এখন সময়:রাত ১০:৪১- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ১০:৪১- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

রাতের কুটুম

আলী আসকর

রাস্তাটা হালকা ঢালু হয়ে নিচের দিকে নেমে গেছে। রাস্তার একপাশে সারি সারি গাড়ি দাঁড়ানো। বেশিরভাগ গাড়িই নতুন এবং ঝকঝকে। এয়ারপোর্টের আশপাশে সাধারণত পুরনো গাড়ি চোখে পড়ে না। এই এলাকাটা রাতদিন ভিআইপিদের পদচারণায় মুখর থাকে। স্যুট-টাই পরা লোকদের ছুটোছুটি থাকে। এয়ারপোর্ট এরিয়াটা যেন দেশের একটুকরো ছিমছাম স্বর্গ।

গাড়ি রাখার একটা জায়গা পাওয়া গেল। পেছনে চার-পাঁচ ফুট জায়গা রেখে জুতমতো করে গাড়িটা পার্ক করল রাহাত। সিটবেল্ট খুলে গাড়ি থেকে নেমে মিথিলার নামার জন্য অপেক্ষায় থাকল। খুব ধীরে মিথিলা পা রাখল বাইরে। তার পিঠে হাত রেখে পাশাপাশি হাঁটতে থাকল দুজন।

মিথিলার বাচ্চার বয়স আট মাস চলছে। রাহাতের ইচ্ছে ছিল বাচ্চার ফুলটা এখানে ফুটুক। কিন্তু  শ্বশুর-শাশুড়ির বাড়াবাড়ির জন্য তার ইচ্ছেটার মৃত্যু হয়ে গেল। শ্বশুর ডাক্তার হওয়ার কারণে তাঁর একটা বিরাট পরিধিও আছে কানাডায়। নিজের তত্ত্বাবধানে থাকবে মেয়ে। সুঁই-সুতোর ঝামেলাও থাকবে না কোথাও। এমন লোভনীয় ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে কেইবা কথা বলতে পারে। মিথিলাকেও মা-বাবার কাছে হার মানতে হয়েছিল সেদিন।

 

মিথিলা হাঁটতে হাঁটতে বলল, এবার তোমার ভিসা প্রসেসিংটা করে ফেলব। আর কিন্তু না করতে পারবে না। বাচ্চার কথাও একবার ভাবা উচিত। কী, চুপ হয়ে আছো কেন?

এই চাকরি কানাডায় পাওয়া যাবে?

চাকরি পাওয়া যাবে না হয়তো, কিন্তু টাকা তো পাওয়া যাবে।

তুমি তো কখনো টাকা নিয়ে ভাবোনি। যেদিন আমাকে প্রথম প্রেমের পাঠ দিয়েছিলে সেদিনটায় আমার কাছে কপর্দকও ছিল না। তুমিই রেস্তোরাঁর বিল দিয়েছিলে। আমি ভীষণ লজ্জায় পড়েছিলাম।

এখন থেকে নতুন মেহমান নিয়ে ভাবো। মেহমান আসার বাকি মাত্রই দুই মাস। তোমার এই বেতনে আমাদের আর চলবে না।

আমি কি এখন কম বেতন পাই? সর্বমোটে সোয়া লাখ তো উঠেই।

এতোদিন তোমার কথায় চলেছি। এখন আমাদের কথায় চলবে।

আমাদের কথায় মানে?

আমি এবং আমার বাচ্চার।

বাচ্চার কথা শোনে রাহাতের বিরাট হাসি আসতে চাইল। কিন্তু ততক্ষণে সময় শেষ হয়ে গিয়েছে, প্রবেশ পথেই সিকিউরিটি তাকে পথ আটকে দিল।

মিথিলা বলল, ফ্লাইট আকাশে না ওড়া পর্যন্ত এয়ারপোর্টেই থাকবে।

আচ্ছা, থাকবো।

হাত নেড়ে ভেতরে ঢুকে গেল মিথিলা। মিথিলার জন্য মনটা হঠাৎ কেমন করে উঠল রাহাতের। মিথিলার অনুপস্থিতির অভাবটা তার ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল। আজ থেকে আবার হয়তো ব্যাচেলর জীবন শুরু হবে। ব্যাচেলর জীবন যে কতো কষ্টের পেছনে না তাকালে তা বোঝাই যায় না।

এগারোটা বিশ মিনিটে ফ্লাইট উড়াল দেওয়ার সময়। এখন বাজে মাত্র দশটা বিশ মিনিট। আরও এক ঘণ্টা সময় বাকি। এতো লম্বা সময় ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকা মোটেই সম্ভব নয়। রাহাত গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল। মিনিট দুই হাঁটলে গাড়ির কাছাকাছি পৌঁছে যাবে নিঃসন্দেহে।

গাড়ির দরজায় চাবি দিতেই ভীষণ চমকে উঠল রাহাত। দরজা খোলা। গাড়ি থেকে নেমে যে গাড়ি লক করেনি পরে অবশ্য সেটা মনে পড়ল। যদিওবা এলাকাটা নিরাপত্তার চাদরে মোড়া। গাড়ি চুরি হওয়ার ভয় নেই। তার পকেটে পার্কিং কার্ডও আছে। এই কার্ড ছাড়া গাড়ি বের করাও অসম্ভব। ও দরজা খুলে আয়েসি ভঙ্গিতে সিটে হেলান দিয়ে রেকর্ড প্লেয়ার চালু করল। মান্না দের অলস দুঃখ-বেদনার একটি গান করুণ সুরে বাজতে থাকল।

পেছনের সিট থেকে কিছু-একটা শব্দ পেয়ে ঘাড় ফেরাতেই কেউ একজন খসখসে গলায় বলে উঠল, একদম চুপ। একটিমাত্র কথায়ও মাথা থেতলে যেতে পারে।

রাহাত কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কে আপনি?

আমি কুটুম।

কুটুম! কেমন কুটুম? প্লিজ ওটা নামিয়ে ফেলুন। বিপদ হয়ে যেতে পারে।

বিপদের কাজ করলে নির্ঘাত বিপদ হবে। সুবোধের মতো সোজা বের হয়ে পড়ুন। এক দুই তিন বলার সময় নেই।

কোথায় যাব?

আপনার বাসায়।

আমার বাসায়?

হ্যাঁ, আপনার বাসায়। আপনার সাথে আমার আজ বাসর হবে। খেলাধুলা হবে। এ কদিন তো বউয়ের পেটের জন্য দূরে দূরেই ছিলেন। আয়েস মতো খেলতে পারেননি। এমন একটা ম্যাডম্যাডে মেয়েকে বউ করেছেন যাকে কোনোদিন সিনেমার নায়িকাও বানাতে পারেননি। চুটিয়ে প্রেম-ভালোবাসাও করতে পারেননি। গাড়ি স্টার্ট দেন। গুলি-টুলি চালাব না। ভীতু মানুষকে গুলি চালিয়ে লাভ নেই।

রাহাত প্রকৃত ছোটকাল থেকেই ভীতু টাইপের ছিল। কলেজ-ভার্সিটিতে কোনোদিন রাজনীতি-টাজনীতিও করেনি। এসবে না জড়ানোর পেছনে ছিল ভয়। লাঠিসোটার ভয়, পিস্তল-বন্দুকের ভয়, মারামারি ভয়। আজো রাহাত কোথাও কোনো আড্ডায়-ফাড্ডায় থাকে না। সে ভোটার হয়েছে এগারো বছর হলো। অথচ ভোট দেওয়ার জন্য কোনোদিন ভোট কেন্দ্রেও যায়নি। ওই একটাই কারণ, মারামারির ভয়, সংঘর্ষের ভয়।

রাহাত গাড়ি স্টার্ট দিল। পার্কিং কার্ড সিকিউরিটির হাতে দিয়ে গাড়ি রাস্তায় তুলে দিল। এয়ারপোর্টের রাস্তা বলে কথা। অসম্ভব পরিপাটি মসৃন। সোডিয়াম আলোতে রাস্তায় আলোর কণাগুলো হুলুস্থুল খেলে যাচ্ছে। কী আশ্চর্য, এমন ঝকঝকে আলোতেও তার গাড়ির গতি উঠছে না। তার হাত কাঁপছে। স্টিয়ারিং থেকে বারবার হাত আলাদা হয়ে যাচ্ছে।

বাড়ির কাছাকাছি এসে রাহাত গাড়ি থামাল। নিরিবিলি সুনসান বাড়ি। চারপাশটা নিঝঝুম হয়ে আছে। কুটুম মেয়েটি একটি হাত লুকিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকল।

একটি রুমাল মুড়িয়ে পিস্তলটা একপাশে রাখল মেয়েটি। ওই পিস্তলটার দিকে তাকাতে রাহাতের প্রচ- ভয় হচ্ছে। ও ক্রমশ মিইয়ে যেতে থাকে। শরীরের কোষগুলো দ্রুত প্রাণ হারাতে থাকে। মেয়েটির দিকে তাকাতেও তার ভয় ভয় লাগছে।

মেয়েটি বলল, আমার নাম আজরা। ইডেনে রাজনীতি করা মেয়ে। সামনের কাতারে থাকতাম। শুধু মেয়ে না, ছেলেদেরও পিটানোর ইতিহাস আছে আমার। গুলি করার ইতিহাস আছে। ইডেনের সেই মেয়েটি এখন রাতের কুটুম হয়ে গিয়েছে। সুন্দরবনের হিং¯্র বাঘ হয়ে গিয়েছে। কাপড় বদলে রাতের কাপড় পরুন। আমার সময় কম। খেলাধুলা শেষ করে আবার একটা ছয় ঘণ্টার ঘুম দিতে হবে। একদম চটজলদি। দ্রুত।

প্রসাবের বেগ পেয়েছে রাহাতের। টেনশন বাড়লে তার প্রসাবের বেগও বেড়ে যায়। কাপড় বদলিয়ে তাকে বাথরুমে যেতে হবে আগে। বাথরুম থেকে ফিরে এলে সে কী রকম বিপদে পড়ে যাবে তার কিছুই আন্দাজ করতে পারে না রাহাত।

রাহাত যখন ফিরল তখন কিছু সময় গড়িয়ে গেছে। এই দেরি সময়টুকুন কিছুতেই মেনে নিতে পারল না আজরা। সে সাথে সাথে তাচ্ছিল্য স্বরে বলল, মেয়ে মানুষের কাপড়-চোপড় পরতে দেরি হয় জানতাম, কিন্তু পুরুষ মানুষের কাপড় পরতে দেরি হয় জানতাম না।

রাহাত মাথা নিচু করে বলল, কাপড় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। শেষে ওর ব্রিফকেসে পেলাম।

আলো বন্ধ করে বিছানায় ওঠুন। তারপর কাপড় খুলে ফেলুন। গায়ে কিছুই রাখার দরকার নেই। আপনি নিশ্চয় রাতে বিনা কাপড়ে ঘুমান?

চুপ হয়ে থাকে রাহাত। কোনো জবাব দেয় না সে।

প্রশ্নের পর উত্তর না দিলে আমার মেজাজ সাত আকাশে ওঠে যায়। তখন আমার অঘটন তৈরি করতে দুই মিনিটও লাগে না।

রাহাত আড়চোখে পিস্তলের দিকে তাকায়। আজরার ডান হাতটা পিস্তলের একটা অংশে লেগে আছে। পিস্তলের গায়ে হাত দেখে রাহাত ভয়ে আরও কুঁকড়ে যায়।

লাইট অফ করে দেবো?

আপনি কি লাইট জ্বালিয়ে করেন?

না না, লাইটে আমি ঘুমাতে পারি না। মিথিলাও পারে না।

আপনার স্ত্রীর নাম কি মিথিলা?

জি, মিথিলা।

জি জি করে কথা বলবেন না। খেলাধুলা লোকদের সাথে কেউ জি-হুজুর করে কথা বলে না। একটু পর আমিও আপনার সাথে তুমি করে কথা বলবো। তুমি’র ভেতর খেলাধুলার একটা আমিত্ব আছে। অবশ্য তাল, লয় আজ আমিই সৃষ্টি করবো। আমিই আজ গানের ইশ্বর, আমিই সুরকার, আমিই কণ্ঠসম্রাজ্ঞী।

লাইট অফ হয়ে গেলে পুরো ঘরটা মিশমিশে অন্ধকার হয়ে গেল। ভয় পেতে শুরু করল রাহাত। ভয়ে থিরথির কাঁপতে থাকল সে। বাইরের অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছে আজ শুক্লাপক্ষের আশেপাশের কোনো রাত হবে। খচখচের কিসের যেন শব্দ হচ্ছে। কাপড় খোলার শব্দ নয় তো? মাথায় কোনো কিছুই স্থির করতে পারে না রাহাত। সাপের গতির মতো কে যেন উঠে আসছে বিছানায়। ঘরে আজরা ছাড়া দ্বিতীয়টি কেউ নেই।  তার গায়ে উদোম একটি হাত পড়ল। উদোম একটি পা উঠল নাভির কাছাকাছি।

উদোম একজোড়া উষ্ণ ঠোঁট ওর ঠোঁটে বাজপাখির মতো হামলে পড়ল। রিমান্ডে আক্রান্ত কোনো নিরাপরাধী ভুতুড়ে মানুষটির মতো চুপ হয়ে থাকল রাহাত।

সকালবেলা একথালা রোদ নিয়ে সূর্য উঠল। ফকফকা তেজী রোদ। ঘুমিয়ে আছে রাহাত। কম্বল ঠেলে পরণের কাপড় মুঠোয় নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল আজরা। সাওয়ার ছেড়ে দিয়ে অনেকক্ষণ পানি ঢালল উদোম শরীরে। বাইরে একটানা ডেকে চলেছে অচেনা সব পাখি। ও খানিক পাখির কিচিরমিচির শুনল। পাখিদের কণ্ঠও যে এতো সুন্দর হয় আজরা এতদিন সামান্যও আঁচ করতে পারেনি। কাপড়চোপড় গায়ে লাগিয়ে কাকে যেন ফোন করল আজরা। তার উপস্থিতির ঠিকানা দিল। ধড়ফড় করে ওঠে পড়ল রাহাত। পুলিশ-টুলিশের কাছে ফোন দেয়নি তো মেয়েটি? এমন কিছু হলে তো তার মানসম্মানের টিকিটাও থাকবে না। এ মাটিতে বসবাসেরও অযোগ্য হয়ে যাবে সে।

আজরা নরম স্বরে বলল, ওঠুন মিস্টার। আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।

বিছানা ছেড়ে আজরার হাস্যমুখে তাকিয়ে থাকল রাহাত।

কী দেখছেন হাবাগোবার মতো, আপনি ভালোই পারেন বটে। আপনার ম্যাডাম ছাড়া সামনের এতোগুলো রাত কীভাবে কাটাবেন? আপনি চাইলে আমি ছুটে চলে আসবো। আমার অনেক টাকার প্রয়োজন। এক লাখ, পাঁচ লাখ… আজ অবশ্য দশ হাজার দিলে হবে।

একটা ফোন এলো আজরার মোবাইলে। সে লোকটাকে উপরে উঠে আসতে বলল।

আজরা দরজা খুলে দিলে এক জরাজীর্ণ লোক এসে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। রাহাতের জমাটবাঁধা ভয়টা ধীরে ধীরে গলতে শুরু করল।

আজরা লোকটির দিকে নরম চোখে তাকিয়ে বলল, আমার স্বামী আফজাল টুকু। একসময় সেরা ফুটবল প্লেয়ার ছিল। কিন্তু ক্যান্সার তার শরীরটাকে তুলোধুনো করে দিয়েছে। আজ ওর থেরাপির তারিখ। দশ হাজার টাকা লাগবে। দশ হাজার তো আর চাট্টিখানি কথা না। আপনাকে কাল না পেলে টুকুর বিরাট ক্ষতি হয়ে যেত। ও ছাড়া যে আমার কেউ নেই। ওকে প্রচ- ভালোবাসি আমি, প্রচ- ভালোবাসি-এই বলে হু হু করে কেঁদে উঠল আজরা।

রাহাত আলমিরা থেকে দশ হাজার টাকার একটা বান্ডিল বের করে দিল আজরার হাতে। টাকার বান্ডিলটা হাতে নিয়ে আজরা আবার কাঁদতে শুরু করল।

 

 

আলী আসকর, গল্পকার

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে