অমল বড়ুয়া : বাংলা সাহিত্যের অমর কথাসাহিত্যিক আনোয়ার পাশা ছিলেন একজন কবি, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী। দেশাত্মবোধ, মননশীলতা এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনার চালচিত্র ফুটে ওঠে তাঁর সাহিত্যকর্মে। আনোয়ার পাশা একজন শক্তিমান লেখক। তাঁর সাহিত্য জীবনের সুচনা ছাত্রাবস্থায়। রাজশাহী কলেজে বিএ শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি ‘হাস্নাহেনা’ শিরোনামে একটি রম্যরচনা প্রকাশ করেন। তারপর থেকে সোৎসাহে চলতে থাকে তাঁর শুদ্ধতম সাহিত্য সাধনা। তাঁর দুই দশকের সাহিত্যজীবনে প্রকাশিত হয় মোট দশটি গ্রন্থ ও পনেরোটি প্রবন্ধ। তার মধ্যে আছে দুটি কাব্যসংকলন, একটি গল্পসংকলন, তিনটি উপন্যাস ও দুটি সমালোচনা গ্রন্থ। এ ছাড়া মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের সহযোগিতায় তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের চারটি কাব্য সম্পাদনা করেন। বহু পত্রপত্রিকায় তাঁর বহু মূল্যবান রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত সাহিত্যকর্ম বাংলা সাহিত্যকে যেমন ঋদ্ধ করেছে তেমনি করেছে উর্বর। তাঁর রচনাবলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- উপন্যাস- ‘নীড় সন্ধানী’ (১৯৬৮), ‘নিশুতি রাতের গাথা’ (১৯৬৮), ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ (১৯৭৩)। তাঁর রচিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ‘নদী নিঃশেষিত হলে’ (১৯৬৩), ‘সমুদ্র শৃঙ্খলতা উজ্জয়িনী’ (১৯৭৪) ও ‘অন্যান্য কবিতা’ (১৯৭৪)। তাঁর রচিত প্রবন্ধের মধ্যে আছে- ‘সাহিত্যশিল্পী আবুল ফজল’ (১৯৬৭) ও ‘রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা’ (প্রথম খ–১৯৬৯, দ্বিতীয় খ–১৯৭৮)। আছে তাঁর গল্পগ্রন্থ- ‘নিরুপায় হরিণী’ (১৯৭০)। তাঁর রচিত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ বাংলা সাহিত্যে তাঁর অনন্য সাহিত্যকর্ম হিসেবে ভূয়সী প্রশংসা লাভ করে। এই উপন্যাসটি রচিত হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে। অনেকে এই উপন্যাসকে মুক্তিযুদ্ধের একটি প্রামাণ্য দলিল হিসেবেও গণ্য করে থাকেন। আনোয়ার পাশা রচিত বিখ্যাত উপন্যাস ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ শুরু করেছেন তিনি- ‘বাংলাদেশে নামলো ভোর’ -লাইনটি দিয়ে; আর শেষ করেছেন এভাবে- ‘নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কতো দূরে। বেশি দূরে হ’তে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো ! মা ভৈঃ ! কেটে যাবে।’ তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন এবং মুক্তিযুদ্ধের একজন একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্নের বাস্তব রূপায়ণ তিনি দেখে যেতে পারেননি।
‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’ উপন্যাস প্রসঙ্গে কথাসাহিত্যিক আনোয়ারা সৈয়দ হক বলেন,- ‘এই উপন্যাসটি আমি বহু আগেই পড়েছিলাম। এখন আবার পড়তে গিয়ে বইয়ের পাতায় পাতায় আমি পুরোনো স্মৃতিতে চলে গিয়েছি। ভীষণভাবে একাত্তরের সেই দিনগুলো নিজের অন্তরের ভিতর অনুভব করেছি এবং আমার চোখ সজল হয়ে উঠেছে।’ আনোয়ার পাশা নিজেই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তিনি সেই সময়ে প্রত্যক্ষ করেছেন ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও তার পালিত পুত্র, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, ড. মুকতাদির, ড. ফজলুর রহমান সহ আরো অনেক হত্যাকা-ের বিভৎসতা। সেগুলো তিনি উপন্যাসের পাতায় তুলে এনেছেন। সে রাতের গণহত্যার পর রক্তের ধারা কীভাবে বয়ে যাচ্ছে সিঁড়ির উপর দিয়ে আনোয়ার পাশা তাঁর বর্ণনা দিয়েছেন। এই বর্ণনা অত্যন্ত লোমহর্ষক এবং বেদনাদায়ক সমস্ত বাঙ্গালির জন্য। উপন্যাসে একাত্তরের সেই মর্মান্তিক রক্তাক্ত অধ্যায়ের বর্ণনা করা হয়েছে। সবচেয়ে করুণ বিষয় যেটি, সেটি উপন্যাসটির নাম। ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ এই নামের মূল প্রতিপাদ্য হলো পাকিস্তানী সেনাদের কাছে খাদ্য, রাইফেল এবং নারী এই তিনটিই ছিলো মৌলিক চাহিদা। উপন্যাসের শেষের দিকের কয়েকটি লাইনে আমরা দেখি,- ‘শুধু চাই মদ-মাগী ও হালুয়া-রুটির ব্যবস্থা। সেজন্য পূর্ব-বাংলাকে শোষণ অব্যাহত রাখতে হবে। প্রীতি চাইলে শোষণ চলে না-এটুকু বুদ্ধি ওদের আছে।’ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী যে প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ চোখে দেখেননি তাদের জন্য এই উপন্যাসটি পড়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনবদ্য দলিল আনোয়ার পাশা রচিত মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস ‘রাইফেল, রোটি, আওরাত’। এই উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন ভয়াবহ হত্যা, নৃশংসতা ও অত্যাচারের সকরুণ বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। এতে উঠে এসেছে বাঙালির উপর পরিচালিত নিধনযজ্ঞের ভয়াবহ বর্ণনা। এই উপন্যাসের রচয়িতা আনোয়ার পাশা যুদ্ধকালিন পাকহানাদার বাহিনীর নৃশংস হত্যাকা-ের একজন প্রত্যক্ষদর্শী, যার সরল বয়ান ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে। একাত্তর সালে পাকিস্তানী সেনারা পুরো বাংলাদেশকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল। গোটা বাংলাদেশই সে-দিন বন্দিশিবিরে পরিণত হয়েছিল। সেই অবরুদ্ধ নগরের বন্দিশিবিরে বসে আনোয়ার পাশা লিখেছিলেন ‘রাইফেল রোটি আওরাত’ উপন্যাসটি। যাতে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাধীনতার কাঙ্খিত আশার বাণী শুনিয়েছেন কলম আর কালিতে। বন্দিশিবিরের ভয়াবহতার মধ্যে বসে আশার অভয়বাণী শোনানোর এমন গল্প বিশ্বসাহিত্যে বিরল। এই কাজটিই করেছেন আনোয়ার পাশা রাইফেল, রোটি, আওয়াত গ্রন্থে। ২৫ মার্চের গণহত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের হত্যার নির্মম কাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষের শিক্ষকদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের নানাভাবে সহযোগিতাকারী মানুষদের ত্যাগের গল্প, শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাহাকার, চারপাশের মানুষের মননে-আচরণে সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতার দ্বন্ধই উঠে এসেছে এ উপন্যাসে।
‘বাংলাদেশীরা সব হিন্দু হয়ে গেছে’- এই অজুহাতে পাকিস্তানী সেনারা বাংলাদেশের মানুষের উপর হামলে পড়েছিল। এর প্রমাণ বর্তমানে অনেক পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বইপত্রেও পাওয়া যায়। এই উপন্যাসে লেখক এই দিকটিও তুলে ধরেছেন চরম দক্ষতার সাথে। উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র সুদীপ্তকে যখন খাকি পোশাকের পাকিস্তানি জওয়ান ‘কুত্তা’ বলে সম্বোধন করে তখন উপন্যাসের চরিত্র সুদীপ্ত বলে উঠে,
‘হাম কুত্তা নেহি হ্যায়, হাম মুসলমান হ্যায়।’
‘তোম যো মুসলমান হ্যায় উ তো ভোল গিয়া।’
যুদ্ধ চলার সময়ে আনোয়ার পাশা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিকভাবে বাচনিকভাবে ও মানসিকভাবে সাহায্য করেছেন। যোগান দিয়েছেন খাদ্য ও পথ্যের। দিয়েছেন মনোবল ও সাহস। সেই সময় তিনি রেডিওতে নিয়মিত অনুষ্ঠান করতেন। যে অনুষ্ঠান দেশের পক্ষে যায় না, সে অনুষ্ঠান তিনি করতেন না। প্রকাশ্যে পাকিস্তানীদের বিরোধিতা করতেন তিনি। তাঁর পরিবারের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল তাঁর প্রিয় স্বদেশ, বাংলাদেশ। আর তাইতো পরিবারের নিরাপত্তার কথা না ভেবে দেশের স্বাধীনতা নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি আপোস করেননি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপক লিখছেন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক কিন্তু গৌরবময় সময়ের দলিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস রাইফেল, রোটি, আওরাত। আনোয়ার পাশা লিখেছেন,- ‘বাঙ্গালীর অস্ত্রের শক্তি আজ সীমিত হতে পারে, কিন্তু ভালোবাসার সম্পদ তো অফুরন্ত। সেই প্রীতি ভালোবাসার সঙ্গে এবার অস্ত্রের সম্মেলন হয়েছে – এবার বাঙ্গালী দুর্জয়।’ তিনি রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে গবেষণা করেছেন। রবীন্দ্র ছোটগল্প সমীক্ষা নামে দু’খন্ডের সমালোচনা গ্রন্থ লিখেছেন। ষাটের দশকে আইয়ুব সরকারের আমলে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী পালন করার অপরাধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাঁর পাসপোর্ট ছয় বছরের জন্য স্থগিত করে।
বুদ্ধিজীবী, শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক আনোয়ার পাশার জন্ম ১৯২৮ সালের ১৫ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরের ডাবকাই গ্রামে। পিতা হাজী মকরম আলী ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। আনোয়ার পাশা ভাবতা আজিজিয়া উচ্চ মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ করে ১৯৪৬ সালে উচ্চ মাদ্রাসা পরীক্ষায় পাস করেন। পরে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন ১৯৪৮ সালে, রাজশাহী কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন ১৯৫১ সালে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এমএ পাস করেন ১৯৫৩ সালে। মানিকচক হাই মাদ্রাসার সুপারিনটেন্ডেন্ট হিসেবে তিনি কর্মজীবন শুরু করেন। পরে বিভিন্ন স্কুল এবং ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে শিক্ষকতা করেন। পর ১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন এবং আমৃত্যু এখানেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগী দোসর আল বদরদের একটি দল আনোয়ার পাশাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যায় এবং মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছে হত্যা করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জামে মসজিদের পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়। তিনি ১৯৭১ সালে প্রবন্ধ গবেষণায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০২০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে (মরণোত্তর) ভূষিত হন।
অমল বড়ুয়া : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট