রূপক বরন বড়ুয়া
এইতো সেদিন ‘আন্দরকিল্লা’ পত্রিকার সম্পাদক ও আবির প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী কবি ‘মুহম্মদ নুরুল আবসার’ ভাই আমাকে বললেন কবি মিনার মনসুরে’র অতি সাম্প্রতিক প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিলো মনোরম’ বইটি আলোচনা করার জন্য। মিনার মনসুর আমার ভালো লাগা কবিদের একজন। বইটা আলোচনা করতে হবে ভেবে কেমন যেন উশখুশ করছে মনে। মিনার মনসুর একজন বহুমাত্রিক কবি। তার চিন্তা চেতনায় রয়েছে সুদূরপ্রসারী ভাবনা, সৃজনশীলতায় রয়েছে আবেগী আবেদন। চট্টগ্রামের বাতিঘর থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন লাইব্রেরিতে আতিপাতি করে খুঁজলাম বইটা। বইটা কোথাও পেলাম না। তারপর হঠাৎ মনে পড়লো কবি রুহু রুহেল তো কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়েছিলেন মিনার মনসুরকে ঘিরে যে অনুষ্ঠান হয়েছে তাতে কবিতা আবৃত্তি করতে। ভাবলাম হয়তো রুহু রুহেলের কাছ থেকে বইটা পেতে পারি। যেই ভাবা সেই কাজ কবি রুহু রুহেল’কে ফোন করে জানতে চাইলাম কাব্যগ্রন্থটা আছে কিনা। জানতে পারলাম বইটা আছে আর রুহু রুহেল নিজেই এক শনিবারে তা আবির প্রকাশনে রেখে গেলেন। বইটা পেয়েই খুব ভালো করে পড়লাম ৪৫ টা কবিতা। নতুন মাত্রিকে আর নতুন আঙ্গিকে সাজানো প্রতিটা কবিতায় রয়েছে দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধু আর শেখ হাসিনা’কে ঘিরে অনন্য অনুভূতি, দ্রোহের বৈভবী চমক। তাই কাব্যগ্রন্থটি ব্যবচ্ছেদের আগে মেধাবী কবি ‘মিনার মনসুর’ সম্পর্কে কিছু কথা না বললেই নয়। মিনার মনসুর কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। বর্তমানে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। মিনার মনসুর সম্পাদক, প্রকাশক ও সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন পঁচাত্তর-পরবর্তীকালে। ১৯৭৫-৮৫ সালে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে বৈরী শক্তির বিরুদ্ধে অবিরাম লড়াই করে যাওয়া মিনার মনসুর একজন সাহসী শব্দসৈনিক। বিপুল জনপ্রিয়তার গুণে তিনি চাকসুর বার্ষিকী সম্পাদক নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের প্রতিবাদে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত প্রথম সংকলন-গ্রন্থ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ (১৯৭৯; বাংলা একাডেমি, ২০২০)। সে-সময় ‘এপিটাফ’ সম্পাদক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে তাঁর স্পর্ধিত তারুণ্য। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ (১৯৮৩) সামরিক সরকারের গাত্রদাহের কারণে নিষিদ্ধ হয়। তিনি জাতীয় কবিতা পরিষদ ও বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্য এবং বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটির জীবন সদস্য। মিনার মনসুর আদ্যোপান্ত মুজিবীয় আদর্শে অনুপ্রাণিত একজন সাহসী শব্দশিকারী, এক দ্রোহী কবি।তার ৪৫ টি কবিতা সৃজিত হয়েছে অসাধারণ কারুতে তথা সমাজ, স্বদেশ ও রাজনীতিমনস্কতা রূপায়িত এবং আরোপিত হয়েছে বহুমাত্রিকতায়। তার প্রজ্ঞা ও মেধায় রয়েছে প্রথাকে আকড়ে ধরে প্রথাকে ভাঙ্গার এক অদম্য স্পৃহা। বর্তমানকে ঢেলে সাজানো এবং সুন্দরের আবরণে সজ্জিত করতে শব্দ ও আবেগকে শব্দশৈল্পিকতায় যেমন মুখর হয়েছেন ঠিক তেমনি ছন্দে ছন্দে কবিতার দেহকে করেছেন নদী। ফল্গুধারার মতো বয়ে গেছে শব্দের ঝংকার কবির সমস্ত আবেগ ও তার মর্মবেদনা।
‘ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম’ এ শিরোনাম ও অনেক অর্থবহ এখান থেকে বিচ্ছুরিত হয় বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের এবং তার পরবর্তী সময়ের নির্মম ঘটনাসমূহের ইতিহাস। তাই খুব সহজেই ইতিহাস সচেতন পাঠক এ কাব্যগ্রন্থের কবিতার শরীর থেকে শোকাবহ মর্মান্তিক মূল উপাদানের সত্যতা খুঁজে পাবেন। ১৯৭৫ সালে পরিবার- পরিজনসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা- এবং সে সময়ে ব্রাসেলসে বাংলাদেশি দূতাবাসে জাতির পিতার বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা যে অমানবিক এবং সাধারণ শিষ্টাচার বহির্ভূত নিষ্ঠুর বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছিলেন বইটির শিরোনাম সে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তবে কাব্যগ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত ৪৫টি কবিতা সর্বতোভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যাকা- ও তৎপরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে আবর্তিত হয়েছে তা কিন্তু নয়। বরং এখানে নানাভাবে প্রতিফলিত হয়েছে জীবনের বহুমাত্রিক রূপ।দেশ কাল সময়ের অন্তঃস্থিত দ্রোহ, ক্রন্দন, স্পৃহা কল্পনায় ইন্দ্রজাল, বিমূর্ততায় কবিতাগুলো অসম্ভব সুন্দর ও ব্যতিক্রমী ধারায় ডানা মেলেছে। কাব্যগ্রন্থে কবিতার কাঠামো তৈরি হয়েছে ব্যতিক্রমী চিন্তা চেতনায়। অধিকাংশ আধুনিক গদ্য কবিতার সমন্বয়ে কাব্যগ্রন্থের বিষয়বস্তু অর্থাৎ কবির মনোকথা ব্যক্ত হলেও প্রতিটা কবিতা ছন্দকে আঁকড়ে ধরে সবল বাহু বিস্তার করেছে কেবল উপস্থাপনে এনেছেন নতুনত্বের ধারা ও তার বিকাশ।
২.
কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘ বৃথাই তুমি রোদন করছো, কবি’। কবিতার চুম্বকাংশে দেখা যায় যার জন্য কান্নায় ভারী বুক সেই দেখা যাচ্ছে গোগ্রাসে গিলছে একটা জাতির ভবিষ্যৎ। এখানে কবিকে আশাহত হতে দেখা যায়। আমাদের চিন্তা চেতনায় অশনির যে ছায়া তা পরিযায়ী পাখির মতো উড়ে আসে আর আবহে তার বিস্তারণের জাতির ভবিষ্য ক্ষরণ,অবাঞ্চিত অন্ধকারের নিকষ আগ্রাসন। কবির শঙ্কা এখানেই;
‘তুমি যার জন্য বুকে করাঘাত করছো, সে এখন টেবিলের ওপর লোমশ পা তুলে বিদঘুটে ঢেকুর তুলছে আমাদের আদর্শ বিদ্যানিকেতনে। অনাবৃত নিম্নাঙ্গে তার আমাজনের আদিম অন্ধকার। আর তার ক্রমপ্রসারমান পুরুষাঙ্গের ফলায় বিদ্ধ হচ্ছে ব-দ্বীপের সোনালি ভবিষ্যৎ!”
কবিতাটা প্রতীকী কবিতা। শব্দ ব্যঞ্জনা আর তার মাধুকরী প্রয়োগে প্রকাশিত হয়েছে দ্রোহ আর বলার ধরণে প্রকটিত কবির অতৃপ্ততার আফসোস আর সাহসী চিত্তের আর্তচিৎকার। কবি লড়াকু,কলমের ধার শাণিত তাই দীপ্ত কন্ঠে উচ্চারিত হয়েছে দেশপ্রেমের গান, গভীর সঙ্কট দেখতে পেয়ে শব্দবানে জাতিকে জাগরিত করতে তিনি মরিয়া। কবিকে তার কবিতা ‘
কাভার্ডভ্যানটি এখন তার দিকেই ধেয়ে আসছে ‘ কবিতায় দারুণ এক উদ্বেগের ছবি আঁকতে দেখা যায়। কবিতাটা উপমায় মোড়ানো এক অনন্য সৃজন। ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া এক তরুণীর যন্ত্র – দানবের তলায় পিষ্ট হতে দেখলেন এই মরণফাঁদ এক শ্রেণির নীতিভ্রষ্ট নেতাদের অনৈতিক চিন্তা চেতনার ফসল যারা লাল সবুজের দেশটাকে পিষে ধ্বংস করার তালে রয়েছে। তাই তিনি বলে উঠলেন ;
“তুমি ভাবছো,তার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া মেয়ের কথা ভেবেই কবির এই অরণ্য রোদন! সবুজ শাড়ি কপালে লাল টিপ পরিহিতা যে – নারী খররৌদ্রে বটমূলে তাঁর আশ্চর্য আঁচলখানি বিছিয়ে তোমাকে আগলে রেখেছে সব বালামুসিবত থেকে, তিনিএখন পাথারে মাথা ঠুকছেন। কেননা কাভার্ডভ্যানটি এখন তাঁর দিকেই ধেয়ে যাচ্ছে। ”
দেশপ্রেমের এক অনুপ চিত্র কবিতার করিডোরে শব্দে শব্দে তা প্রতিধ্বনিত হয়েছে অপূর্ব একবার্তার মাধ্যমে। কবির অন্তঃসত্ত্বা জুড়ে রয়েছে দেশমাতৃকার প্রতি গভীর টান। তাই কবি দেশের সঙ্কটময় মূহুর্তের আগাম চিত্র হৃদয়ে ধারণ করে নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন শব্দদ্রোহে। এরপর কবিকে দেখি দেশের অভ্যন্তরে অপশক্তির কারণে যে জটিল আগ্রাসন আর আগ্রাসনের স্রোতে তলিয়ে যেতে দেখে ত্রাতার সন্ধান করতে গিয়ে দেখলেন সবজায়গায় রিক্ততা জাতি যখন খাবি খেতে খেতে অতলে ডুবতে বসেছে, পরাধীনতার জালে আবদ্ধ হচ্ছে আপন স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে ব্যস্ত তখনই দেখলেন বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ সন্তান তার তর্জনী উঁচু করে জাতিকে দেখালেন দিশা তিনি হলেন একমাত্র ত্রাতা যার তর্জনী হেলনে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল, তেরোশত নদনদী আর সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্ষায় গর্জে উঠেছিলো। কবি তা হৃদয়ে ধারণ করে বলে উঠলেন;
“পাথরটি এবার তার তীক্ষè ধারালো চঞ্চু বাড়িয়ে দেয় ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে বিস্তৃত ব-দ্বীপের শ্যামল কোমল মানচিত্রের দিকে। সাড়ে সাত কোটি ভূমিপুত্র আর তেরোশত নদী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে যখন আর্তনাদ করছে, ক্লান্ত-ক্ষুব্ধ-বাকরুদ্ধ নবরতœসভা তখন ফিনফিনে পাঞ্জাবির আস্তিন গুটিয়ে ধেয়ে যাচ্ছে পরস্পরের দিকে। একটি তর্জনী-কেবল একটি তর্জনী তখন গর্জন করে উঠেছিল। আর তাতেই বদলে গিয়েছিল আমাদের হাজার বছরের দাসত্বের ইতিহাস। ”
তিনিই সেই উদ্ধারকর্তা, হাজার বছরের বাঙালি দেশনেতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর প্রতি কবির গভীর ভালোবাসা এখানে উৎসারিত হয়েছে। তারপরও দেখলেন স্বাধীন এদেশে যুদ্ধ শেষ হয়েও যেন শেষ হয়নি অনৈতিকতা,অনিয়ম, নাশকতা দেহাভ্যন্তরে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে যুঝতে যুঝতে দেশের জন্য প্রাণপাত করতে করতে নিজেকে উজাড় করেও নিঃশেষ করেও দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় আত্মাহুতি দিয়েও বারবার ফিরে আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত হয়েছে। এখানে দেশপ্রেমের সাথে সাথে পুনঃজন্মের মতো একদর্শনকে উন্মোচিত হতে দেখা যায়। তাই তিনি পৃৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন এদেশে মাতৃভূমিতে ফেরার অঙ্গীকার ব্যক্ত হয়েছে;
“আমরা আবার ফিরে আসবো। উরাল পর্বতমালা পার হয়ে চীনের প্রাচীর টপকে সিল্করুট হয়ে ঠিক ফিরে আসবো আমরা। উহান থেকে ইস্পাহান থেকে মিলান থেকে ম্যানহাটন থেকে আমরা আসবো ”
পৃথিবী ব্যাপী করোনা মহামারীর দিনে সবই যখন করোনার দাপটে পৃথিবী থেকে একে একে উৎপাটিত হচ্ছে তখন সূর্য গোলকটাই কেবল বেঁচে যাচ্ছে। কবি তা হৃদয়ের গভীর থেকে উপলব্ধি করলেন বিশাল এক শূন্যতা কেবল ফাঁকি দিয়ে যাচ্ছে। প্রকৃতির এহেন বিষম কা-ে কবি দারুণভাবে ক্রোধান্বিত তাই দ্রোহকন্ঠে বললেন ;
“তোমার যেখানে ইচ্ছে চলে যাও, গাধা,চুমু খাও প্রকৃতির পোঁদে-কে দেয় তোমাকে বাধা!এখানে আমিই রাজা – আমি একাই গিলবো সব করোনা মানুষ খাবে-আমি খাবো করোনার শব!”
তারপর কত শব্দ জড় হলো হুড়মুড় করে দখল করে নিতে চাইলো এক মহাবিপর্যয় আর মহাসমরের পর অবশিষ্ট জন, নদনদী, হাওর-বাঁওর আর বঙ্গোপসাগর, রূপসী বাংলা ছুটে আসে বুকে নিয়ে সমন্বয়ের বিশাল স্বাক্ষর।গাঢ় সবুজের বুকে জ্বলন্ত আগুনের টিপ। মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের কানে কানে নিসর্গের কোণায় কাণায় ঢেলে দেয় কে যেন মধুর বাঁশরীর সুর। উজ্জীবনের মন্ত্র মুগ্ধ সুরে কে যেন বলে ওঠে জাগো সব জাগো। এখানে কবি তার শব্দবাক্য শাণিত করলেন;
“খাঁ খাঁ ক্যানভাস জুড়ে বইতে থাকে মৃত্যুঞ্জয়ী মানুষের ঢল। যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে ছুটে আসে ব- দ্বীপের যত নদ-নদী,হাওর- বাঁওর খালবিল জলাশয়। তারও পিছে পড়িমরি বঙ্গোপসাগর। ধানসিঁড়ি নদীটির তীরে মাতাল হাওয়ায় উড়তে থাকে প্রগাঢ় দীর্ঘশ্বাসময় অনিঃশেষ এক ধূসর পা-ুলিপি। সূর্য তার কপালে পরিয়ে দেয় আগুনের টিপ। বেজে ওঠে এক অলৌকিক বাঁশি। ”
এই বংশীবাদক বা বাঁশীর মালিক আর কেউ নয় বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই কিংবদন্তি নেতার যে দেশপ্রেম তার প্রতি রয়েছে কবির গভীর আনুগত্যবোধ। কবির সর্বান্তকরণ জুড়ে রয়েছে এই মহান নেতার ছায়া। তিনি তার “তুমিইতো বয়ে যাও, পিতা’ কবিতায় বলে ওঠলেন ” সতত হে কবি তুমি বয়ে যাও, তুমিই তো বয়ে যাও, পিতা দুঃখিনী বাংলার দগ্ধ শিরায় শিরায়।”
এরপর কত ঝড় বয়ে গেলো কত সুনামী আঁছড়ে পড়লো ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল লাল সবুজের দেশে। দেশি বিদেশি ষড়যন্ত্রের শিকার হলো বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। হত্যা করা হলো তাঁকে সপরিবারে নির্মমভাবে। বেঁচে গেলো শুধুমাত্র দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা, তারা তখন ছিলো ফ্রান্সে। জাতির পিতার মৃত্যুর পর সম্পূর্ণ এতিম সর্বস্ব হারিয়ে ব্রাসেলসের রাষ্ট্রদূতের কার্যালয়ে এলে যে দুরবস্থার শিকার হয়েছিলেন তারা তার একটা প্রতীকী অথচ চরম সত্যের একটা শব্দচিত্র আঁকলেন ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিলো মনোরম’ নাম দিয়ে। এই কবিতাকে ঘিরেই কাব্যগ্রন্থের নামকরণ। ব্রাসেলসের সেই সন্ধ্যাটি ছিলো মনোরম কেন কবি এ ক্ষণটাকে মনোরমব ললেন তা নিয়ে বিভিন্ন রকম মতামত রয়েছে কেননা ওই সন্ধ্যাটি শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুই বোনের কারো জন্য সুখকর ছিলো না। কবি তবু কেন ওই সন্ধ্যাকে মনোরম বললেন। কবিতার মর্মকথা নিয়ে বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ যে অনাদর, অবহেলা,তুচ্চ তাচ্ছিল্যেভরা আচরণ, যে নিষ্ঠুরতা তারা অবলোকন করেছিলো তা কাটিয়ে তারা পিতার হত্যার প্রতিশোধ নিতে পেরেছিলো, পিতার সুনাম রক্ষা করে দেশকে প্রগতির দিকে নিয়ে যাবার সক্ষমতা তৈরি করে দেশোন্নয়নে ঝাঁপিয়ে পড়ার শক্তি পেয়েছিলো সেই সন্ধ্যাকে মনে রেখেই। কবি সেই সন্ধ্যাকে অনেকটা বিদ্রƒপার্থে মনোরম বললেও সেই সন্ধ্যা একদিন অংকুরোদগম করেছিলো আজকের এক পরিপক্ক নেতৃত্বের। তাই কবি খুব সহজেই দ্বৈত অর্থকে ধারণ করে সন্ধ্যাটিকে মনোরম বলেছেন ;
“ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিলো মনোরম। মান্যবর রাষ্ট্রদূত মহোদয় সযতেœ নির্মাণ করেছিলেন সেই সন্ধ্যাটিকে। কেননা কিঞ্চিৎ কবিখ্যাতিও ছিলো তাঁর। দূর্লভ এক ফুলদানির মতোই নজর কাড়ছিল তাঁর ডিম্বাকৃতি কুসুমকোমল অবয়ব। কেননা সেখানে খেলা করছিল ভক্তি, আনুগত্য পেশাদারিত্ব আর পলাশীর প্রান্তরের সব আলো অন্ধকার।
ঠিক তখনই বঙ্গোপসাগর থেকে ধেয়ে এসেছিলো রক্তের সুনামি তারপর কত তুষার ঝড় বয়ে গেল। বুড়িগঙ্গায় ডুবে গেল কত টাইটানিক। কিন্তুু কী আশ্চর্য,ওরা আপনার কাছ থেকে কী যেন আড়াল করতে চায়!”
একসময় কবিকে অদৃষ্টবাদী হতে দেখা যায়। জীবনের দুঃখের অধ্যায় যেন শেষ হতে চায় না। তাই গ্রিক মিথের সিসিফাস যেমন পাথরকে ঠেলে উপরে ওঠাচ্ছে বিরতিহীনভাবে তিনিও দেখলেন জাতীর জীবনে যেন দুঃখের ভার টেনে নিতে হচ্ছে বিরতিহীনভাবে এখানে কে যাত্রী কে চালকতা অদৃশ্য এক সুতোয় ঝুলছে।
“টানো, টানতেই থাকো ত্রিচক্র যানের জীবন, নাকি জীবনের ত্রিচক্র যান- কিই বা এসে যায় তাতে একালের সিসিফাস তুমি। শুধু টানো, টানতেই থাকো।” “এ প্রশ্ন কেবল আঠারো কোটি মানুষের নয়, বরং বিশ্ব-মানুষের প্রকৃতিগত মনোগত আত্মজিজ্ঞাসা আধ্যাত্মিকতায় এসে বোবা দাঁড়িয়ে থাকে। যেন এ প্রশ্নের জবাব কোনো অন্তহীন জবাবে জবাবহীন হয়ে আছে শোষণ আর বিকলাঙ্গ সভ্যতার এ পৃথিবীতে!
৩. কবির রয়েছে গাঢ় দেশপ্রেম দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসায় তিনি যেন অন্তরে ডাক শুনতে পেলেন সবুজ শ্যামল নিজ মাতৃভূমির শব্দে শব্দে আঁকলেন নিসর্গের অনুপ চিত্র নিয়ে’ ডাকিছে সুবর্ণগ্রাম ‘ডাকিছে সুবর্ণগ্রাম! কপিলা ও কপিলা,চলো যাই মাঝি,কোথায় তোমার সুবর্ণগ্রাম? জন্ম থেইক্কা দ্যাখতাছি চাইরপাশে অভাবের থকথইক্যা কাদা মরা মহিষের নাড়িভুড়ির লাহান। ক্যান কপিলা কই নাই তুমারে – পদ্মার ওই পাড়ে তুন চরের মতো ডাক পাড়ে সেই সোনামাখা মাটি -যেইখানে শুইয়া আছে বাংলাদেশ আমি তার নাম দিছি সুবর্ণগ্রাম।”
এই সেই সুবর্ণ গ্রাম পদ্মার পাড়ে যেখানে বহুদিনের লালিত স্বপ্নকে বুকে করে প্রজন্মের আলোকিত সাহসী নেত্রী লৌহ মানবী শেখ হাসিনা আজ পদ্মার বুকে বাংলার জনগনকে নিয়ে তৈরি করেছেন ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতু। দু’ পারের মানুষের মঝে এনে দিয়েছেন সেতুবন্ধন। মৈত্রীর সুবাতাস বইয়ে দিয়েছেন দু’পারের মানুষের মাঝে।
“ভয় কিসের ভয়? সম্মূখে চাইয়া দ্যাখো মুজিবেরবেটি গইড়্যা দিছে কি এক আশ্চর্য সেতু – আন্ধারে সোনার মালার মতন জ্বলজ্বল করেপদ্মা মায়ের উত্তাল বুকখানিজুড়ে। এমন যে থত্থুরে বুড়ি – আমাগো বুড়িগঙ্গা- হেই বেডিও অহন কয় একবার টুঙ্গিপাড়ায় যামু তীর্থদর্শনে। ”
কবি মিনার মনসুর অনেকটা গল্পের আকারে কী অবলীলায় দেশপ্রেম,জাতির জনকের প্রতি ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা, পৃথিবী ও তার পরিবেশ, প্রাণ ও প্রকৃতির মধ্যেকার নিগূঢ় সম্পর্কের জটিল ব্যাকরণ ও টানাপোড়নের সূত্রটিকে তুলে ধরেছেন অনন্য প্রাজ্ঞতায়। একইসঙ্গে ব্যতিক্রমী এক সুখপাঠ্য ও চিন্তাউদ্দীপক, সুসংবদ্ধ অথচ উড়ালপ্রবণ অজস্র উত্তীর্ণ কবিতার সমন্বয়ে গ্রন্থটি করেছেন দারুণ মনোময় ও বাহারি।কবিতার নির্মাণে প্রাজ্ঞতা,শব্দের ব্যবহারে মুন্সিয়ানা, প্রতীক, উপমা ও পুরাণের যথার্থ ব্যবহার প্রতিটা কবিতা কাব্যগ্রন্থকে দিয়েছে অন্যমাত্রা।কাব্যগ্রন্থের প্রতিটা কবিতা কেমন যেন একটা ম্যাসেজ বা বার্তা রেখে গেছে কবিতার শরীরে। কবিতায় রয়েছে বাস্তববোধ, দর্শন আধ্যাত্মিকতা,বিমূর্ততা ও পরাবাস্তবতার এক অনির্বচনীয় রসায়ন। স্বল্প পরিসরে আলোচনায় ৪৫ টি কবিতা বিশ্লেষণ করা খুবই দুরূহ তারপরও যে কয়টা কবিতা হৃদয়ে গভীর দাগ কেটেছে তার যৎকিঞ্চিত আলোচনা করা হলেও অনেকগুলো কবিতা ব্যবচ্ছেদ করে তার রস আস্বাদন করা গেলেও তা শব্দচিত্রে চিত্রায়িত করা হয়নি। এরকম কবিতাগুলোর মধ্যে ‘কবিদের কবি তুমি’ ‘সবাই তখন প্রমিথিউসকে খুঁজছিলো’,’নার্সিসাস’, ‘কিয়েভ থেকে লিখছি এ দীর্ঘশ্বাস’,’সহস্র এক রজনীর গল্প’,’আয়নামহল’, ‘চক্রবুহ্য’,’তুমিই হাদি, তুমিই আদি’; কবিতা,গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
বলতে গেলে কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম নিজেই একটা এক পঙক্তির কবিতা। শিরোনাম নির্ধারণে কবি মিনার মনসুরের মধ্যে একটা অনুভবী শব্দ- শিল্পচর্চার গতিশীলতা সর্বোপরি সহজ সরল শব্দ ব্যবহারের অঙ্গীকার তথা একটা ব্যতিক্রমী শৈল্পিকতা বিদ্যমান। তিনি ‘মনোরম’ শব্দটিকে অনন্য শক্তিতে রূপান্তর করে শিরোনামেই নান্দনিক ব্যঞ্জনার অনুপ্রবেশ ঘটাতে চেয়েছেন বলে মনে হয়।
১৯৭৫ সালে পরিবার-পরিজনসহ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যাকা- এবং সে সময়ে ব্রাসেলসে বাংলাদেশি দূতাবাসে জাতির পিতার বেঁচে যাওয়া দুই কন্যা যে অমানবিক এবং সাধারণ শিষ্টাচারবহির্ভূত নিষ্ঠুর বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছিলেন বইটির শিরোনাম সে কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু মনোরম শব্দটি এখানে দারুণ এক কৌতুহলের সৃষ্টি করে। এটার গভীরে রয়েছে দ্বৈত অর্থ এক অনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভুত জঘন্য আচরণ, অন্যদিকে এক বৈরী আবহাওয়ার পর উত্তরণের জয়যাত্রার যে আভাস দেখতে পেয়েছিলেন তাকে নির্দেশ করতে চেয়েছেন। তবে কাব্যগ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত ৪৫টি কবিতা সর্বতোভাবে কেবল সেই বিষয়বস্তুকে নিয়েই যে ধাবিত হয়েছে তা নয়। বরং এ ঘটনার বহুমাত্রিকতার সাথে সরাসরি এবং দূরবর্তী সংযোগ, অন্তঃস্থিত ক্রন্দন, দ্রোহ, স্পৃহা, পুনর্জাগরণের বোধে আর কল্পনার ইন্দ্রজালে বিমূর্ত ভাবনার বহুবিধ সূত্রে কবিতাগুলো নিসংকোচে কবি ও কবিতার বিষয়বস্তুকে প্রাণমুখী করেছে।
‘ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম ‘ চার ফর্মার কাব্যগ্রন্থ’টি প্রকাশ করেছে কথাপ্রকাশ। প্রচ্ছদ এবং অলংকরণ করেছেন, ধ্রুব এষ। হার্ড কভারে চার ফর্মার এ বইটির মূল্য, ২৫০.০০ টাকা। কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে ডিসেম্বর ২০২২। বইটির সার্বিক উপস্থাপনা পরিচ্ছন্ন এবং নান্দনিক। দৃষ্টিনন্দন এই গ্রন্থের বহুল প্রচার কামনা করছি।
রূপক বরন বড়ুয়া, কবি ও প্রাবন্ধিক