এখন সময়:দুপুর ২:৫৩- আজ: মঙ্গলবার-২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

এখন সময়:দুপুর ২:৫৩- আজ: মঙ্গলবার
২৫শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-১১ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-বসন্তকাল

যুদ্ধঘোরের মেটাফোর

নাসরীন জাহান

 

চারপাশে যখন কুয়াশার মিশেলে ছায়া আলো শিশিরের তর্ক চলছে, তখন বাবাকে ঘুমন্ত দেখে যেনবা ডায়েরি নিয়ে সন্তর্পণে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় অথই। তখন ঘুম নয়, এক আচ্ছাদিত প্রচ্ছায়া থেকে ফের যেনবা একটা শ্মশান ফুঁড়ে উঠে দাঁড়ালেন ইলিয়াস।

বিছানার নরম ব্যালকনিতে অবসাদে, শান্তিতে ফের আধ ঘুমে তলিয়ে পড়েন। এমন তুমুল নিখুঁত চারপাশের অন্ধকার… ফের আরও একটু চোখ মেলতেই প্রগাঢ় অন্ধকার, তিনি আমূল আচ্ছন্নে ঘুমের পাতালের অণুপরমাণুতে অল্প মাথা তুলে ফের তুমুল স্মৃতিমগ্নতায় সমর্পিত হয়ে পড়েন।

এরপর একটি নক্ষত্র চ্যুত হলে যেভাবে আসমান শূন্যে কাঁদে, রাশি রাশি বেদনার ঐশ্বর্যের মধ্যে নিমগ্ন ইলিয়াস দেখেন, সবুজের বুকের রক্তাক্ত হৃৎপিণ্ড… তাঁর কাছে সমস্ত দেশ, পৃথিবী যেনবা অফুরন্ত অন্ধকারে ডুবন্ত। কিন্তু তার অবচেতনে চক্কর খেতে থাকে… এদেশের বোদ্ধা পাঠকেরা তাঁকে সিরিয়াস লেখকের মর্যাদা দিয়েছে। এক সময় ইলিয়াসের অবচেতন আত্মা তাঁকে বারবার বলতে থাকে, আমি তো একজন আর্মি। কার কাছে কী লুকিয়েছি একেবারেই মনে পড়ছে না। কিন্তু আর্মি সত্তা বলছে, এক বিন্দু বিভ্রান্ত হলে চলবে না। কিন্তু তাঁর সর্বগ্রাসী অন্ধকার ভ্রমে বা বিভ্রমে এখনো তার চারপাশে তমস নিশিময়ীতার ঝালর বিছিয়ে দেয়। ক্ষয়িত হৃৎপিণ্ড বারবার বলছে তোমাকে এখনো উঠে পড়তেই হবে। এরপর ফের অবিশ্রান্ত প্রচ্ছায়া…।

এতক্ষণ কেউ তাকে ডিস্টার্ব করেনি, নিজেকে কিছুটা বিন্যস্ত করে শাসন করেন তিনি। যথেষ্ট আবেগ আর বুদ্বুদের ফরফরানি হয়েছে ইলিয়াস, এইবার তোমাকে পুরোপুরি সম্পূর্ণ জাগরিত হতেই হবে। সামনে সাংঘাতিক ভয়াবহতা অপেক্ষমাণ! তুমি যদি এখন বেঘোর ঘুম থেকে না দাঁড়াতে পারো, আর কোনোদিন জয়ী হতে পারবে না। পরাজয়ের সূর্যহারা গ্লানি আজীবন তোমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। চারপাশে যেন কিম্ভুত উড়তে থাকে যাতনাপিষ্ট মন দেহ, যেনবা উট টাইগার হয়, টাইগার টাকা হয়, টাকা শাপলা ফুল হয়, হরিণ পতাকা হয়, পতাকা রক্তাভ অক্ষর হয়… কে যেন অস্ফুট দৃঢ়তায় ডাকে, ইলিয়াস?… ইলিয়াস আচমকা দুচোখ খোলেন… অলৌকিকভাবে এই প্রথম একটু একটু করে… তারপর দুর্মর গতিতে ছুটতে ছুটতে তিনি কোটিতে সীমাহীন কোটি যা অন্ধকার, ঘোলাটে… সেসবের সম্পূর্ণ উল্টোমুখী ঘুরে দাঁড়ান।

এখন তাঁর দেহমনের অণু—পরমাণু হৃৎপিণ্ডের শাখা—প্রশাখায়, নিজেকে আচানক বিন্যস্ত করা সটান স্বাধীন দেশে নিরন্তর একটা জাদু খেলা, এর মতোই নিঃসীম ঘুম, তন্দ্রাকে ছুড়ে ফেলে মাথা উচ্চকিত করে নিজের মধ্যে তিনি ক্রমাগত পাক খেতে থাকেন।

এরপর বিছানায় পঙ্গু অবয়বের শাখা—প্রশাখার দিকে ছায়া চোখ মেলেন। ফের যুদ্ধদিনের দিকে দ্রুত ধাবিত হতে থাকেন। মন—মননেরও যেন তীব্র স্পৃহা থাকে, তিনি রীতিমতো ব্রত নেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের প্রত্যয়ে নিজের স্বপ্নপূরণের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্বাধীন দেশের জন্য লড়ে যাবেন।

মুস্তাফিজ বললেন, ইলিয়াস, ঠিক আছে, যতটুকু তুমি প্রত্যয়ী আবার বিভ্রমময়ও আমি বুঝে গেছি পুরোটা। যতই তা নিয়ে নিমগ্ন তুমি, যুদ্ধে এসে পাক্কা বুঝেছি, তুমি একজন দক্ষ লড়াকু।

ইলিয়াসের মাথায় ফসলের করোটি কুকায়। বলয়চ্যুত নক্ষত্রের মতো তিনি আকাশের সীমারেখায় ঝুলতে ঝুলতে মেরুদণ্ডে লাথি দেন, মুস্তাফিজ ভাই, আপনার অনুভূতির জন্য থ্যাংকস, আমার সম্পর্কে আপনার এই দৃঢ় উচ্চারণে আমি কতটা পজেটিভ প্রভাবিত হয়েছি, আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। শালা কুত্তার বাচ্চা পাকিস্তানি আর্মি, আমাদের রক্তচোষা ঢোল মশারা, আসলে মিথ্যেই নিজেদের দৈত্য… অজগর ভাবে, এক্ষুনি দু আঙুলের চাপে ফেলি দেখবেন,… হাসতে থাকেন মুস্তাফিজ ভাই, মশা মেরে হাত লাল ভুলে যাও, যেভাবে আছো, সেভাবেই অটুট প্রত্যয়ে থাকো, তার মুখ থেকে কথা ছিনতাই ইলিয়াসের, মুস্তাফিজ ভাই, আপনি দেখবেন বঙ্গবন্ধুর জন্মশত্রু পশ্চিম পাকিস্তানিরা আর একবার যদি বেইমানি করে, শুয়োর পাকসেনারা… ইলিয়াসের চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।

মুস্তাফিজ বললেন, ওকে থামো, উত্তেজনা এখন প্রশমিত করো। কবে কোন বড় লেখক ছিলে ভুলে যাও… । ক্রমশ ইলিয়াসের চোখে চক্কর খায় রাক্ষুসে হাতি দাঁত, গোখরোর বিষ… হাঙ্গরের হিসহিস, আফ্রিকার দৈত্যগাছের আক্রমণ।

এর মধ্যে ঘোরাচ্ছন্ন তন্দ্রাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুটো মারাত্মক সম্মুখযুদ্ধ ইলিয়াসের কৌশলী বুদ্ধি আর অনবদ্য শক্তির জন্য সাফল্যের মুখ দেখেছে।

মুস্তাফিজ ভাই, দলের অন্যদের সঙ্গে আলতাফ ভাই ও ইলিয়াসকে আমূল জড়িয়ে ধরে বলেছেন, ব্র্যাভো!

একসময় এই চিত্র থেকে সরে ইলিয়াস পাকসেনাদের কাছে অহর্নিশ বিমূর্ত আবহে ঘুরপাক খেতে থাকেন। স্ত্রীর ভেজাচুল মোড়ানো লাল ডোরাকাটা গামছার স্মৃতির নিস্পৃহতায়ই কী? তিনি বিড়বিড় প্রত্যয়ে বলতে থাকেন, আমি ততক্ষণ শান্ত হব না যতক্ষণ আমার আত্মা পাঁজরের দাহ না নেভে। এখন বলুন মুস্তাফিজ ভাই, আমাদের এই মুহূর্তে কী করা উচিত?

লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কপালের কষ্ট ভাঁজ প্রশমিত করে মুস্তাফিজ ভাই বলেন,

ইলিয়াসের সম্মুখে ধেয়ে আসতে থাকে নেকড়ের ভয়ংকর থাবার মতো যেনবা আগডুম বাগডুম কিছু।

পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তুমুল যুদ্ধের জন্য নিজের আত্মার সঙ্গে বিড়বিড় প্রমিজে কথা দেন, এই যুদ্ধে যদি জয়ী হতে পারি, এরপর যদি আমার মৃত্যু হয়, আমার হৃদয় সূর্যের জ্বলনে, হাড়মাংসসহ নিঃসীমে যদি উবেও যায়, আমি হাসতে হাসতে নিজেকে শহিদ ভাবার অনন্ত প্রেরণা পাব।

 

দিন, মাস ধরে এ্যাদ্দিন প্রতিটি আক্রমণে জয়ের পর নতুন উদ্ভাসনে তিনি যেমন আকাশের সামনে টানটান দাঁড়াতেন, তেমনই দাঁড়িয়ে প্রথমে ফিসফিস যেন…পর মুহূর্তে তার সফেদ হৃদয়ে গ্লানির ধিক্কার তোলপাড় করতে থাকে, বিষাদ ঘোরের অনন্তে ডুবে নিজেকে বলেন, ধিক! ধিক ইলিয়াস নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম নয়? বিনিময়ে শহিদ হওয়ার লোভ? তিনি অপরাধবোধে মাটিতে ভূলুণ্ঠিত হয়ে সৃষ্টিকর্তার দিকে ক্ষমার হাত তোলেন।

কিছুটা প্রশান্তি মেলে। এরপর ধীরে ধীরে মুস্তাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে রেডিও ঘুরান। আহ… কী অপার্থিব! এই বজ্রকণ্ঠের উত্তাল ভাষণ কী অসাধারণ! তীব্র বায়ুপ্রবাহের মতো তোলপাড় করা অনন্ত ভাষণ! এর সঙ্গে অন্য আর কিছুর তুলনা হয় না! ইলিয়াসের দেহ শিরশিরে গাঙ ঢেউয়ের আছাড়ি—বিছাড়ি খায়। কোথায় পাকসেনারা ব্রিজ ভেঙে চুরমার করেছে, কোথায় রেললাইন উপড়ে দুর্মর অ্যাক্সিডেন্ট ঘটিয়েছে এর দ্রোহ শিরায় শিরায় ঢেউ খেলে… সেই সুন্দর ভাষণের তরঙ্গে তুমুল প্রতিশোধ স্পৃহা ইন্দ্রিয়, আত্মা করোটিকে ঝক্কাস ধাক্কা দেয়।

ক্রমশ দুজন উঠে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর অন্য সব আঙুল ভুলে প্রিয় নেতার সঙ্গে নিজেদের একমাত্র তর্জনী উচ্চকিতে তোলেন।

মনে পড়ে, কালুরঘাট রেলওয়ে সেতুর কাছে একাত্তরের ১৬ এপ্রিল এক মারাত্মক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। প্রথমে আর্মির বড় অফিসার আলতাফ ভাইয়ের নেতৃত্বে যুদ্ধের লড়াইয়ের মধ্যে পুরোপুরি ইলিয়াসরা ঢুকে পড়েন। নিজ ঘরের বিছানায় যেনবা ফের দেহে কোনো এক ঘা খেয়ে ইলিয়াস নিজেকে বিন্যস্ত করতে নিজেকে গভীর ঘুমের দিকে ঠেলে দিলে অথই আচ্ছন্ন আলোর নিচে বাবার ডায়েরিতে সাঁতার কাটতে থাকে।

 

একদিন ফজরের নামাজের পরপরই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আক্রমণ করে। এ আগ্রাসন কতটা ভয়াবহ কেউ এর আগে কল্পনাও করতে পারেনি। রীতিমতো চিল চমকানো আক্রমণ!

আমরা কতটা প্রস্তুত ছিলাম মনে নেই, আমরা যখনই এমন ভয়ংকর অবস্থার মুখোমুখি হতাম তখনই কী এক প্রত্যয়ে তর্জনীর দিকে তাকিয়ে তুমুল প্রেরণা পেতাম, ২৬শে মার্চের পর চট্টগ্রামে আর্টিলারি মর্টারসহ বিভিন্ন ধরনের মেশিনসহ অনেক ভারী অস্ত্র ব্যবহার করি। আলতাফ স্যারসহ যতটুকু মনে পড়ে, আমাদের তিনজন অফিসার আরও কেউ কেউ সেখানে ছিল, এই মুহূর্তে সবার কথা মনে পড়ছে না, একেবারেই অপ্রস্তুত ছিলাম আমরা। মনে হচ্ছিল, বিশাল আসমান থেকে, তার চাইতেও বিশাল নক্ষত্রচ্যুত হলো। প্রতিটি যুদ্ধ এবং প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সবাই সচেতন থাকলেও মাঝে মাঝে যখন ইন্দ্রিয় কুপ্রচ্ছায়ার বিন্দু পর্যন্ত দেখতে পেত না, তখন আমি কেমন যেন মুহূর্তের তন্দ্রায় টার্ন নিয়ে স্মরণ করতাম, কন্যা অথইয়ের উচ্ছ্বাস হাসিময়তার মধ্যে দৃঢ়তার অবয়বের প্রত্যয় ধ্বনি এদেশের নামকরা লেখক ছাড়াও যুদ্ধের আগে আমি আর্মি ছাড়াও একজন মনোবিদ্যার ডাক্তার ছিলাম। মুস্তাফিজ ভাই আমাদের বিল্ডিংয়ের গা ঘেঁষাঘেঁষি ছিলেন। তারও একমাত্র কন্যা অথইয়ের মতো কিশোরী।

আমি জাগরণের ফাঁকে ফাঁকে একদিকে উন্মাতাল দিনরাত্রির কোলাজ অন্যদিকে হাহাকার সময়ের দিনলিপি অল্প করে করে ডায়েরিতেই নিজের অভিজ্ঞতা আর অনুভূতি নাককান সতর্ক রেখে টুকে টুকে রাখছি।

অথই এবার কী এক কাতরধ্বনি শুনে ঘরের দিকে ছুটে যায়। বাবার পাশে হাতপাখা হাতে মেঝেতে বসে মা আধ ঘুমন্ত। সে যথারীতি নিথর চোখে শয্যাশায়ী বাবার ছায়াচ্ছন্ন অবয়বের দিকে তাকায়। যেনবা অন্ধ চিৎকার ফালি ফালি শব্দে বাবার নিকষ কষ্টের নিঃশ্বাস ওঠানামা করছে! অথইয়ের হৃদয় কেন এমন দৃশ্যে প্রতিবার আত্মার দেয়ালে আছড়ে পড়ে আহা!

অথইয়ের টিচার এলে সে সযত্ন জায়গায় ডায়েরি রেখে মাকে বলে, একগ্লাস পানি। মা পানি আনতে গেলে অথই যখন টিচারের সঙ্গে চেয়ার টেবিলে নিমগ্ন তখন এবার ইলিয়াস যেনবা ছায়াচ্ছন্ন সীমান্তের মেরুরেখা পেরুচ্ছেন, এরপরও অথইয়ের নিমগ্নতার সুতো ছিঁড়ে না।

ইলিয়াস কখনো কেয়ার বিন্যস্ত করে দেওয়া চেয়ার টেবিলে বসে মনের জোরকে ধাপিত করে কখনো উপন্যাসে লেখেন, কখনো বিশ্বসাহিত্যের বইয়ের অক্ষরে নিজেকে ডুবিয়ে, কখনো অথইয়ের হাতে দেওয়া ডায়েরির অক্ষর কানে যেন হর্ন বাজায়, কখনো ক্লান্ত বেদনার শয্যাশায়ী অবয়বে ভাবেন, আজীবন হয় হুইলচেয়ার নয় ক্র্যাচে ভর দিয়ে?

এমন ভাবনা বিমর্ষতার দিকে নিজেকে ধাবিত করতেই যেন ধিক! উচ্চারণ করে খোলা আকাশের নিচে দাঁড়ান। এদেশের লক্ষ লক্ষ শহিদের কোরাসের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে জয়বাংলা তরঙ্গে ভেসে যেতে থাকেন।

… ধীর পায়ে বেরিয়ে ফের অথই ডায়েরির আক্ষরিক নিজেকে ফের ধাবিত করে।

সারা দিন যুদ্ধ শেষে আমার, মুস্তাফিজ ভাইয়ের মনে পড়ে তিন দিন কী চারদিন আমাদের টানা যুদ্ধের মধ্যে কেটেছে। কত দিন এখনই মনে পড়ে যায় কোথায় পাকসেনারা তাঁবু গেড়েছে। বৃষ্টির ঋতু ওদের ভীষণ বিপর্যস্ত করে। প্রতিনিয়ত তখন আমরা মুহুর্মুহু তাদের আক্রমণে ধ্বংসের চূড়ান্তে নিয়ে ফেলি। এখন হেমন্ত গড়ায়িত, ওদের নিমজ্জনে আমাদের কান খাড়া। আক্রমণ শেষে ফিরে এসে দুর্মর যাতনার মধ্যে ক্লান্তিতে ঢলে পড়তে পড়তেও… মনে পড়ে, মুজিবের পছন্দমতো তখন বেলি ফুল অদল—বদল করে বিয়ের একটা ছোট্ট হিড়িক পড়েছিল। বিয়েতে সিম্পল আর যা যা করতে হয় সব শেষ করে, কেয়া আর আমি যুথবদ্ধতার মধ্যে আমূল ভালোবাসার সুন্দরতম গভীরতার মধ্যে ডুবে গিয়েছিলাম।

এখনো আমরা একজন আরেকজনের প্রগাঢ় ভালোবাসা থেকে বিচ্যুত। কী এক কারণে কেয়া যুদ্ধে আসার পর থেকেই বলা যায় কোনো চিঠি লেখেনি। এ নিয়ে অথইকে প্রায়ই চিঠিতে প্রশ্ন করলে কী যেন এড়িয়ে জানায়, সব ঠিক আছে। যুদ্ধে তার ওপর দিয়েও যে ভয়াবহ ট্রমা বয়ে গেছে যা থেকে সে কিছুতেই বেরুতে পারে না, এইসবই আমি যুদ্ধ শেষে বাড়ি এসে শুনেছি। কিন্তু একমাত্র কন্যা অথই যে বয়সের চেয়ে অনেকে বেশি মেধাবী, সৃষ্টিশীল। অসাধারণ কবিতা লেখে ও। অথই আমাদের হাজব্যান্ড ওয়াইফের সমুদ্র থেকে দোদুল্যমান কিন্তু তেজস্বী হীরক কন্যা। আমাদের পাঁজরের প্রান্ত নিঃশ্বাস ধ্বনি…। ক্রমশ কেয়ার বিষাদ দূর করানিয়া মমতার সেতু।

অথই অনেক আবেগপ্রবণ হলেও দৃঢ়তায় সে আমার আর কেয়ার গার্জিয়ান যেন। যেন সে এমন ভ্রম্নণ থেকে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই। আমাদের দেশপ্রেম, মুজিব প্রেম তার তরঙ্গে তরঙ্গে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই প্রতিনিয়ত প্রবাহিত হেসে হেসে বলেছে, আব্বু তুমি এখনো যুদ্ধে যাচ্ছ না যে? অন্যদিকে মুস্তাফিজ ভাইয়ের মেয়ে জয়িতা বয়সের তুলনায় অনেক অবুঝ। তার স্ত্রী নাসিমাও তেমনই। নাসিমা অবশ্য যুদ্ধ শুরু হওয়ার শুরুর অনেক আগে থেকে প্রগাঢ়ভাবে বঙ্গবন্ধুর অনুসারী হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার তুমুল প্রেরণা দিয়েছিল। আমরা প্রাণের সহস্র সীমানা দিয়ে মেনে নিয়েছিলাম, আমরা বঙ্গবন্ধুর এবং একমাত্র তিনিই এদেশের লক্ষ কোটি মানুষের  সর্বশ্রেষ্ঠ নেতা। তার জেলবন্দি জীবন থেকে শুরু করে আরও সব বিপজ্জনক যুদ্ধের সম্মুখীন সম্পর্কে বিন্দু বিন্দু অবহিত হয়ে আমরা দুজনই তার কীর্তি অটুট প্রত্যয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু যুদ্ধে আসার আগে আমার মনটা অদ্ভুতভাবে বলেছে, দৌড়াও, আর দেরি নয়, এখনই ছোট… তখন নিজের আজীবনের আত্মবিশ্বাসী স্বভাব ছেড়ে আচানক কেয়া একটু দ্বিধাগ্রস্ত—আমার মনটা কু ডাকছে গো। কেয়ার কিছু সময়ের জন্য অন্ধবিশ্বাসে চারপাশ ফালি ফালি করে বিস্ময়ে মার দিকে অথই তাকায়, আম্মুু? তুমি ভয় পাচ্ছ? তুমি?

মুহূর্তে কেয়া যেন ইউটার্ন নিল, যখন আমি বেরোনের ঝটপট প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, মা মেয়ে আমার ঘনিষ্ঠবর্তী হয়ে বলল, গিয়ে জয়ী হয়ে ফিরে আসো, আমরা অপেক্ষা করব।

অথই অবশ্য একটু ফিসফিস ধ্বনি আবেগে বাড়তি বলেছে, আমি নিজেকে আমি যতই শক্ত করি আব্বু, আসলে আমি আম্মুর মতো অপেক্ষা করতে পারব না। তুমি মাঝে মাঝেই তোমার অবস্থার কথা আমাকে অবশ্যই চিঠি লিখে কাউকে—না—কাউকে দিয়ে জানাবে।

কিন্তু জয়িতা এবং তার মা নাসিমা তুমুল আবেগে ভেঙে চুরচুর হয়ে সব প্রত্যয় ভুলে আপ্লম্নত আমূল ভেঙে পড়ে মুস্তাফিজ ভাইয়ের যুদ্ধের পথে কঠিন বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুতেই তুমি যেয়ো না… আমার গর্ভে আমাদের সন্তান এসেছে, দুমাস গোপন রেখেছি, নিশ্চিত হওয়ার জন্য। আমাদের গর্ভের সন্তানের দোহাই, প্লিজ আমাকে এ অবস্থায় রেখে যেয়ো না।

এরপর মুস্তাফিজ ভাই কিছুক্ষণের জন্য গর্ভসন্তান… একরকম শিহরিত রিন রিনে বোধে প্রচণ্ড অভিভূত হয়ে পড়েন। মুহূর্তের মধ্যে ফের নিজেকে উল্টোমুখো দাঁড় করান। এরপর রীতিমতো ঘর থেকে ছুটতে ছুটতে বেরিয়ে বলেন, আমার কিন্তু আরেকটা মেয়েই চাই, বাকিটা ভাগ্যে যা লেখা আছে। জয়িতা, তুই না আমার সাহসী বাচ্চা? মা—কে দেখিস।

এরপর প্রতিনিয়ত রুদ্ধশ্বাস লড়াইয়ের মুখোমুখি। গেরিলা যুদ্ধে ওরা আমাদের সহযোদ্ধাদের যেভাবে আক্রমণ করে আহত মৃত্যুময় রক্তপ্লাবনে ভাসিয়েছে, আলতাফ ভাইয়ের বজ্রকণ্ঠ তেপান্তরে আছড়ে পড়ে, ইলিয়াস! আমরা এরচেয়ে কোটি গুণ প্রতিশোধস্পৃহায় ওদের রক্তস্রোতে ভাসাব।

সেদিন কুয়াশায় চারপাশ যখন বিকেলেই অন্ধকারাচ্ছন্ন, ঢাকা যাওয়ার ট্রেন ছাড়ল বিকেল পাঁচটায়। পনেরো দিন আগে এমন চিঠি আসার পর ওদিকটা চুপ হয়ে গেলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন। মুস্তাফিজ ভাইয়ের স্ত্রীর গর্ভেই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে, তার নিজের অবস্থায়ও খারাপ। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ—এর বাস ধরে মুস্তাফিজ ভাই এক চিমটি স্ত্রীকে দেখেই ফিরে আসবেন, তাঁর এমন অনুভবে সঙ্গ দিতে স্টেশনে এসেছি তাকে ছাড়তে। সন্ধে নামা পর্যন্ত দেখি, মাঝে মধ্যে পুল পাহারা দিচ্ছে হানাদার মাছুয়ারা। কোমরে শেকল বাঁধা আর সঙ্গে ফিস প্লেটে তালা লাগানো। মুক্তিবাহিনীর ভয়ে যাতে কেউ পালাতে না পারে। তাই এই শিকল তালার ব্যবস্থা।

ক্যাম্পে ফেরার পর জাস্ট কয়েক ঘণ্টা গেছে, হঠাৎ দেখি হাঁপাতে হাঁপাতে মুস্তাফিজ ভাই ফিরে এসেছেন, বলেন, কিছুক্ষণ পরেই নাকি হানাদাররা ট্রেনে উঠে গণহত্যা চালিয়েছে, কীভাবে বেঁচে এসেছি, থ্যাংকস গড!

চারপাশ পুরোদিন স্তব্ধ। গুমোট গাছের ছায়ায় হেলান দিয়ে শিশির কুয়াশার হেমন্তের ধীরলয়ের কালচক্রের দিকে ঠায়, নিঃসাড় তাকিয়ে থাকি। এরপর খানিকটা অপ্রস্তুত আমরা! মুস্তাফিজ ভাই ফেঁাকর গলিয়ে কোনোভাবে পালিয়ে এসে তীব্র গ্লানিতে ভুগছেন, আমি কেন পালালাম? কেন একাই যুদ্ধ করে শহিদ হলাম না?

পরক্ষণেই আলতাফ ভাইয়ের তীব্র হুঁশিয়ার ধ্বনি, কতবার এক কথা বলব, এখানে আমরা শহিদ শহিদ খেলতে আসিনি। যখন দেখবে এক বিন্দু বাঁচার উপায় নেই, তেমন অবস্থায় গা ঢাকা দেওয়ার কৌশল জানাও কম বীরত্বের কাজ না। প্রত্যেকটা মুক্তিযোদ্ধার দেহের প্রাণের মূল্য আছে। সবাই শহিদ হলে যুদ্ধটা করবে কে?

যা হোক দুদিন পর হঠাৎ আমাদের ওপর তুমুল আক্রমণের ঘ্রাণ টের পাই। তৎক্ষণাৎ আমরা নিজেদের প্রস্তুত করে ফেলি। বুকের মধ্যে দাউদাউ উত্তাপ ধ্বনি! আমরা প্রস্তুত হওয়ার মুহূর্ত আগে বিশাল বাহিনী মেশিনগান ব্যবহার করে তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদেশের সবাই জানি তখন ভারতের কাছে কত ভাগ ঋণী ছিলাম। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রগাঢ় বন্ধুত্বে তারা অস্ত্র তো বটেই যেসব সেনাবাহিনী, যতজন লাগবে ততজনই সেনাবাহিনী দিয়ে তারা এদেশকে প্রাণপণে সাহায্য করেছে। কিন্তু সেই হিমহিম বিষাক্ত স্রোতস্বী বিপরীত সময়ে তেজি অস্ত্রগুলি যেনবা অসহায়তার নিষি্ক্রতার অতলে পড়ল।

আমরা সমুদ্রে পড়া কানকোহীন মাছ। জলে আমাদের মাথা অব্দি ডুবে গেছে। এরপর কখনো মনে হতো অটুট প্রত্যয়ে ঘুরে দাঁড়ানো, কখনো মনে হতো এই বুঝি ডুবে গেলাম… শেষ অব্দি প্রত্যয়ের তীব্রতাই জয়ী হতো।

যা হোক, একে একে আমরা মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে দুর্মর গতিতে ওদের দিকে এগোতে থাকি। এদেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে কৃষক পর্যন্ত আগরতলায় ট্রেনিং নিয়েছিল। যদিও ভাগ করা ছিল কে কোথায় নেতৃত্ব দিবে। কে কখন গুলিবিদ্ধ সে সম্পর্কে আমাদের কারও হুঁশ ছিল না। আলতাফ ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা ক্রমশ সামনের দিকে এগোতে থাকি। তিনি বলেছিলেন, যতদিন যুদ্ধ চলতে থাকবে, স্যার নয় ভাই সম্বোধন করবে।

তুমুল যুদ্ধেও কিন্তু আমার সম্পূর্ণ হুঁশে থাকে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুস্তাফিজ ভাইয়ের কথা। তিনি বলতেন, আলতাফ ভাই আর্মির হেড, বলো কীভাবে তাকে ভাই বলে ডাকি?

আমি বলি, তাতে কি? তখনকার বাস্তবতা আলাদা, যুদ্ধের সময় আবার স্যার কি? অতঃপর সর্বগ্রাসী অন্ধকার, ইন্দ্রিয় বেদনা, ক্ষয়িত হৃৎপিণ্ডের ছায়া বিস্তারিত মাঝখানে ছারখার আসমান, সমস্ত জল তেপান্তর।

ধুঁধুঁ খেতের ওপার থেকে নিঃশব্দে ওরা এগিয়ে আসছিল, আমরাও পুরো দেহ কচুরিপানায় ঢেকে বিড়াল বুকে এগোচ্ছিলাম।

এমন ভয়ংকর এরপরও আক্রমণ! পুড়ে গেছি কিনা সহসা বুঝতে পারি না, এরপর আমি নীল রঙের বুদ্বুদে একপলক চেয়ে দেখি মুস্তাফিজ ভাইও রুদ্ধশ্বাস গতিতে লড়ে যাচ্ছেন। একসময় অনুভব করি আলতাফ ভাইয়ের মুহূর্ত অজ্ঞাতে পেছন থেকে কান ফাটানো গুলির শব্দ ধেয়ে আসছে। মুহূর্তের মধ্যে আমি ইউটার্ন নিয়ে তেজি ক্রুদ্ধতায় সাঁই সাঁই করে ওদের ওপর মারণাস্ত্র চালাতে থাকি। তারাও এই যুদ্ধের জন্য এক বিন্দু প্রস্তুত ছিল না। মুহূর্তে ওদের ভূপাতিত করে ঘুরে দাঁড়ালে আলতাফ ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরেন শাবাশ!

আচমকা বঙ্গবন্ধুর তর্জনী অনন্ত আত্মায় জাস্ট একফালি ভেসে ওঠে। প্রগাঢ় অনুভবে প্রত্যয়ী চেহারা সিনা টান… এরপর বিড়বিড় করে বলি, দেখি শুয়োরের বাচ্চারা কীভাবে আমাদের পরাস্ত করে? উত্থান দেহে যতই এগিয়ে যেতে থাকি, যথাসম্ভব গুলিতে পরাস্ত করে ভূলুণ্ঠিত করতে করতে, ততই আমরা মুহুর্মুহু উল্লাসে ফেটে পড়তে থাকি।

এ অবস্থায় একসময় পর আমাদের গুলি ফুরিয়ে যায়। অস্ত্র ছিল, গোলাবারুদ ছিল না। মুহূর্তে আমরা মারাত্মক অসহায় অবস্থার মধ্যে পড়ি। আলতাফ ভাইয়ের কণ্ঠ ঝনঝনিয়ে ওঠে, ধৈর্য ধরো,

এরপর ফের প্রচ্ছায়া কখনো কঠিন সচেতনে কখনো প্রায় অচেতন আমি নিজের অবয়ব ঠাহর করতে পারি না সহসা। এরপর অবিশ্বাস্য চোখে দেখি শ্রমিক, গুলি চালাতে থাকা নারী যেনবা এদেশের সব যোদ্ধা খেতের কিনারে রাখালের করুণ বাঁশি, যেনবা মেটাফোর, আদিম ছাতিম তলে কুয়াশার পেইংটিং ফুঁড়ে কোন দেহ আসমান ধেয়ে মৃত্তিকায় পতিত হচ্ছে। ঘোর অবিশ্বাস চোখে দেখি, মুস্তাফিজ ভাই মারাত্মকভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে রক্তের তলায় ডুবে যাচ্ছেন। আলতাফ ভাই মুস্তাফিজ ভাইয়ের সঙ্গে আমার আবেগী সম্পর্কের কথা জানতেন। আমরা যখন ভাষাহীন স্তব্ধতায় স্থবির, মুস্তাফিজ ভাই কীভাবে যেন কোন অদম্য শক্তিতে উচ্চকিত বিড়বিড় কণ্ঠে বলতে থাকেন, আমার কথা ভুলে যাও, সবাই হারলে আমিও যে লক্ষতে এক শ কোটি হেরে যাব।

পুরো যুদ্ধের সময়টাই বলা যায় আমার স্বপ্নে বাস্তব ঘোর লড়াইয়ে কেটেছে। যেখানে বেশির ভাগ সময় বাস্তব জয়ী হয়েছে। মনে পড়ে, যুদ্ধ শুরুর দুমাস পর এক মিশনে গোপনে ওঁত পেতে ছিল তারা। একসময় গা হিম করা এক দৃশ্য দেখি, উঠোনে হয়তোবা নাতনিকে নিয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন এক চামড়া কুঁচকে যাওয়া বয়সের ভারে নুয়ে পড়তে থাকা এক বৃদ্ধা। নিচে একটা ধান কাটার কাস্তে পড়েছিল। পাকসেনারা তাকে ঘিরে উর্দুতে কাস্তেটা তুলে দিতে বলে, বৃদ্ধ নুয়ে পড়ে কাস্তেটা তাদের হাতে দিয়ে তির তির কাঁপতে থাকে। কিন্তু শিশুটি জমিনে পড়ে চিৎকারে ফেটে পড়ে।

এক সেনা শিশুটির গলায় পা রেখে সাঁই করে বৃদ্ধটির শিশ্ন কেটে ফেলে প্রথম, বৃদ্ধটি ছিটকে ভূলুণ্ঠিত হতে হতেই আসমান জমিন ফাটানিয়া চিৎকারের মধ্যে মুহূর্তে ওরা এক দু করে হাত—পা কাটতে থাকে। পুরো জমিন রক্তে থই থই—এর মধ্যে ওরা যখন অট্টহাসিতে মেতে উঠেছে, আমি মুহূর্তে মুক্তিযোদ্ধার সমস্ত নিয়ম রুটিন প্রবণতা খুইয়ে ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে অস্ত্র হাতে ছুটে ধাবিত হতে চাইলাম ওদের দিকে।

আমাকে রীতিমতো খাবলা দিয়ে আটকান আলতাফ ভাই, পাগল হয়েছ? এখনো আমাদের সময় হয়নি। এই যুদ্ধে আমি এমন অনেক নৃশংস দেখেছি। একবার এক বিশাল মাঠে প্রায় একশজন নারীপুরুষকে এক সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে ওরা যখন মারণাস্ত্র তাক করে একেকজনের সঙ্গে নানারকম রসিকতা করছে, সেই ভিড়ের পেছন দিকে সাধারণ পোশাকে এক শিশু কোলে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুস্তাফিজ ভাই। পাকসেনারাও সংখ্যায় অনেক ছিল। একসময় বিদ্যুতের মতো গুলি ছুটতে থাকল। মুহূর্তের মধ্যে রক্তসমুদ্রের মাঠে দাঁড়িয়ে বজ্জাতগুলো সারি বেঁধে হিসি করতে শুরু করে। মুস্তাফিজ ভাইয়ের কোল থেকে শিশুটি ছিটকে গিয়েছিল। তিনি লাশ স্তূপের নিচে প্রায় দম আটকে নিঃসাড় পড়েছিলেন। যেন ভূমণ্ডল ফুঁড়ে আমাদের তাজ্জব করে সেই মৃত্যুস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন মুস্তাফিজ ভাই।

ফিরে আসার পর মুহূর্তেই আলতাফ ভাই দক্ষতার সঙ্গে আমাদের নিয়ে সেখানে পেঁৗছলে আমরাও সেই পেশাব করতে থাকা পাক আর্মিদের অট্টহাসির টুঁটি চেপে মুহূর্তের মধ্যে সব কটা পাক আর্মিকে শ্মশান সমুদ্রের যমদূতের হাতে পেঁৗছে দিই।

যুদ্ধের রুটিন না মেনে আমি নিজেও বলতে পারব না, কীভাবে এই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলাম আমিই। আলতাফ ভাই লড়াই শেষে আমাকে প্রথমে এমন আবেগী ছেলেমানুষী ফের না করতে কঠিন নির্দেশ দিয়ে পরক্ষণেই বুকের সঙ্গে আমূল মিলিয়ে বললেন, ইউ আর গ্রেট ইলিয়াস। যুদ্ধ আমাদের মতো কতজনকে এমন কত যে লোমহর্ষক স্মৃতির মুখোমুখি করছে! মাঝে মাঝেই আমি আর আমি থাকি না, মনোডাক্তার থাকি না। মনস্তাত্ত্বিক লেখকের চরিত্র বনে যাই।

এইবার সেই অবস্থা রীতিমতো চূড়ান্তে গিয়ে পেঁৗছায়।

আলতাফ ভাইয়ের কণ্ঠ যেনবা ঝাপসা শোনায়, তোমাকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে, একটু ধৈর্য ধরো, আমি দ্রুত তোমাকে কাছের তাঁবু হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি।

এবার সেই ভয়াবহ আক্রমণের মুখোমুখি পাল্টাপাল্টি আক্রমণ হচ্ছিল। একসময় ওরা পিছু হটেছে পাক্কা নিশ্চিত হয়ে আমরা ক’জন জাস্ট জিপে এসে বসেছি, কোত্থেকে যেন ভূতের মতো ক’জন পাক আর্মি জিপের সামনে এলে ঝাপসা চোখে দেখি বরাবর গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালাতে চাইলে মুস্তাফিজ ভাই মুহূর্তে লুটিয়ে পড়েন। আমি হতবিহ্বলতার মধ্যেই আলতাফ ভাই মুহূর্ত ইশারায় ওদের পেছনে ধাওয়া করে সবকটাকে মাটিতে মিশিয়ে ফের জিপে ফিরে আসেন। এরপর রক্তাপ্লম্নত মুস্তাফিজ ভাইকে হারি আপ দেখে ওকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে, এর মধ্যে বেঁচে থাকা আরও পাকিস্তানি বেইমানগুলো যেহেতু অনেকটা ক্লান্ত, আমি কিছুক্ষণের জন্য ওদের বিশ্রাম চাইছি। আমার কানে আলতাফ ভাইয়ের কোনো শব্দাবলি পেঁৗছায় না। আমার চোখে তখনো একটি বৃহদাকার নক্ষত্রচ্যুত্যের বিকট শব্দের বিবর। আমি মুস্তাফিজ ভাইয়ের ওপর লুটিয়ে পড়ি। শুধু একবার আপনি নাসিমা ভাবির কথা ভাবুন। আমার কণ্ঠে কুয়াশার বরফ জমতে থাকে যেন, আলতাফ ভাই উত্তেজিত, হারি আপ, কে আছেন… কুইক হাসপাতালে…

এরপর ধূমায়িত হেমন্তের প্রচ্ছায়া ছিঁড়ে সবাই মুস্তাফিজ ভাইকে অ্যাম্বুলেন্স উঠালে মুস্তাফিজ ভাইয়ের ধীরলয় কণ্ঠের ধেঁায়াশা ধ্বনি… ইলিয়াস, আমি চলে যাচ্ছি, নাসিমা শিক্ষিত, কিছু একটা করে জয়িতাকে নিয়ে দিব্যি চলতে পারবে, এরপর ওদের দায়িত্ব আমি তোমার ওপর ছাড়লাম… আমি তাঁর দেহটা নবজাতকের মতো কোলে তুলতে চাই যেন, চুপ মুস্তাফিজ ভাই, বি—পজেটিভ, কিছু হবে না আপনার, কিন্তু তার বিলীয়মান কণ্ঠধ্বনির কুহক শিরশির করে আহ! আমি আমার জয়িতার মুখটা দেখে যেতে পারলাম না!

আমার শিরায় শিরায় রোদন, একসময় মুস্তাফিজ ভাই নিস্তেজ হয়ে গেলেন। আমি যখন মৃত্যু আর জীবনের সীমান্তে আছি কি আছি না এমন দশায় অস্ফুট চিৎকার আকুলে ঘোর খাচ্ছি তখন আলতাফ ভাই যেন আমাকে বিস্ময়তার ঘোর ভেঙে দুর্মর এক হেঁচকা টানে দাঁড় করান। আমরা সবাই তো মৃত্যুর প্রস্তুতি নিয়েই এখানে এসেছি। ইলিয়াস! বাহাদুর বাচ্চা আমার। শান্ত হও, তার কণ্ঠস্বর স্রোতস্বী কান্নায় কাঁপতে থাকে। তিনি ফের বলেন, ঘুরে দাঁড়বে তুমি, আমি নিশ্চিত জানি, বরাবরই তো তুমি আমাদের একেকটা চমক দেখাও! অ্যাম্বুলেন্সে আর যারা ছিলেন, তাদের মধ্যেও গুমোর কান্নাধ্বনি! কিন্তু আলতাফ ভাইয়ের প্রত্যয়ী কণ্ঠ আমাকে, আমাদের যেন নিজ নিজ সত্তার ভূমণ্ডল থেকে ওপরে টেনে তোলে। এরপর সব ইন্দ্রিয়কে নিজের আমূল অস্তিত্বকে বুদ্বুদে ছেড়ে দিয়ে যাতনায় ফিসফিস কান খুলে রাখলাম, আলতাফ ভাই এখন কী করতে হবে, প্লিজ আলতাফ ভাই বলুন।

আলতাফ ভাই বলেন, আপাতত ওরা কিছুটা ক্লান্ত। কিন্তু ওদের কোনো গ্যারান্টি নেই। চল… চল… এখান থেকে যত দূরে যাওয়া যায়।

কোথা থেকে যেনবা খামারের পোড়া ইটের গন্ধ ভেসে আসে। সহসা নিজেকে ঘুরিয়ে আমরা সেখান থেকে নিজেকে উইড্র করে রক্তসমুদ্রে ভাসতে ভাসতে আলতাফ ভাইকে অনুসরণ করে দ্রুত গতিতে পার্বত্য চট্টগ্রামের মহালছড়িতে চলে যেতে থাকি। নিজেকে তীব্র বেদনাহত ছুরিবিদ্ধ ডাহুক, হরিণ, ঘোড়া কখনো কখনো কর্পূর ভ্রম হতে থাকে। আলতাফ ভাইয়ের নির্দেশে আহত মুখ তুলি, হ্যঁা, এই রাস্তাই ঠিক, ড্রাইভার, জোরে চালাও…। একটা চিন্তা ছিল, যদি আমরা ফাইট করতে করতে কক্সবাজারের দিকে চলে যাই, তবে আমাদের অন্য কারোর সঙ্গে যোগাযোগের উপায় থাকবে না।

কিছুক্ষণ পর আমরা দ্রুত টার্ন নিয়ে একটা হাসপাতালে তাঁবুর সামনে গাড়ি দাঁড় করাই। কিন্তু যেতে যেতেই আমি ফের আত্মনিমগ্ন! ফিসফাস শুনি। জাস্ট কয়েক মুহূর্তের জন্য। সন্তর্পণ চিৎকার শুনি।

একজন অস্ফুটে চেঁচায় যেন ইলিয়াস ভাইয়ের ডান হাত—পায়ে যে গুলি লেগেছে, আমি দেখেছি সেই বেদনাতুর দৃশ্য! মৃত্যুতে ঢলে পড়তেও ইলিয়াস ভাই পকেট থেকে যথাসম্ভব সুরক্ষার ব্যান্ডেজ বের করেছিলেন আর সবাইকে যাতে টেনশনে পড়তে না হয়, সন্তর্পণে কখনো হাতে, কখনো ব্যান্ডেজ মুড়িয়েছিলেন। কিন্তু এখনো ভেতরে গুলি রয়ে গেছে। ব্যান্ডেজ ফুঁড়ে এখনো চাপ চাপ করে রক্ত বেরুচ্ছে! দেখেন দেখেন সবাই!

হতবিহ্বল আমি মহাবিরক্ত, ব্যাটা মুস্তাফিজ ভাইয়ের কথা বলতে গিয়ে আমার নাম নিচ্ছে কেন? নির্ঘাত পাগল হয়ে গেছে! যা হোক আলতাফ ভাইয়ের দ্রুত নির্দেশে আমরা অস্থায়ী হাসপাতালের সামনে একসময় ভেতরে ঢুকে রক্তপিষ্ট মাথায়ও ভাবতে থাকি, এখানে সত্যিকারের নার্স নিজ দায়িত্বে এই সেবাকার্যে এসেছেন। অনেক আগেই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে এখানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত হাসপাতালের নার্স তো আছেনই, পাশাপাশি অস্থায়ী ট্রেনিং নিয়ে এখানে প্রচুর নার্স নার্সিংয়ের দায়িত্ব নিয়ে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে অনেক ধৈর্য আর নিপুণতার সঙ্গে নিজেদের জীবনকে বলা যায় সমর্পণ করেই দিনরাত তাদের সেবা করে যাচ্ছেন, ফিসফিস দৃঢ়তায় বলি, আলতাফ ভাই, ওদেরও কিন্তু মুক্তিযোদ্ধার খেতাব দিতে হবে।

আমার উত্তেজিত কণ্ঠকে দাবিয়ে আলতাফ ভাই বলেন, এ নিয়ে বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই বলে রেখেছেন। তুমি আর কথা বোলো না, চুপ, ইলিয়াস চুপ! মুস্তাফিজ ভাইকে ট্রলিতে করে ভেতরে নিয়ে আমরা দেখি, কত যে আহত পুরুষ নারী যোদ্ধা, বীরাঙ্গনা প্রায় খণ্ডিত শিশুরাও কাতরাচ্ছে! এর মধ্যে ডাক্তার—নার্সরা কতটা মাথা ঠান্ডা রেখে সবার নিখুঁত চিকিৎসা করে যাচ্ছেন!

কিছু পরে যা হলো, জাস্ট কয়েক মুহূর্তের মধ্যে মুস্তাফিজ ভাইয়ের দেহ থেকে গুলি বের করে, সুন্দর ব্যান্ডেজ করে তার দেহে রক্ত ঢুকাল!

একজন ডাক্তার আমাকে বলেছিলেন, আজ পুরোটা রাত ওনাকে ঘুমাতে হবেই। আমরা এক্ষুনি ঘুমের ইনজেকশান দিচ্ছি। ফের অনুভব করি আমার তালগোলের বোধের তীব্র তরঙ্গে, আমি কখনো নিজেকে ইলিয়াস, কখনো মুস্তাফিজ ভাই দুটো চরিত্রের মধ্যে নিজেকে প্রায়শ গুলিয়ে ফেলছি।

ক্রমশ প্রভাত গড়ায়মান, কেয়ার ডোরাকাটা গামছায় টুপটুপ ভেজাচুল, অথইয়ের মায়াবী চাহনি বারবার প্রতিভাত হয়। ঘুমের ইনজেকশনের পর আলতাফ ভাই যুদ্ধ—ক্যাম্পে ফেরত গিয়েছিলেন। আমি কি মুস্তাফিজ ভাইয়ের পাশে বসে ঢুলছিলাম? এর মধ্যে আমাকে দুর্মর কাঁপিয়ে একজন ডাক্তার চিৎকার করতে থাকেন, এত কড়া নজরের মধ্যে এমন পেসেন্ট কীভাবে তাঁবু থেকে পালালেন?

তাঁবুর বাইরে এক চিমটি ঘাপটি মেরে ছিলাম। কী? মুস্তাফিজ ভাই জাদুকরী সত্তায় কোথাও পালিয়ে গেছেন? আমার হিমশীতল স্থবির বরফ আত্মায় সহসা কোনো বোধ কাজ করে না।

দণ্ডায়মান জিপে উঠে মরিয়া হয়ে ক্যাম্পে এসে আমি হাঁ হয়ে যাই। আলতাফ ভাই চিৎকার করছেন। রক্তাভ মুস্তাফিজ ভাই যেন মাথা নিচু স্ট্যাচু। আলতাফ ভাইয়ের বিস্ময়, ক্রোধ কান্নাজড়ানো কণ্ঠ সমস্ত ক্যাম্পে আছড়ে পড়ে। নিশ্চয়ই তুমি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে এসেছ? এত জলদি কেন এতটা অধৈর্য হলে? সম্পূর্ণ চিকিৎসাটা নিলে না? বাকি কত মাস যুদ্ধ করতে হবে, তার সম্পর্কে আমরা কি কেউ জানি? তুমি হাল ছেড়ে মৃত্যুর কাছে সমর্পিত হওয়ার জন্য ভেতরে আকুল হয়ে ওপরে ওপরে আমাকে মাস্তানি দেখাতে এসেছ? ছি! তুমি জানো না আমাদের দলে ঢুকে যাওয়া, নানা জায়গায় অবিশ্বাসী রাজাকার ঢুকে গেছে? কী ভয়াবহ অবস্থায় আমাদের দিনরাত্রি যাচ্ছে। কে ভালো কে বেইমান বোঝা কতটা কঠিন? ভয়ংকর শত্রু এরা! ভুলে গেছ? এরা শুরু থেকেই আমাদের মাঝে মাঝে বিভ্রান্ত করছে। প্রথমে গুরুত্ব দিইনি, এ দেশেরই শত্রু  হয়ে কুত্তা রাজাকারগুলো কালুরঘাট থেকে এ পর্যন্ত নানারকম উল্টাপাল্টা তথ্যে প্রত্যয় দিয়ে যাচ্ছিল? তুমি কথা দিয়েছিলে, এদেশেরই যারা শত্রু তারা পাকসেনাদের চেয়ে কম হিংস্র না, ওর একটা কঠিন উচিত শিক্ষা দেওয়ার কথা বঙ্গবন্ধুর কানে পেঁৗছাবেই, এর জন্য বেঁচে থাকতে হবে না? কী হলো সেসব কথার?

আমি সম্পূর্ণ ধৈর্যের আশ্রয়ে আলতাফ ভাইয়ের ভেতরের রক্তমাংসের মানুষটার প্রত্যয় দৃঢ়তার আড়ালের আনুভূতিক মানুষটাকে প্রত্যক্ষ করে যেন বোবা হয়ে থাকলাম।

এরপর,

বৃক্ষ তোমার নাম কী? ফলে পরিচয়।

সেই ফলের অমৃত স্বাদ তো আলতাফ ভাইকে না খাওয়ালেই চলবে না। কিন্তু করোটির করুণতা ফের ফিসফিস রিন রিন কোন ধ্বনিতে ধাবিত কোনদিকে করছে আমাকে? প্রতিনিয়ত হামলেপড়া সব মুক্তিযোদ্ধার মতো আমাকেও রেডিও তর্জনী ভাষণের পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার বেতারে গানের তরঙ্গধ্বনি, যা প্রতিনিয়ত আমাকে, আমাদের রক্তমাংসের দুর্মর প্রেরণায় বারংবার কঠিন যুদ্ধে ঝাঁপানোর প্রেরণা দিত… মরু প্রান্তরে কেন সেই সুর ভেসে আসে, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি…। এই তো সব খোলস ভেঙে গেছে, যেন ক্যাম্প নয়, চারপাশে বোবা হয়ে থাকা  অন্য যোদ্ধাদের কেউ নেই পাশে, হুহু তেপান্তরে রাইফেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি, ইলিয়াস রিজভী আহমেদ। ফের ক্যাম্পে আলতাফ ভাইয়ের সামনে ভাঙচুর অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমার বুক হুহু করে। মুস্তাফিজ ভাই কোথায়? আচানক হকচকিত হয়ে চারপাশে তাকাই। আবার রক্তাভ শরীর নিয়ে ফের কোথায় হাওয়া হলেন? আচমকা কানের মধ্যে রূপকথার ব্যাঙমী যেন আমাকে লম্বা উসকানি দিয়ে কঠিন চেতনার দিকে ধাবিত করেন, আলতাফ ভাই তোমাকেই বকছেন ইলিয়াস।

তাই—ই? আমাকে! বিভ্রম কাটা শব্দে গর্জরিত সূর্যের শব্দ নিভে গেল।

 

এরপর কখনো ধেঁায়ায় বাকিটা দৃশ্যমান যুদ্ধে, যেনবা ফড়িংয়ের ঘাড়ে চেপে কখনো অথই, যাকে মাঝে মধ্যেই ভালো থাকার চিঠি লিখি, সে জানায় একদম চিন্তা না করতে, সব ঠিক আছে। সে অথই আমাকে অদৃশ্য সঙ্গ দেয়, কখনো নিশ্চুপ কেয়া… শূন্য বুকের মরুভূমিতে বারংবার মুস্তাফিজ ভাইয়ের প্রছায়া, হে মহিরুহ! আপনি কোথায়। পৃথিবীটা যে অঁাধার লাগে প্রায়শ? হুশ করে একেবারে কর্পূর হয়ে মিশে গেলেন? যুদ্ধ শেষে, এই যে এখনো হাত—পাহীন নিজ ছিন্নঘর বিছানায় আপনাকে খুউব মনে পড়ে গো।

যা হোক, রাতে একটু সময় পেলেই আরও বেশি যুদ্ধদিনের স্মৃতিতে আশ্রয় নিই। খুব নিস্পৃহ বোধ করলে আমার মন মননে অথই ধেইধেই লাফাতে থাকে। কখনোই অথই বলতে থাকে, আব্বু জয়িতাদের বাড়ি একবারেই যাবে না, ও ফোনে বলেছে, তুমি যদি সুস্থ হয়ে ফিরে আসো, সে এবং আন্টিও মুস্তাফিজ চাচার মৃত্যুর জন্য তোমাকেই দায়ী করবে। তুমি নাকি উনাকে জোর করে যুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিলে।

বিছানা থেকে দেহ উচ্চকিত করতে চাই, আহ যন্ত্রণা!

যুদ্ধ জয়ের আনন্দে আত্মহারা হতে আমার একটু সময় লাগছিল। কখনো অস্থির, ঘাপটি মারে খরস্রোতা ঢেউ… কিন্তু ফিরে এসে ডান হাতকে বিশ্রাম দিয়ে অথইকে বলতে থাকি, কীভাবে আমি গুলিবিদ্ধ হলাম, তারপর কী, সব ডায়েরিতে লেখা আছে। ক্যাম্পে টুকরো টুকরো, ফিরে এসে অনেকটা বিস্তারে ডায়েরিতে অনেক কিছু লিখেছি। স্কুলে না গেলে সারাক্ষণ আমার পাশেই থাকবি। তোর সান্নিধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ মানুষ মনে হয়। তাই তুই ডায়েরি এমন সময় পড়বি যখন আমি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকি।

এরকম ধূপছায়া রক্ত বীজের উল্লাসে ডেটলপ্রাণ, নার্স, ডাক্তার গোলাবারুদ বৃদ্ধের শিশ্নের উল্লাস, যাতনাপিষ্ঠ আমি যখন ধাতস্থ হচ্ছি সবে, শুনি, চারপাশে লক্ষকোটি মানুষের জয়ধ্বনির উল্লাস, জয় বাংলা, বাংলার জয়।

জয়টা কী উপভোগই করতে পারিনি? পঙ্গুত্বের কাছে, লেখক সত্তার বিকারের কাছে, মুক্তিযোদ্ধা আমি হেরে গেলাম শেষ পর্যন্ত? ভাবতেই পাঁজরে পিন ফোটে! বিকলাঙ্গ আমি এদেশের বোঝা না হয়ে যুদ্ধের মাঠে মরে গেলাম না কেন? পরক্ষণেই পজেটিভ ধ্বনি তুমি না লেখক? তুমি কীভাবে দেশের ভার হও?

কিছুটা নির্ভরতা পেয়ে ভাবি, এর মধ্যেই কোনো না কোনো একটা কাজে আমাকে ঢুকতেই হবে।

যতই ঘোর বিভ্রাট লেখক মগজে খেলা করুক, যুদ্ধটা আমি নিপুণ সাফল্যের সঙ্গেই করেছি। আলতাফ ভাই বারংবার বলছিলেন, আমাদের জাতে মাতাল তালে ঠিক বীর ইলিয়াস!

শেষে বিপর্যস্ত বাসায় ফিরলে অথই, কেয়া কান্নায় ভেঙে পড়ে। কদিন গেলে ধীরে ধীরে ওরা ধাতস্থ হয়। আলো—ছায়ায় যেন ঠিকঠাকভাবে এই প্রথম দেখি, দেহ থেকে আমার একটি পা আর একটি হাত সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। যেনবা পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত ব্যান্ডেজে মোড়ানো।

তাঁবুতে মুস্তাফিজ ভাইকে নয়, আমাকে যখন ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে অচেতন করেছিলেন ডাক্তার, মধ্যরাতের ফিসফিস কুয়াশা আবহে মরণ যন্ত্রণায় কেঁাকানো চেপে আমি নিজের অস্তিত্ব বেমালুম বিস্মৃত হয়ে যোদ্ধাদের সহজাত কৌশলে বক পা দিয়ে চারপাশে সন্তর্পণে তাকাই… কেউ ব্যস্ত, কেউ চিকিৎসা শেষে ক্লান্ত …এমন ডাক্তার—নার্স চোখ ফাঁকি দিয়ে মুস্তাফিজ ভাই নয়, আমি দণ্ডায়মান স্ট্যাচু হয়ে আলতাফ ভাইয়ের ক্রোধমায়া শব্দ যত শুনছিলাম ততই আমার ভেতর আমূল ঢুকে যাওয়া মুস্তাফিজ ভাই আমার ভেতর থেকে যেনবা বুদ্বুদ হয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলেন।

ডায়েরি চাপা দিতে দিতে অথইয়ের চোখ নোনা স্রোতে ভিজে যায়। কেয়া বিকেলের নাস্তা এনে দেখে, ইলিয়াস বিড়বিড় করতে করতে ঘুমের বেঘোরে তলিয়ে যাচ্ছেন। তখন গভীর নিবিড়ে নিবিষ্ট অথই হিবিজিবি মাথা নিয়ে সুররিয়ালিস্টিক লেখক বাবার গোছালো কথার ডায়েরির অক্ষরে ফের ধীরে হাঁটতে থাকে। বাবা লিখেছেন, আসলে গুলি লেগেছিল আমার আর মুস্তাফিজ ভাই দুজনেরই দেহে। মুস্তাফিজ ভাই হাত অঁাকড়ে ফিসফিস কিছু কথা বলেই মৃত্যুর অনন্তে ঢলে পড়েন। এই ধাক্কাটা সত্যিই আমি নিতে পারিনি। রক্তস্রোতে ভাসছিলাম দুজনই। এরপর পকেট থেকে ব্যান্ডেজ বের করা থেকে শুরু করে মুস্তাফিজ ভাইকে মর্গে পাঠিয়ে অপারেশন শেষে ঘুমের ইনজেকশান আমার দেহেই পুশ করা হয়েছিল।

বাড়ি ফেরার পর দীর্ঘ দুমাসে মুস্তাফিজ ভাইয়ের মৃত্যৃর ট্রমা যতই কেটেছে, ততই বিছানায় বসানো কেয়ার সাজিয়ে রাখা বালিশ—টেবিলে ভর করে আমি ডায়েরি লেখার মধ্যে মাঝে মাঝেই দীর্ঘসময় ধরে ডুবে থেকেছি। সে চর রাজাকারের ভুল তথ্যে যাত্রাপথে আমি আর মুস্তাফিজ ভাই কীভাবে অতলে পড়েছিলাম, একটু একটু করে লিখতে থাকি। একটা পর্যায় পর্যন্ত লেখা শেষ করে দেখি ডায়েরির দিকে অথইয়ের তিতিরের মতো তাকিয়ে থাকা, দেখে বলি, নে, পড়, তুই তো আমার যোদ্ধামেয়ে, তাও বলছি, মন শক্ত করে পড়বি, একটুও যেন না কাঁদিস, তুই কাঁদলে আমার জাদু ইন্দ্রিয় কিন্তু টের পেয়ে যাবে…।

এ কদিনে কেয়া সমুদ্র সাম্পানের মাঝি হয়ে উঠেছে যেন, নিখুঁত নির্জীব নিমগ্নতায় সে এটাও আমাকে বুঝতে দেয় না। সেও কিছু হারিয়েছে যুদ্ধ শুরুর মাসখানেক পর একদা রাজাকারদের লুটতরাজের চক্করে পড়ে ওর গর্ভের ভ্রম্নণটি নষ্ট হলে কতটা উদ্ভ্রান্ত পাগল চক্করে দিনরাত্রি চোখের স্রোতে ভাসিয়ে দিত! ভাগ্যিস সেদিন অথই কী কাজে যেন অন্য কোয়ার্টারে গিয়েছিল। প্রতিবেশীরা বিশেষ করে অথই বহু কষ্টে তাকে সামলেছে। কিন্তু অথই চিঠিতে এসবের চিহ্ন বিসর্গও আমাকে জানতে দেয়নি। মুস্তাফিজ ভাইয়ের জীবন বাস্তবতার সঙ্গেও আমাদের কী মিল!

অথই ডায়েরিতে ঢুকে আছে।

বাবা আরও লিখেছেন, আমি যুদ্ধে প্রতিহত হওয়া পাক আর্মিদের মধ্যে কোনো চতুষ্পদের ছায়া খুঁজে পাই না।

ন’মাস শেষে আমরা জয়ী হয়ে যখন আলতাফ ভাইয়ের উন্মাতাল নৌকায় চেপে ক্রমশ ঘরমুখী, আমার মাথার ওপর

 

 

নয়… যেন সম্মুখে আসমানের মেঘপুঞ্জের ছায়া পুরোটা মিহি বিস্তারিত।

যেন এর মধ্যে সম্মুখের কঠিন শীতের কালো কুয়াশা ছাপিয়ে আশ্চর্য এক রক্তাভ সূর্যচ্ছটা দণ্ডায়মান! কে? কী? বিমূঢ় বিস্ময়ের ঘোর কাটতে থাকে যাতনা—ভোলা এক অদ্ভুত বিস্ময়কর বিমূঢ় তরঙ্গে!

মানুষ যেমন বলে, আমরা যত দূরে চলে যাই,যত ভুল বোঝাবুঝি হোক,আমরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেব আমাদের সম্পর্ককে,তেমনই কী বুঝে আলতাফ ভাই বলে ওঠেন,ভাবিষ্যতে রাজনীতি নিয়ে, দল নিয়ে যত ভুলবোঝাবুঝি হোক,যত আলাদা হয়ে যাই আমরা, এই দেশ কিন্তু আমাদের। এই জায়গায় কোন আপস নেই।

এমন ভাবতে ভাবতে মধ্যরাত তিনি ঘুমিয়ে পড়েন।

যুদ্ধ শেষ হয়েছে কত বছর হবে অথই?

৫৩ বছর।

ক্রাচে ভর করে, বিছানায় গাড়িয়ে এতটা বছর কীভাবে বেঁচে রইলাম? তুইও বুড়ি হয়ে যাচ্ছিস,মা মরে গেলে আমার জন্য আর বিয়ে করলি না। দেশে কতকিছু ঘটে গেল। বঙ্গবন্ধু হত্যা। কত নতুন দল হল, ইলিয়াস নতুন দলে যোগ দিয়ে আমার কাছে থেকে জীবনের জন্য আলাদা হয়ে গেল। বুড়ো থুত্থুড়ে আমাকে একবার দেখতে আসার কথাও মনে পড়ে না।

ইলিয়াস চাচু মারা গেছেন, আর কতবার বলব?তুমি শুধু ভুলে যাও। তিনি অন্য দলে গেলেও আমাকে ফোন করে তোমার খবর নিতেন আমেরিকা থেকে। এরপর স্ট্রোক করে,,

থাক,আর বলতে হবে না,টিভিতে ষোলই ডিসেম্বর চলছে না?

পতাকা উড়িয়েছিস?

পাতলা ফিনফিনে অথই বাইরে ছুটে যায়,এবং দিব্যি এক কিশোরীর মতো ছুটে ছাদে ছুটে যায়।

 

ঘনায়িত প্রভাতের শিশির টিন চালের দিকে অথই ভেজা প্রথম চোখে, পরক্ষণেই উদ্ভাসিত মুখের প্রস্ফুটনে সে শীতালু বৃষ্টি ঝড়ে পতাকাকে কাত হতে দেখে মই বেয়ে পতাকাটা পতপত উড়িয়ে দেয়।

 

নাসরীন জাহান, কথাসাহিত্যিক

লাহোর প্রস্তাব বিকৃতির কারণে একাত্তর অনিবার্য হয়ে ওঠে

হোসাইন আনোয়ার ২৩ মার্চ ১৯৪০। পাকিস্তানিরা ভুলে গেছে ২৩ মার্চের ইতিহাস। একটি ভুল ইতিহাসের উপর ভিত্তি করেই ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবস পালিত হয় সমগ্র পাকিস্তানে।

ইফতার পার্টি নয়, সেদিন যেন তারার হাট বসেছিল পিটস্টপে

রুহু রুহেল সমাজ ও সংস্কৃতির বড় পরিচয় সম্প্রীতির অটুট বন্ধনে সামনের পথে অবিরাম এগিয়ে চলা। সাম্য সুন্দর স্বদেশ গঠনের জন্য প্রয়োজন বিবিধ মত ও পথকে

নভোচারী সুনিতা মহাকাশে ফুল ফোটায় পৃথিবীতে নারীর পায়ে শেকল পরায় কে?

প্রদীপ খাস্তগীর চমৎকার একটি সফল মহাকাশ সফর শেষ হয়েছে গত ১৮ মার্চ মঙ্গলবার দিবাগত রাত ৩টা ৫৭ মিনিটে। গত বছরের ৬ জুন মাত্র ৮ দিনের

দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ: দর্শনের বিজ্ঞান

রাজেশ কান্তি দাশ দর্শনের ক্ষেত্রে বস্তু ও ভাবের দ্বন্দ্ব অতি প্রাচীন। খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের। বস্তুবাদী দার্শনিকেরা মনে করেন বস্তু থেকে জাগতিক সব কিছুর উৎপত্তি। গ্রীক দার্শনিক

মানুষ ও মঙ্গল মানব

সরকার হুমায়ুন দুজন মহাকাশচারী- একজন পুরুষ এবং একজন মহিলা মঙ্গল গ্রহ অভিযানে গেলেন। তারা নিরাপদে মঙ্গল গ্রহে অবতরণ করেন। সেখানে তাদেরকে অতিথি হিসেবে মঙ্গলবাসীরা সাদরে