নির্মল সরকার
মাটির সুরে বাংলার লোকায়ত গানের কথা বলতে গেলে যে গানের কথা সর্বাগ্রে মাথায় আসে তা হল ‘ভাটিয়ালি’ গান। নদীমাতৃক বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চলের একটি অন্যতম জনপ্রিয় সঙ্গীত ধারা। ভাটি অঞ্চল মূলত মেঘনা নদীর অববাহিকা এবং ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তর-পূর্ব দিকের হাওড়, বাওড়, খাল বেষ্টিত এক বিশাল ভূভাগ।বাংলাদেশের নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, সিলেট, হবিবগঞ্জ, ব্রাহ্মণবেড়িয়াসহ এদেশের আসামের শিলচর, করিমগঞ্জ মিলিয়ে সাতটি জেলার প্রায় আড়াই কোটি মানুষ এই ভাটি অঞ্চলের অন্তর্গত। এই বিস্তীর্ণ জনপদ ঘিরেই ভাটিয়ালি গানের সৃষ্টি, চর্চা ও প্রসার। আনুমানিক ১৩৫০ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা সাহিত্যর অন্ধকার যুগ শেষ হয়ে মধ্যযুগ শুরু হওয়ার সাথে সাথে পূর্ববঙ্গে বাংলার আদি লোকসঙ্গীতে ভাটিয়ালি গানের বিকাশ ঘটতে থাকে।
ভাটি অঞ্চলের ঋতু দুটি – বর্ষা আর হেমন্ত। হেমন্তে নতুন ধান উঠলে গ্রামের মেয়ে বউরা দল বেঁধে মেতে উঠতো “ধামাইল” গানে। তাই বর্ষাতেই ভাটিয়ালি বেশি গাওয়া হতো। সাধারনত বৈশাখের শেষে বা জৈষ্ঠ্যের শুরুতেই ভাটি অঞ্চলে বর্ষা শুরু হয়, উজানের জলে নদ, নদী, খাল, বাওড় প্লাবিত হয়।ভাটির জনপদ কর্মহীন হয়ে পড়ে। জল একটু নামতেই ভাটির টানে ফিরে আসে উৎসবের মেজাজ, ঘর থেকে বের হয় নৌকা। মাঝি মল্লার ভাটি গাঙে নাও ভাসিয়ে আপন মনে গাইতে থাকে ভাটির সেই মন কাড়া সুরে,-
মন মাঝি তোর বৈঠা নে রে,
আমি আর বাইতে পারলামনা।
আবার কখনও
তুমি কার বা বুকের মানিক ওগো, কার বা ঝিয়ারী।
কাঁন্দো কেন নদীর ঘাটে, তোমার নেই কি ঘরবাড়ি।
ভাটির দিকে পাল তোলা নৌকার ক্ষেত্রে যেহেতু শুধু হাল ধরলেই নৌকা চলে, তাই দীর্ঘ নদীপথের অলসতা কাটাতে সবাই নৌকার ছইয়ের উপরে বসে একজন হাল ধরে বাকীরা মজে যেত ভাটিয়ালি গানে।মাসের পর মাস বাড়ি ছাড়া মাঝিদের আকূল পরানের কষ্ট দূর হতো নানা বিরহ বিচ্ছেদের ভাটি সুরে। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে শোনা গ্রাম্য যুবক যবতীদের প্রাণে তুলতো প্রেমের ঢেউ।কেউবা স্বজন বিয়োগের অতীত রোমন্থনে একাত্ম হতো মাঝির সুরের সাথে। তাই বোধহয় গবেষক নির্মলেন্দু ভৌমিক যথার্থ বলেছেন,”ভাটিয়ালি গান যত না নদী-প্রান্তরের গান, ঢের বেশি কোনো একটি বিশেষ অঞ্চলের(পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চল) গান।” আবার কতিপয় গবেষকগন ভাটিয়ালি গানের উদ্ভাবক হিসেবে দূর পথের বাণিজ্য নৌকায় সওয়ার হওয়া মাঝি মল্লারদেরকেই মনে করেন। ফিরতি বাণিজ্য পথে নদীর দু’ধারের অনেক দৃশ্য মাঝিদের মনে গানের জন্ম দিত। নৌকার পালের সঙ্গে মন পালকেও ভাসিয়ে দিয়ে তারা গাইতো –
কলসী কাঁখে যায়গো কইন্যা
নদীর প্রান্ত দিয়া।
ফিইরা ফিইরা চায় কেন সে
কাঁইপে যে মোর হিয়া রে..।।
বাউল সাধকরা মনে করেন, ভাটিয়ালী কখনই দেহতত্ত্বের গান নয়, এ গানে প্রকৃতি তত্ত্বই প্রাধান্য পায়। অনেকে বলেন – এ গান মূলত গ্রামীন মানুষের প্রেম বিরহ হতাশা নৈরাশ্য নিয়ে তৈরী হলেও পরবর্তীকালে এর সাথে ধীরে ধীরে বাউল দর্শন ও আধ্যাত্মিক রস মিশেছে। ভাটিয়ালি গান মূলত রচনা হয় – মাঝি, নৌকা, দাঁড়, পাল, গুন এগুলিকে নিয়ে। তবে এর মধ্যদিয়ে নদী পাড়ের গ্রামীণ জনজীবন, নর-নারীর প্রেম, বিরহ, ভালোবাসা, নৈরাশ্য, আকূলতা ব্যক্ত হয়। মাঝি নৌকার সাথে সম্পর্কিত হওয়ায় এ গানকে অনেক সারি গানের কাছাকাছি ভাবেন। সুরের প্রাধান্য ভাটিয়ালি গানের একটি বিশেষ গুণ।
আসলে ভাটিয়ালি কোনো কাব্য বা ছন্দ নয়, এটা একটা সুর। উদ্ভবকালে এ সুর নৌকা মাঝির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও কালক্রমে তা সাধারন মানুষ, রাখাল, কৃষক, বাড়ির গৃহিনীদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, এমন কি বাউল, মুর্শিদি গানেও এ সুর প্রভাব বিস্তার করে। বিশিষ্ট গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য বাংলার লোকসাহিত্য গ্রন্থে যথার্থ বলেছেন,-“অন্তরের সুগভীর ভাব ও সুক্ষ্মতম অনুভূতি প্রকাশ করিবার ভাটিয়ালির যে শক্তি, তাহা বাংলার আর কোনো সঙ্গীতে নাই।”
ভাটিয়ালি গানের লয় বিলম্বিত,সুর করুন, উদাসীন ও বিবাগী। রচনার দিক থেকে নিতান্ত সহজ সরল হলেও এর মাহাত্ম্য এটাই যে মুহূর্তের মধ্যে এ গানের গভীর বেদনার্ত ও অতলাশ্রয়ী সুর মনকে আন্দোলিত করে মধুর আবেদন তৈরী করে দেয়। হৃদয় বিগলিত হয় গায়কীর সকরুণ আবেশে। কিন্তু যান্ত্রিকতার গ্রাসে বাংলার নদী, খাল, বাওড় কমছে। এখন আর সেই পালতোলা সওদাগরী নৌকার দেখা মেলেনা, ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে বাংলার জনপ্রিয় লোকধারার এই ভাটিয়ালি গান।
নির্মল সরকার, বগুলা, নদীয়া।