লুইস গ্ল্যুক-এর তিনটি কবিতা
অনুবাদ- আবু মুসা চৌধুরী
লুইস গ্ল্যুক ১৯৪৩ সালে নিউইয়র্ক সিটিতে জন্মগ্রহণ করেন। লং আইল্যান্ডে তার বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেন সারাহ লরেন্স কলেজ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমেরিকার গুণবিচারী ও মনস্বী কবিদের একজন তিনি। প্রায়োগিক নৈপুণ্য, সংবেদনা এবং নিঃসঙ্গতা, পারিবারিক পিচ্ছিল সম্পর্ক, বিচ্ছেদ এবং মৃত্যুর অন্তর্দৃষ্টি গ্ল্যুকের কবিতা প্রতিপাদ্য। তাঁর কবিতা সম্পর্কে খ্যাত-কবি রবার্ট হাসে বলেন, সবচেয়ে খাঁটি এবং চূড়ান্ত গুণান্বিত লিরিক কবিদের একজন এখন লিখছেন। লুইস গ্ল্যুক অর্জন করেছেন ২০২০ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। তার কবিতা ‘অভ্রান্ত’ কাব্যিক কণ্ঠ যা সাদামাটা সৌন্দর্য সৃষ্টি করে ব্যক্তিক অস্তিত্বের সর্বজননীতায়। তার কাব্য ‘ফেইথফুল অ্যান্ড ভেরিয়াস নাইট (২০১৪) লাভ করে ন্যাশনাল বুক অ্যাওয়ার্ড। পরে পায় লস এঞ্জেলস টাইমস্ পুরস্কার। লুইস্যক-এর অন্য কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে-দ্য হাউস অর্স মার্সাল্যান্ড, দ্য গার্ডেন, ডিসেন্ডিং ফিগার ইত্যাদি। তিনি দ্য ওয়াইল্ড আইরিস কাব্যের জন্যে পুলিৎজার পেয়েছেন।
সূর্যাস্ত
সূর্য যখন অস্তগামী সে সময়
মৃত পাতায় আগুন জ্বালায় এক রাখাল।
তা কিছুই না, এই অগ্নি
তা এক তুচ্ছ বিষয়, নিয়ন্ত্রিত
যেন এক স্বৈরচারীর পরিবার-পরিচালন
এখনো, যখন এটা প্রজ্জ্বলন্ত, রাখালটি অন্তর্হিত,
পথ থেকে, অদৃশ্য সে।
সূর্যের তুলনায় এ আগুন
ক্ষণস্থায়ী অপেশাদারÑ
পাতা ফুরিয়ে গেলেই তা শেষ।
অতঃপর রাখাল ফিরে আসে ফের, ছাই জড়ো করে।
কিন্তু মৃত্যুই হলো মৌল।
যদিও যা করার জন্যে আগমন তা সূর্য করেছে
মাটি যেন উর্বরা হয় তারপর
তারপর বসুধার দাহনের অনুপ্রেরণা
এভাবে তা এখন ডুবে যায়।
—————————
জ্বলন্ত পত্রগুচ্ছ
এই মৃত পাতাগুলো আগুন ছোঁয় খুব দ্রুত।
এবং ওগুলো জ্বলে দ্রুততম; বিন্দুমাত্র সময়েই
কিছু একটা থেকে পাল্টে তারা কিছুই না হয়ে যায়।
মধ্যাহ্ন। আকাশ ঠা-া নীল
আগুনের আওতায়, পৃথিবী ধূসর।
সবকিছু কেমন মিলিয়ে যায় দ্রুত, কী দ্রুত ধোঁয়া পরিষ্কার
কিন্তু যেখানে রয়েছে
যেখানে রয়েছে স্তূপ পাত্রালির,
মনে হয় অতর্কিতে এক শূন্যতা ছড়িয়ে পড়েছে।
রাস্তার ওপারে চেয়ে আছে এক বালক।
সে আছে দীর্ঘ সময়, দেখছে পাতা পোড়ানো।
সম্ভবত এটা হলো তুমি কীভাবে জানবে কখন পৃথিবী মৃত
তা জ্বলবে।
——————————
শ্রান্তি
পুরো শীত ঘুমিয়েছে সে।
তারপর সে জেগে ওঠে, সে মুখম-ল করেÑ
একজন মানুষের পুনর্বার ফিরে আসা, তা এক দীর্ঘ সময়,
আয়নায় অন্ধকার চুল সমেত তার কর্কশ মুখ।
পৃথিবী এখন এক মেয়ে মানুষের মতো তার জন্যে অপেক্ষমাণ।
এক মহান আশাবাদিতাÑযা তাদের বেঁধেছে পরস্পর
এই মেয়েমানুষ এবং তাকে।
যোগ্যতা প্রমাণে সে এখন কাজের উপযোগী
মধ্যাহ্নে: সে ক্লান্ত, সে তৃষিত।
কিন্তু এখন ক্ষ্যান্ত হলেই সে মূল্যহীন।
তার ঘাড় ও বাহু ঢেকে দেয় ঘাম
যেন তার জীবন উপচে পড়েছে তার ওপর
সে কাজ করে জন্তুর মতোন, অতঃপর
একটি মেশিনের মতো অনুভূতিহীন।
কিন্তু এ বাঁধন কখনো ভেঙে যাবে না
যদিও পৃথিবী এখন যুযুধান, গ্রীষ্মাতপে বন্যÑ
সে কনুই পেতে বসে পায়ের পাতায়, আঙুলে পরিষ্কার করে কান
সূর্য ডুবে গেলো, আঁধার নেমে আসে
এখন এই গ্রীষ্ম শেষ, পৃথিবী কঠিন। ঠান্ডা;
রাস্তায় জ্বলে কিছু নিঃসঙ্গ আগুন।
ভালোবাসার অবশেষ থাকে না,
কেবল বিস্ময় এবং ঘৃণা।
কবিতা
ময়ুখ চৌধুরী
১. বৈঠক শেষে, উঠোনে নেমে
ÑÑদেখেছেন, কী সুন্দর চাঁদটা?
ÑÑআকাশেরটা?
২. সময় ঠিক রাখতে পারো না।
পঁচিশ হাজার মাইল পরিধির এই পৃথিবীতে
কোথাও না কোথাও তো এখন সাতটা বাজে প্রায়।
চলো, সেইখানে যাই।
৩. অসম্পূর্ণ দৃশ্য
বিছানায় মুখোমুখি শুয়ে আছে দুইজন,
দুটি মুগ্ধতার মিথস্ক্রিয়া।
দেড় দিন পেরোবার আগে
দৃশ্যটা গিয়েছে ভেঙে
যেন জলাশয়ে জলছবি।
পূর্ণতা পেল না কেন, কেন এই কৃপণতাÑÑ
অভিযোগ উঠেছিল তাই,
অপূর্ণ দায়িত্বটুকু পালন করেনি তবে কে?
৪. প্রত্যাখ্যান
কোনো কোনো প্রত্যাখ্যানও প্রেমের মতোই সুশোভন।
এই শতাব্দীতে এসে পঞ্চাশ বছর আগেকার
ডান হাত সরে গিয়েছিল।
সবুজ যানবাহন রাগান্বিত কণ্ঠস্বরে তীব্র সরে গেল।
==========================
আদিবাসী রিপোর্ট
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
[ভ্যাঙ্কুভারের আমার ২১৫টি লাশ]
পিতৃতুল্য পাথর থেকে বের করে এনেছি আগুনের প্রাণ।
এখন রাজ্য জুড়ে বিদ্যুতের রাজত্ব।
*
আমরা এখনো কালা পাহাড়ে গুহাবাসী,
এখনো নেটিব, অন্ধকারে
নেংটি ইঁদুর খাই; কাঁচা মাছ, কুমিরের ডিম খাই।
থাকি ইতিহাসের অপর প্রান্তে, পেছনে
ভূগোলের নিচে।
*
মাতৃতুল্য মাটিতে জড়িয়ে থাকি
মিশে থাকি
সহোদর সাপের সাথে
আমাদের গায়ের রঙ মাটির মতন ময়লা,
সেজন্য পিতামহকে হত্যা করা হয়েছিলো-
কারণ তিনি ইংরেজি জানতেন না!
*
আমাদের বোনেরা তোমাদের বারবিকিউর মাংস
ফুফুরা তোমাদের নাচঘরে নাচনিওয়ালী
আমাদের ভাইয়েরা তোমাদের গেলমান!
আমাদের পিতারা
মে দিবসের আগের শিকল পরা শ্রমিক।
*
আফ্রিকায়, লাতিন আমেরিকায়, পার্বত্য চট্রগ্রামে,
আমাকে বার বার হত্যা করা হয়েছে, হচ্ছে
ভ্যাঙ্কুভারের পরিত্যক্ত স্কুলেও
আমার শৈশবের ২১৫টি পুরনো লাশ।
*
তাহারা পাহাড় কিনে, সমুদ্র কিনে, আকাশ কিনে
কিনে নৃ-জাতিগোষ্ঠীর খতিয়ান।
*
নেংটি পরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি
আমার হাতে তীর-ধনুক, বর্শা-বল্লম; গুচ্ছ গুচ্ছ ঘৃণা!
=================================
অহংকার
রূপক বরন বড়ুয়া
একটু একটু করে বাড়ে তরুলতা
পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে আকাশের পানে চোখ রেখে
তারাদের আপন এবং আত্মীয়তা খোঁজে!
মগডাল অবধি লকলকিয়ে বাড়ে
ভেতরের অনুভূতি! খুব গোপনে সংক্রামক খোঁড়ে
মগজের কোষে কোষে বিচ্ছিন্নতার ধারাল সুর
শেকড় শেকড়ে অতীতের বিস্মরণ
নিচে পড়ে থাকে শৈশবের উলুখঁড়।
সবুজ দূর্বায় শাদা শাদা ফুল
আকাশ বুকে ধরে রাখে একাকিত্বের ভূগোল।
তবু রৌদ্রে মায়াবতী মেঘের আনাগোনা
গাঢ় কালো মেঘে জলে ডোবা মুখ
এসব গায়ে মাখে কয়জনা।
এলিনিয়েশান তত্ত্বে কার্ল মার্ক্স ডুবেছিলো রাষ্ট্রে সমাজে
উপর থেকে ফল-ফুল,পাতা ঝরে পড়ে
নেমে আসে বিধ্বস্ত শরীরে মৃত্তিকায়।
মাটির পুতুল মাটিতেই মানায় জলে যায় মিশে
পুজো হোক বা না হোক অবশেষে। জানো তো
আকাশ ও জলে নামে সায়হ্নে গা ধুতে।
=============================
মানুষ নামের মানুষ নেই
সাথী দাশ
হৃদয়ের ক্ষত হৃদয়ে থাকে দেখতে দেয় না কাউকেও
হাসি হাসি মুখে শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে
অন্যের হৃদয়ে তোলে ঢেউ।
মানুষের মধ্যে মানুষ পৃথক,মাঝে মধ্যে দেখা মেলে।
তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে ভালোবাসা নেই, মানুষের কাছে যেতে
অনাগ্রহী সবাই।ইতিউতি মন ধানের চেনেনা কেউই।
প্রযুক্তির আসক্তি,হাতের আঙুল প্রাত্যহিকতা অনড় অলস।
বাঁশিওয়ালা বাজাচ্ছে বাঁশি,মাতৃভূমিতে প্রাণের সুরে
ব্যাঘাত
কয়জনে বোঝে?পান্ডুলিপি মলিন এখনো তো
চোখে পড়া যায়। অন্দরমহলের মানবিক কোষগুলো
নিস্তেজ-অচল,এটাই কেউ দেখেও দেখেনা।
মানুষেরা আছে, মনে হয় মানুষ নামের মানুষ নেই।
===================================
সন্ধ্যাটুকু একান্ত নিজের
মাহমুদ কামাল
চলে যাচ্ছে গতিময় দিন
গতিহীন সকাল,দুপুর
বিকেল ও রাত, শুধু
সন্ধ্যাটুকু একান্ত নিজের
পথ ভুল করে, ঠিকানাবিহীন
শুকনো নদীর পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে
পথশ্রম প- করে দিয়ে
চলে যাচ্ছে গতিময় দিন।
ঝড়ের বেগের সাথে পাল্লা দিয়ে
যে জীবন আলোড়িত ছিল
আলোকিত সব অন্ধকার
পরাজিত দীপ্রময় দিনে
এই তো সে দিন!
চলে যাচ্ছে গতিময় দিন…
সমস্ত প্রহর, শুধু
সন্ধ্যাটুকু একান্ত নিজের
================================
পূর্ণতা
শেখর দেব
কী এক অপূর্ণ ইচ্ছা…
কোথায় কিশের জন্যে বৃথা হয়ে যাবে সব?
কী সেই দক্ষতা জানি অন্তর্গত লোকে
গভীর গোপন ঘরে রয়েছে লুকিয়ে।
কোন সে মাহেন্দ্রক্ষণ অপেক্ষায় আছে
ছুঁয়ে দিতে দ্বিধাহীন পরিণত চূড়া
তোমাকে জিজ্ঞেস করি আধেক অঙ্গাধিকারী
উত্তরে বলেছো তুমি কিছু সম্ভাব্য জবাব
কে জানে নবাব ছুটে যায় রাজ্যহীন
অলক্ষ্যের দিকে, হয়তো নিজেরই সন্ধানে!
সীমানা ছাড়িয়ে যেতে
নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে
আদর্শের কাছাকাছি, দর্শনের দ্বিধাবোধে।
সহজ সরল জানি হয় না কিছুই
তবু তোমার কাছেই ফিরে যাবো
তুমিই তো রাজ্য আর প্রার্থিত পূর্ণতা।
========================
বিষন্নতা ডট কম
শহিদ মিয়া বাহার
তোমার প্রসেসর কত গিগাবাইট চারুমণি?
কতটুকু সম্বল আমার?
এক রত্তি যায়গা দিয়ে দিলেই হয় আমায়!!
আমার বিষন্ন রাত্রির প্রহর রেখে দিতে চাই!
আমি জানি–
তোমার আছে ইনফিনিটি গিগাবাইট
অনায়াসেই একটি দোচালা ঘর হয়ে যায়
আর একটি আগোছালো সংসার!!
এখন আমার নিঃসঙ্গতা ছুঁয়ে দিলেই ইথার তরঙ্গের মেলায় খুঁজে পাবে
ইন্টিগ্রেটেড বেদনার বিষণœতা ডট কম।
============================
ঈশ্বরও একটা দুঃখের নাম
তাপস চক্রবর্তী
কপাট খুলেই আজকাল দুঃখ বাড়ে।
ঘুমিয়ে থাকা স্বপ্নরা যেমন
আস্তো একটা কোলবালিশ ছোপ ছোপ লালার দাগ
আর রজবতী কুশন
অথচ
ভাতের থালায় ঈশ্বর
গোগ্রাসে বলে গেছে শিখ-ীকথা।
জানি ঈশ্বরও একটা দুঃখের নাম
তুমিও রাষ্ট্র যেমন।
=============================
চাঁদের বৃত্তে বাংলাদেশ
কমরুদ্দিন আহমদ
চোখের সীমানা পেরিয়ে ৫৬ হাজার বর্গমাইলজুড়ে
ঘুমের শান্তিতে ডাকে আশ্চর্য সবুজ ঘাস-লতা-পাতা নির্মল জল,
উর্বর মাটির চাতাল।
উপকূলে দাঁড়ালে ফুরোয় না সমুদ্রের চড়াই উৎরাই
বুকের সিন্ধুকে দেশ নিন্দুকের নেই দাঁড়াবার ঠাঁই।
নীলগিরি থেকে সাজেক, কুয়াকাটা হতে টেকনাফ
বান্দরবান থেকে সুন্দরবন আমাদের বাংলাদেশ।
মন্দার টনিক শষ্যের সুবাসে প্রশান্ত ঘর্মাক্ত কৃষক
শিল্পের খরায় প্রতীক্ষার বর্ষণে শ্রমক
আমাদের স্বার্বভৌম চেতনা হোক গর্বের স্বদেশ।
ছড়াক গন্ধরাজ প্রেম, ভোরের আকাশে জাগে রক্তগোলাপ
গোধূলিতে উঁকি দেয় তিরিশ লক্ষ শহীদের লোহিত বরণ মুখ।
অষ্টপ্রহর হৃদয়ে বহে লাল-সবুজের মিলন-ধারা
চির-জাগ্রত পূর্ণিমা চাঁদের বৃত্তে দ্যাখো বাংলার মানচিত্র!
===================================
মরা নদীর বাঁকে
আ ন ম ইলিয়াছ
মরা নদীর বাঁকে
কষ্টরা চুমু খাই দুঃখের গতরে
পোড়ায় সতত যৌবনের অতীত।
একদিন কোলাহল ছিলো
শব্দের পরতে ছিলো শব্দ
কথার পরতে কথা
মুখরিত জীবনের কথা
জীবনের গান,
মিশে গেছে পদচ্ছাপ পদচ্ছাপে।
স্মৃতির প্রতিবিম্বে নতজানু সময়
সময়ের কাছে।
মরা নদীর বাঁকে
যেন থেমে গেছে কোলাহল
নিস্তব্ধ দুই প্রান্তর
হাত ধরাধরি সখ্যতা
মাটির আস্তরণে
মাটির ঘ্রাণে।
নীল জ্যোৎস্নায় বিভ্রমে ছুটে আসে গাঙচিল
গলুইয়ের আঁশটে গন্ধের সন্ধানে।
মরা নদীর বাঁকে
যেন ফুরিয়েছে ব্যাস্ততা
থেমে গেছে কোলাহল
মাঝিমল্লার পাটে –
জীবন যৌবনের স্বাদ।
মরা নদীর বাঁকে
যেন নদী-ই করছে নোঙর
পলির পরতে।
===========================
দূরে হৃদয় অন্তঃপুরে
কুমকুম দত্ত
রাখাল রাজা বাজায় বাঁশি
দূরে হৃদয় অন্তঃপুরে ;
ডাকে মাঘ নিশীথে অচিন পাখি
গভীর রাগিণী সুরে।
ক্ষুধায় প্রেম সরোবর
জলের আঁচড় ঢেউ তুলে ;
দু’জন মনে একান্ত কামনায়
সাঁতার কাটে রাত
স্পর্শে অবিরাম ;
রাত্রি অঝোর ঝরে পড়ে।
==================
ব্যাঙ গান
আজিজ কাজল
নবজাতকের পছন্দ সুস্থ মাতৃজরায়ু
ব্যাঙাচিদের পছন্দ সুস্থ জলাশয়-জরায়ু
বিশুদ্ধ জলাশয়ের জরায়ু-জলে সাঁতার কাটে না ব্যাঙাচি-ফুল
সুস্থ মায়ের জরায়ু-জলে সাঁতার কাটে না নবজাতক
উভয়ের পৃথিবীতে এখন মহাসংকট।
==========================
দূর বনবাস
সাঈদুল আরেফীন
দূর বনবাসে পাহাড়ি কোন এক বালিকা গাইছিলো গান
ঝর্নার কলকল ধ্বনির মতো সুরাবেশ ছড়িয়ে
উপত্যকায় বসে শুনছিলাম সুমধুর সঙ্গীত
বনবিলাসী উচাটন আনমনা আমি
কাব্যকথায় ভাসছিলোম চপল উদাসী হাওয়ায়
নগর থেকে দূরে উপকূলের জলের সীমানা ছাড়িয়ে
এসেছিলাম আমরা ক’জন উপত্যকায় সেদিন।
গল্প পাঠ হলো,
জমলো জমজমাট কবিতা পাঠের আসর
দীর্ঘদেহী বৃক্ষ তরুলতার ফাঁক গলে সন্ধ্যের আকাশে
উঁকি দেয়া পূর্ণিমার ঝলসানো রূপালি চাঁদে আলোয়
সেই বারোয়ারি আড্ডা। সমস্ত লু-হাওয়া পালিয়েছিলো
উন্মুক্ত আকাশের গা ছুঁয়ে ছুঁয়ে ;
হলো আনন্দোৎসবের আয়োজন আদিবাসী গানে নৃত্যে
সবুজাভ বনরাজিতে ছড়ালো সুপ্রসন্ন আবেশ,
চঞ্চল জীবন নাটকের এ অংশগুলো দৃশ্যত
বড়োই অদ্ভূত রম্যকাহিনিকে ছাড়িয়ে যায়
বেলাশেষের গাড়িতে চড়ে আমরা ক’জন আনন্দোৎসবে
স্বচ্ছ জলের ¯্রােতোধারা বেয়ে বেয়ে ফিরে এলাম
কণ্টকাকীর্ণ এই নগরে ইট পাথরের স্থবিরতায়।
====================================
তুমি বলেছিলে
হুমায়রা খানম
তুমি বলেছিলে
আমাকে নিয়ে যাবে তুমি
যেখানে ছুঁয়েছে পৃথিবী নোনাজল সমুদ্রের
যেখানে শালিক গায়
শান্তির গান। পানকৌড়ি কথা কয়
জলের নিচে ডোবে না কখনো নরোম রোদ্দুর
যেখানে বেলা বয়ে যায়না মরুৎ ছলে ¯্রােতের মতো
শান্তির কবুতর যেখানে বাঁধে নীড় শত শত।
তুমি বলেছিলে
নিয়ে যাবে আমাকে
স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের মিলনভূমিতে
যেখানে বইছে জোছনার বন্যা
রূপালী ফুলের গন্ধে ভরে গেছে পৃথিবী
রাতের প্রখর জ্বলে, ছায়া¯িœগ্ধ প্রেমে।
তুমি বলেছিলে
নিয়ে যাবে আমাকে
যেখানে মেঠো পথে কিশোরী হাসছে কল্কল্
যেখানে নক্ষত্র-তারকার বিমূঢ় কথোপকথন
বইছে ঝর্নার শাদা প্রণয়ী অর্পণ
যেতে যেতে থেমে গেছে নগরীর কোলাহল
যেখানে স্থির সূর্যমুখী নারীর অয়ন।
তুমি বলেছিলে
নিয়ে যাবে আমাকে
যেখানে আকাশ পেতেছে মিতালী নক্ষত্রের আসরে
ফুলচন্দন পড়ে আধবোজা কুমারীর মুখে
ভালোবাসার নিঃশব্দ তৃপ্তি নিরন্তর সুখে
যেখানে কালপুরুষের ঘায় পড়েনি পৃথিবীর’ পরে।
তুমি বলেছিলে
আমাকে নিয়ে যাবে তুমি
হিরন্ময় রৌদ্র কমনীয় মানুষের দেশে
পৃথিবী ঘুমায়েছে তিনকাল মহাশূন্যের’ পরে
যেখানে জেগেছে মৈত্রীর শহর ভালোবাসার চরে
আমরা দুজনে বিবশ বন্ধনে যাবো ভেসে ভেসে।
========================
খেলাঘর
রাশিদা তিথি
হারানো পথ খুঁজতে গিয়ে
পিছন ফিরে দেখতে পাই
পথটা যেন মেলায় খোয়া
কিশোরী এক শ্যামলা মেয়ে!
রুক্ষ মাটি পুড়ছে রোদে
ঘরের খোঁজ দেয় না কেউ,
অচেনা মুখ ছুটছে জোরে
পথের ঘোরে কোথায় যায়!
কিনছে কেউ চুলের ফিতে
কাঠের ঘোড়া মাটির পাখি
ঘুরছে কেউ চরকি চড়ে
জমেছে খুব বিক্রিবাটা।
কার যে হাতে টুকরো টান
গোপন করে জমাট আছে!
ঝাঁপিয়ে এসে বলবে চলো
গুমোট মেঘ যেমন ঝরে।
ভিড়ের মাঝে হাতটা পেলে
আঁকড়ে ধরে রাখবো খুব;
হঠাৎ যেন আঙুল ছেড়ে
যায় না চলে মেঘের সুখ।
============================
ধূমায়িত প্রচ্ছদ
নুরুন্নাহার মুন্নি
আপাদমস্তক তোমাকে অনুধাবন করি
নবান্নের ধানের গোলা থেকে বেরিয়ে আসা
ভাপের মতন সে অনুভব,
এ আমার অনুভূতিকাল।
তোমার মায়াবি হাসিতে
আমার পাঁজর ভেঙে চৌচির
সীমানা লঙ্ঘিত বেদনায় এ আমার মৃত্যুকাল।
চিরচেনা সদালাপী তুমি,
কতো লাল রঙা আবির ধবংস করে তোমার আমিত্ব!
কথায়, ঢংয়ে, সাজসজ্জায়,
আমি ছেড়ে দেই
এ আমার মানবিক কাল।
সততার আয়নায় ঢাকা তোমার আগুন সরষে ফুল
আবেদনগুলো ফাইলচাপা পড়ে তাই-
তখন এসে যায় আমার হিমায়িতকাল।
========================
জীবন্ত লাশ
আফরিনা পারভীন
বৃষ্টিতে গা ধুয়ে যাওয়া পাতার মতো
মন ধুয়েছে অশ্রু জলে।
শিশিরে লেপটে যাওয়া দুর্বা ঘাসের মতো
হৃদ মাজার জল লেপনে সিক্ত।
কাব্যের প্রচ্ছদ পটে পানসিরা খেলা করে।
জবা’র পাঁপড়িতে চুম্বন চোষক ভ্রমর ব্যস্ত,
তেমনি ব্যস্ত থাকি নিজ জ্ঞানের আঁধারে।
এদিকে, ওদিকে সেদিকে।
নয়নের স্বাধ জ্ঞানের পিপাসায় মত্ত হই
ক্ষণে অক্ষণে।
পৃথিবী আমার কাছে একটি শূন্যস্থান।
দৃষ্টি পটে কখনো ভরাট হবেনা জানি।
একটি নক্ষত্র খসে যাওয়া স্থান পুরুনে
শত নক্ষত্রের জন্ম যেখানে
এই আমার স্থান শূন্য সেখানে।
আত্মা বহু শেকলে আবদ্ধ,
এক সময় ছুটে চলতো ব্রহ্মা- থেকে ব্রহ্মা-ে
এখন ছুটে চলা পা বড়ই ক্লান্ত।
তাই ক্ষণে ক্ষণে আঘাত চাপে হৃদয় ক্ষত।
অশ্রু নহর নজর বন্দিতে ও বাঁধ ভাঙা।
উপচে পড়া জল অহর্নিশ।
প্লাবনে ভেসে চলি জীবন্ত এক লাশ।
============================
বাঁশখালী
ওসমান গণি
লতা-গুল্মে করতালি
পাহাড় সমুদ্র আড়াআড়ি টান
সবুজ ঝিকিমিকির আঁশ ভরপুর দীপ্তির আধাঁরে
নুনের দিগন্ত মাঠ ছনোয়ায়
জলরাশি লইট্যা মাছের সংসার
টইটং প্রেমবাজার মানুষের হাট
বামের-ছড়ায় ইকো পার্কে
সমর্পণ নিয়ে হাওয়ার স্বপ্ন কাছে দাঁড়ায়
পুকুরিয়া চা-পাতা পাখাসখা শব্দ করে
সরলবর্গীয় বৃক্ষ মেঘের মতন এলোমেলো
বিন্দুবিসর্গ জানি না নক্ষত্র তামাম উইল
আব্দুল করিম, নসরত খাঁ’র কোষের নূর
আমার অনন্ত উঠোন জুড়ে…
=========================
তোমার জন্য জেগে আছি স্বাধীনতা
রওশন মতিন
এখনত জ্যোৎ¯œার গ্রীবায় গাঢ় রক্তের প্লাবন,
অথচ দুঃসময়ের জানালায় খেলা করে ভালবাসার কফিন,
পতিতা সভ্যতার চোখ থেকে ঝরে যায় বেদনার গলিত দ্রবণ-
আর কতকাল চোখের জলের নিবেদনে ভেসে চলা:
আর কতকাল বুকের ভেতরে কষ্টের শেকড় ছড়াবে
আতঙ্কের ভয়াল অক্টোপাসের ক্ষমাহীন বিরুদ্ধতা,
মৃত্যুমুখর আগুনের কাছে পতঙ্গের কি প্রত্যাশা আছে;
আমাদের দিনগুলো ক্ষয়ে যায় ম্রিয়মান বিবর্ণ লজ্জায়,
প্রতিদিন উত্তাল জোয়ারের মতো বেপরোয়া ইচ্ছার আত্মহনন
মুহূর্তের পৃথিবীর মৃত্যু হতাশার অন্ধকূপে ডুবে যায়;
মনে হয় আমরা সবাই আস্তাবলের ভারবাহী গাধার মত
নিয়তি নির্ধারিত সীমাবদ্ধতায় ইচ্ছা মৃত্যু নিয়ে বেঁচে আছি।
আঁস্তাকুড়ের পাশের ক্ষুধার কাঙ্গাল অনাথ শিশুটির মত
অসুস্থ সমকাল স্ব-কালের ক্ষত-বিক্ষত বিদ্ধস্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে
বাতাসের বিষাক্ত সীসায় ফুসফুসের অসুখ,
রাজনীতির ভাড়, বেশ্যার দালাল,
এইডস ও সস্তা দারিদ্র্যতার রঙ্গিন মোড়কে
অপূর্ণ শিশুর বিকলাঙ্গ হাসির মত ঝুলে আছে সারাক্ষণ,
চাপচাপ বরফ বাক্সবন্দি মুত রক্ত-শীতল রুপালি মাছেদে মত।
একদিন হারাবার নিজস্ব তাড়নায় হারিয়ে যাবে সবাই,
আমরা কি স্বপ্ন রেখে যাব আমাদের সন্তানের জন্য,
গুহাবাসী, গৃহবাসী হয়ে কার আশ্রয় ফিরে যাবো শেষ পর্যন্ত;
শুধুই কি শোনাবো রক্ত ঝরার গান, অস্ত্রের ঝংকার,
অসহায় মৃত্যুর বিলাপ আর মানবতার পরাজিত চিৎকার;
ভোরের ¯িœগ্ধ আলোয় প্রাত্যহিক জাগরণে পাখির ডাকে,
আমরা কি জেগে উঠব না শুভ দিনের শুভক্ষণে,
আমরা কি খুলে দেবনা সব দরজা-জনালা বিশুদ্ধ বাতাসের জন্য,
আমরা কি বুকের ভিতরে পুষে রাখবো না শান্তির পাখিটাকে
আমরা কি ফিরেয়ে দেব না সেই শিশুটি র্পম নিরাপত্তার ঘুম-
যে আজ জেগে অসুস্থ ও উৎকন্ঠা-ব্যাকুল।
===============================
প্রিয়তমা দেশ তোমার মাতৃমোহনীয় আলিঙ্গনে
জাফর আলম
প্রিয়তমা দেশ,
প্রিয় জন্মভূমি,
তোমাকে ভালোবাসতে গিয়ে হারিয়েছি আমার হাজার বছর,
তোমার পবিত্র মাটি ললাটে মেখে
নিয়েছি হিজল তমালের ঘ্রাণ।
তোমার সবুজ ছায়া
ধ্রুপদী শ্যামলিমা সংবৃত মাতৃমুখ
আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে আমার ত্রস্ত উড্ডীয়মান পাখা।
আমি ভুলিনি তোমার পদ্মা-মেঘনা-যমুনা,
কর্ণফুলী,
আমার রক্তস্রোতে বহমান স্রোতস্বিনী ডাকাতিয়া নদী!
আমাকেও ডেকেছিল পার্থ, অন্টারিও, লাসভেগাস,জান্জিবার উপদ্বীপ
ভিক্টোরিয়ার জল, বৈকাল হ্রদ
নায়াগ্রার উষ্ণ আলিঙ্গন।
সামার ভ্যাকেশনে
আমিও উড়ে যেতে পারতাম ফিলাডেলফিয়া থেকে বুদাপেস্ট,
ব্রাসেলস ছেড়ে হেলসিংকি !
কেপটাউন থেকে জ্যামাইকা…
প্রিয়তমা দেশ,
তোমার মাতৃমোহনীয় আলিঙ্গনে,
আমি ভালোবেসেছি তোমাকেই।
প্রত্যহ ঘুম থেকে জেগে,
একটি স্বাপ্নিক সবুজ পৃথিবী দেখার ইচ্ছে লালন করেছি আজন্ম,
দেখতে চেয়েছি মেঘমুক্ত সূর্যের হাসি।
প্রিয় জন্মভূমি,
আমি কি ভুল করেছি তোমার সবুজ হৃদয় কে ভালবেসে?
=========================
বাংলার পথে পথে
বদরুল আলম
বাংলার পথে পথে কতো রূপ দেখেছি-
মাঠ-ঘাট,ঝিল-নদী শত ছবি এঁকেছি
সবুজের সমারোহে আছে যে দেশটা
গোধূলির সূর্যতে রাঙা পরিবেশটা।
কত আলো,কত শোভা, কত শত গাঁও
কত আশা,কত ভাষা,নদী পথে নাও
চলে রোজ নাই খোঁজ চলছে তো চলছে
নদীপথে মাঝিমাল্লা সুখে-দুঃখে বলছে…
অপরূপ দেশটা যে চারিদিকে আলো
পথে পথে ঘুরে ফিরে দিন কাটে ভালো।
এ দেশে কৃষাণের চাষাবাদে কত আশা
ধান, পাট, সরষেতে সুনিপুণ ভালবাসা!
এ মাটির সোনাফলা কৃষকের মুখে হাসি
নবান্নের উৎসবে দেশটাকে ভালবাসি।
এ গাঁয়ে তাতি জেলে,কুমার আর কামারের
কারুকাজ, নাই লাজ, আঁখি জল চামাড়ের
এ দেশের বাউলেরা গান গায়,কথা বলে…
মানবতা মনোব্যথা থেকে থেকে পাশে চলে।
এই ত বাংলা আমার কি অপরূপ দেশটা!
সুখে-দুঃখে বেঁচে থাকা শুরু থেকে শেষটা।