?
কাশিরাম সমাদ্দার স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। মকবুলের মুখের ওপর তাকিয়ে জবাব দেয়Ñ কিচ্ছু নাÑ সামান্য কয়েক মুঠো ছাই ফেলতে এসেছি।
কি ফেলতে এসেছেন ?
ছাই।
ছাই ?
হ্যাঁ।
কিন্তু কেনো ?
মেঝেতে রাখা পোঁটলাটা দেখিয়ে বলে কাশিনাথ সমাদ্দারÑ পোঁটলার মধ্যে আমার বাবার মৃতদেহ পোড়ার ছাই।
ছাই নিয়ে এসেছেন কেনো ?
আমার বাবার অন্তিম ইচ্ছেÑ তার জন্ম, শৈশব, বাল্যকাল-বয়োঃসন্ধিকাল যেখানে কেটেছেÑ সেখানে যেন দেহভস্ম ছাইÑ বলতে বলতে গলাটা ধরে আসে কাশিনাথ সমাদ্দারের।
মকবুল হোসেন পুরো ব্যাপারটা একটা স্বচ্ছ মানচিত্র দেখতে পায় চোখের সামনে। জন্ম, শৈশব, বাল্যকাল এবং বয়োঃসন্ধিকালের মোহন মৈথুন-মানুষের মৃত্যুর অন্তিমকালেও সামনে এসে দাঁড়ায়। অবশ্যই দাঁড়ায়। মানুষের যৌবন, পৌঢ়ত্ব, বার্ধক্য-চলে কামনায়, লোভে এবং উপরে ওঠার প্রতিযোগিতায়, দড়ি টানাটানিতে। কিন্তু জন্মকাল, শৈশবকাল, বাল্যকাল এবং বয়োসন্ধিকাল-বিলীয়মান পথের রেখায় বাঁশির সুরের মতো জেগে থাকে পূর্ণ পূর্ণিমায়, পূর্ণ অমাবশ্যায়। সে কারণেই কাশিনাথ সমাদ্দারের বাবাÑ
আপনার বাবার নাম কি ?
সোমনাথ সমাদ্দার। আপনি সাংবাদিক-আমার বাবার নাম জানা থাকতে পারে। উনি দীর্ঘদিন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
হ্যাঁÑ মনে পড়ছে। কিন্তু উনি জীবিত অবস্থায় আসলেতো ভালো করতেন। বিশেষ করে মন্ত্রী থাকাকালীন সময়েÑ বোঝেনতো সমাজ ক্ষমতাকে খুব মান্য করে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রী রাষ্ট্রীয়ভাবে আসতেন-দেখতেন আজকে যারা কান্নাকাটি করছে, বিরোধিকা করছেÑ তারা সর্বেসর্বা ফুলের মালা পরিয়ে দিতেন। বলতেন- আমাদের ছেলে সোমনাথ সমাদ্দার। স্মৃতিচারণের জন্য অনেক লোক ছুটে যেত। বন্ধুরা বলতো সোমনাথের সঙ্গে কতো ডাংগুলি খেলেছি। শিক্ষকরা বলত, সোমনাথের মেধা দেখেই আমরা বুঝেছিলাম ও একটা কিছু হবে। কিন্তু এখন সামান্য ছাই হয়ে আসায় দেখুন কি বিপত্তিটা বাজিয়েছেন ?
এ রকম যে ভাবিনি।
কি ভেবেছিলেন ?
ভেবেছিলাম বাবার দেয়া ঠিকানা অনুসারে এসে, বাড়িটি খুঁজে বের করেÑ আমার বাবার অন্তিম ইচ্ছের কথা বলবো। সঙ্গে সঙ্গে তারা রাজি হলেন। সামান্য কয়েক মুঠো ছাই ছড়িয়ে দেবো বাড়িতে; কিছুটা ছড়িয়ে দেবো পোনা নদীতে। কারণÑ বাবা পোনা নদীতে অনেক গোসল করেছেন, সাঁতার কেটেছেন। কিছুই হলো না উল্টো আমাকেÑ সোমনাথ সমাদ্দারের ছেলে কাশিনাথ সমাদ্দারের কথা আটকে যায়।
যাই হোক, আপনিতো ঠিক বাড়িতে গিয়েছিলেন ?
হ্যাঁ-ওরা, ওই সালাউদ্দিনের সঙ্গে আমি প্রথমে কথা বলিÑ সে প্রথমে রাজি হয়ে আমাকে বাড়িতে নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর তার বাবা, বৃদ্ধ মানুষ, কেরামত মোল্লা বাবার সঙ্গে স্কুলে পড়তো সে এসে আমাকে হুমকি দেয়া আরম্ভ করে। বারবার জানতে চায়Ñ আমি একা এসেছি না সঙ্গে আরও লোক নিয়ে এসেছি, আমি যত বুঝাতে চাই তারা সবাই তত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ইতিমধ্যে বাড়িতে অনেক লোক জমেছে। কেউ একজন থানায় খবর দেয়। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে। তারপরতো দেখতেই পাচ্ছেনÑ
আপনার খাওয়া দাওয়া হয়েছেÑ
খাওয়া দাওয়া বাদ দেন। আমার যে কি হবে বুঝতে পারছি না।
কাশিনাথ ?
বলুন।
আমার মনে হয় পুলিশ গিয়ে আপনাকে নিয়ে এসে ভালোই করেছে। নইলে এতোক্ষণে আপনি মানুষ থাকতেন না। লাশ হয়ে যেতেন।
সেটা আবারও মনে হয়েছে।
ওসি শামসুজ্জামান এসে দাঁড়ায়Ñ মকবুল আর কতো ?
একটু কথা বলছি। অসুবিধা কি ?
সরকারি দলের কয়েকজন লোকাল নেতা ভিতরে এসেছে। তারা চাচ্ছে নাÑ আপনি বেশি সময় এখানে থাকেন। তাছাড়াÑ
কি ?
দেখছেন না বাইরে কত লোক জমা হয়েছে। মকবুল হোসেন বাইরে তাকায়। আশ্চর্য ! অনেক লোক। কোত্থেকে আসে এরা ? কি চায় ? এইসব মানুষ নিশ্চয় বিশ্বাস করছে কাশিনাথ সত্যিই ভারত থেকে এসেছে কেরামত মোল্লার বাড়ি দখল করতে। এদেশের মানুষ যেভাবে কান কথা বিশ্বাস করে ! সম্ভব-অসম্ভব, বাস্তব-অবাস্তব কোনও কিছুই বুঝতে চাইবে না। কেউ একজন উসকে দিলেই হলো থানা আক্রমণ হতে পারে।
মকবুল খুব বিপন্ন আর অসহায় বোধ করে। এতোসব মানুষ, কাশিনাথ সমাদ্দারের পক্ষে। থানার ওসি শামসুজ্জামানকে যতোটা বুদ্ধিদীপ্ত, বাস্তববাদী, প্রগতিমনস্ক মানুষ সে ভেবেছিল, আসলে শামসুজ্জামান তা নয়। খোলস এঁটে সরকারি পোশাকপরা একজন সুবিধাবাদী মাত্র।
চলে আসুন মকবুলÑ ওসি তাড়া দেয়।
আপনি যান, আমি আসছি।
তাড়াতাড়ি আসেনÑ ওসি পা বাড়ায়।
আচ্ছা ওসি সাহেবÑ ডিসির কাছ থেকে কোনও খবর পেলেন ?
আধঘণ্টা আগে ফোন করেছিল ডিসির অফিস থেকে। খুব শীঘ্রই ঢাকার সংবাদ জানানো হবে। ওসি চলে যায়।
মকবুল হোসেন ভাবেÑ ঢাকা পর্যন্ত, সরকারের কাছে যখন খবরটা পৌঁছেছে তখন কাশিনাথ সমাদ্দার অনেকটা নিরাপদ। বিকেলের ফিকে হয়ে আসার রোদ গাছের উপর আড়াআড়িভাবে হেলে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর সন্ধান নামবে। তারপর রাত। সারারাত কাশিনাথকে মৃত পিতার ভস্ম নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হবে ? বাইরে মানুষজনের উত্তেজনা বাড়ছে।
কি ভাবছেন ? প্রশ্ন করে কাশিনাথ।
ভাবছি কতো সরল সাধারণ আবেগমহিত একটি বিষয়কে মানুষ তার বুদ্ধিবিবেকহীনতা আর স্বার্থের কারণে কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে !
জানেনÑ আমার বাবা সময় পেলেই পূর্ব বঙ্গে কথা অর্থাৎ বাংলাদেশের গল্প বলতেন। তার কতো সহস্র যে স্মৃতি এখানের মানুষ সম্পর্কে। অনেকবার আসতে চেয়েছেনÑ সংসার, রাজনীতি ইত্যাদির কারণে আসতে পারেননি। তার সঙ্গে কেউ আধাঘণ্টা কথা বললেই বুঝতে পারবেনÑ যে মানুষটা শারীরিকভাবে আছেন পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু মানসিকভাবে, দিব্য দৃষ্টিতে আছেন পূর্ব বাংলায়, সাতচল্লিশের দাঙ্গার কারণে পশ্চিমবঙ্গে যেতে হয়েছিল, ভেবেছিলেনÑ এটা সাময়িক, দাঙ্গা কমলে আবার ফিরে আসবেন বাস্তুভিটায়। কিন্তু দাঙ্গা কমলেও ফিরে আসা আর সম্ভব হয়নি। কারণÑ বাবার বাবা আমাদের ঠাকুরদা খবর পেয়েছিলেন-তাদের বাস্তুভিটা দখল হয়ে গেছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বৈরী সরকার। বুকভাঙ্গা বেদনাকে সঙ্গী করে কলকাতায় শুরু হলো তাদের অন্যজীবন। সেই অন্যজীবনের প্রতিটি শোকে এবং আনন্দে আমার বাবা তার জন্মস্থানকে মনে রেখেছেন। বিনিদ্র রাত জেগে কাটিয়েছেন। আসবেন আসবেন করেও আসা হয়ে উঠলো না। বছর তিনেক আগে অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। তখন প্রতিদিন বলতেন তার ফেলে আসা আম কুড়ানো শৈশবের গল্প। আর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে আমার হাত ধরে বলেছিলেনÑ কাশিনাথ, আমি তো আর যেতে পারলাম না, মরার পর কয়েক মুঠো ছাই আমার শৈশবের বাড়িতে আর বাড়ির সামনের পোনা নদীতে ফেলে আসিস। আমি স্বর্গে বসে দেখবোÑ
কাশিনাথ আবার কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মকবুল হোসেন গরাদের ফাঁক দিয়ে মাথায় হাত রাখে। স্বাস্থ্যবান মানুষটাকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখে মকবুল নিজেকে সামলাতে পারে না, চোখে পানি আসে।
সন্ধ্যার পর ছায়া নেমে আসে থানায় কম্পাউন্ড জুড়ে। বিষণœ অসহায় মকবুল ফিরে আসে ওসির টেবিলে। ওসি জানায়Ñ কাশিনাথ সমাদ্দারকে নিয়ে যাবার জন্য ডিসি কিছুক্ষণ আগে ফোন করেছে। গাড়ি তৈরি, নিয়ে যাবেই এখনই। লোকটাকে এভাবে বিদায় করতে পারায়, কোন ঝামেলা ছাড়াই সে খুব খুশি। টেবিলের উপর দু’হাতে ছন্দ তোলে।
গাড়িতে ওঠানো হয়েছে কাশিনাথ সমাদ্দারকে। পাশে দাঁড়িয়ে আছে মকবুল হোসেন। কাশিনাথ ভরসা পায় মকবুলকে দেখে। মকবুল হাত বাড়ায় কাশিনাথের কাঁধে। চোখে চোখ রেখে অভয় দেয়Ñ বলে, কিছু ভাববেন না। কেউ আপনার কোনও ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ অলরেডি ঢাকায় আমার পত্রিকায় বিস্তারিত জানিয়ে রিপোর্ট করেছি। আর যতদুর প্রশাসনে আলাপ করে জেনেছিÑ ব্যাপারটা আপনার দূতাবাসকেও জানানো হয়েছে।
কাশিনাথ সমাদ্দার চোখ তুলে তাকায়Ñ যতদিন বাঁচবো, আপনার কথা মনে রাখবো।
হাসে মকবুলÑ আপনাকেও মনে থাকবে আমার।
ড্রাইভার ফিরে আসে। সে দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসে। এখই গাড়ি স্ট্রার্ট দেবে। চারদিকে অজস্র মানুষ। মানুষজন ঘিরে দাঁড়ানো পুলিশ। সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। সবার মনে স্বস্তি। যাক-বাঁচা গেল। এখনই ছুটবে গাড়ি সামনের দিকে। কাশিনাথের পায়ের কাছে রাখা সোমনাথ সোমদ্দারের ভস্মেয় পোঁটলা। তাকায় কাশিনাথ।
আচমকা মাথায় একটা প্রশ্ন আসে মকবুল হোসেনেরÑ কাশিনাথ, যদি কেউ বাংলাদেশ থেকে এমন মানুষ, আপনার বাবার মতো, কবরের জন্য এক টুকরো মাটি আনতে যায়Ñ তার জন্মের শৈশবের গ্রামেরÑ আনতে পারবে কি ?
ইতিমধ্যে অন্ধকার গাঢ় হয়েছে আরও। কাশিনাথের মাথাটা ঝুলে পড়ে হাঁটুর উপর। কয়েক পলকের মধ্যে গাড়িটি আর দেখা যায় না।
মনি হায়দার, কথাসাহিত্যিক