অজয় দাশগুপ্ত
বাংলাদেশের ইতিহাসে বিজয় দিবস সবচেয়ে অনন্য একটি দিন। স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের সব কটি দিন সমান গুরুত্বপ‚র্ণ হলে ও বিজয় দিবস ম‚লত সবচেয়ে গৌরবের । কেন জানি না এই দিনটি তেমন ভাবে উদযাপিত হয় না। তেমন আলোড়ন ও দেখি না যা সত্যিকার অর্থে ছিল বিজয়ের প্রাপ্য। অথচ আমি এমন দু’জন বিদেশির কথা জানি যাঁরা আমার সাথে আলাপচারিতায় এই দিনটি নিয়ে বলতে গিয়ে আবেগ তাড়িত হয়ে পড়েছিলেন। শুধু তাই নয় উভয়ের অশ্রæরুদ্ধ কন্ঠ টের পেয়েছিলাম ফোনে। তাঁদের একজনের নাম ব্রুস উইলসন।
আমি যখন তাঁর কথা জানি এবং তাঁর সাথে যোগাযোগ করি তিনি তখন বিলেতের এক হাসপাতালে শয্যাশায়ী। এতদিন বেঁচে থাকার কথা নয় তাঁর। লন্ডনের সাধে সময় মিলিয়ে যখন ফোনে পেয়েছিলাম তখন ওখানে সকাল। কী পরিচয় দেব ? কী বলবো ? এসব দ্বিধা দ‚রে সরিয়ে সরাসরি বলেছিলাম আমি এক গর্বিত বাংলাদেশি। প্রবাসে সিডনিতে থাকি। তাঁকে বলেছিলাম, আমি জানি তিনি একজন অষ্ট্রেলিয়ান যিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস রণাঙ্গনে কাটিয়েছিলেন। মেলবোর্ণ এজ পত্রিকার হয়ে নয় মাস যুদ্ধের খবর কভার করার পাশাপাশি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন । তাদের সাহায্য সহযোগতা করার পাশাপাশি তাদের একজন হয়ে ওঠা ব্রুস যে বিজয় দিবসে আত্মসমপর্ণের দিন তখনকার রেসকোর্সে ছিলেন সে কথাও জানিয়েছিলাম তাঁকে। ব্যস ঐ টুকুতেই কাজ হলো।
ব্রæস উইলসন শুরুতেই চমকে দিয়েছিলেন আমার জন্মগত পরিচয়ের কারণে গোত্র বর্ণ এসব বিষয়ে তথ্য দিয়ে। আমি যে হিন্দু ধর্মে জন্মেছি তা আমার নাম ও পদবিতে বোঝা কঠিন নয় কিন্তু একজন বিদেশী কতট‚কু জানলে বলে দিতে পারে যে আমি বৈদ্য স¤প্রদায় নামে পরিচিত বর্ণের কেউ। তা ছাড়া সব কথাতেই আমি বারেবারে টের পেয়েছিলাম বাংলাদেশের রাস্তাঘাট এমন কি জনজীবন বিষয়ে ও অনেক কিছু তাঁর নখদর্পণে। হাসপাতালের বিছানায় শায়িত ব্রুস আমাকে ষোল ডিসেম্বর বিষয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন ওসমানী বা সে মাপের কেউ সেদিন উপস্হিত না থাকাটা তাঁদের ভালো লাগেনি। মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী শহিদ তাজ উদ্দীনের অনুপস্থিতিও পীড়া দিয়েছিল তাঁকে তাঁর ধারণায় পাকবাহিনী বা তারাই চায়নি এমন কিছু। আর ভারত তখন তাড়াতাড়ি আত্মসমর্পণ প্রক্রিয়া সারতে ব্যগ্র। তাদের মাথায় তখনো আমেরিকা চীনের কথা ঘুরছিল। কারণ পাকিদের জন্য এ দুই পরাশক্তি কোন আক্রমণ শানালে বা যে কোন কিছু করলে এমন প্রক্রিয়া ভেস্তে যেতে পারে। তাদের অনুমান যে মিথ্যা না তার প্রমাণ বঙ্গোপসাগরে আমেরিকার সপ্তম নৌবহরের আনাগোনা। যদিও পরে তারা মাছ ধরার জন্য এসেছিল এমন ফালতু হাস্যকর অজুহাত দিয়ে চলে গিয়েছিল। ব্রুস মনে করতেন সেদিন যদি সৈয়দ নজরুল তাজ উদ্দীনের মতো কেউ থাকতেন তবে ইতিহাস আরো গতি লাভ করতো। আর এতো ইতিহাস বিকৃতির শিকার হতো না দেশ।
ইতিহাস ও বিজয় দিবস এ দুই বিষয়ে তাঁর পরিষ্কার ধারণা আর অভিমত আমরা জানলে বা মানলে দেশ ও সমাজেরই উপকার হতো। ব্রুস উইলসন বাংলাদেশি না হয়ে ও বুঝেছিলেন আমাদের দুর্বলতার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে অনৈক্য আর বিভেদ। তাঁর মতে এই বিভেদের ম‚ল কারণগুলোর একটি হচ্ছে বিজয় দিবসের প্রতি যথাযথ মনযোগ আর ধ্যানের অভাব। ব্রুস আমাকে বলেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি অন্যায় আর অবিচারের পাশাপাশি অবহেলা তাঁর বুকে দাগ কেটেছিল। তিনি তখনই আমাকে বলেছিলেন একমাত্র বিজয় দিবসের তাৎপর্য আর উদ্ভাসই পারে মুক্তিযুদ্ধের সম্মান বাঁচাতে। একাত্তরের পর আর মাত্র একবার গিয়েছিলেন বাংলাদেশে। কিন্তু তখন মুক্তিযদ্ধের সরকার দেশশাসনে না থাকায় তিনি ফিরেছিলেন হতাশ হয়ে। তাঁর সাথে আলাপচারিতার শেষ অংশটুকু অনেকদিন মনে থাকবে আমার। বারবার বলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের এই দেশ যদি বিজয় দিবস এবং ইতিহাসমুখি না হয় তাহলে এর চারিত্র যেমন সঠিক থাকবে না তেমনি দেশ ও থাকবে রাজনৈতিক দ্ব›েদ্ব নিমজ্জিত। এখন ফিরে তাকালে আসন্ন ডিসেম্বরের আগে উত্তপ্ত হয়ে ওঠা স্বদেশ যেন ব্রুস উইলসনের কথামতোই সে পথে এগুচ্ছে ।
আর একজন যিনি বিজয় দিবসের গর্বিত শরীক তিনি আমাদের একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীক। ওডারল্যান্ড কে চেনেন না এমন মুক্তিযোদ্ধা বিরল। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে ঢাকা বাটা সু কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একজন তরুণ যোদ্ধা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছিলেন ডাচ অষ্ট্রেলিয়ান ওডারল্যান্ড। জন্মস‚ত্রে নেদারল্যান্ডের নাগরিক পরবর্তীকালে অষ্ট্রেলিয়ার নাগরিকত্ব নেয়া এই যোদ্ধা শুরু থেকেই ছিলেন আমাদের জন্য মরিয়া। মুক্তিযোদ্ধাদের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে দেয়া গেরিলা ট্রেনিং এর মাধ্যমে যুদ্ধে পাঠাতেন তিনি। একসময় নিজেও জড়িয়ে গেছিলেন যুদ্ধে। অস্ত্র আতে তুলে নিয়েছিলেন মাঠে রণাঙ্গনে লড়াই করেছিলেন আমাদের হয়ে। ওডারল্যান্ড থাকতেন পশ্চিম অষ্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে। আমি তখন সবে এসেছি এই দেশে। সিডনি থেকে অনেক দ‚রে প্রায় সিঙ্গাপুরের কাছাকাছি আরেকটি শহর পার্থে উড়ে যাওয়া তখন ছিল অসম্ভব। ফলে ফোনে কথা বলার বিকল্প ছিল না। সে পথটাও মসৃণ ছিল না ।
ওডারল্যান্ড তখন চোখে ভালো দেখতে পান না। বলতে গেলে দেখতেই পান না। তার ওপর তাঁর স্নায়ু তখন নিয়ম মানছে না। রক্তচাপ ও আয়ত্বের বাইরে। ফলে বেশীরভাগ সময়ই বিছানায় কাটতো তাঁর। কোন ধরণের উত্তেজনা বা চাপ নেয়া ছিল ডাক্তারের বারণ। বাংলাদেশ এই নামটা শুনলেই উত্তেজনা হতো তাঁর। মাঝে মাঝে প্রচন্ড আবেগ আর রাগে ফেটে পড়তেন। ফলে তাঁর স্ত্রী কিছুতেই কথা বলতে দিতে রাজি হতেন না। আমিও নাছোড়বান্দা। যে ভাবেই হোক একবার অন্তত: কথা বলতেই হবে। জীবদ্দশায় একমাত্র বিদেশী বীরপ্রতীকের কন্ঠ না শোনার মতো কাজ করতে রাজি ছিলাম না আমি। বারবার চেষ্টার ফলে একসময় বরফ গলেছিল।
ওডারল্যান্ড খুব কাঁপা কাপা কন্ঠে ধীরে ধীরে কথা বলেছিলেন। তাঁর কথা ছিল একটাই যে জাতির জন্য তিনি জান হাতে লড়াই করেছিলেন তাদের নৈতিক অধ:পতন তার ভালো লাগতো না। বিশেষত: বঙ্গবন্ধু হত্যাকাÐ ও পরবতীতে চার জাতীয় নেতাকে কারাগারে হতার পর বাংলাদেশের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। যে কারণে রাষ্ট্রীয় আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিতে দ্বিধা করেন নি এই মুক্তিযোদ্ধা। বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসকে প্রচন্ড শ্রদ্ধা করা এই মানুষটি আমাকে বলেছিলেন, ষোল ডিসেম্বর যদি ফিকে হয় বা কোন কারণে অনুজ্জ্বল হয়ে পড়ে মনে রাখতে হবে তাঁর বা তাঁর মতো যাঁরা আত্মত্যাগ করেছিলেন তাঁদের আত্মার অভিশাপ এড়ানো যাবে না । আমি জানি না এমন অমোঘ সত্য কথাটি তিনি কেমন করে বলেছিলেন সেদিন । আজ যখন তিনি পরপারে তখন মনে হয় এঁদের প্রতি কি আমরা আজীবন নিরবতার ভেতর দিয়েই ভুল করতে থাকব ? আমরা যে বিজয়ের কারণে আজ স্বাধীন আজ গর্বিত আজ পতাকা মাটির প্রেমে মাতোয়ারা তার পেছনে দাঁড়ানো ওডারল্যান্ড বা তাঁর মতো মুক্তিযোদ্ধারা। যাঁদের অবদান কোন কালে কোন জন্মেও ভোলা যাবে না।
আমার গর্ব আমি ব্রুস উইলসন ও ডাবøু এস ওডারল্যান্ডের সাথে কধা বলেছিলাম। এমন দুই বিদেশি বীরের মতো আরো অনেকেই আছেন আকাশের তারায় তারায়। তাঁদের কথা যেন বিফলে না যায়। এই দেশ ও মাটি তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এখন দায় মানুষের।
অজয় দাশগুপ্ত, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট, সিডনি প্রবাসী