বাবুল সিদ্দিক : পুরো নাম মোহাম্মদ আবুল কাশেম ফেরদৌসি তুসি। ফেরদৌসি নামেই অধিক পরিচিত। পারস্যের (বর্তমানে ইরান) একজন বিখ্যাত কবি। তিনি বিখ্যাত ফার্সি মহাকাব্য শাহনামার রচয়িতা। তিনি ইরানের তুস নগরের পাজ নামক গ্রামে ৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। তুস নগরে একটি সুন্দর বাগান ছিল। সেখানে কত রকমের গোলাপ ফুটতো তার কোন লেখাজোখা ছিল না। বাগানটি ছিল আবার সেদেশের রাজার। ওই বাগানের দেখাশোনা করতেন মোহাম্মদ ইসহাক ইবনে শরফ শাহ। তারই পুত্র ছিলেন আবুল কাশেম। ছোটবেলায় আবুল কাশেম পিতার সাথে বাগানে ঘুরে বেড়াতেন। সুন্দর সুন্দর ফুল দেখতে যেমন তার ভাল লাগত আবার সেগুলোর মন মাতানো সুগন্ধি তিনি প্রানভরে গ্রহণ করতেন। গোলাপের বাগানে ঘুরে মুগ্ধ হয়ে যেতেন আবুল কাশেম । উপরে নীল আকাশ, সবুজ গাছপালা তার মাঝে ফুটে আছে ছোট বড় হরেক রকমের গোলাপ – আবুল কাশেমকে ভাবুক করে তোলে। বাল্যকালে পিতার কাছে লেখাপড়া শেখেন। পরে তিনি স্থানীয় একজন প-িতের কাছে জ্ঞান অর্জন করেন। পিতা রাজার বাগানের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। পরিবার মোটামুটি সচ্ছল ছিল, কোন অভাব ছিল না। রাজার কাছ থেকে ‘তনখা’ হিসাবে যা কিছু পেতেন তাতে ভালভাবেই তার সংসার চলে যেত। ছোটবেলায় বাগানে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে আবুল কাশেমের মনে কবিতা লেখার ভাব চলে আসে। বাগানের পাশ দিয়ে বয়ে চলা একটি ছোট্ট নদী । কোথা থেকে এত পানি আসে আবার কোথায় চলে যায়! এগুলো তার মনে গভীর রেখাপাত করে। নদীর তীরে কত পাথর পরে আছে। তিনি সেখানে বসেন আর প্রকৃতির এসব সৌন্দর্য উপভোগ করেন।
এখানে বসেই আবুল কাশেম লিখতে শুরু করেন। পিতার অবস্থা ভাল ছিল। পিতা মারা যাবার সময় অনেক জায়গা জমি রেখে যান। কাজেই জীবন কাটানোর মত প্রয়োজনীয় অর্থের কোন অভাব ছিল না আবুল কাশেমের। তিনি প্রতি বছর এসব জায়গা জমি থেকে প্রচুর আয় করতেন। কিন্তু ধন-সম্পদের দিকে তার কোন নজর ছিল না, কোন মতে খেয়ে পরে চালটাই তার লক্ষ। তার সাধনা ছিল ভাল ভাল কবিতা রচনার মাধ্যমে মানুষকে ভাল ও কল্যাণের পথে উদ্বুদ্ধ করা। সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত হওয়াই ছিল তার জীবনের লক্ষ।
পিতা মাতা শখ করে অল্পবয়সে তার বিয়ের ব্যবস্থা করেন। তার ঘরে মাত্র একটি মেয়ে। মেয়েটিকে নিজের কাছে রেখেই লেখাপড়া শেখান। সাধারণ মানুষের দু:খ কষ্ট উপশম করতে চাইতেন। বিভিন্নভাবে মানুষকে উপকার করে সুনাম অর্জন করেন। এসব খবর ওই দেশের রাজার কানে গেল। তখনকার দিনে রাজার গোয়েন্দা লোকেরা এসব খবর রাখত। তারা কোন লোককে জনপ্রিয় হতে দেখলে রাজাকে জানিয়ে দিত। এর ফলে রাজা সেই লোককে সহ্য করতে পারতেন না। হয় তাকে সে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হত না হয় তাকে রাজার সাথে মোকাবিলা করে টিকে থাকতে হত। আবুল কাশেম ঝক্কি ঝামেলা পছন্দ করতেন না। তিনি কবি, রাজা হওয়া তার লক্ষ নয়। কবিতা লেখা আর দুঃখী মানুষের দু:খ দূর করাই ছিল তার একমাত্র কাজ। রাজার কাছে তার বিরুদ্ধে অনেক রকম মিথ্যা অভিযোগ আনা হল। ফলে রাজা তাকে গ্রেফতারের পরিকল্পনা করলেন। আবুল কাশেম সে খবর আগেভাগেই পেলেন। রাজার দরবারের সভাসদ কবিকে ভালবাসতেন। তারা সময়মত রাজার পরিকল্পনা কবিকে জানিয়ে দিলেন। আবুল কাশেম মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন অজানার উদ্দেশ্যে, নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। তিনি গজনিতে গেলেন। শুনেছেন সেখানকার সুলতান খুব ভাল মানুষ। তার নাম মাহমুদ। দেশ বিদেশী জ্ঞানী গুনি লোকজনকে মাহমুদ খুবই সম্মান ও শ্রদ্ধা করতেন। রাজদরবারে বসত কবিতা আবৃত্তির আসর।
আবুল কাশেম কবিতা রচনা করতেন কাজেই তিনি ভাবলেন সুলতানের সাথে দেখা করতে পারলে তিনি যথাযথ কদর পাবেন। কিন্তু সুলতানের সাথে দেখা করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। মন চাইলেই আর তার সাথে দেখা করা যায় না। এ জন্য অনেক নিয়ম কানুন রয়েছে। সুলতানের দরবারে যারা কবি রয়েছেন তারা সহজেই অন্য কবিকে তাদের মাঝে স্থান দিতে চান না। কাজেই রাজদরবারে প্রবেশের অনুমতি আর মেলে না। আবুল কাশেম সুলতানের দরবারে প্রবেশের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেন। কিন্তু সৎ, ভাল মানুষের সহায় থাকেন আল্লাহ। আল্লাহ্র ইচ্ছায় সুলতানের উজির মেহেক বাহাদুর তার প্রতি সদয় হলেন। মেহেক আবুল কাশেমকে সুলতানের দরবারে সুলতানের সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করলেন। সুলতানের সাথে আবুল কাশেমের প্রথম পরিচয় হয় কবিতা পাঠের মাধ্যমে। সুলতান আবুল কাশেমের কবিতা শুনে মুগ্ধ হলেন। কবিতার ভাব, চিত্রকল্প, শব্দচয়ন এত উচ্চস্তরের ছিল যে, সুলতান বুঝলেন ইনি অনেক বড় মাপের কবি। তিনি এরকম একজন কবির জন্যই এতকাল অপেক্ষা করছিলেন। তার বহু কালের প্রতাশা যেন আজ পূরণ হতে চলেছে। মাহমুদ মহাখুশি হলেন। তিনি নিজেও একজন কবি ছিলেন। আবুল কাশেমের কবিতা শুনে তিনি তাকে ‘ফেরদৌসি’ উপাধি দিলেন।
বেহেস্তের মধ্যে সবচেয়ে সেরা এই জান্নাতুল ফেরদৌস। এই কবিও সকল কবির সেরা তাই তাকে যথার্থই ফেরদৌসি বলা যায়। সুলতান আবেগ ভরে আবুল কাশেমকে উদ্দেশ করে বলে উঠলেন “আয় ফেরদৌসি, তু দরবার মে ফেরদৌস কর দি। “এর মানে হল, “হে ফেরদৌসি তুমি সত্যিই আমার রাজ দরবারকে সেরা বেহেস্তে পরিনত করে দিয়েছ। “তখন থেকেই আবুল কাশেম ‘ফেরদৌসি হিসাবে সকলের কাছে পরিচিত হলেন। আবুল কাশেম নাম চাঁপা পড়ে গেল ফেরদৌসি নামের আড়ালে। সুলতান কবির জন্য থাকা খাওয়ার ভাল ব্যবস্থা করে দিলেন। আর তাকেই রাজকবি মনোনীত করলেন। আস্তে আস্তে সুলতান মাহামুদের সাথে ঘনিষ্টতা হলে। দু’জনে প্রিয় বন্ধু হলেন। কবির জ্ঞান বুদ্ধিতে সুলতান খুব মুগ্ধ হন। কিন্তু তাদের এই বন্ধুত্ব বেশি দিন স্থায়ী হলো না। ফেরদৌসির প্রতি সুলতানের এত ভালবাসা ও তার প্রতি এত সম্মান দেখে অন্যান্য কবি ও উজির-নাজিররা ঈষান্বিত হয়ে উঠলেন। তারা কবিকে রাজ-দরবার থেকে বের করে দেবার গভীর যড়যন্ত্রের লিপ্ত হলেন। সুলতানের প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দিও কবির বিরূদ্ধ গেলেন। তিনি গোপনে তার ক্ষতি করার চেস্টা করতে লাগলেন।
শাহনামা প্রণয়ন- : এদিকে সুলতান মাহমুদ ফেরদৌসিকে শাহনামা মহাকাব্য রচনা করার অনুরোধ করলেন। এর প্রতি ‘শ্লোক’ এর জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা কবিকে দেবার ওয়াদা করলেন। ফেরদৌসি ৩০ বৎসর পরিশ্রম করে ‘শাহনামা’ রচনা করলেন। এতে ৬০ হাজার ‘শ্লোক‘ আছে এবং এটি ৭টি খ-ে বিভক্ত। শাহনামা হচ্ছে প্রাচীন ইতিহাস, কৃষ্টি ও সাংস্কৃতি নিয়ে বিভিন্ন কাব্যগাঁথা। পুরো মহাকাব্যে ৬০ হাজার বার আছে অন্ত্যমিল। এটি হোমারের ‘ইলিয়ট’ এর চেয়ে সাতগুণ বড়। ইংরেজি, রাশিয়ান সহ পৃথিবীর বহু ভাষায় এটি অনুবাদ হয়েছে।
পারস্য সম্রাট সুলতান মাহমুদ যখন ফেরদৌসিকে শাহনামা লেখার দায়ীত্ব দিয়েছিলেন তখন তিনি ওয়াদা করেছিলেন এই মহাকাব্য যতগুলি শ্লোক থাকবে তার প্রত্যেকটির জন্য ১টি করে স্বর্ণমুদ্রা কবিকে দেয়া হবে, সে হিসাবে কবির প্রাপ্য হয় ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা। সুলতান শাহনামার জন্য কবিকে ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা দিতে চাইলেন কিন্তু রাজ-দরবারের হিংসুটে কয়েকজন উজির সুলতানকে পরামর্শ দিলেন, এত স্বর্ণমুদ্রা দেয়ার প্রয়োজন কি ? এ জন্য কবিকে ৬০ হাজার রৌপমুদ্রা দিলেই যথেষ্ট হবে। সুলতান সভাসদদের যড়যন্ত্র বুঝতে পারলেন না। তাই তাদের পরামর্শমত কবিকে ৬০ হাজার রৌপমুদ্রা পাঠিয়ে দিলেন। ফেরদৌসি সুলতানের ওয়াদাকৃত ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে রাগে, দুঃখে কী করবেন ভেবে পেলেন না। তিনি অর্থ, ধন দৌলতের লোভে এ কাজ করেন নি। বরং এই অর্থ দিয়ে দীন দুঃখি মানুষের কল্যাণে ব্যয় করবেন এটাই ছিল তার আকাক্সক্ষা। তিনি এ ঘটনা তার জন্য অনেক অপমানজনক মনে করলেন। ফেরদৌসি রৌপমুদ্রাগুলি তার চাকরদের মধ্যে বিলিয়ে দিলেন এবং সুলতানের পাঠানো পত্রের এক কোণে ‘আলিফ, লাম, মিম এই তিনটি অক্ষর লিখে দেন। সুলতান মাহমুদ এই তিনটি অক্ষরের অর্থ বুঝতে পারলেন না। তার রাজ-দরবারের কেউই এর মর্ম উদ্ধার করতে পারলেন না। তখন তিনি রাজ-দরবারের ফেরদৌসির অভাব অনুভব করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, আজ যদি কবি ফেরদৌসি দরবারে থাকতেন তা হলে এর অর্থ তিনি অনায়াসেই বলে দিতে পারতেন। অর্থ বোঝার জন্য দরবারের বাইরে যেতে হত না।
সুলতান মাহমুদ এ সময় কুয়েস্তানের রাজা নাসিরুদ্দিনের কাছ থেকে একটি পত্র পেলেন। পত্রে কবি ফেরদৌসির খুব প্রশংসা করা হয়েছে। সুলতান পত্র পড়ে নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন, কবিকে তার ওয়াদামত স্বণমুদ্র না দেয়া উচিত হয় নাই এবং অনুভব করলেন স্বর্ণমুদ্রা না পেয়ে নিশ্চয়ই কবি খুব দুঃখ পেয়েছেন। রাজসভার অন্যান্য কবি ও উজির-নাজিররা যে ষড়যন্ত্র করেছিল এ কথাও বুঝতে সুলতানের বাকি থাকল না। তিনি প্রধানমন্ত্রী খাজা ময়মন্দিকে রাজপদ থেকে বিতড়িত করলেন। আর কবিকে ফিরিয়ে আনার সংকল্প করলেন। তিনি কবির প্রাপ্য স্বর্ণমুদ্রা সহ কবির জন্মভূমি তুস নগরীর কবির বাড়িতে দূত পাঠালেন।
কিন্তু তখন দেরি হয়ে গেছে। অভিমানী কবি ফেরদৌসী তখন এ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অনন্তের পথে পাড়ি জমিয়েছেন।
তার লাশ কাঁধে করে দাফনের জন্য লোকজন যখন তার বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল সেই সময় সুলতান মাহমুদের প্রেরিত দূত ৬০ হাজার স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে কবির বাড়িতে প্রবেশ করছিলেন। কবির কন্যা এ মুদ্রা গ্রহণ করেন নি। পরবর্তীতে কিছু মুদ্রা দিয়ে কবির মাজার সংস্কার করা হয় ও কিছু মুদ্রা গরিবের মাঝে বিতরন করা হয়। মহাকবি আবুল কাশেম ফেরদৌসি ১০২০ সালে ৮০ বৎসর বয়সে ইরানের তুস নগরীতে মৃত্যুবরণ করেন।
পৃথিবীর যে কয়জন হাতে গোনা মহাকবি রয়েছেন ফেরদৌসী তাদের মধ্যে অন্যতম। বিভিন্ন ভাষায় তার মহাকাব্য শাহনামা অনূদিত হয়েছে। বিশ্বের কাব্য প্রেমিক মানুষের কাছে তিনি চির সবুজ, চিরনবীন এক মহাপুরুষ।
ফেরদৌসির রচিত মহাকাব্য শাহনামা এত জনপ্রিয় ও মূল্যবান ছিল যে, বিগত একশ’ বছরের মধ্যে তা বাংলা, উর্দু, হিন্দি, চীনা, জাপানিজ, ইন্দোনেশিয়ান, মালয়েশিয়ান, ফরাসি, গ্রিক, জার্মান, ও ইংরেজিসহ বিশ্বের প্রায় অর্ধশত ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। পূর্বে ১২২৪ সালেই আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলাদেশেও শাহনামা অনুবাদ হয়েছে। এটি করেছেন মনির উদ্দিন ইউসুফ এবং এই অনুবাদ কর্মটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
বাবুল সিদ্দিক : প্রাবন্ধিক, নিউইয়র্ক প্রবাসী