এস ডি সুব্রত :
সব্যসাচী লেখক আহমদ ছফা আমাদের সাহিত্যের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় যিনি প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। তিনি অধ্যাপক রাজ্জাকের ছাত্র। দীর্ঘদিন মেলামেশা করার ফলে অধ্যাপক রাজ্জাককে খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার যে দুর্লভ সুযোগ তাঁর হয়েছে, তাই অকপটে তুলে ধরেছেন তাঁর যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থটিতে। অধ্যাপক রাজ্জাকের ওপর খোলামেলা, তীক্ষè, গভীর এবং সরস এমন একটি গ্রন্থ রচনা করা একমাত্র আহমদ ছফার পক্ষেই সম্ভব। লেখক অধ্যাপক রাজ্জাকের উচ্চারিত বাক্যের শুধু প্রতিধ্বনি করেননি, ব্যাখ্যা করেছেন, উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন, প্রয়োজনে প্রতিবাদও করেছেন। এখানেই গ্রন্থটির আসল উৎকর্ষ। অধ্যাপক রাজ্জাক নিজের কথা বলতে গিয়ে তাঁর সময় সমাজ এবং সমকালীন বিশ্বের কথা বলেছেন। আহমদ ছফা বাংলা একাডেমি থেকে গবেষণা বৃত্তি নিয়ে পি.এইচ.ডি করার প্রস্তুতি সময়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে প্রথম পরিচিত হন। তখন তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল ১৮০০-১৮৫৮ সাল পর্যন্ত বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলা সাহিত্য,সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে তার প্রভাব’। তখন বন্ধুদের পরামর্শে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে পরিচয়।
যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থটি অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের সাথে আহমদ ছফার বিভিন্ন স্মৃতি নিয়ে রচিত। লেখক এখানে সহজ ও সাবলীল ভাবে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে তার গুরু বলে অভিহিত করেছেন। লেখক বলেন, প্রফেসর রাজ্জাকের সান্নিধ্যে আসতে পারার কারণে আমার ভাবনার পরিম-ল বিস্তৃত হয়েছে প্রভুত পরিমাণে, মানসজীবন ঋদ্ধ এবং সমৃদ্ধতর হয়েছে। রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি, ইতিহাস, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের অগাধ পা-িত্যে মুগ্ধ লেখক আহমদ ছফা। আহমদ ছফা অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের যেসব মূল্যবান বিষয় ও স্মৃতি স্মরণ করতে পেরেছেন তা নিয়েই রচনা করেছেন ‘যদ্যপি আমার গুরু’ গ্রন্থটি। লেখক এই গ্রন্থে বলা উল্লেখ করেছেন যে,বাংলা ভাষার পরিবর্তন সম্পর্কে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক বলতেন, “ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প-িতেরা ভাষার স্ট্রাকচারটা খাড়া করেছিলেন, তার লগে ভাগীরথী পাড়ের ভাষার মিশ্রণে আধুনিক বাংলা ভাষাটা জন্মাইছে। আধুনিক বাংলা বঙ্গসন্তানের ঠিক মুখের ভাষা না, লেখাপড়া শিইখ্যা লায়েক অইলে তখনই ওই ভাষাটা তার মুখে আসে।”আজীবন অকৃতদার এই অধ্যাপক তার ছোট ভাইয়ের স;সারে থেকে নিয়মিত জ্ঞানচর্চা করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেয়ার প্রতি তার খুুব একটা আগ্রহ ছিলো না। ক্লাসে পাঠ দেয়া ও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য প্রদানে ছিলো তার অনীহা, কিন্তু তারপরও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থীদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করেছেন। হুকা টানা ও দাবা খেলার প্রতি ছিল তার বিশেষ দুর্বলতা। তবে সবচেয়ে বেশী দূর্বল ছিলেন তিনি বিলাস ভোজনে। এমনকি দেশের বাইরে গেলে সেখান থেকেও তিনি অন্তত একটা খাবার মেনু রান্না করা শিখতেন। দোকানের বই ও খাদ্যাভ্যাস দেখে ঐ জাতির সভ্যতার স্তর নির্ণয় করার মতবাদ দিয়েছেন তিনি। আহমদ ছফা এই বইয়ে যেমন অধ্যাপক রাজ্জাকের গুণাবলী তুলে ধরেছেন তেমনি তার দুর্বলতাগুলোকেও অকপটে স্বীকার করেছেন। আহমদ ছফা উল্লেখ করেছেন কথা বলার সময় তার আঞ্চলিকতার কথা। তিনি স উচ্চারণ করতে পারতেন না। স কে ছ উচ্চারণ করতেন। লেখার প্রতি তার ছিল অনীহা এবং স্বভাব অনেকটাই একরোখা। খানিকটা অহংকারীও বটে। তবে সবচেয়ে বড় ক্ষমতা ছিল মানুষকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা। এজন্য শুধু দেশেই নয় বিদেশেরও অনেক গুণীজন তার প্রতি বিশেষভাবে মুগ্ধ ছিলেন। ইলাস্টেটেড পত্রিকায় তাকে নিয়ে কভার স্টোরি করা হয় এবং তাকে বাংলার ডায়োজিনিস বলে অভিহিত করা হয়। হেনরী কিসিন্জারের মতো দক্ষ কুটনীতিবিদ বাংলাদেশে এসে তার সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাকে নিজের সহকর্মী হিসেবে অবহিত করেন। সাহিত্যপ্রিয় এই মানুষটি ছিলেন নজরুল ইসলাম ও জসীমউদ্দীনের অন্ধ ভক্ত। কবি জসীমউদ্দীন তার কাজের মাধ্যমে অমরত্ব লাভ করবে বলে ভবিষ্যতবাণী করে দূরদৃষ্টির প্রমাণ দেন। তবে উনিশ শতকের সবচেয়ে বড় অবদান হিসেবে তিনি উল্লেখ করেছেন বাংলা গদ্যের বিকাশ। আর এ ক্ষেত্রে ব্যাকরণ রচনার কারণেই রামমোহনের কৃতিত্বের কথা বলেন। উনিশ শতকের মানুষ হিসেবে তিনি বিদ্যাসাগরকে অভিহিত করেছেন সিংহপুরুষ বলে। তবে বঙ্কিম, কেশব, দেবেন ঠাকুরকে দায়ী করেছেন রিভাইভিলিজম এর বিকাশের জন্য। বঙ্কিমকে সমালোচনা করেছেন মুসলমানের টাকায় লেখাপড়া করে সারা জীবন মুসলমাদের বিরুদ্ধে লেখার জন্য, বিদ্যাসাগরের উপর তার অভিযোগ সংস্কৃত বহুল বাংলা চর্চার কারণে। তার চোখে রবীন্দ্রনাথ একজন বড় লেখক,তবে বড় মানুষ নয়। তিনি অনুভব করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাখাতের চাইতেও অন্যক্ষেত্রে আরও বেশী অবদান রেখেছে। পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই তিনটি অবদানকে বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। মাওলানা ভাসানীর পলিটিক্যাল অসুখ, মাওলানা আবুল কালাম আজাদের সত্য কথা না বলার অভ্যাস প্রভৃতি মন্তব্যের মাধ্যমে তিনি তৎকালীন রাজনীতির একটা অবস্থা তুলে ধরেছেন। ফজলুল হককে রাজনীতির দক্ষ সৈনিক বলে অভিহিত করেছেন। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রুটিপূর্ণ দিকগুলো উল্লেখ করে তিনি বলেছেন- অহন আমাগো দরকার শক্তিশালী মিডল স্কুল। হেইদিকে কারও নজর নাই। বাস্তবঅর্থেও আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ বাড়ছে। তবে শিক্ষার ভিত্তি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায় অনেক দূর্বল। এছাড়াও বাংলাদেশের অভিজাত ও গণমানুষের ভাষা ব্যবহারের মধ্যে বিশাল পার্থক্যের কথা উল্লেখ করে তিনি দুঃখ প্রকাশ করেছেন। দেশ ও সমাজের প্রতি নিঃশর্ত অঙ্গীকার থেকেই তিনি বদরুদ্দিন উমরসহ আরো অনেককেই দেশের জন্য কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন। বাঙালি মুসলমানদেরকে বুদ্ধিবৃত্তিক ভাবে সাবালক করার পিছনে তার অবদান অসামান্য বলে লেখক দাবি করেছেন। ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলমানদের পশ্চাদপদতা ও হিন্দুদের আধিপাত্য বিস্তারের প্রবনতা প্রকট হলে তিনি মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্টের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। ঠিক একই ভাবে অধিকার আদায়ের প্রশ্নে তিনি ১৯৭১ এ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন। এসব কারণেই মুসলিম লীগের প্রতি বিশেষ ধরনের দূর্বলতা থেকে তিনি তার তৎকালীন পি.এইচ.ডি সুপারভাইজার অধ্যাপক হ্যারল্ড লাস্কিকে বলেছেন, “আই অ্যাম এ মেম্বার অব মুসলীম লীগ এন্ড এ ফলোয়ার অব জিন্নাহ”। কিন্তু তিনি সাম্প্রদায়িক ছিলেন না। বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতে লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা তৈরী না হওয়ায় তাদের শান্তিপূর্ণ দীর্ঘকালীন সহাবস্থান নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তিনি। এছাড়া লেখকের বর্ণনায় রাশিয়ার সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় লেলিনের অর্ন্তদৃষ্টি, রাশিয়ার শিল্প বিপ্লব, মার্কসীয় দর্শন প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ে অধ্যাপক রাজ্জাকের দূরদর্শীতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থটি আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে লেখক অহমদ ছফার একটি গভীর ও সরস রচনা। দীর্ঘদিনের সান্নিধ্যের কারণে ব্যক্তিগত দূর্বলতা থেকে অধ্যাপক রাজ্জাক হয়তো লেখকের বিশেষ কিছু অনুভূতি দখল করেছেন তবে তাঁর প্রতি দেশ ও বিদেশের অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তির শ্রদ্ধার বহিঃপ্রকাশই প্রমাণ করে, তিনি ছিলেন সত্যিকার অর্থেই একজন কিংবদন্তী। অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে রচিত এই গ্রন্থটিতে সেই সময়ের সমাজ, সমকালীন বিশ্ব ও রাজনীতির যে বিষয়গুলো উন্মোচিত হয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ একটি সামাজিক দলিল।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে আহমদ ছফা তাঁর যদ্যপি আমার গুরু গ্রন্থটিতে বলেছেন –
“আমার ধারণা ‘ঢাকার পোলা’ এর চাইতে অন্য কোনো বিশেষণ তাঁর সম্পর্কে প্রযোজ্য হতে পারে না। তিনি ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ থানায় জন্মগ্রহণ করেছেন। সেটাই তাঁকে ঢাকার পোলা বলার একমাত্র কারণ নয়। ঢাকার যা-কিছু উজ্জ্বল গৌরবের অনেক কিছুই প্রফেসর রাজ্জাকের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে। তিনি সবসময়ে ঢাকাইয়া ভাষায় কথা বলেন। ঢাকাইয়া বুলিতে যে একজন সুশিক্ষিত সুরুচিসম্পন্ন ভদ্রলোক মনের গহন ভাব অনুভাব বিভাব প্রকাশ করতে পারেন এবং সে প্রকাশ কতটা মৌলিক গুণসম্পন্ন হয়ে উঠতে পারে, রাজ্জাক সাহেবের মুখের কথা যিনি শোনেননি, কোনোদিন বুঝতে পারবেন না। ঢাকার পুরোনো দিনের খাবারদাবার রান্নাবান্না যেগুলো হারিয়ে গেছে অথবা হারিয়ে যাওয়ার পথে প্রফেসর রাজ্জাক তার অনেকগুলোই ধরে রেখেছেন।” সবশেষে লেখক প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে বলেছেন –‘ বলতে গেলে কিছুই না লিখে শুধুমাত্র সাহচর্য, সংস্পর্শের মাধ্যমে কত কত আকর্ষিত তরুণচিত্তের মধ্যে প্রশ্নশীলতার অঙ্কুর জাগিয়ে তুলেছেন, একথা এখন যখন ভাবি বিস্ময়ে অভিভূত না হয়ে উপায় থাকে না।’
এস. ডি. সুব্রত, প্রাবন্ধিক, হবিগঞ্জ