অরূপ পালিত : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি আর অবিরাম ছুটে চলা জলধারাকে নিয়ে করলডেঙ্গা পাহাড়। এই পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে থাকা কষ্ট আর ঝর্নার স্রোতধারাকে বহন করে নিয়ে আসছে সুন্দরী হারগেজি। হারগেজির চিকচিকে চঞ্চলা দেহটাকে কর্ণফুলী মেয়ের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে। শত প্রতিকূলতা সত্বেও কোন সময় হারগেজি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠতো না। খুবই শান্ত সরলা। কারো ক্ষতি কোন সময় করতো না। জোয়ার আর ভাটা সবসময় মুখরিত থাকত নৌকা আর মাঝিদের নিয়ে। বর্ষা এলে কিছুটা হাওয়া বদলাতো হারগেজি। হারগেজির পাশ ধরে নয়া হাট। এই হাটে সপ্তাহে দুইদিন দশ গ্রামের মানুষের বাজার। নয়া হাটের সবার পরিচিত মুখ খলিল মাঝি। শহরে যাবার জন্য একমাত্র ভরসা খলিল মাঝির নৌকা। ভোর ফোঁটার আগে মাঝি আশেপাশের সব দোকানদারকে নিয়ে বাজার করার জন্য চাক্তাই রওনা হতো । গ্রামের মুদির দোকানদার নিয়ে মাঝির সংসার। নৌকা বাইতে বাইতে জীবন শেষ মাঝির। সহজ-সরল মানুষটি সারাজীবন অন্যের মালামাল শহর থেকে চড়িয়ে এই গ্রামে আনেন। কিন্তু মাঝি নিজের জন্য কিছু করেননি।
গ্রামের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা উনাকে বেশ সন্মান করতো। গ্রামের ছোটরা মাঝিকে সবাই নানা বলে ডাকতো। নানার আশায় প্রায় সময় হারগেজির পাশে বসে থাকতো জুয়েল। উনি করলডেঙ্গা পাহাড় থেকে কাঁচা তরকারি শহরে নেবার সময় জুয়েলের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে মারতো। আর বলতো নানা এইগুলো তোর জন্য। নানাও জুয়েলের মায়ায় পড়ে যায়। জুয়েলকে না দেখলে নানা বলতো, তুই খয়ইরে নানাভাই।
হাতে নৌকা বাইতে বাইতে দুইভাই খলিল মাঝি এবং অংদ মাঝি চট্টগ্রামের শেফালী ঘোষের গান গাইতেন।
“ওরে সাম্পানওয়ালা তুই আমারে করলি দিওয়ানা “।
অনেক দুর থেকে নৌকার শব্দ”কে কুরুত”শোনা যেত।”কে কুরত” শব্দটির সাথে সাথে প্রকৃতির মন মাতানো মিষ্টি বাতাস অনেক দূরে শব্দটিকে নিয়ে খেলা করতো। আশেপাশের জঙ্গলের থেকে সব পাখিরা গান গাইতে থাকতো।সন্ধ্যা নেমে আসলে হুক্কাহুয়া শেয়ালের ডাকে মন প্রাণ জুড়িয়ে যেত।
হঠাৎ একদিন উপর থেকে নির্দেশ আসে হারগেজি খালের খনন লাগবে। বড় করতে হবে হারগেজিকে । গাড়ি-গোড়া নেই শহরের সাথে যাতায়েত এবং ব্যাবসা বাণিজ্য বাড়াতে এই কাজ শুরু।
ছোট শান্ত হারগেজিকে সবাই মিলেমিশে বড়ো করার কাজে ব্যস্ত। আশেপাশের সব গাছ-গাছালি কাঁটা পরে যায়। অনেক পাখি বিলুপ্ত হয়ে যায়। শুরু হয় ইঞ্জিন চালিত নৌকা। ইঞ্জিন নৌকার আওয়াজে প্রকৃতির ঘুম ভাঙ্গার সাখে সাথে, মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙ্গে যেতে থাকে।
সবার প্রিয় দুই মাঝির দিন শেষ। উনাদের ছেলে মেয়েরা সবাই শিক্ষিত। আর উনাকে নৌকা বাইতে আসতে দেয় না।
দিনে দিনে একসময় ছোট হারগেজির চরিত্র পাল্টাতে থাকে। অশান্ত হয়ে যায়। রাতের অন্ধকারে অনেক বসতিকে তুলে নিয়ে যায়। বর্ষায় ইদানিং হারগেজিকে চেনা যাচ্ছে না।
একদিন শোনা যায় দত্ত বাড়িতে আশ্রিত ছোট শান্ত ছেলে শিবুকে হারগেজি খেয়ে ফেলেছে। শিবু গাছের সেতুটি পার হতে গেলে, সিকদার পাড়ার দুষ্টু ছেলেরা সেতুর উপরে উঠে দুইপাশে দোলাতে থাকে। কিছু বোঝার আগে সেতুটির মাঝখানে ভেঙ্গে পড়ে যায় শিবু। পূর্ণিমার ভরা জোয়ারের টান। মুহূর্তে সব শেষ। পানি থৈ থৈ ফুঁপিয়ে উঠলো চারপাশ। গ্রামের লোক সবাই সাঁতার জানলেও গভীরতার কারণে নামতে ভয় করে।
তবু ও নেমে গেছে অনেক লোক। শিবুর লাশ উদ্ধার হয়নি। শিবুর মায়ের কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে আসে। শিবুর বড়ো ভাই দেবু সাঁতার কাটতে জানে না। তবু ও ভাইকে পাওয়ার আশায় নেমে যেতে চাই বারবার। জুয়েলকে দেখলে শিবুর মা জড়িয়ে ধরে আরো বেশি কাঁদে। জুয়েল আর শিবু একই দিনে জন্ম। সারাক্ষণ থাকতো ও ওরা একসাথে। জুয়েলও হতভম্ব হয়ে পড়ে।
একদিন পর লাশ উদ্ধার হয় শিবুর। শিবুর লাশটি পায় জুয়েলের মা। অদ্ভুত রহস্যময় আচরণ প্রকৃতির। লাশ কিন্তু সেই জায়গার থেকে পরের দিন উদ্ধার হয়েছে। শিবুর মা ছেলের শোকে পাথর হয়ে যায় ।
পুত্র শোক বলে কথা। শিবুর বাবা স্থানীয় বা পয়সা ওয়ালা হলে, হয়তো শিকদার পাড়ার সব বড় ছেলেদের নামে মামলা ঠুকে দিতেন। ছেলেটি মরার পেছনে এই পাড়ার লোক দায়ী। এমনিতে সেতুটি ছিল পুরাতন কাঠের। তার উপরে পাড়ার ছেলেরা যদি ভাঙ্গা সেতুর উপরে উঠে না নাচতো। হয়তো ছেলেটা ডুবে মরতো না।
ছেলেটা তখন সেতু পার হচ্ছিল। তার মাথার উপর ছিল ধানের বস্তা। বড়ো ভাইয়ের সাথে ধানকলে যাচ্ছিল। বড়ো ভাই আগে পার হয়ে গিয়েছিল। একবার বলেছিলও তুই থাক শিবু। আমি এসে তোকে পার করে নিব। দশবছরের শিবু কতটুকু বুদ্ধি বা ছিল তার। ভাইয়ের পেছনে পেছনে চলে।
শিবুর মা ছেলে হারিয়ে পাগল। ছেলেরা যেখানে খেলা করে সেখানে চলে আসে। অবাক দৃষ্টিতে ছেলেদের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর সন্ধ্যে নামলে ভাইরে ভাই করে বড়ো বোন দুইটা মুক্তি আর শুপ্তির কান্নার আওয়াজে আশেপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে আসে। ওদের কান্নার আওয়াজে প্রায় সময় আশেপাশের লোকজন ও কেঁদে দিত। পাড়ার সবাই বলাবলি করছে, ঘোষ বাড়ির জঙ্গল রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যের সময় কাউকে না আসতে। অনেক লোক দেখেছেন,
এই ছেলেটি সন্ধ্যা হলেই পাড়ার মধ্যে হাঁটতে থাকে। বেশ কয়েকজন শিবুকে নাকি আবছা আলোয় সামনে দিয়ে দৌড়ে রাস্তা পার হয়ে যেতে দেখেছে। মুরব্বিদের কথা অপমৃত্যু। এই ছেলে সহজেই গ্রাম ছেড়ে যাবে না। ওঝা নিয়ে এসে গ্রামে শস্য পড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছে। তবু ও কাজ হয় নি। সন্ধ্যে হওয়া মাত্র পাড়ার ছোট ছোট ছেলে- মেয়েরা আতঙ্কে থাকে। কেউ দোকানে পর্যন্ত যায় না।
একদিন জুয়েলের মা সন্ধ্যার সময় দেখতে পায়, ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে শিবু এসে ’পিসি’ ’পিসি’ করে ডাকছে। শিবুকে দেখে জুয়েলের মা এমন একটা জোরে চিৎকার করে উঠলো। আশেপাশের ঘরের থেকে সবাই বের হয়ে দৌড়ে আসে। সবাই জুয়েলের মাকে ধরে রাখতে পারছিল না। সারারাত কিছুক্ষণ পরপর কান্না আর কিছুক্ষণ হাসতে ছিল। পাড়ার বৈদ্য হারাধন ঠাকুরকে নিয়ে আসা হয়। ঠাকুর এসে ঝাড়-ফুক দিয়ে জুয়েলের মাকে ভালো করেন। হারাধন ঠাকুর সবাইকে ডেকে বললেন ছেলেটির আত্মা সহজে গ্রাম ছেড়ে যাবে না।
গ্রামের লোকজন পরিবারের সবাইকে বাঁচাতে শিবুর মা-বাবাকে ডেকে বললেন, আপনারা নিজ বাড়িতে চলে যান। ছেলেকে মাটির ঘরে শুয়ে রেখে একবুক যন্ত্রণা নিয়ে বাধ্য হয়ে অন্ধকার রাতে চলে যায় শিবুর পরিবার।
..দুই
হে বিধাতা এমন সুন্দর মেয়ের জন্য এই কেমন শাস্তি তুমি লিখে রেখেছ। স্বপ্ন মানুষ দেখেন। আর স্বপ্ন মানুষেই ভঙ্গ করেন। বিধাতার অপরূপ সৃষ্টিতে যতই দেখি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকি। তাকে দেখার পরে মনে হলো সকল অপূর্ণতা আজ পূর্ণতা পেয়েছে। সকালে কারো ঘুম ভাঙ্গে প্রিয়তমার নরম কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে। কারো ঘুম ভাঙ্গে স্বপ্নের ভেতরে প্রিয়তমার নুপুরের শব্দে। আর অনেকের ঘুম ভাঙে সংসারের চিৎকার চেঁচামেচিতে। একমুটো ভাতের জন্য।
জেলে পাড়াতে বয়স্ক বলতে আছেন শুধু সুখেন্দু মাঝি। ভিটেমাটি সব হারগেজি খালের পেটে গেছে। ফুটো হয়ে গেছে অনেক সাধের নৌকা। নৌকাটা আর মেরামত করে কোন লাভ নেই। বয়সের ভারে সুখেন্দু মাঝির দিন শেষ। জেলেপাড়ায় একসময় মাঝিকে সবাই মান্য করত। এখন সবাই মাঝিকে এড়িয়ে চলে। ভরা মৌসুমে এখন মাছের আকাল নেমে এসেছে। যিনি এতো কষ্ট করে মাছ ধরলেন তিনি খেতে পান না। একজন জেলে হলো সেই ব্যক্তি যিনি সারাদিন কষ্ট করে মাছ ধরেন। কিন্তু বউ ছেলে-মেয়েদের খাবার পাতে একটুকরো মাছও তুলে দিতে পারে না। মহাজনের হয়ে বাজারে মাছ বিক্রি করেন। কিন্তু সে টাকা নিজের পকেটে নিতে পারেন না। একসময় মহাজনের হয়ে কাজ করতে করতে কখন যে মহাজনের গোলাম বনে যায় নিজে ও টের পান না। গোলামি করতে গিয়ে আর, ভালো ভাবে জীবিকা নির্বাহ করার সুযোগ হয়ে উঠেনা। অনেকে এই পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এখন গ্রামের হাওর,বিল,খাল, পুকুর ও অন্যান্য জলাশয় থেকে আগে যে ভাবে মাছ পাওয়া যেত, এখন সবগুলো জলাশয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়ে সাধারণ জেলেদের ভাগ্য নিবে যাচ্ছে। অনেক জেলে একটু সুখের আশায় মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছেন। অন্যের পুকুর বা ডোবা লিজ নিয়ে মাছ চাষ করে পথের ফকির ও হয়ে যায়। অধিকাংশ জেলেদের নৌকা এবং দামি জাল কেনার সামর্থ্য থাকে না। তাই তারা মহাজনের থেকে নৌকা ও জাল ভাড়া নেয়। ভাড়ার টাকা পরিশোধ করার পর তাদের আর খুব বেশি উপার্জন থাকে না। নদীতে ও সাগরে মাছ ধরতে গেলে জেলেদের রেডিও বা মোবাইল দরকার হয়। ঝড় বা তুফান এর আবহাওয়ার সর্বশেষ তথ্য জানতে পারে। কিন্তু অনেক জেলেরই এই আধুনিক উপকরণ গুলো রাখার বা কেনার সামর্থ্য থাকে না। এইসব কারণে মাঝে মাঝে সমুদ্র তীর থেকে দূরে মাছ ধরতে গেলে অনেকের জীবন হারায়। অনেক সময় অনেকের লাশ ও পাওয়া যায় না।
নিজেদের পুকুর সবার থাকে না। অন্যের পুকুরে জাল ফেলে অনেকের সংসার চলে। পুকুর থেকে মাছ ধরতে গেলে জেলেদের জালে আটকা পড়া অনেক বড় মাছ ধরার কৌশল সবাই বুঝে না। পুকুরের মালিক ও বুঝতে পারে না জালের ভাঁজে ভাঁজে অনেক মাছ জেলেরা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। একমাত্র সরদার সব কিছু বুঝেন। সেখানেই সরদার একেকজনের সাথে একেকরকম ভাষা ব্যাবহার করেন। চট্টগ্রামের বিশেষভাবে আঞ্চলিক ভাষা ব্যাবহার করে। যখন পুকুরে জাল ফেলেন মালিকের সামনে যে কোন একজন বলেন ( বিলা খাবালি দিও)। মানে সুযোগ বুঝে কাজ করে দিও।
কপাল দোষে সমাজে সুখেন্দু মাঝির দিন শেষ। এখন ছেলে মনু আর ছেলের বউ মালতির মুখখানি শুধু চোখের সামনে ভাসে। মনুর ছেলের চয়নের বয়স এক বছরের ঘরেও যায়নি। ছেলেটা বাপ ছাড়া হয়ে যায়। সবাইকে ছেড়ে যাবার আগে মনুর স্বপ্ন ছিল ছেলেকে ইশকুলে পাঠাবে। শিক্ষিত হয়ে নিজেদের জেলে পেশা থেকে যেন আলাদা হয়। নয়াহাঠে এখন সবাই মিলে ছেঁড়া জাল সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত। মনুও কাঁধে গামছা আর বিড়ি একটা মুখে দিয়ে বাজারের উদ্দেশ্য রওনা দেয়। কতজন কতো রকমের দুষ্টমি করে মনুর সাথে। হঠাৎ মনুকে একজনে বলে ফেলে মনু সুন্দরী বউ ফেলে জাল বুনতে বাজারে আসতে ও চায় না। বউয়ের আঁচলের নিছে থাকতে, আজকে মনুকে মেরামতে না রেখে বউয়ের কাছে পাঠিয়ে দিলে ভালো হয়। মনু সবার হাসিঠাট্টা আর কথাগুলো অপমান মনে করেন।
জাল মেরামত নিয়ে কথাকাটি হওয়াতে মনু সর্দারকে খারাপ ব্যাবহার করে ফেলেন। রেগে গিয়ে সর্দ্দার বাঁশ দিয়ে মনুর মাথায় আগাত করে। মনুও নিজেকে বাচাঁতে সর্দ্দারের উপর হাত তুলেন। সর্দ্দারের উপর হাত তোলাতে বাজারের সবাই ক্ষিপ্ত হয়ে যায় মনুর উপরে। সবাই চড়াও হয়ে বাঁশ আর লাঠি নিয়ে আঘাত করতে থাকে মনুকে। বাজারে এতগুলো লোক কেউ মনুকে বাঁচাতে কাছে আসেনি। খবর পেয়ে মালতি স্বামিকে বাঁচাতে দৌঁড়ে এসে নিজেও আগাত পান। তবু শেষ রক্ষা করতে পারেনি স্বামীকে। হসপিটালে নিতে নিতে মারা যায় মনু। পুলিশ কেইস বলে কথা। লাশ নিয়ে টানা হেঁচড়া করতে করতে দুদিনে লাশের পচন ধরে যায়। মহাজন এসে কোন রকমে পুলিশ থেকে লাশ এনে পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়।
…তিন
মহাজন লাল মিয়া তেমন সুবিধের লোক নয়। কিছু করেন না। সুদে কারবারি হিসাবে পরিচিত। জেলে পাড়ার হিন্দু যুবতীর উপরে নজর বেশি। সারাক্ষন জেলেপাড়ার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে থাকে। জোযান ছেলেদের দিয়ে মদের ব্যবসা করায়। এইসব আবার পরিচালনা হয়, নিটু বাবুর চায়ের দোকান থেকে।
এখন মালতির স্বামী নেই। বুড়ো শ^শুরও ভালো করে চোখে দেখেন না। একমাসের সন্তানকে নিয়ে কষ্টে পড়ে যায় মালতি। মহাজন গায়ে পড়ে নিজ থেকে সবকিছুতে সাহায্য করতে চান মালতিকে। মহাজন বেটার চোখ মালতির সুন্দর শরীরের উপরে। এইদিকে স্বামীর স্বাক্ষীর জন্য পুলিশের চাপ। পুলিশ আসলে মহাজনের যেন মালতি এবং ছেলের জন্য দরদ উথলে পরে। এইভাবে মহাজনের কাছে অনেক টাকা দেনা হয়ে যায়। মহাজন মালতিকে এইবার প্রস্তাব দেই মহাজনকে বিয়ে করতে। মহাজনের লম্পটের কারণে আগের দুই স্ত্রী ও ওকে ছেড়ে যায়।
রাত বিরাতে মহাজন মালতির কাছে আসা-যাওয়াকে সমাজের চোখে সবাই খারাপ ভাবে নিচ্ছে। নিরুপায় হয়ে মালতি নিজেকে মহাজনের লোভ লালসার থেকে বাঁচতে একমাত্র ছেলেটাকে ফেলে, অন্ধকার রাতে মহাজনের হাত ধরে বাড়ি ছাড়েন। নিজের ছেলে বলে কথা। মালতি চয়নকে দেখতে কয়েকবার আসলেও ঘাট থেকে গ্রামের সর্দ্দারের জন্য পেছনে ফিরতে হয়। বুড়ো বয়সে সুখের্ন্দ মাঝিকে শেষমেষ ছেলের বউয়ের কারণে গ্রাম ছাড়তে হয়।
পরের বাড়িতে থেকে সুখেন্দু মাঝি নাতিকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছেন। স্কুলে ভর্তি করে হাই স্কুল পর্যন্ত নিয়ে গেছেন। নিজের অসুস্থ সমাজের থেকে অনেক দূরে রেখেছেন নাতিকে। একদিন সুখেন্দু মাঝি নাতি চয়নকে ডেকে বলেন।
দাদুভাই তোকে তো একটা মাষ্টার দেবার সামর্থ্য নেই আমার। লেখাপড়াও তো ঠিক মতো হচ্ছে না। এমন লেখাপড়ায়একবারে মেট্রিক পাস করতে পারবি কিনা সন্দেহ আছে। তার চেয়ে হাতের যে কোন কাজ শিখলে ভালো হয়। গ্রামের পরিবেশ নষ্ট হয়ে গেছে। গ্রামে থেকে লাভ নেই । তুই তোর মামার কাছে শহরে চলে যা। সেখানে তোর মামা তোকে একটা ব্যবস্থা করে দিবেন।
ঃ দাদাভাই তোমাকে ছেড়ে আমি মামার কাছে আমি যাবো না। উনি আবার সেই মাছের আড়তে বসাইয়া দিবে। তাহলে তো আরো ভাল হয় তুই ব্যবসা শিখতে পারলে নিজে নিজে করতে পারবি। দেখনা পরের বাড়ীতে গরুর ঘরের একচালা ঘরে বসবাস করছি। তবু ও শান্তি নেই গ্রামের কিছু মানুষের জন্য। সবসময় উঠতে-বসতে নিচু জাতের খোঁটা। দেখছিস না সমাজের সবাই একসাথে পুকুরে গোসল ও অন্যান্য কাজ কর্মে কেমন অনিহা প্রকাশ করে। আমরা কেমন একঘরে হয়ে আছি। মা-বাবা নেই তাই বাধ্য হয়ে চয়নের কাছে দাদার কথা শুনতে হয়।
মামাদের অবস্থা বেশ ভালো। কিন্তু খবর রাখেন না কেউ তেমনি। মামার কাছে যেতে হবে বলেই চয়নের মন খারাপ হয়ে গেছে। যে ব্যবসা করলে শরীরের মাঝে জাতের গন্ধ লেগে যায় সে ব্যবসা করে লাভ কি। এখন জেলে ছেলে হলে শুধু এই পেশায় তাই তো নয় । সমাজের সব শ্রেণির লোক এই পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করছে।
এখন দাদুর কথা না শুনেও উপায় নেই। উনার শরীরে কঠিন রোগে বাসা বেঁধেছে। দাদু আজ যাবে না কাল যাবেন দিন গুনছেন।
চয়নের ছোট বেলা থেকেই শখ কবুতর পালন করা। শহরে চলে যেতে হবে বলেই অনেকগুলো কবুতর হাটে নিয়ে কম দামে বিক্রি করে দেয়।
চট্টগ্রাম শহরে মামার বাসাতেই চলে আসে চয়ন। মামা কৃষ্ণ চৌধুরীর বেশ নামডাক। উনি এক কথার মানুষ বলে সবাই বেশ ভালোবাসেন। সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে চয়নকে সাথে করে নিয়ে বাজারে চলে যান মামা। বারোটার দিকে আবার ছেড়ে দেন।
চয়ন বাসায় এসে আবার পড়তে বসে। মামির চোখে পড়ে চয়নের লেখাপড়ার দিকে মনোযোগ বেশি। মামি ও মামাকে বলেন, ছেলেটি গাইড করলে ভালো করবে মনে হয়। মামা এইসবকে পাত্তা দেন না। চয়নের মামা লেখাপড়া না জানলে কি হবে, মামি লেখাপড়া জানেন। মামি লেখাপড়া কে বেশ গুরুত্ব দেন।
সেজন্য মামাতো ভাইবোন দুজনকে মামি ভারতের দার্জিলিংয়ে নামকরা স্কুলে রেখে লেখাপড়া করান।
আজগুবি শহরে আজগুবি সব ধরনের কাজ। চয়নের মামি-মামা নিজেদের জলদাস পরিচয় দিতে বেশ লজ্জা বোধ করেন। ছেলে মেয়ে দুটিকেও চৌধুরী লেখাতে গিয়ে নিজেরাই কখন যে চৌধুরী হয়ে গেছেন নিজেরাও জানে না।
চয়নকে মামি-মামা বলে দিয়েছেন আশেপাশের কেউবা যদি পদবী জিজ্ঞাসা করে বলতে বলেছেন চৌধুরী বংশ ।
আর মামা কী ব্যবসা করেন, কেউ জানতে চাইলে বলবে মাছের আড়তদার বা ইম্পোটার। বা নিজেদের ব্যবসা।
এমন করে ছয়টি মাস কেটে গেলো কখন বুঝতে পারলো না চয়ন।
মামার বাসায় মন খারাপ লাগলে পড়ন্ত বিকেলে মাঝে মাঝে ছাদে উঠে যায় চয়ন। সূর্যনা ডোবা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে থাকে আকাশের দিখে মুখ করে। যখন মাথার উপর দিয়ে কোন চিল উড়ে যায়, চয়নের মনে হয় এখনি মেঘ জমবে। বৃষ্টি নামতে পারে। ছোটবেলা থেকে প্রকৃতির এমন আচরণ চয়ন বুঝতে পারে।
চয়ন যখন ছাদে উঠে পাশের বাসার ছাদ থেকে একটা মেয়ে চয়নের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। অদ্ভুত রহস্যময় ভঙ্গিতে ওর আচরণ। সাথে মাকে ও দেখা যায়। প্রায় সময় মেয়েটাকে টেনে হেঁচড়ে ও নিচে নামিয়ে নিতে চাইলেও সহজে পারে না। সবার সাথে কথা বলতে চায়। আনমনে আকাশ পানে তীর্থের কাকের মতো বৃষ্টির জন্য চেয়ে অপেক্ষা করতে থাকে মেয়েটা। হয়তো একফোঁটা জল খসিয়ে পড়বে মুখপানে তখনই আনন্দে আত্মহারা হয়ে নাচবেন।
..চার
মনে হয় বিধাতা নিজের হাতে গড়েছেন এমনি রূপ। মেয়েটা একা থাকলে চোখে চোখ পড়লে একটি মিষ্টি হাসি দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নেমে যায়। চোখের ইশারায় সে যেন কিছু বলে আবার হবে দেখা। মেয়েটার চেহারাটি যেন অদ্ভুত সুন্দর। লাবণ্যময়ী চেহারাটা মায়ার চাদরে ঢেকে রাখা। এই ভাবে কেটে যায় একটি বছর মেয়েটির চোখে চোখে।
চয়ন দিনরাত পরিশ্রম করে গ্রামে গিয়ে কোন রকমে দুইবারে এসএসসি পাস করে। যেখানে গোল্ডেন এ প্লাসের ছড়াছড়ি। সেখানে এমন টানাটানি পাশের কোনো সরকারি কলেজে চান্স নেই। আবার সেই গ্রামে গিয়ে নাম লেখায় এইচএসসিতে । মামী অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেন চয়নকে বাসায় রাখতে। চয়নের চলাফেড়া সুন্দর না। চলাফেরায় আশেপাশের কেউ যদি জেনে যায় জলদাস। তাহলে সমাজে মুখ দেখাবেন কি করে। সবাই নিছু জাতের খোঁটা দেবেন।
চয়ন নিজের শিখরের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ানোর মতো ছেলে নয়। চয়নের নামের পাশেই জলদাস লেখাকে নিজে গৌরবান্বিত ও আদর্শ মনে করেন।
চয়ন মামার বাসায় থেকে চলে যাবে সে কারণে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটি কে আর দেখতে পারবেনা বলে। স্কুলে পড়ে না কলেজে সে কথা জানার মতো কোনো সুযোগ হচ্ছে না।
সকালে ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে যায় মেয়েটার পেছন পেছন। মেয়েটির সাথে কোন রকমে কথা বলতে পারছে না চয়ন। প্রতিদিন ওর সাথে মা অথবা বোন কেউ না কেউ ওর সাথে লেগে থাকে। আজকে একা রিকশা করে স্কুলে পাঠানো হয়েছে। সুযোগটা কাজে লাগাতে হবে।
মেয়েটিকে পেছন থেকেই চয়ন দেখে ও না দেখার ভান করে চলে যায়।
স্কুলের সামনে গিয়ে চয়ন দুচোখের জল ছেড়ে দিলো। অবাক হয়ে যায়। শ্রবণ প্রতিবন্ধী স্কুল দেখে চয়নের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। হে বিধাতা এমন সুন্দর মেয়ের জন্য এই কেমন শাস্তি তুমি লিখে রেখেছ।
চয়ন গ্রামে চলে যায়। দুই-তিনটি টিউশন করে নিজের এবং দাদুর দেখভাল করে। হঠাৎ করে দাদু ও এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। চয়ন এখন পৃথিবীতে একা। কোনদিকে একা বসে থাকলে শুধু মেয়েটির মুখটি চোখের কোণে ভাসে। মন ভালো না লাগলে প্রায় সময় শহরে আসে মেয়েটার সাথে দেখা করতে। নাম না জানা মেয়েটা চয়নের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
অনেক দিন পর একা মেয়েটাকে দেখতে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায় চয়ন। চয়ন বলে কেমন আছেন?
সে হাঁ করে চয়নের মুখের দিখে তাকিয়ে থাকে।
চয়ন আবার বলে কথা বলো না কেন, রাগ করেছো ?
তা-ও কোন উত্তর দিল না। এইবার কাছে গিয়ে ইশারা করে বললো তুমি এতোদিন কোথায় ছিলে ? আমাকে দেখতে আসনি কেন।
চয়নের কথাগুলো শুনতে বা বুঝতে পারছেনা । মেয়েটি খাতা নিয়ে গজগজ করে লিখল ।
ঃ তুমি ভালো না। এখন আর ছাদে উঠো না কেন? আমি কথা বলতে পারি না বলে তুমি জানতে পেরেছ। তাই আমার থেকে দূরে সরে গেছো।
অনেকক্ষন পরে মাথায় এলো সে তো শ্রবণ প্রতিবন্ধী। চয়ন খাতায় লিখলো না তাঁর পাড়ার কাকার ছেলের ও একই সমস্যা। সে কারণে ওই বধির ভাষা ওর জানা আছে। ওদের ভাষায় হাত নাড়িয়ে কথা বলে। আমি আর তোমাদের শহরে থাকি না। বাড়িতে চলে গেছি। তোমাদের শহর বড়ো কঠিন। এইখানে শুধু শোষণ শ্রেণীর লোক। আমি গরীব আমার বংশ পরিচয় জানতে পারলে তুমি ও দূরে সরে যাবে।
ঃ ওই সব জানার কোন ইন্টারেষ্ট নেই আমার।
আমি জেলের এর ছেলে গ্রামের ছেলে। তাই গ্রামে চলে গেছি। গ্রামের একটি কলেজে ভর্তি হয়েছি।
ঃ তাহলে আসছ কেন?
তোমাকে দেখতে। কথাটি শোনার পরে মেয়েটির মুখে একটা লাবণ্যময় হাসি। টোল পড়া মিষ্টি হাসিতে হৃদয় জুড়ে ভালোবাসা নিয়ে গেল মেয়েটি ।
তোমাকে কি নামে ডাকবো বলো।
ঃ তোমার যে নামে ইচ্ছে।
তাহলে তোমাকে আঁখি বলে ডাকি।
ঃহুম
তুমি মোবাইল ইউজ করো ?
ঃ না ।
তাহলে কি করে আমাদের দেখা হবে।
ঃ আমি জানি না। আর আমি তো স্কুলে প্রতিদিন আসতে পারি না। মা আমাকে একা একা আসতে দেই না।
এরপরে আঁখির সাখে দেখা করতে চয়ন অনেক দিন আসে স্কুলে। কিন্তু আঁখিকে আর কোন দিন দেখেনি।
অনেক দিন পেরিয়ে গেছে। চয়ন ইন্টারে ও তেমন ভালো রেজাল্ট করতে পারেনি। ড্রিগ্রিতে গিয়ে হঠাৎ করে রেজাল্ট ভাল করে ফেলে। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে টিকে যাবার পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সৃষ্টিকর্তা হঠাৎ করে সব মেধা যেন একসাথে দিয়ে দেয়েছেন চয়নকে।
….পাঁচ
ভার্সিটিতে সর্বকালের সেরা রেজাল্ট করেছেন চয়ন। ভার্সিটি থেকে স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করতে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেক্ট হন।
লন্ডনে যাবার আগে খুব ইচ্ছে হলো আঁখিকে একবার দেখতে। সাহস নিয়ে সোজা চলে যায় আঁখিদের বাসায়। চয়নের পরিবর্তন শুধুমাত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নয়। আমূল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে সমাজে ও।
চয়নের ইচ্ছে সমাজের অটিজম নিয়ে কাজ করার। এরমধ্যে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় কাজ ও শুরু করে দিয়েছেন চয়ন।
বাসায় আসার সময় সৃষ্টিকর্তা কে একবার স¥রণ করলেন। অভিবাবক বিহীন সংসারে আজকে নিজের ভালো মন্দের দায়িত্ব নিজেকে সামলে নিতে হয়।
রুমে ঢুকে আঁখির মাকে পরিচয় দেবার প্রয়োজন হয় নাই। বরং চয়নকে দেখার পর আঁখির মা চমকে উঠেন।
মনে মনে এমন দিনের প্রতিক্ষায় ছিলেন পুরো পরিবার।
চয়নের মন খুলে কথা আঁখির মা সবকিছুকে ভালো ভাবে নিয়েছেন। উনি শুধু একবার বললো অনেক দেরি করে ফেলেছ বাবা।
বাকিটুকু তুমি ওই রুমে গেলে বুঝতে পারবে।
আঁখির রুমে গিয়ে দেখল আঁখি একপাশ হয়ে শুয়ে আছে। পুরো রুমে বই আর কাপড় চোপড় ছড়ানো ছিটানো। আঁখিকে হঠাৎ করে দেখতে পেয়ে সব কিছু ভুলে যেতে বসেছে চয়ন। আঁখি চয়নকে দেখে ছোট বাচ্ছার মতো হাউমাউ কওে কেঁদে উঠলো। চয়নকে অনেক দিন পর দেখে শার্টের কলার চেপে ধরে ছিঁড়ে ফেলে। দৌড়ে এসে আঁখির মা মেয়েকে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করেন।
চয়ন আঁখিকে একবার বললো, তুমি কি আমার সাথে যাবে?
মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছে।
আঁখির মা চয়নকে বললেন, বাবা তুমি যে দিন ওর স্কুলে ওর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে, আমি সেই দিন থেকে তোমার ব্যাপারে সব খোঁজ খবর নিয়েছিলাম। মেয়েটি স্কুল থেকে ফেরার পর থেকে কেমন যানি অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে। অনেক কষ্ট করে আবিষ্কার করলাম সে তোমাকে খুঁজছে। নিজের থেকে ছাদে যাওয়া বন্ধ করে দেয়। আস্তে আস্তে কেমন যানি নিস্তেজ হয়ে গেল। আমি তোমার খোঁজে তোমার মামার বাসায় যায়। সেখানে গিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভুতি হলো। পয়সা থাকলে সব কিছু যেমন পাওয়া যায় না। তেমনি করে পয়সা দিয়ে চরিত্র পাল্টানো যায় না। উনি তোমাকে ছোট করতে গিয়ে নিজেকে কখন যে ছোট করেছেন নিজে ও বুঝতে পারল না। তুমি এখন বড়ো হয়েছ। সেটি তোমার মামির চক্ষুশুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। উনার ছেলে মেয়ে দুজনই বাইরে পড়তে গিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে। সেটাকে উনি গর্ববোধ করছেন। পাড়ার সবাই কে বলে বেড়ায় উনার ছেলে মেয়ে দুজনই বিদেশে সেটেল।
তোমার সঙ্গ আমার মেয়েটাকে আমূল পরিবর্তন করে ফেলেছে। সৃষ্টিকর্তা ওকে মুখের কথা বলার ভাষা দেইনি সত্যিই, কিন্তু মানুষ চেনার ক্ষমতা দিয়েছেন।
সেই দিন মেয়েকে অনেক করে বুঝিয়েছি। মেয়ের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে তোমার আংকেল কে তোমার বাড়িতে পাঠিয়েছিলাম। উনি তোমার খোঁজে গিয়ে দেখে তোমার ঘর বাড়ি কিছু নেই। সেটা নিয়ে দেখলাম উনার মাথাব্যথা নেই।
হুঁ, তোমাকে উনি এসেসমেন্ট করতে ভুল করেনি। সেজন্য তোমার সাথে উনি আর দেখা করেন নি তোমার ভবিষ্যতের কথা ভেবে। উনি তোমাকে দেখে তোমার ভবিষ্যৎ বলে দিয়েছে। তুমি একদিন এই সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যাক্তি হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়াবে।
আমার মেয়েকে আজকে তিন-চার বছর ধরে কিভাবে রেখেছি সেটা সৃষ্টিকর্তা জানেন।
তোমার আঙ্কেল মেয়েকে ভালো রাখতে অনেক চেষ্টা করে যাচ্ছেন। ভারতে পর্যন্ত নিয়ে গেছেন।
উনি মেয়েকে বলেছে তুমি তোমার মতো করে লেখাপড়ায় এগিয়ে যাও। মনের মধ্যে বিশ্বাস থাকলে জয় তোমার।
কি বলবো বাবা আমার মেয়েটা তোমাকে ফ্রেক মনে করেছে। সেজন্য নিজের অবস্থা কি করেছে দেখ।
সত্যি আঁখিকে দেখে চেনার কোন উপায় নেই। কি সুন্দর মেয়েটা কি হয়ে গেল।
চয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন আন্টি আমি কি আপনার কাছে কিছু চাইতে পারি ?
আঁখির মা চয়নের কথার উত্তর এড়িয়ে গেছেন। মনে মনে বললেন সময়ের সাথে সব কিছুর উত্তর তোমার একসময় মিলিয়ে যাবে।
বাবা আমার কাছে জাত মানে কি জানো? স্বজাতিকে হেয় করা নয়। একটা সুস্থ সুন্দর মনের মানুষ। আর মানুষ মানে কি জানো? যার কাছে হুস আছে।
নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজে কৌশলে কি করে দিবেন। সে সাহস নেই চয়নের।
আন্টি আমি দুই একদিনের মধ্যে দেশ ছাড়বো। আমার অভিভাবক বলতে কেউ নেই। তাই দেশ ছাড়ার আগে আঁখিকে আমার সাথে দিবেন। ওর সারা জীবনের সুখ দুঃখের বার এবং চিকিৎসার বার আমার কাছে থাকবে। যদি আপনারা আমাকে বিশ্বাস করেন।
আঁখির মা বিনয়ের সাথে বললেন। আমার মনে হয় তোমার আরেকটু সময় নেবার প্রয়োজন রয়েছে। হুট করে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিয়ো না। যা পরে তোমার নিজের জন্য সমস্যা হতে পারে। আঁখির মা সেইদিন চয়নকে বিদায় দিয়ে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন। এখনো চয়নকে বিশ^াস করতে কষ্ট হচ্ছে। জলদাস বলে নয়। উচ্চশিক্ষিত বলে।
যদি মেয়েটিকে ভালো না লাগলে মেরে ফেলে। বা ফেলে রেখে চলে যায়। তার চেয়ে নিজের বুকে থাকলে ভালো। অনেক সময় গড়িয়ে গেছে। সমাজের উচ্চ প্রতিষ্টিত ব্যাক্তি হিসাবে চয়নকে সবাই চিনেন।
পাখিরা সব নীড়ে ফিরে যাচ্ছে। একা দাঁড়িয়ে আছেন বেলকনির জানালা ধরে ডক্টর চয়ন। চোখের আড়াল হলেও হৃদয়ে যার আশ্রয়। সে ফুটে ওঠে দু’চোখে স্থির প্রতিচ্ছবির মত। তাকে দেখবার জন্য নয়ন মেলে ধরতে হয় অন্তরে। আলোর মতো বিরাজ করে সে সারা হৃদয়ে। এখন বয়সের মাঝখানে, একা! যিনি সমাজে সবাইকে আলোর মুখ দেখাচ্ছেন,আজকে অন্ধকার উনার ঘর। আলোকিত করবে সেই মানুষটি যে নেই। হয়তোবা অন্ধ কারাচ্ছন্ন ঘরটি আলোকিত হবে না আর কোনদিন।
অরূপ পালিত, গল্পকার