গৌতম বিশ্বাস : বিয়ের মাস ছয়েক না পেরোতে স্বামী নটবর মারা যেতেই শ্বশুর নিতাই ম-ল পুষ্পকে বলেছিল,” আর কার জন্যি ইখানে পড়্যে থাকপা। তার চেইয়ে বাপ-ভাইর সোংসারে ফিইরে যাও। নতুন কইরে জেবন শুরু করো।”
শুনে একরাশ কান্না বুকের ভেতর ছলকে উঠেছিল পুষ্পর। চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল সেই চেনা মুখ আর অতীতের দিনযাপনের ছবি। আর তাই সে বলেছিল,” না বাবা,আমি তুমাগের সাথেই থাকপো।”
চোখেমুখে বিকৃতির ছাপ ফুটিয়ে নিতাই ম-ল বলেছিল,” আমার ছেল্যেই যহন নাই তহন তুমারে দে আমি কী করবো? তুমার পথ বাপু তুমিই দ্যাহো।”
না, আর সেই সংসারে পড়ে থাকেনি পুষ্প। পরদিন যাকে বলে এক কাপড়েই ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।পুষ্পর মুখে সব শুনে বাপ নগেন বেরা বলেছিল,” অমন মানষের কাছে থেক্যে খালি কষ্টই পাতি। চল্যে এস্যে বেশ করিছিস। মেইয়ের যহন জম্ম দিতি পারছি তহন দুইবেলা দুই মুঠ খাতিও দিতি পারবো।”
পুষ্পর তহন চোখ ভরা জল। বুক ভরা কষ্ট। বাপের কথায় কষ্টটা যেন আচমকাই কমে গিয়েছিল খানিক। একবার আকাশের দিকে তাকিয়েছিল। একবার বাপের দিকে। তারপর নিজের ঘরখানির দিকে তাকিয়ে বলেছিল,” আমার কপালডাই খারাপ। না হলি এই বয়াসে কেউ বেধবা হয়?”
নগেন বেরা বুকের মধ্যে আটকে থাকা দীর্ঘশ্বাসটা বাইরে ছাড়তে ছাড়তে বলেছিল,” আসলে দোষখান আমারই রে মা। ঘটকের কথায় যদি না লোভে পইড়ে অমন জাগায় তোর বে দিতাম – ”
বাপের কথা মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে পুষ্প বলেছিল,” থাক বাবা,ওই কথা আর ভাবার দরকার নাই। যা হবার তা হইছে। অহন ইডাই আমার ঘর। ইডাই আমার সোংসার।”
তখন কতই বা আর বয়স পুষ্পর। আঠারো পেরিয়ে উনিশে পা দিয়েছে। শরীরে ভরা যৌবন। চলায় শ্রাবণের নদীর চঞ্চলতা। বাপ নগেন বেরা অনেক চেষ্টা চরিত্তির করেছিল মেয়েটার ফের একবার বিয়ে দিতে। ভেঙে যাওয়া স্বপ্ন গুলোকে জোড়া লাগিয়ে ফের একবার স্বামীর ঘরে পাঠাতে। কিন্তু রাজি হয়নি পুষ্প। বলেছে,” আমি হলাম গে ঘরপোড়া গোপ্র। সিন্দুরে ম্যাঘেও ভয় পাই। না বাবা, ওই চিন্তে আর কইরো না। এই আমি বেশ আছি।”
হ্যাঁ, ভালোই ছিল পুষ্প। হোক বাপ-ভাইয়ের সংসার। তবু নিজেরই তো বাড়ি। এই বাড়িতেই সে জন্মেছে। বড়ো হয়েছে। মা,বাবা,ভাই – সবই তো নিজের জন। ভাই নাদু তখন নিতান্তই ছোট। সবে বাপের সাথে খেত খামারে যাওয়া শুরু করেছে। নিজেদের ফালি জায়গাটুকুতেই কেবল যাতায়াত তার। সেই ভাই ও বলেছিল,” না রে দি, তোর বে’ কইরে কাম নাই। তুই এখেনেই থাক। আমরা সবাই মিল্যে আবারও একসাথে থাকপো।”
ভাইয়ের এমন আদুরে কথায় চোখে জল এসে গিয়েছিল পুষ্পর। মনে হয়েছিল এত ভালোবাসা সে রাখে কোথায়।
না, বসে খায়নি পুষ্প। সে ছাগল পুষেছে। হাঁস-মুরগি পুষেছে। ঘুঁটে বানিয়ে বেচেছে। মাঠঘাট থেকে শাকপাতা কুড়িয়ে এনেছে। আবার পাড়ার বৌ-ঝি দের সাথে খালে নেমে ছাঁকনি জাল দিয়ে ধরে এনেছে চ্যালা, পুঁটি, খলসের মত ছোট ছোট মাছ। এই করতে করতে কবে যে জীবনের বেলা ফুরিয়ে এসেছে টেরও পায়নি পুষ্প। সে আর এখন সেই উনিশের যুবতী নেই। বয়স এখন তার আশির কোটায়। সারা মাথায় সাদা ফেঁসোর মত চুল। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়া শরীর আজ নিজের ভার বইতেও যেন অক্ষম। মুখের চামড়ায় সহ¯্র বলিরেখার ভাঁজ। পচা ডিমের কুসুমের মত ঘোলা চোখের দৃষ্টিটাও বড়ো বেশিই ধুসর। আজ বাপ নেই। মা ও মরেছে সেই কবে। পুষ্প বুড়ি তবু এই সংসারেই পড়ে আছে। সংসারটা অবশ্য আর তার নেই। ভাই নাদু বিয়ে করেছে। ঘরে বৌ এসেছে। বৌয়ের পেটে আবার হয়েছে দু’দুটো ছেলে। তাদেরই এখন জোয়ান বয়স। আজ বাদে কাল বিয়ে করে তারাও বৌ আনবে সংসারে। সংসারের পেট যত বাড়বে খরচও তত বাড়বে। আর এই চিন্তাতেই যেন ঘুম আসে না নাদুর বৌ কালীতারার। সে সারাক্ষণই বুড়ির মৃত্যু কামনা করে। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয় তার মুখ চলা। ঘরের দাওয়ায় বসে বুড়ি কেবল শুনেই যায়। শুনতে শুনতে আকাশ দ্যাখে। উড়ে যাওয়া পাখি দ্যাখে। ভেসে থাকা মেঘ দ্যাখে। ছড়িয়ে থাকা রোদ দ্যাখে। ভাবখানা এমন – কালীতারার কথা যেন শুনতেই পাচ্ছে না।আর সে যত এমন করে থাকে ততই আরও রেগে যায় কালীতারা। গলাটা আরও খানিক চড়িয়ে বলে,” এ্যাত্তো মানষের মরণ হয় আর এ মাগীর হয় না কো। হায় ভগমান,আমার ওপর এ কার বোঝা চাপাল্যে গো ”
ভাই বৌয়ের মুখে নিজের মৃত্যু কামনা শুনে কষ্ট হয় বুড়ির। বুকের ভেতর কিসের একটা ঢেউ ওঠে। নীরব কান্নারা গুমরে মরে ভেতরে ভেতরে। আড়চোখে একবার কালীতারার দিকে তাকায় বুড়ি। কালীতারার নজর এড়ায় না তা। সে বুড়ির দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,” দ্যাহো ক্যামনে শকুনির মতন চাইয়ে আছে। আমি কী ভাগাড়ের মড়া নেকি রে বুড়ি?” এমন কথা শোনার পর আর তাকিয়ে থাকতে পারে না বুড়ি। পারে না বসে থাকতেও। একটা গরম ভাপ যেন উঠে আসতে থাকে মেঝের মাটি ফুঁড়ে। মনে হয় জ্বলন্ত উনুনের ওপর যেন ‘পাছা’ দিয়ে বসে আছে। না,আর বসে থাকে না সে। শরীরটাকে যতটা সম্ভব সোজা করে উঠে পড়ে। পাশে রাখা জাম কাঠের লাঠি টা হাতে নিয়ে ঠুক ঠুক করতে করতে উঠোন পেরিয়ে উঠে আসে রাস্তায়। তারপর হাঁটতে হাঁটতে সোজা লখিন্দরের বাড়িতে। লখিন্দরের মা খাদু বুড়ি বলতে গেলে একমাত্র তার আপনজন। না,রক্তের সম্পর্ক তাদের নেই। যা আছে তা হল মনের সম্পর্ক। সেই কবে থেকে এই সম্পর্ক তাদের। সময় অসময়ে মন খারাপ করলে পুষ্প বুড়ি ছুটে যায় খাদুবুড়ির কাছে। লখীন্দরের বাড়ির পাশে ছোট্ট একফালি পতিত জমি। জমির ওপর একটা নিমগাছ। গাছের নিচে বসে দুই বুড়ি ফিরে ফিরে তাদের অতীত দ্যাখে। অতীতের কথা কত যে এসে ভীড় করে দু’ঠোঁটের ফাঁকে। কতগুলো বলা হয়। আবার হয়ও না কতগুলো। তবু এক সময় মনটা ভালো হয়ে যায় দু’জনেরই।
খাদু বুড়ি বলে, “বয়াস তো কম হল না। কিন্তুক কিসির জন্যি যে অহনও পড়্যে আছি বুঝি নে। এই সোংসারের উপর থ্যিকে মায়া ডা আজও যে ক্যান ছাড়তি পাটলাম না।”
পুষ্প বুড়ি মাথা নেড়ে সায় দেয় খাদু বুড়ির কথায়।বলে,” ঠিকই কইছো তুমি লখিনীর মা সবই হল মায়া।এই মায়ার টানেই পড়্যে আছি। এই যে দ্যাহো নাদুর বৌ এত যে আমার মরণ কামনা করে, তবুও মরি নে। ক্যান মরি নে জানো? সবই ওই মায়ার জন্যি। ওই মায়ার জন্যিই কুথাও চল্যে যাতিও পারি নে।”
খাদু বুড়ি বলে,” কী যে বৌ ঘরে আনলো নাদু।তুমার বাড়ি তুমার ঘর,তুমিই অহন তাগের পর।না গো,তুমার কথা যত ভাবি ততই দুঃখ্য হয়। কী যে কপাল তুমার।”
এ সময় একদলা কষ্ট ঠেলে ওঠে পুষ্প বুড়ির বুকের ভেতর।ব্ুিড় আকাশের দিকে তাকায়। সেই আকাশে তখন দিনের আলো ফুরিয়ে হয় তো সন্ধে নামছে। আকাশের গা থেকে খসে পড়ছে ধূসর একটা অস্পষ্টতা। চাপ চাপ আঁধার জমতে শুরু করেছে ঝোপঝাড়ে, গাছের মাথায়।বাসায় ফেরা পাখির ডানায় জড়িয়ে ধরেছে ক্লান্তি। পুষ্প বুড়ি উঠে পড়ে,” যাই গো ভাই,না হলি ওরা চিন্তে করবে।”
এক নাদু ছাড়া কেউই যে তার না ফেরায় চিন্তা করবে না তা বুড়ি বেশ জানে। তবু কথাটা বলতে পেরে বেশ ভালো লাগে তার। কোথায় যেন একটা সুখ অনুভব করে সে।
আজকের ব্যাপারটা অবশ্য তেমন হয় নি।
তখন বিকেল। আকাশের গা থেকে একটু একটু করে খসে পড়ছে রোদের পরত। চারপাশে কমে আসা ঝলমলে ভাবটার গায়ে জড়িয়ে আসছে ধূসর একটা অস্পষ্টতা। সূর্যটা নামতে নামতে এসে দাঁড়িয়েছে দিগন্তের কাছাকাছি। পুষ্প বুড়ি বসেছিল দাওয়ায়। যেমনি করে থাকে নিত্যদিন।কীসে যে কী হয়েছিল তা সে জানে না। অনেকটা অবাকই হয়েছিল তাই কালীতারাকে মুখ চালাতে দেখে। যা নয় তাই বলে গাল পাড়ছিল কালীতারা। সবটাই বুড়িকে উদ্দেশ্য করে। আজ যেন মুখটা একটু বেশিই চলছিল তার। অন্যদিন চুপচাপই থাকে বুড়ি। কিন্তু আজ কী যেন একটা হয়েছিল তার। নিত্যদিন একটু একটু করে অভিমান জমতে জমতে কথা বলতে আজ যেন বাধ্যই করেছিল বুড়ি কে। বুড়ি গলা তুলে বলেছিল,” দ্যাহো বৌ,নিত্যিদিন আমারে এ্যাতো গঞ্জনা দেবা না কইয়ে দিলাম। এই বাড়ি খালি তুমার না। আমারও। আমার বাড়িতি – “কথা আর শেষ করতে পারে নি বুড়ি। তার আগেই খেঁকিয়ে উঠেছিল কালীতারা,” ও মা, মা – মগীর দেহি ত্যাওড় কমে না। আজ বাদে কাল চোখ বুজলি মুহে আগুন দেবে কেডা সেই হিসেব নাই, আর মাগী কিনা – ”
শুরুটা হয়েছিল এ সব দিয়েই। তারপরে যত যা মুখে এসেছে বলেছে কালীতারা। বসে থাকতে না পেরে এক সময় উঠে পড়েছে বুড়ি। তারপর পাশে রাখা লাঠি টা হাতে নিয়ে ঠুক ঠুক করতে করতে বেরিয়ে পড়েছে।
না,আজ আর লখীন্দরের বাড়িমুখো হয় নি সে। বরং উল্টোদিকে হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়েছে এই খালপাড়টায়। জনবসতি থেকে বেশ খানিকটা সরে এসে এই খাল। পাড় দিয়ে গোটা কতক কাঁটা বাবলার গাছ। তার নিচে ছড়িয়ে থাকা কিছু বুনো ঝোপ। তেমনই একটা ঝোপের গায়ে পিঠ ঠেকিয়ে খালের দিকে মুখ করে বসে আছে বুড়ি। দিন ফুরিয়ে সন্ধে নেমেছে। সন্ধে উতরে রাত। সেই রাতটাও এখন অনেকটা বেশির দিকে। চারপাশ ঘিরে নিয়েছে হিংগ্র এক নির্জনতা। খানিক আগেও পাড়ার দিকটায় জেগে থাকা মানুষের সাড়া ছিল। এখন তা থেমে গিয়ে বড়ো বেশি চুপচাপ। একটা নৈঃশব্দ্য এসে ঘিরে ধরেছে বুড়ি কে। আর সেই নৈঃশব্দের সুযোগ নিয়ে বুড়ির চোখে ভেসে উঠছে অতীত।নাদুর ছোটবেলা। তাকে হাতে ধরে হাঁটতে শেখানোর দৃশ্য। ছোট মুখে আধো আধো কথা। নাদুর কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতর কোথায় যেন একটা টান অনুভব করলো বুড়ি। এতক্ষণ ভেতরে ভেতরে অভিমানের যে পাহাড় গড়ে উঠেছিল আচমকাই তা গলে জল হয়ে গেল।আর তা হতেই গায়ে ঝাঁকা দিয়ে উঠে পড়লো বুড়ি। ঠিক তখনই দূরে পাড়ার মাথায় নাদুর গলা শুনতে পেল। গলা ছেড়ে নাদু ডাকছে,” দি? ওই দি,কই গেলি তুই?”
সেই ছোটবেলায় একটু চোখের আড়াল হলেই এমনি করে কত ডাকতো ভাই টা। মনে পড়তেই একরাশ ভালোলাগা বুকের ভেতরটাকে উদ্বেল করে দিল বুড়ির। সব রাগ, অভিমান নিঃশেষ হয়ে গেল মুহূর্তে। সারা বিকেল নিজেকে এই জগৎ সংসারে একদম একা মনে হলেও এই মুহূর্তে মনে হল – না, একা নয়, আরও কেউ একজনা তার আছে।
ভোরের আলোর মত একটা খুশি ভেতরটাকে ছুঁয়ে দিয়ে যেতেই বাড়িমুখো ছুটতে লাগলো বুড়ি।
তখনও গলা ছেড়ে ডাকছে নাদু,” দি? ওই দি – ”
গৌতম বিশ্বাস, গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক