এনামুল গোফরান চৌধুরী : “ভালোবাসা” – চার অক্ষরের একটি সহজ সরল নিরীহ গোবেচারা শব্দ, কিন্তু বিশাল এর ব্যপ্তি, ততোধিক অতলান্ত গভীর এর অনুভূতি। মনে হয় ভালোবাসা নামক এক মহাসমুদ্রের বেলাভূমিতে আমি এক মরীচিকা। কত দেখেছি ভালবেসে সুখী হতে; ভালবেসে ভিখারী বিবাগী হতে; ভালবেসে পরিণয় হয়েছে, তারপর যে ভালোবাসা উধাও হয়েছে তা আর ফিরে আসেনি যুগের পর যুগ এক ছাদের নীচে থেকে; ভাল না বেসেও পরিণয় হয়েছে, কিন্তু কখনো ভালোবাসা বাসা বাঁধেনি, পরিণয় হয়ে ভালোবাসা হয়েছে, কিন্তু তাও দৃষ্টির অগোচরে প্রতারণা প্রবঞ্চনায় পরিণত হয়েছে, ভালবেসে প্রণয় হয়ে ওঠেনি, অথচ সে ভালোবাসা বিরাজ করছে অনন্তকাল, গভীর থেকে গভীরতর হয়ে, রেল লাইন সমান্তরালে বহমান। অব্যক্ত বা বোবা ভালোবাসাও দেখেছি, ভালোবাসা দিয়ে গেছে, কিন্তু শোনানো হয়ে ওঠেনি; ভালোবাসা পেয়ে গেছে, অনুভূতিতে অনুভব করেছে, দৃষ্টির গভীরতায় ডুব দিয়ে দেখে আসা হয়েছে, কিন্তু শোনা হয়নি কান পেতে। দেখেছি দূর্বোধ্য ভালোবাসাও, প্রিয়জন না প্রয়োজন বুঝা যায়নি; স্বার্থপরতা না ভালোবাসা, লগ্নি না ভালোবাসা, আবেগ না ভালোবাসা, বিবেক না ভালোবাসা, স্পন্দন না ভালোবাসা – ব্যবচ্ছেদ করা যায়নি।
এখানে যেমন হাসি আছে, আকর্ষণ আছে, মোহ আছে, প্রতীক্ষা আছে; তেমনি আছে বিরহ, দ্রোহ, উপেক্ষা; আছে কান্না – চাপা কিংবা সজল স্বশব্দ। তথাপি সবাই ছোটে, ছুটছে – ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসার পিছু – আশায় বুক বেঁধে; বাস্তবে, কল্পনায়, স্বপ্নে, দুঃস্বপ্নে; ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে, পরিবারে পরিবারে; সাহিত্যের পরতে পরতে, অর্কেস্ট্রার অন্তরা মুখরায়, সেলুলয়েডের ফিতায়, পোট্রেট ক্যানভাসে তুলির আঁচড়ে, আকাশের ঠিকানায়। যেন ভালোবাসা ব্যতিরেকে নিস্তার নেই, গত্যন্তর নেই; যেন অনিবার্য্য, অপরিহার্য্য; যেন জীবনের জন্যে, বেঁচে থাকার জন্যে ভালোবাসাই রসায়ন, নিউক্লিয়াস। হোঁচট খাচ্ছে তবুও ছুটছে, প্রতারিত হচ্ছে তবুও ছুটছে; পেয়েও ছুটছে, আরো চাই; না পেয়েও ছুটছে, পেতে যে হবেই; পেয়ে হারিয়েছে, আবার খুঁজে ফিরছে, ভুল হয়ে গেছে বলে; এ এক অনন্ত যাত্রা; ক্লান্তিহীন, বিরামহীন, বিশ্রামহীন। কোন যুক্তি মানেনা; তর্ক চলেনা; স্থান, কাল, পাত্র, ধম্ম, অধম্ম, জাত, পাত, বর্ণ, গোত্র, ভেদ বোঝেনা; আবেগ আর শিহরণের বল্গাহরিণের পদভারে শাসিত ও শোষিত হয় বিবেক, জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেচনা। কখনো কখনো কেবলি রুধির হয়ে অশ্রু ঝরায়, গলায় কলসি-উড়না বাঁধায়, পরিণতি জলে, গাছের ডালে, ঘরের কার্নিশে, ফ্যানে; কখনো একা, কখনো যুগলবন্দী। তখন গরলও মনে হয় নেক্টার, হলিগ্রেইল, মৃতসঞ্জীবনী সুধা; পেটে বুকে কন্ঠে শিরায় আমূল বসিয়ে দেয়া ফলার শোণিত স্রোতও যেন অমীয়ধারা। আবার মন্দির মসজিদ গীর্জা থেকেও পুত পবিত্র, ঐশ্বর্য্যমন্ডিত; মাধুরী প্রবাহিত – শতধারায় শতদিকে ধিকি ধিকি, হৃদয়ের গহীনের অলিন্দে অলিন্দে, নিভৃত কোন আস্তাবলে। ভালোবাসার কোন দিন-ক্ষণ, মুহূর্ত-প্রহর-দন্ড নেই, তথাপি বছর চক্রে একটা দিবস আসে, নতুন করে আশায় বুক বাঁধতে; নতুন করে ভালোবাসায় সিক্ত হতে; পুরনো ভালোবাসায় মাধুরী মেশাতে; মরিচা পড়া দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া ভালোবাসাকে আবীরে রাঙাতে। ভালোবাসা শিক্ষা দিতে, হৃদয়ের দ্বিপ জ্বালাতে; ভালোবাসার শ্রী ও মাধুর্য্যে অবগাহনের ধৈর্য্য ও পরিচর্চা শেখাতে; ভালোবাসা এবং পঙ্কিলতা ও মলিনতার ব্যবচ্ছেদ শেখাতে। সর্বোপরি ভালোবাসাকে ভাল ও পরিচ্ছন্ন রাখতে, ভালোবাসার সাথে শুদ্ধাচার করতে। ভালোবাসার দিনে সবার জন্য ভালোবাসা, ভালোবাসা শুধু ভালোবাসা, বয়ে যাক ফল্গুধারা হয়ে অমলিন অনন্তকালের সীমানা পেরিয়ে।
এনামুল গোফরান চৌধুরী, প্রাবন্ধিক ও চিন্তক