এখন সময়:বিকাল ৫:৩১- আজ: শুক্রবার-২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:বিকাল ৫:৩১- আজ: শুক্রবার
২১শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

মাকড়সা

দেবাশীষ ভট্টাচার্য

একটা ভয়ংকর যুদ্ধের আলামত আগেই টের পেয়েছিলাম। হাটখোলায় পেটে আগুন নিয়ে জেট বিমানগুলো যেদিন বৃষ্টির মতন গুলি চালিয়ে গেল তার পরদিনই আমরা ঠিক করলাম চলে যাব। অনেকটা মৃত্যু ভয়েই হিম ঠান্ডার ভেতর আমরা এক কাপড়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাবা অনেক বোঝানোর পরও রমেশ কাকা গেলেন না পড়ে রইলেন ভিটে কামড়ে সুরেন মিস্ত্রির মত।

ভারতে উদ্বাস্তু হয়ে যেতে হবে কখনো ভাবিনি। নয়টি মাস জীবন মৃত্যুর দুর্বিসহ যন্ত্রণায় আমরা বেঁচে রইলাম তবু। যুদ্ধ থামতে না থামতেই আবার ওয়ার্ল্ড ফুডের গাড়িগুলো জঞ্জালের মত আমাদের ফেলে দিয়ে গেল হাটখোলার বড় রাস্তাটার ওপর। যুদ্ধের ভয়াবহতা টের পেলাম দেশের মাটিতে নেমেই। ধু ধু বিরান হয়ে গেছে চারদিক পোড়ামাটি ছাড়া আর কিছুই পেলাম না আমরা। হাটখোলা থেকে দু’চোখ পশ্চিমে ফেরাতেই দেখলাম ধ্বংসযজ্ঞ কত প্রচ- হয়েছে গ্রামে। ঠিক রমেশ কাকার ডিসপেনসারি যেখানে ছিল, সেখানে দেখলাম কু-লী পাকিয়ে শুয়ে আছে একটা কুকুর। পুরনো মানুষের গন্ধে কুকুরটি লোভী চোখে ল্যাজ নেড়ে চললো।

 

 

আমি যেন স্বপ্নের ঘোরে তখনো খুঁজছিলাম আমাদের পুরনো বাড়িটাকে। পূর্ব পশ্চিমে টানা দোতালা বাড়িটার কোনো অস্তিত্ব আর পেলাম না খুঁজে। কাঠের সিঁড়িগুলোতে পা রেখে আমি আর পারমিতাদি লুকোচুরি খেলতাম। স্মৃতিগুলো করোটির ভেতর প্রখর হয়ে উঠতেই বাবা বিষাদে জ্ঞান হারিয়ে কাত হয়ে পড়লেন মাটিতে।

মা চিৎকার করে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। তোর বাবার দু’চোখে জল দে খোকা তিনি মূর্চ্ছা গেছেন। আমি দ্রুত ছুটে গিয়ে পাশের ডোবা থেকে অঞ্জলি ভরে জল এনে ভিজিয়ে দিলাম বাবার চোখ-মুখ। চোখ দু’টো সাদা হয়ে গেছে বাবার। দুঃস্বপ্ন দেখলে মানুষের যে অবস্থা হয় বাবার ভেতরে হয়তো সেরকম সাংঘাতিক কিছু হয়ে যাচ্ছে। বাবা যেন খানিকটা দুঃস্বপ্নের ঘোরেই আমাকে বললেন, এত এত ধ্বংসের ভেতর আমরা কোথায় যাব বাবা ?

আমার চোখ পড়লো একটা আমের বিচির ওপর। বিচিটা ফেটে ভেতর থেকে গ্যাজ বেরুচ্ছে। একদিন গাছটি বড় হবে। শেকড় পাবে মাটি। পাতা পাবে পর্যাপ্ত আলো আর হাওয়া। গাছটি একদিন বড় হবে। মাকড়সাটা আমার নজরেই পড়েনি। বাবা চোখ খুলেই বললেন, দ্যাখ ক্যামন একটা বিষাক্ত মাকড়সা লেপটে আছে আমের বিচিটার ভেতর। পাগুলো খুব ধারালো মুখে বিষ। সাবধান ওদিকে যাবি না…।

 

দুই.

পারমিতাদি রমেশকাকার মেয়ে। আমাদের পশ্চিমে এক চিলতে উঠানের লালটালির ছাদওয়ালা ঘরটিতে ওরা থাকতো। রমেশ কাকা হোমিও ডাক্তার ছিলেন। কোনো সার্টিফিকেট না থাকলেও হাত যশের কারণে গ্রামে বেশ ভালো নাম ডাক ছিল তাঁর। ছেলেবেলা থেকে হাটখোলার রমেশকাকার ডিসপেনসারিতে ছককাটা হোমিও ওষুধের শিশিগুলো ছিল আমাদের খুব প্রিয়। সামান্য কিছু হলেই রমেশ কাকার সামনে গিয়ে হাত পাততাম। বাড়িয়ে বলতাম কত রোগের ফিরিস্তি। তিনি আমার চালাকি ধরতে পেরে ঔষধ ছাড়াই খানিক সুগার পিল হা করিয়ে ঢুকিয়ে দিতেন আমার মুখের ভেতর।

আমি সময় পেলেই যেতাম ওখানে। হাটখোলায় গেলে কাকার দোকানের একপাশে কালো চকচকে টুলটার ওপর বুকের কাছে হাত রেখে ঝুঁকে বসে থাকতাম। রমেশ কাকাকে আমি সে বয়সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম খানিক কৌতুহল নিয়ে। মাখনের মত মিষ্টি মানুষটার জন্য আমার বুকে জমতো শ্রদ্ধা মেশানো শিশির। সে সময়ের কিছু দৃশ্য ঠিক এ রকম স্থায়ী গেঁথেছিল আমার মনে।

রমেশ কাকা কথা বলছেন রোগীদের সাথে।

রমেশ কাকা চশমা কপালে তুলে রোগীর জিব দেখছেন।

রমেশ কাকা আলমারী খুলে সুগারের সাথে সাদা কাগজে ওষুধের ফোঁটা ফেলছেন গুনেগুনে।

রমেশ কাকা অতঃপর সুগারগুলোকে চারকোনা কাগজে ফেলে পুরিয়া বাঁধছেন ঔষধের।

রমেশ কাকা রোগীদের যৎ সামান্য দেয়া টাকা না গুনে পাঞ্জাবির পকেটে ফেলছেন…।

প্রাণভরে দেখতাম রমেশ কাকাকে। হাটবারেই কাকার রোগীসংখ্যা বেশি থাকতো। বাবা আমাকে কাকার দোকানে বসিয়ে বাজার সেরে নিতেন। হাটখোলার বিশাল নারকেল গাছগুলোর পাতায় বিকেলের রোদ মরে আসতো। আমার কেবল মনে হতো পারমিতাদির এ অবস্থার জন্য ডাক্তার কাকাই দায়ি। কি একটা ওষুধের রিসার্চ করতে গিয়ে মুখের এ অবস্থা হয়ে যায় পারমিতাদির। বাবার ভুল ওষুধে সারাজীবনের জন্য অমন সুন্দর মেয়েটির মুখটা নষ্ট হয়ে গেল।

 

এসময় অন্ধকার ঘনিয়ে এলে আমরা পথে নামতাম। অগ্রহায়ণের শেষে চৈত্রের মতো বালির স্তুপ পড়তো আমাদের মেঠো পথে। হাঁটতে গেলেই পায়ে ধুলোর মোজা হয়ে যেত। কড়ে আঙুল থেকে হাঁটু পর্যন্ত সাদা মোজা। বাবাই আমাকে একদিন নিয়ে গিয়েছিলেন রমেশ কাকার বাড়ি। দোরে দাঁড়িয়েই কাকা নাম ধরে ডাকলেন বাবা। কাকিমা ছুটে এলেন দোরে। সাথে পারমিতাদি। কেমন অদ্ভুত বিষণœতা মেয়েটির মুখে।

আমাকে দেখে দিদিটা হেসে দিল যেন, আমার তখন এক ধরনের ভালোলাগা হল মনে। দিদি হাসলে মুখের ভয়ংকর দাগগুলোর কথা আমার মনেই পড়ে না আর। বাবা ছাতাটা দরজার একপাশে রেখে কাকিমার সাথে ভেতর চলে গেলেন। অতঃপর আমি আর পারমিতাদি… পারমিতাদি আর আমি…।

আমরা হেসে কুটিকুটি হলাম। বৃষ্টির মতো কথা বলতে থাকলাম চোখে চোখে। আমরা উঠানের ঘাসে পা ছড়িয়ে বসলাম মুখোমুখি। পারমিতাদির এত শঙ্কা কেন?

আমি তার চাঁপাকলির মতো আঙুলগুলো ছুঁয়েদিলাম। দিদির চোখজোড়া যেন নড়ে উঠলো। আমি আকুল হয়ে জানতে চাইলাম, কিন্তু বলবে দিদি? আমার খুব অসুখ খোকা। তুই রোজ আসবি আমাদের বাড়ি। বাতাসে যেন একটু একটু শীতের আঁচড় লাগছে গায়ে। তবুও বুকের ভেতর এক অনন্ত তেষ্টা জেগে উঠলো যেন। বল দিদি তোমার কি অসুখ…?

পারমিতাদির দু’চোখে গভীর কালসিটে, দৃষ্টি মাদকতাময় চোখে চোখে সেদিন কত কথা হয় পারমিতাদির সাথে। সন্ধ্যায় অন্ধকারে দিদি হাত ধরে আমাকে উঠিয়ে নেয় ঘরে।

কাকিমা বাতি জ্বালিয়েছেন। বাবা বসে আছেন বেতের চেয়ারে।

 

তিন.

ভিটেয় ফিরে খড়কুটো দিয়ে পাখির মতো বুনলাম ঘর। কবে ভেঙে যায় আবার সে শঙ্কাও কাটেনি মন থেকে। বাড়িতে আমি আর মা। বাবা পুরনো ব্যবসা চালু করার জন্য টাকা আনতে গেছেন মামার বাড়ি । গ্রামে ইতোমধ্যে অনেকেই ফিরে ঘর বাঁধছেন নতুন করে। চারদিকে আবার জেগে উঠছে মানুষের হাঁক ডাক।

পারমিতাদিরা আসে না, কোথায় আছে কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবিরা পারমিতাদিকে নিয়ে গেছে ধরে। ডাক্তার কাকাকে মেরে ফেলেছে।

এসব আমার বিশ্বাস হয় না। রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে মিলিটারি কনভয়গুলো।

পারমিতাদি তুমি কোথায়? আমি এদেশের সবকটি টর্চার ক্যাম্পে খোঁজ নেব তোমার। মাথা নিচু করতেই এক বোবা যন্ত্রণায় ছিটকে পড়ে গেলাম উল্টে মাটিতে। আর তখন থেকেই একটা দৃশ্যে আমার দু’চোখ স্থির হয়ে আছে। অবিকল আগের সে মাকড়সাটির মতো জ্বলজ্বলে চোখে আমার গা বেয়ে উঠে আসছে যেন আরেকটি মাকড়সা। কিছুটা বিধ্বস্ত ভাঙাচোরা শরীর নিয়ে মাকড়সাটা যেন ক্রমেই এগিয়ে আসছে আমার বুকের দিকে। এক ভয় মেশানো অনুভূতি আমাকে গ্রাস করলো যেন। হঠাৎ মাকড়সাটির ভয়ংকর চেহারায় এক অদ্ভুত পরিবর্তন এলো। আমার ভয় করতে লাগলো মাকড়সাটি যেন আমার যন্ত্রণাদগ্ধ পারমিতাদি হয়ে গেল। আমি দু’হাতে বিষাক্ত মাকড়সাটিকে খামচে ধরলাম। মাকড়সাটির কোন বিষ নেই! মুখের লালাগুলোতে মিষ্টি এক সুন্দর সুগন্ধ…।

 

দেবাশীষ ভট্টাচার্য, কথাসাহিত্যিক

 

ভাষার যতো মান অপমান

অজয় দাশগুপ্ত : বাংলাদেশ আমাদের দেশ। আমাদের মাতৃভাষার নাম বাংলা ভাষা। আপনি আশ্চর্য হবেন জেনে প্রবাসের বাঙালিরা প্রাণপণ চেষ্টা করে তাদের সন্তানদের বাংলা শেখায়। এ

চাঁদপুর চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির কবিতা উৎসবে ১০ গুণী ব্যক্তির পুরস্কার লাভ

আন্দরকিল্লা ডেক্স : নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হলো চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির কবিতা উৎসব-২০২৫। গত ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় চাঁদপুর শহরের ইউরেশিয়া চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সবুজ

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্কুলের শতবর্ষ উদযাপন

আন্দরকিল্লা ডেক্স : শতবর্ষ পূর্ণ হওয়া চট্টগ্রামের হাতেগোনা কয়েকটি স্কুলের মধ্যে বাংলাদেশ রেলওয়ে সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, পাহাড়তলী অন্যতম একটি। ১৯২৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই স্কুল ২০২৪

কেনো ইহুদিরা জাতি হিসেবে এত বুদ্ধিমান?

মূল লেখক: ডঃ স্টিফেন কার লিওন অনুবাদক— আসিফ ইকবাল তারেক   ইসরাইলের কয়েকটি হাসপাতালে তিন বছর মধ্যবর্তীকালীন কাজ করার কারণেই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করার চিন্তা

আগমনী এবং দুর্দান্ত দুপুর

দীপক বড়ুয়া ঋষিতার মুখে খই ফুটে। কালো মেঘে ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ার সময়। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পরে। আনন্দে বৃষ্টি ফোটা ছুঁয়ে হাসে। মাঝেমধ্যে