গৌতম বিশ্বাস:
বাবা মারা গিয়েছিল আগেই। এরপর মাও মারা গেলে যখন আকাশ জোড়া একরাশ শূন্যতা এসে দাঁত নখ বের করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল আমার ওপর, ঠিক তখনই জীবনে এসেছিল অপর্ণা।
এক দুপুরে তার খবরটা এনেছিল নিবারণ ঘটক। বলেছিল,” মেয়েটা দেখতে যেমন, তেমনই তার স্বভাব চরিত্র। ছোটবেলা থেকেই তো দেখছি। বিয়ে করলে তুই সুখীই হবি গোবিন্দ। ”
আমার তখন জীবন জোড়া অসুখ। বাবা-মায়ের না থাকাটা মন থেকে মেনে নিতে পারছি না কিছুতেই। নাওয়া খাওয়ার ঠিক নেই। কাজে কর্মে মন নেই। চারপাশে ‘আছে ‘র থেকে ‘নেই’ জিনিসটাই বেশি। যেদিকেই তাকাই কেমন শূন্য শূন্য লাগে। সেই শূন্যতার মাঝে কিছু একটা পেতে বড়ো ইচ্ছে হয়। আর সেই ইচ্ছেটা এক একটা সময় আমাকে ভেতর থেকে অস্থির করে তোলে। আমি তখন ঘরের দাওয়ায় বাঁশের খুঁটিতে পিঠটাকে হেলান দিয়ে বসে আকাশ দেখি। আকাশের মেঘ দেখি। মেঘের নিচে উড়ে যাওয়া পাখি দেখি। পাখির ডানায় ঝলকে ওঠা রোদ দেখি। আর এসব দেখতে দেখতেই একসময় হারিয়ে যাই কোথায়।
ঘটকের কথা শুনে চুপ করে ছিলাম অনেক্ষণ। কী সব ভাবনারা এসে নাড়া দিতে শুরু করেছিল আমায়। আমি তাকিয়েছিলাম
আকাশের দিকে। সেদিকে তাকিয়েই বলেছিলাম,” সে সব যে অনেক ঝক্কির কাজ কাকা। আমি একা মানুষ- ”
” ওরে এ জন্যেই তো তোকে বলছি। আসলে দুনিয়াটাই এমন। এখানে একা না বোকা। একা মানুষ জীবন কাটানো বড়োই ঝামেলার। এই যে দ্যাখ না, কী খাবি তা যেমন তোকে জোগাড় করে আনতে হচ্ছে তেমনি রান্নাটাও তোরই করতে হচ্ছে হাত পুড়িয়ে। অথচ যদি একটা বৌ থাকতো তাহলে খেটে খুটে ফিরে এসেই দেখতি ভাত বেড়ে এগিয়ে দিয়েছে বৌ। পাশাপাশি বসে দু’টো সুখ-দুঃখের কথাও কইতে পারতি। ঘরদোরের কী অবস্থা হয়েছে একবার দ্যাখ। যদি একটা মেয়ে মানুষ থাকতো সংসারে। ওরে, মেয়ে মানুষের ছোঁয়া না থাকলে সংসারের ছিরি থাকে না। তাই বলছি – ”
” ঠিক আছে কাকা তুমি যখন বলছো – , আচ্ছা কাকা – ”
” বল।”
” মেয়েটাকে একবার দেখতে পাবো না?”
” এ আবার একটা প্রশ্ন হল গোবিন্দ? যাকে বিয়ে করবি তাকে দেখে নিবি নে? কালই তোকে নিয়ে আমি-”
পরদিনই নিবারন ঘটক আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল কৈখালি সুবল কবিরাজের বাড়ি। কবিরাজি করলে কী হবে, যেমনি সাজানো গোছানো বাড়িঘর, তেমনি আতিথেয়তা। তারপর আবার যখন সেজেগুজে অপর্ণা এসে সামনে বসলো তখন ঘটককে বলেছিলাম,” বিয়ে আমি এই মেয়েকেই করতে চাই কাকা।”
দু’ঠোঁটের ফাঁকে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে নিবারই ঘটক বলেছিল,” আমি জানতাম তুই এ কথাই বলবি। তাই তো”
অগত্যা বিয়েটা হয়ে গিয়েছিল আমার। অপর্ণা এসে উঠেছিল আমার বাড়িতে। আর সে উঠতেই বাড়িটাও যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছিল হঠাৎ। ফের একবার সেজে উঠেছিল ঘর-উঠোন। তকতকে উঠোনটায় ঝাঁট পড়তে শুরু করেছিল দুইবেলা। নতুন করে তুলসির চারা বসেছিল উঠোনের একপাশে। সন্ধেবেলায় সেখানে জ্বলতে শুরু করেছিল সাঁঝ প্রদীপ। শাঁখ-উলুর আওয়াজে বাড়িটা আমার তখন যেন স্বর্গেরই কোনও স্থান।
সকাল সকাল কোনওদিন কাস্তে, আবার কোনওদিন কোদাল হাতে বেরিয়ে যেতাম মাঠে। রোদ চড়তে না চড়তেই গামলায় ভাত তরকারি নিয়ে আমায় খাওয়াতে যেত অপর্ণা। আমি যতক্ষণ খেতাম পাশে বসে আমার খাওয়া দেখতো সে। তখন হয়তো আকাশ জোড়া রোদ আঁচল বিছিয়ে দিয়েছে পুরো মাঠ জুড়ে। আমাদের মাথার ওপর জিওল গাছের ছায়া। দূরের আকাশটায় আনমনে ভেসে যাচ্ছে একফালি মেঘ। একঝাঁক শালিকও হয়তো উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে।
খেতে খেতে আড়চোখে অপর্ণার দিকে তাকাতাম আমি। চোখে চোখ পড়ে গেলে অপর্ণা জিজ্ঞেস করতো,” কী দ্যাখো গো এমন করে?”
আমি খেতে খেতেই উত্তর দিতাম,” সাগর।”
অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো অপর্ণা, “সাগর! এই খটখটে মাঠের মধ্যে তুমি সাগর পেলে কোথা?”
আমি বলতাল,”সাগর তোমার চোখে। তাও একটা নয়, দু’টো।”
অপর্ণা হাসতো,” বাঃ, বেশ কাব্য করে কথা বলতে পারো তো তুমি।”
“তাই বুঝি?”
“হুম।”
বিঘে পাঁচেক জমি ছিল আমার। সবটাই অবশ্য পেয়েছিলাম বাবার কাছ থেকে। পড়াশোনায় একদমই মাথা ছিল না। তার ওপর অল্প বয়সেই বাবা মারা যেতে মা বলেছিল,” ও সব পড়ালেখা তোর জন্যে নয় রে গোবিন্দ। তার চেয়ে আয় বাবা আমরা মা-ছেলেতে মিলে জমিগুলো চাষ করি। ফসল ফলাই। খেয়ে পরে বাঁচতে হবে তো।”
সেই আমার পড়াশোনায় ইতি। মায়ের সঙ্গে নেমে গিয়েছিলাম চাষে। দু’জনে মিলে চাষ করতাম। ফসল ফলাতাম। সেইসঙ্গে স্বপ্নও দেখতাম নতুন করে সাজানো গোছানো একখানি সংসারের। আরও একজন মানুষ। আরও বেশি জমিজমা। আরও বেশি ফসল।
মা বলতো,” তোকে বিয়ে দিয়ে টুকটুকে একটা বৌ আনবো। আমার বয়স বাড়ছে। কদ্দিন আর এ সব করতে পারবো। তোদের সংসার তোরাই করে ধরে খাস।”
সেই বিয়ে করলাম। নতুন বৌ এলো। অথচ মা ততদিনে কোথায়।
অপর্ণা সংসারে আসার পর থেকে স্বপ্ন দেখাটা আরও যেন বেড়ে গিয়েছিল আমার। চাষবাস, মাটি, ফসলকে আরও বেশি করে আঁকড়ে ধরেছিলাম আমি। সারাদিন বলতে গেলে খেতেই পড়ে থাকতাম। সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিতাম মাটির দাওয়ায়। বাঁশের খুঁটিতে পিঠটাকে হেলান দিয়ে বসে ঘাড় কাত করে তাকাতাম আকাশের দিকে। সেই আকাশ জুড়ে তখন সন্ধ্যা নামছে। দিনান্তের সব আলো মুছে দিয়ে চারদিক থেকে এগিয়ে আসছে একটা আঁধারের অস্পষ্টতা। আশেপাশে ডাকতে শুরু করেছে ঝিঁঝির দল। ঝোপের আড়াল থেকে উঁকি মারছে জোনাকপোকা।
উঠোন ঝাটানো শেষ করে হাঁস-মুরগির খাঁচার দোর এঁটে দিয়ে কলতলায় হয়তো তখন হাত-মুখ ধুচ্ছে অপর্ণা। খানিক পরেই শাঁখ আর উলুধ্বনিতে মুখর হয়ে উঠতো সারাবাড়ি। ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভরে যেত বাতাস। শরীরের সব ক্লান্তি ভুলে তীব্র এক ভালোলাগার ছোঁয়ায় নিজের ভেতরেই হারিয়ে যেতাম আমি।
খানিক পরেই অপর্ণা এসে পাশে বসতো। ধূপের গন্ধে তখন মাখামাখি তার শরীর। আকাশে ততক্ষণে তারা ফুটতে শুরু করেছে। কোনও এক কোনে হয়তো উঁকি দিয়েছে আধখানা চাঁদ। আমি সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকাতাম অপর্ণার দিকে। প্রতিদিনই এ সময়ে আমি যেন নতুন করে আবিস্কার করতাম তাকে। আমি তাকিয়েই থাকতাম তাই।
একসময় অপর্ণা বলতো,” সেই কখন বেরিয়েছো, আর এই তোমার ফেরার সময় হল? এত খাটলে শরীর সইবে?”
আমি হাসতাম। দেখে যেন হালকা রাগ হত তার। কিংবা হয়তো রাগের ভান করতো কেবল। বলতো,” খাই তো আমরা দু’জন তার জন্যে এত খাটতে হয়?”
আমি তেমনি করেই হাসতাম। বলতাম,” আজ দু’জন আছি। কাল তিনজন হবো। পরশু –
না, তিনজন আর হতে পারিনি আমরা। এক সন্ধেবেলায় মাঠ থেকে ফিরে এসে দেখি ঘরের দরজাটা হাট খোলা হয়ে পড়ে আছে। হাঁস-মুরগি তখনও চরে বেড়াচ্ছে উঠোনে। কোথাও ঝাঁট পড়ার এতটুকু চিহ্ন নেই। তুলসিতলায় জমাট বাঁধতে শুরু করেছে আঁধার। বাড়ি থেকে উধাও ধূপ-ধুনোর গন্ধ। একটু যেন অবাকই হয়েছিলাম সেদিন। এমন তো হয় না কোনওদিন। কোনও আশঙ্কা কী মুহূর্তের জন্যেও উঁকি দিয়ে গিয়েছিল মনে? আজ আর তা মনে পড়ে না। তবে এটুকু বেশ মনে আছে সেদিন সন্ধেটাকে বড়ো বিষণœ মনে হয়েছিল আমার। সেই বিষণœতা একসময় ছড়িয়ে পড়েছিল আঁধারের পরতে পরতে। সন্ধে উতরে রাত্রি নেমেছিল। একসময় গভীর রাত হামাগুড়ি দিয়ে উঠে এসেছিল আমার দাওয়ায়। নিশাচর পাখির মত জেগে ছিলাম আমি। আমার ঘরের পেছনের বাতাবি গাছটার ডালে মাঝে মাঝে ডেকে উঠে কোনও এক নিশাচর পাখি জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছিলো আমি একা নই, সেও জেগে আছে আমার সঙ্গে।
একসময় এক নদী যন্ত্রণা পেরিয়ে রাত ফুরিয়ে ভোর হয়েছিল। আর কী করে কী করে খবরটা ছড়িয়ে পড়েছিল পাড়ায়। সারা পাড়ার মানুষ ছুটে এসেছিল আমার বাড়ি। ওইটুকু বাড়ি। মুখ লুকোনোর এতটুকু জায়গা পাচ্ছিলাম না আমি। অগত্যা প্রতিবেশী বৃদ্ধা হরিদাসীকে একপাশে টেনে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম,” আমি এখন কী করবো কাকি?”
পরম মমতায় আমার মাথায় হাত রেখেছিল সে। বলেছিল,” যে যাবার সে গেছে। এতে তোর তো আর দোষ নেই। তার কথা না ভেবে বরং নিজের কথাটা ভাব। সে ছাড়া কী আর মেয়ে নেই দেশে?”
চারপাশে এত আলোর মাঝেও বড়ো বিবর্ণ লাগছিল সবকিছু। মনের ভেতরে লালিত স্বপ্নেরা উড়োখই হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিলো চারিদিক। একরাশ বোবা বিষণœতা এসে চারপাশে হিং¯্রতার এক বৃত্ত তৈরি করতে শুরু করতেই বেরিয়ে পড়েছিলাম পথে। কত পথ ঘুরে শেষে ঠাঁই নিয়েছিলাম নিত্যানন্দ বাউলের আখড়ায়। সেও ছিল আমার মতই এক ঘরপোড়া গোরু। আমাকে তাই আপন করে বুকে টেনে নিয়েছিল মানুষটা। বলেছিল,” এপথে তেমন সুখ নেই। তবে শান্তি আছে। একজন গেছে তো কী? আরও তো হাজার জন আছে। একজনের কথা না ভেবে বরং সেই হাজার জনের কথা ভাব। তবেই না শান্তি পাবি।”
না, শান্তি আমি পাইনি। সাত সাতটা বছর পেরিয়ে গেলেও আমি ভুলতে পারিনি বাড়ির কথা। আমার ছোট্ট ভিটেটার কথা। সেই বাতাবির গাছ,ফালি উঠোন, তুলসির চারা- সবাই আমাকে ডেকেছে। নীরব রাতের বিষন্ন আঁধারে আখড়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে কালোয় মোড়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বারে বারেই ভেসে উঠতে দেখেছি তাদের। আমার সেই গাঁয়ের মেঠো পথ, গাছের সারি, ফসলের খেত আমায় ডেকেছে। চেনা মুখের মিছিল আমায় ডেকেছে। আরও ডেকেছে সেই চেনা আকাশ। সেই মাটির গন্ধ। সেই সব সোনালি বিকেল।
আমি উপেক্ষা করতে পারিনি সেই ডাক। অগত্যা এসে দাঁড়িয়েছি ফের একবার আমার সেই ভিটেটায়। কিন্তু কোথায় সেই ভিটে? ঘাস- আগাছায় ঢেকে আছে চতুর্দিক। ঝোপ-জঙ্গল এসে গিলে খেয়েছে পুরো উঠোন। আর আমার সেই ঘর? বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়া বৃদ্ধের মত দাঁড়িয়ে আছে আজও। বয়সের ভারে বৃদ্ধ সেও। কতদিন তার গায়ে মানুষের ছোঁয়া পড়ে না। অথচ এই ঘরে একদিন কত হাসি ছিল। কত সুখ ছিল। ঘর ভর্তি যৌবন ছিল। যৌবনের স্বপ্ন ছিল।
হ্যাঁ, এই ঘরে শুয়েই স্বপ্ন দেখাতো অপর্ণা। আরও সুন্দর এক সাজানো গোছানো সংসারের স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন সারাক্ষণই বিভোর করে রাখতো আমায়। আজ এতগুলো দিন পরে এসে ফের একবার মনে পড়ে গেল সেই সব দিনের কথা। সেই সব স্বপ্ন দেখা মুহূর্ত। কত কথা আজ আবার স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে আমার। মনে পড়ে যাচ্ছে আমাকে দেওয়া অপর্ণার সেই কথা,” আমি তোমাকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছি জানো।”
” আমিও। আচ্ছা অপু- ”
” বলো।”
” জানো তো,এই তুমি ছাড়া আমার আর আপন বলে কেউ নেই। আমায় তুমি ছেড়ে যাবে না তো কোনওদিন?
” কী সব বলছো বলো তো? ছেড়ে যাবো?ও কথা ভাবার আগে যেন আমার মরণ হয়।”
না, অপর্ণার মরণ হয়নি। কিন্তু আমায় ছেড়ে গেছে। কোথায় গেছে, কার সঙ্গে গেছে কিছুই জানি না আমি।
বিকেলের লাল আলো কমে গিয়ে চারদিকে নামতে শুরু করেছে আসন্ন রাত্রির ইশারা। একটা বিষণœ অস্পষ্টতা এসে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে চারপাশে। বাতাবি গাছটার ডালে কোত্থেকে উড়ে এসে বসলো দু’টো শালিক। আমি তাকালাম ওদের দিকে। আর ঠিক তখনই পেছনে কার পায়ের শব্দ। চমকে ঘুরে তাকানোর আগেই কেউ জিজ্ঞেস করলো,” কে গো বাছা?”
চেনা কন্ঠে চমকে ঘুরে তাকাতেই বৃদ্ধা হরিদাসীর মুখোমুখি। বয়সের ভারে আজ সে বড়োই ভারাক্রান্ত। শরীরটা যেন টাল সামলাতে না পেরে ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। গর্তের ভেতর ঢুকে যাওয়া দুই চোখে অদ্ভুত এক ঘোলাটে দৃষ্টি।
অনেকদিন পরে ফের একবার চেনা মানুষকে কাছ থেকে দেখে একটা ভালোলাগা এসে ছুঁয়ে গেল আমায়। বললাম,” আমি গো কাকি।চিনতে পারছো না?”
” না তো বাবা। কে তুমি?”
” আমি, আমি গোবিন্দ। ”
” গোবিন্দ? গোবিন্দ এসেছিস?”
” হ্যাঁ গো কাকি,আমি এসেছি।”
” কতদিন পর এলি বল তো? এতদিনে মনে পড়লো বাড়ির কথা? এই বাড়িঘর, উঠোন, গাছপালা একদিন না কত ভালোবাসতি তুই? অথচ এতদিন এ সব ছেড়ে – ”
” ভালো তো আজও বাসি কাকি। তাইতো আবারও – ”
” ফিরে এসে বেশ করেছিস গোবিন্দ। বাড়িঘরের কী অবস্থা হয়েছে দ্যাখ তো। তুই ও যেমন। কাউকে কিচ্ছু না বলে- , যার জন্যে ঘর ছাড়লি সে কী তোর কথা ভাবলো? সে তো আরেকজনের সংসারে গিয়ে দিব্যি সংসার করছে। আর তুই কিনা – ”
একটা দীর্ঘশ্বাস এতদিন যেন আটকে ছিল বুকের ভেতর। আজ এই সন্ধেবেলায় আচমকা সুযোগ পেতেই বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়লো হাওয়ায়। নিজেকে যেন অনেকটাই হালকা মনে হল আমার। বললাম,” তার কথা থাক কাকি।”
” আমিও তো সে কথাই বলি। অনেক তো ভাবলি। এবার তার কথা থাক। সংসারটাকে নতুন করে সাজা আবার।”
” কাকি – ”
” হ্যাঁ রে। আরেকটা বিয়ে কর। নতুন একজন আসুক সংসারে। এই বাড়িঘর, সংসার কদ্দিন আর এমন করে পড়ে থাকবে? তুই ই বা আর কদ্দিন এভাবে- ”
” কিন্তু কাকি – ”
” আর অমত করিস নে রে গোবিন্দ। ঘর একবার ভেঙেছে বলে কি আর বাঁধবি নে? না রে, তুই আবার বিয়ে কর। নতুন করে সবকিছু শুরু কর আবার। এই বাড়িঘর, উঠোন ফের আবার আগের মত হয়ে উঠুক। ফের শাঁখ, উলুর আওয়াজ উঠুক বাড়িতে। ফের ধূপ-ধুনোর গন্ধে ভরে উঠুক সাঁঝবেলা। ফের একবার মেয়ে মানুষের হাতের ছোঁয়ায়- ”
তার কথা শেষ হল না, তার আগেই আমার চোখে ভেসে উঠলো তকতকে একফালি উঠোন। উঠোনের পাশে তুলসির চারা। সাঁঝপ্রদীপ। বাতাবির ডালে ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে বসে থাকা দু’টো শালিক। লাল পেড়ে শাড়ির নিচে আলতা পরা দু’খানি পা।
হরিদাসী জিজ্ঞেস করলো,” কী ভাবছিস গোবিন্দ? ”
আমি বাতাবি গাছটার দিকে তাকালাম। দিনান্তের সব আলো মুছে দিয়ে সেখানে তখন সন্ধ্যা নামছে।
গৌতম বিশ্বাস, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার, পশ্চিমবঙ্গ