ড. জাহাঙ্গীর হাবীবউল্লাহ
কবির হাতে জগৎ বদলায়। জীবনের সত্য ও সুন্দরকে কবি তার কবিতায় ভাষার নিজস্বতা নিয়ে নতুন করে সারা বিশ্বের চেনাজানা ছবিকে কলমে এঁকে নেন। কবি মুস্তফা হাবীব সেই অঙ্কিত চিত্রের ঘুড়ি উড়িয়ে থাকেন কবিতার দেশে। আসলে কবির কাজ হচ্ছে সৃষ্টি করা, সৃজন প্রয়াসকে দৃষ্টি গোচরে আনায়ন করা। ভাব -ভাবনা চিন্তা চেতনার বিষয়কে পুনর্জন্ম দেয়া। মুস্তফা হাবীব অহরাত্র সেই কাজের ভেতর দিয়ে ঘাম, শ্রমে মেধার মনস্বীতা দিয়ে অনন্তের রক্ত ঝরিয়ে দ্যুতির ক্ষয় ছড়িয়ে হয়েছেন কবি। হয়েছেন রূপকার রূপকথার নির্মাতা, স্বপ্নের ঘুড়িওয়ালা( আসলে কাব্যভাবের ফেরিওয়ালা)। গভীর গোপন আত্মার শিল্প সৃষ্টির একজন, যে কিনা স্রষ্টা, দ্বিতীয় স্রষ্টা, এলিয়টের ভাষায় যিনি নতুন সব সৃষ্টিকারী। জীবনানন্দের অনুজ্ঞা, যে লোকটি ‘সকল লোকের মাঝে বসে ‘ একা এবং আলাদা।
‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’। এখানে কবি কে তা এক জটিল জ্যামিতি। প্রিয় কবি রবীন্দ্রনাথ যেই বলেন, ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ/ চুনি উঠল রাঙা হয়ে /আমি চোখ মেললাম আকাশে/ জ্বলে উঠল আলো/ পূবে – পশ্চিমে/গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম ‘সুন্দর। সুন্দর হলো সে। তখন অনুরূপ ভাবে পরিচিতি পান কবি বলে।
আসলে কবি হলেন ¯্রষ্টা, দ্বিতীয় ¯্রষ্টা। কবি মুস্তফা হাবীব তার কবিতায় আধার ও আধেয় মূলত জীবন জিজ্ঞাসা ও জীবনবোধের রূপায়ক। সে এক মহাজীবনের ডুবুরি ও শিকারি। জীবন তৃষ্ণাকাতর মুস্তফা হাবীব নিজ ও অন্য জীবনের মধ্যে সমীকরণ করতে গিয়ে নির্মাণ করেন একাকিত্বের খাদ। তাই তার চাই ‘ আর কোনো কাজ নাই’। রচি শুধু অসীমের সীমা, আশা দিয়ে তাহে ভালোবাসা দিয়ে গড়ে তুলি মানসী প্রতীমা ‘- কবি রবীন্দ্রনাথ। ওই মানসীর রূপকল্পের সন্ধানে অসম্ভব রকম ব্যাকুলতা তার কাব্যগুলোতেও অনায়াসেই লক্ষ্য করা যায়। সেই ব্যাকুলতার খাদ গভীর সমুদ্র অতল অভিনিবিষ্টচারী। আর এই ব্যাকুল ভাবময় জগতের তলহীনের আহ্বানে শত উৎস ধারায় ভাষা পায় Man speak to men’ (ওয়ার্ডস ওয়ার্থ) এবং Of their sarrows and delights / of their passions and their spites / of their glory and their shame.’ কবিতার জন্ম ও যাত্রা এই রমণীয় ও বেদনাময় জ্বালার উপাচারে। অসংখ্য যুদ্ধ, লড়াই, মন্বন্তর, পাপ আর পতনের পরেও তাই কবিতা থাকে সকল কবির হাতে হাতে কলমের ডগায়। তাইতো কবিতায় বলা যায়, নিরন্তর প্রবাহিত হয় –‘ নিরালা মানুষের বেদনা ‘আর ঝিনুকে মুক্তা ফলানোর যাতনা।
কবি মুস্তফা হাবীব বৃহৎ বরিশাল জেলার মানুষ। সেখানে জীবনানন্দ দাশের মতো মৌল স্বরের কবির জন্ম। তিনি সৎ ও শুদ্ধ কবি, প্রসুতি জ্ঞানের কবি, কল্পনার ভেতর চিন্তা ও অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্র সারবত্তার কবি। কবি মুস্তফা হাবীব এর কবিতায়ও প্রকৃতি, প্রেম বিশেষ করে মানসীর সন্ধানে আকুলতা লক্ষ্য করার মতো। তার যেসব কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলাম তার সবগুলো প্রচ্ছদ নান্দনিক হলেও তাতে নারী অবয়ব মুখ্য হয়ে আছে। তবে এগুলো তেমন বিচার্য নয়।
কাব্যে ভাষা, শিল্পরূপ কবির শুদ্ধতা, কল্পনা (lmagination),শক্তি, অনুভূতি বা স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান এবং সংবেদন (sensation) অবশ্যই কাব্য বিশ্লেষণ ও বিচারে আনতেই হবে। তাই বলি সমস্ত অন্তরাত্মাকে কর্মচঞ্চল এবং সজীব করাই শ্রেষ্ঠ কাব্যের লক্ষণ। একক এবং সাধারণ আনন্দের দিঙ্ মন্ডল এর পরিক্রমা নয় অথবা মানসলোকের সীমাবদ্ধ লঘু চাঞ্চল্য নিয়েও এর জাগরণ নয়। মানুষের প্রতিদিনকার অভিজ্ঞতা র সম্ভাবনার চাইতেও,যে অভিজ্ঞতা শ্রেষ্ঠ কাব্যের উপাদান্ত তার ব্যাপ্তি এবং গভীরতা অসাধারণ।
উত্তম কবিতায় মানবজীবনের মাত্র কোনো একটা বিশেষ দিকের পরিচর্যা নয়। মুস্তফা হাবীব এর কবিতা পাঠে অতসব বিষয় কম বেশি খুঁজে পাওয়া যায়। তাই তার কবিতার অধিকাংশই উত্তীর্ণ। কবিতা মানবজীবনের মাত্র কোনো একটা বিশেষ দিকের অনুষঙ্গ নয়। মানুষের পরিপূর্ণ ব্যাক্তিত্বের কর্মচঞ্চল রূপের মধ্যে প্রেম। (নারীপ্রেম, দেশপ্রেম, এবং প্রকৃতিপ্রেম ও বিদ্যমান আর রয়েছে সচেতনতা এবং সংগ্রাম)। আমরা পরিপূর্ণ ব্যাক্তিত্ব বলতে বুঝি চিত্তাকর্ষের ক্ষেত্রে প্রজ্ঞা, মনন, সংবেদনশীলতা এবং অনুভূতির সম্মিলিত বিকাশ। মুস্তফা হাবীব এর কবিতায় অনেকটাই তা খুঁজে পাওয়া যায় এ কথা অসংকোচে বলা যায়।
কবিতা তত্ত্ব বা মূলভাব বক্তব্য অভিজ্ঞতাকে রূপ দেবে না কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে তা অবশ্যই উৎসারিত হবে। তবে তা মানসিক দক্ষতার সম্পূর্ণ প্রয়োগ। থেকেই যে বিশিষ্টতা নির্ণীত হয়, তা মনে রেখে কবি মুস্তফা হাবীব এর কবিতাগুলো বিশ্লেষণ করা অপরিহার্য। মনে রাখতে হবে যৌক্তিক বিন্যাসের জন্য কোনো কবিতা একেবারে বিশুদ্ধ হয় না। কবিতার যৌক্তিকতা জীবনের জন্য এবং এ জীবনের পরিচয় কোনো বিশিষ্ট মনের বা বলা যায় উত্তম বা মহৎ হৃদয়ের। নি:সংশয় উপলব্ধিতে। কবিতার মূলভাব কোনো নির্ণয়যোগ্য বস্তু নয়, যাকে কবিতা থেকে আলাদা করে ব্যাখ্যা করা যায়। অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধিই হচ্ছে কবিতার মূলীভূত তত্ত্ব, তাই কবির অভিজ্ঞতাকে আয়ত্ত করেই কাব্য ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন।
নিম্নে একটি উদ্ধৃতি দিচ্ছি –
‘ আমি তোমাদের আপাদমস্তক চিনি
ইদানীংকালে টাইস্যুট পরে যারা
বন্দনা করে যাও কাস্তে কোদালের
সমতন্ত্রের মন্ত্রপাঠে মগ্ন থেকে
বুকের অভ্যন্তরে জন্মাও পুঁজিবাদ।
(শেকড় সন্ধানে,কাব্য – একমুঠো স্বর্ণকমল)
কবিতাটির ছন্দ, উপমা উৎপ্রেক্ষার বিষয়াদি ভালো লাগারই মত,যেমন :
‘এখানে আমার বধূয়া ছড়ায় ছড়ায় অকৃপণ হাসি,
কত না মান অভিমান, রাগ অনুরাগ, ভালবাসা বাসি।
……………………………….
এই আমার স্বর্ণকমল, কবিতা বিলাস বাড়ি
আমার এখান থেকে যাত্রা শুরু, ওপারে দেবো পাড়ি ‘
(স্বর্ণকমল)।
‘যে ঠোঁটে বসন্তের সৌরভ ‘কাব্যের এই শিরোনামের কবিতাটি অতিমাত্রায় রোমান্টিক। এ কাব্যের কবিতা সমূহ ভাবকে অনুসরণ করে ছন্দের পরিধি গঠিত। বিভিন্ন শব্দের পুর্ণবর্তনের মধ্য কবিতায় গতিময়তা মোটেই ক্লান্তিকর নয় বরং অনেক গতিশীলতায় ভালো লেগেছে। এখানে যেমন :
বিশ্বাস অবিশ্বাসে ব্যবধান
কল্পলতায় কুসুম ফোটে বহুমাত্রিক
শখ সাধ পছন্দের রঙে দুস্তর ফাঁক,
……………………………………..
হয়তো পেয়ে যাবো একমাত্র তাঁর কৃপায়
হেসো না হেসো না মানব মানবী।
আলোচনাটি প্রাণবন্ত করার জন্য প্রয়োজন সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ। সে জন্য স্বল্প পরিসরে তা করা অসম্ভব প্রায়। তবু সমাপ্তি টানার আগে অনুরোধ করবো সতর্ক হবার জন্য। তিনি ‘নন্দিতার সেই চিঠি কাব্যে-বয়সে নয় মনে ‘ কবিতাটি ছড়া ছন্দে লিখেছেন। এখানে বসন্তকালে কৃষ্ণচূড়া কুসুম কোথায় পেলেন? প্রকৃতির কালক্ষণ সম্পর্কে অবশ্যই কবিকে সজাগ থাকতে হবে। তবে পরিশেষে সবদিক বিবেচনায় বলা যায় কবি মুস্তফা হাবীব কবিতার অবয়ব নির্মাণে যথেষ্ট মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। আমি তার আরো সমৃদ্ধি চাই।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা, কবি ও সাহিত্যিক। সাবেক সম্পাদক রাষ্ট্রীয় মুখপত্র মাসিক অগ্রদূত ও মাসিক প্রতিরোধ