এখন সময়:রাত ৯:২৩- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৯:২৩- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

যুগ তো খারাপ অই গেইলগুই

আলমগীর মোহাম্মদ

জলকদরের হাঁড়ি বেশ দবোজ। দুইপাশে দুঁউলো ঘাসের বিছানা। কেউ কেউ সেটা ধরে হেঁটে যায়। আবার কেউ কেউ মাঝখানের ধবল এটেল মেঠো পথ দিয়ে। বর্ষাকালে বেশ মজা এসব রাস্তায় হাঁটতে। নখে খুট দিয়ে দিয়ে হাঁটতে হয়। অবশ্যই এটা এই অঞ্চলের সবারই অভ্যেস হয়ে গেছে। এরা পায়ের নখ কাটে না। নিঁচু হয়ে পায়ের দিকে এই অঞ্চলের কোনো মরদ পোয়া  কখনো তাকিয়েছে এমন রেকর্ড বোর্ডঘরের কেরানির কাছেও থাকার কথা না। এখানকার মরদ পোয়ারা স্বাস্থ্যের সৌন্দর্যের বিষয়টা কখনো কোনোদিন খেয়াল করেন না। অবশ্যই, সে সুযোগ কই!

 

 

সাম্পানে মাল বোঝাই, ঘাট পার করা, সাঁকো পার হয়ে ধান ছুরাতে যাওয়া, কারো অসুখ হলে ভারঘোড়া বেঁধে, আটমাইল হেঁটে  কোকদ-ির সুরেন্দ্র ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া, ডায়রিয়ায় জায়গায় মারা যাওয়া, ডেলিভারি কেইসে ধরনী ছাড়া আর কোনো ডাক্তারের মুখ না দেখা, রাত ভর পালা করে ডাকাত পাহারা দেয়া, মাঝেমধ্যে পাড়ায় পাড়ায় জানবাজি যুদ্ধ লেগে যাওয়া, সেই ঝাঁটি সামাল দিতে আসা পুলিশের ঝক্কি সামলানো, মেম্বারের রিলিফের গম চুরি, খালে জাল ফেলা নিয়ে জ্যাঠাতো ভাইয়ের সাথে লাঠালাঠি, শাশুড়ির হাতে অত্যাচারিত বউয়ের রাগ করে বাপের বাড়ি চলে যাওয়া, বিয়ের উকিলের চৌদ্দগুষ্টি ধুয়ে বিচার বসিয়ে বউকে ফিরিয়ে আনা, শ্বশুর জামাইয়ের মেম্বার ইলেকশন নিয়ে পাড়ার দোকানগরম করা তর্ক, শালিম্ম্যের মেয়ে নিয়ে খতিজার পোয়ার পালিয়ে যাওয়া, এই নিয়ে দুই পাড়ার মধ্যে উত্তপ্ততর হাওয়া চালাচালি এবং ব্যর্থ প্রেমিকের দোকানের কোণে ক্যারামবোর্ডে বাজি এসব নিয়ে তাদের জীবন।

 

হাঁড়ির পথ ধরে বেয়ারীরা গল্প করতে করতে হেঁটে যায়। হাটে। সেখানে যেমন  থাকে বাজার দর নিয়ে আলাপ, তেমনি থাকে জুনীর মা’র মেয়ের বিয়ের আগে পেট উঁচু হওয়ার মতো আজগুবি অথচ লোকমুখে বিছুইনোর  বাতাসের মতো ঘুরপাক খাওয়ার গল্প। দুইজন ব্যবসায়ীর একজন হুঁনি বেয়ারী। আরেকজন গরুর। ঠিক ব্যবসায়ী না। এক প্রকার ভাঁজ দিয়ে চলা দালাল। মানে এদের ক্যাপিটাল কম, কিন্তু গালের চল বেশি। কথায় আছে, গাল গুণে ছ্যাঁচা, মালগুণে বেচা। অবশ্যই  এটার বিপরীত ঘটে ঘরুর দোয়ানে। মাল যেমন তেমন, গাল চালু তো মাল চলবেই।

 

বশিয়েল্ল্যে মিজ্জির হাট থেকে দুইজন হাঁটা দিয়েছে সোয়া ঘন্টা আগে। পথে অবশ্যই শেখ আহমদ একবার সাড়ে তিন মিনেটের জন্য লুঙ্গি তুলে বসেছিলেন অমণী গাছের আড়ালে। ছ্যারাতে ছ্যারাতে বেছারা লুজ। গত হালিয়ে মোশালি হাডত্তুন ওজ্ঞো লালসালু তরমুজ আনছিলেন তিনি। পঁয়ষট্টি টাকা দিয়ে। সেটা ঝোলায় গিয়ে কিছুটা নেতিয়ে পড়েছিলো। লাল সালর অংশটা নেতিয়ে পড়েছে একেবারে। যেমনটা পাল যাওয়া শেষে বেরিয়ে আসে গোয়াইল্ল্যের দঁরার নসসা!

 

দুইজনের মধ্যে আঁবিচ্ছ্যের বাপ একটু চালু। কোনো একসময় তিনি ক্লাস থ্রি ফেল করেছেন। মোটামুটি জোড়াতালি দিয়ে রিডিং পড়তে পারেন ভদ্রলোক। বাজারের নির্মল ফার্মেসি থেকে নেওয়া  একটা ছোটো প্যাড তার বুক পকেটে সবসময় থাকে। এটাকে তিনি নোট বই বলেন। পকেটে সাড়ে তিন ট্যাঁয়ার ইকোনো-ডিএক্স ও তৈলার দ্বীপ ফেরি ঘাট থেকে কেনা বারো আইন্ন্যে অঁনি। সেটাও কিনেছিলেন ৮৮’র বন্যার আগের বছর।

 

সেবার বিবির হাটে গরু বেচে বেশ লাভ হয়েছিল। ফেরার পথে ফেরি থেকে একটা চাইর আনার নুঁয়োল ও একটা চিরুনি কিনেছিলেন তিনি। কালের আবর্তে নুঁয়োলটা তাঁর ছেলের ঘরের নাতি ব্যবহার করে। স্কুলে যাওয়ার সময় বেলাইল্ল্যে এটাকে কলারের সাথে বেঁধে যায়। বাঁহা মরোত্তোয়ার অনেকগুলো লক্ষণের একটি লক্ষণ হলো শার্টের কলারের সাথে ধুঁইসস্যে রং’র নুঁয়োল বাঁন্দি গপ মারি মারি রাস্তার দুই পাশ দিয়ে হাঁটা। আর আবিয়াতা মেয়েছেলে দেখলে ‘এহহ্যে ‘ বলে গলা খাঁকারি দেওয়া।

 

তো, আঁবিচ্ছ্যের বাপ’র আলাপে জাতীয় রাজনীতি, সাদ্দাম কোথায় আত্মগোপনে আছেন, করিম বাজারের ডাক আগামীবার কে পেতে পারে, রামদাস হাটের গরুর দোয়ানত পালেগ্রামের মানুষের গায়ের জোরে হাঁচিল আদায়, অথবা র’মান স্যানিটারির মেয়ের অনার্স পাস, গতবারের বানে  হোঁট্টা পাড়ার ছড়া ভেঙে বাইন্ন্যে ফইরো পাড় ছিঁড়ে কুমোরি বিলে নিয়ে যাওয়া, আনন্দ বাজারের নেপালের মিষ্টির সর পাতলা হয়ে যাওয়া, জাফর সা’ব গতকাল ন্যাসস্যে পুকুরের পাড়ের জনসভার কী পরিমাণ চাল দেওয়ার কথা বলেছেন, সামনের ইলেকশনে  ছবুর চেয়ারম্যানের নমিনেশন হবে কিনা, নাকি কালীপুরের  চেয়ারম্যান বাগড়া দিবেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলাপের ফাঁকে ঘটে গেছে একটা মহাকাব্যিক ঘটনা।

 

আঁবিচ্ছ্যের বাপোর একটা নিয়মিত অভ্যেস হলো কোথাও যাওয়ার সময় ছাতা নিয়ে বের হওয়া। এরাবিয়ান হর্স সুপার। একশো বিশ টাকা দিয়ে সদর আমিন হাট থেকে কিনেছিলেন গত মাসে। শবে বরাতের সময় তিনটা গরু বেচাকেনা করে বেশ কিছু লাভ হয়েছিল। তাই ছ’কুড়ি দিয়ে একটা ছাতা, তিন হম ষাট টাকা দিয়ে মুলোমুলি করে  হাজী নুঁয়োল নিয়েছিলেন মফজল সওদাগরের দোকান থেকে। মফজল সা’ব বেশ সুন্দর মানুষ। লোকে তাকে ধলাবুইরগ্যে ডাকে। পুরুষ মানুষ এতো সুন্দর হয় কেমনে! আসলে পুরুষ মানুষ নয়, তিনি দাদা মানুষ। ধবধোব্ব্যে সাদা দাড়ি, সাদা হরো’র পাঞ্জাবি আর পরনে চাইর আইত্ত্যে ডিলাক্স লুঙিতে মজ্জলাকে ফেরেস্তার মতো দেখায়।

 

দুনিয়া উল্টে যেতে পারবে, করিম বাজার শুক্কুর বারের বদলে শনিবার হতে পারবে, মাগার আঁবিচ্ছ্যে বাপোর ছাতি পড়বে না বগল থেকে। বগলে ছাতি নিয়ে আঁবিচ্ছ্যে বাপোর যাতায়াত ষাইট ইংরেজির তুফানের পর থেকে। হাঁটতে হাঁটতে ঠ্যাঙ মারি আসলে ছাতি ধরে হথন অনায়াসে বসে বিশ্রাম নেওয়া যায়।  দুইজন যখন জলকদরের জোয়ারের পানি কমে যাওয়ার সুলুকসন্ধান করছিলেন আচম্বিত ছাতি পড়ে গেলো আঁবিচ্ছ্যে বাপের বগল তল থেকে। সাথে সাথে তিনি ঠাঁডাল হাইয়া মাছের মতো দাঁড়িয়ে গেলেন। তাঁর মুখ দিয়ে আফসোসের সুরে বেরিয়ে এলো, ‘ আঁলাএর ভাইয়ুর! যুগ তো হারাপ অই গেইল্গ্যুই!’

 

এই কথা চাউর হতে বেশি সময় লাগলো না। এদিকে আঁবিচ্ছ্যের বাপো’রও বেশ মন খারাপ। গত ছচল্লিশ বছর যা ঘটেনি সেই ঘটনা ঘটে গেছে আজ দুপুরে। বাজারে মানুষ আসতে লাগলো। চাপাছড়ি, ইলশে, বাহারছড়া, হানহানাবাদ, গুনৌরি থেকে অনেকেই এসেছেন। ঈদের আগে লইল্ল্যে ইছের জোঁ পড়েছে। কেনা থাকলে লাল গরি হোলাৎ দিয়ে খেতে মজা এই চিংড়ি। বাজারে বিক্রি-বাট্টার ফাঁকে ফাঁকে সবার মুখে একই ডায়ালগ,

‘ আঁলাএএর ভাইয়ুর! যুগ তো হারাপ অই গেইল্গ্যুই!’

 

 

আলমগীর মোহাম্মদ, গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে