আশরাফ উদ্দীন আহমদ :
অতঃপর একেই বলে কপাল! কপালে না থাকলে যতোই চেষ্টা করো কিছুই হয় না। কমলার মা আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছে সবই। অভাগী যেদিক তাকায়, সাগর শুকোয়। এভাবে হাতেনাতে ধরা পড়ে যাবে, কে বা জানতো।
রফিকুদ্দি তক্কে-তক্কে ছিলো কয়েকদিন থেকে। জুৎসই একটা মোক্ষম প্রমাণ তার দরকার। সেই প্রমাণের অপেক্ষায় ছিলো সে। তা যে এতো শিগগির পাবে ভাবতেই পারেনি ঘুণাক্ষরে। প্রমাণ ছাড়া কাউকে জালে আটকানো যায় না।
স্কুলের ছাত্রাবাসে সুপারেন্টটেন্টের চাকরি করছে বেশ কয়েক বছর ধরে রফিকুদ্দি। ছেলেদের পাহারা থেকে বাজার করা, খাওয়া-দাওয়া এমনকি দেখাশোনা সবই তার দায়িত্ব। আর তাই রফিকুদ্দি কয়েকদিন থেকে লক্ষ্য করছে ব্যাপারটা। মাছের টুকরো-গোস্তের সাইজ ছোট হচ্ছে ক্রমশ। অথচ কোনোভাবেই এমনটি হওয়ার কথা নয়। দু’ ছয় মাস আগেও একই মাছ বা গোস্ত সমসংখ্যাক বোর্ডারের পাতে যেভাবে পড়তো, এখন আর সেখানে নেই। ব্যাপারটা কেমন যেন একটু রহস্যময়! ফলে অতি গোপনীয়ভাবে রফিকুদ্দি আজ একটু ভিন্ন ধারার ছল করে।
ঠোঁটে একটা সিগারেট গুঁজে এসে বললো, গ্যাসলাইট দাও তো কমলার মা! তৎক্ষণাৎ কোনো শব্দ না করে নিজেই রসুইঘরে ঢোকে। তারপর উনুনের কোণের ঠিক একটু ওপরের গ্রাসলাইট রাখার কুলুঙ্গিটার দিকে হাত বাড়ায়। চোখে পড়ে কুলুঙ্গির ভেতরে কলাপাতায় মোড়ানো কিছু একটা। টান দিতেই বেরিয়ে আসে পাঁচ/সাত খানা পেটের দিককার বড় সাইজের মাছের টুকরো। দেখেই রফিকুদ্দি একেবারে তেলে-বেগুনে জ¦লে ওঠে দপ করে। কমলার মা ঘটনার দিকে নজর দিয়েও না দেখার ভান করলো শুধু। মাছের ঝোলে চামচ দিয়ে লবন চাখচ্ছে তখনো। কলাপাতায় জড়ানো মাছের টুকরোগুলো চট করে হাতে তুলে নেয়। তারপর কমলার মায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ায় রফিকুদ্দি। সিগারেট ঠোঁট থেকে বা-হাতের আঙ্গুলের মাঝে ধরে বিজয়ীর ভঙ্গিতে আড়চোখে তাকায়। বিস্মিত কন্ঠে এবার রফিকুদ্দি বলে, এগুলো কী কমলার মা—
কমলার মা একবার শুধু চোখ তুলে তাকায় খানিক। কিছুক্ষণ পর মাথা নিচু রেখে নিলিপ্ত গলায় উত্তর দেয়, মাছ…
হালকা শাসনের স্বরে রসিকতা করে রফিকুদ্দি বললো, হ্যাঁ-হ্যাঁ মাছ, তা তো আমিও দেখছি কিন্তু…
সরল গলায় কমলার মা তৎক্ষণাৎ জানালো, ভাঁজতে যাবার সময়, ওই ক’ খানা উনুনের পাশে পড়ে ধুলো লেগে—
রফিকুদ্দি এবার মাছগুলোর দিকে দৃষ্টি বুলিয়ে বলে, ও আচ্ছা ভালো কথা, কিন্তু মাছের গায়ে তো… একেবারে চকচকে যে…
Ñনা মানে আবার ধুঁয়ে রেখেছি কি না!
Ñবাহ্ খুউব চমৎকার কথা। মুখের ওপর উত্তর যে বেশ জুগিয়েই রেখেছেন। কড়া শাসনের কন্ঠে আবার রফিকুদ্দি বলে ওঠে, শোনো কমলার মা, অতো সহজে কাউকে কোনোদিন বোকা বানানো যায় না। নিজেকে বড় চালাক ভাবো, না!
কমলার মা নির্বাক-নিস্তব্ধ পাথর যেন। মুখে কোনো শব্দ সরে না। যেন বা একেবারে বোবা হয়ে গেছে সে। কটকটে চোখ দিয়ে রফিকুদ্দির রাগ দাউ-দাউ জ¦লছে এখন। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলো। তবুও দাঁত কটমটিয়ে বলতে থাকে, আজ প্রায় মাসখানেক ধরেই দেখছি, মাছ শুধু ধুলোয় পড়ে যায় আর কলার পাতায় হাওয়ায় উড়ে যায়…
কমলার মা কিছুই বলে না। মুখের সমস্ত ভাষা তার হারিয়ে গেছে। কী বলবে বা! ভাষাও কখনো-সখনো পাথর হয়ে যায়।
আবার রফিকুদ্দি বলে, যাক, আমি কিছুই বলবো না। তবে একটা হেস্তন্যাস্ত করে ছাড়বো। হেডমাস্টার-সেক্রেটারিকে জানাবো… তারা যা ভালো বোঝেন করবেন, আমি এ’ ব্যাপারে মাথা ঘামাবো না!
ধড়াস করে ভেঙে গেলো যেন বা কমলার মায়ের বুকের খাঁচা। মাথাটা টাল খেলো একটু। কাতর মায়াভরা শান্ত চোখ তুলে একবার দেখতে চেষ্টা করলো, কিন্তু ততক্ষণে রফিকুদ্দি মাছ নিয়ে বাইরে বার হয়ে গেছে। আচমকা রাগে মাথার চাদি গরম হয়ে যায়। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারে না সে। নিজের গালে নিজেরই চড় মারতে ইচ্ছে হয় কমলার মায়ের। একী মহান্যায় কাজ করে ফেললো, এখন আর কী-ই বা করবে। ভেবে কোনো কুল কিনারা পায় না! চোখের সামনে আঁধার এসে জট পাঁকায়। এতো আঁধারের মধ্যে পথ খুঁজবে কী করে, সব পথ যে বন্ধ এখন। কোথায় যাবে। কে তাকে হাত ধরে ডাঙায় তুলবে। এভাবে সে কি তবে তলিয়ে যাবে এঁদো পঁচা প্যাঁকে। চোখ তুলে জানালার বাইরের আকাশ দেখে। আকাশ এখন কেমন যেন বিষন্ন। মনে হয় তার মতোই শত-সহ¯্র দুঃখ ব্যথা শোকে অমন ম্লান করে রেখেছে সোনা মুখটা।
ছাত্রাবাসের প্রাচীরের ধারে কৃষ্ণচূড়া আর রাঁধাচূড়া গাছের পাতারা ঝিরিঝিরি বাতাসে কী যেন বলছে চুপিচুপি। ওদিকের পলাশ-শিমুল গাছগুলো নির্বাক তাকিয়ে। বেশ কয়েকদিন হলো, স্কুলের দপ্তরি রাহাত মুন্সী ছুটি নিয়ে দেশের বাড়ি বোয়ালমারী গেছে। কমলার মাকে এই মানুষটা নিজের মেয়ের মতো মনে করে। মানুষটার মনে অনেক কষ্ট। নিজের ছেলে-পুলে নেই বলে এক ভাগ্নিকে কাছে রেখে বড় করেছিলো, কিন্তু সেই ভাগ্নিও একদিন তাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে। মানুষটার মনে বড়ই দয়া। ভাগ্নিটাকে এতোটাই ভালোবাসে, আজো তার একটা ছবি সঙ্গে রাখে। মাঝে-সাঝে দেখে আর কাঁদে।
সেই ভাগ্নি নাকি রাহাত মুন্সীকে বাবা বলে ডাকতো। আজো বাতাসে ভেসে আসে ওর সেই বাবা ডাকটা। কমলার মাকে প্রায় তার ভাগ্নির গল্প শোনায়।—ভাদ্র মাসের এক বিকেল ওয়াক্তে, মাকে আমার, সাপে কাটলো…
কাঁদতে-কাঁদতে বুক ভাসায় তারপর। কমলার মা শোনে রাহাত মুন্সীর বুক ভাঙা আর্তনাদের কথা। বড় দয়া-ভালোবাসা মানুষটার শরীরে। এমন এক লোকের ভাগ্যেও আল্লা এমন কড়া লিখন লিখে রেখেছে ভেবে সেও কষ্ট পায়। কষ্ট এ’ সময় কান্নায় রূপ নেয়।
রাহাত চাচা থাকলে ব্যাপারটা হালকা করে দিতো। এমন কি করবে বুঝতে পারছে না। পৃথিবীতে ওই একটা লোকই কমলার মায়ের কষ্ট বোঝে। বাপের মতো মানুষই বটে। জন্ম দিলেই কি শুধু বাপ হওয়া যায়! রাহাত চাচা একজন হতভাগ্য মানুষ বলেই কমলার মায়ের দুঃখটা অনুভব করতে পারে। পুরানো লোক বলে হেডমাস্টার-সেক্রেটারি এমনকি স্কুলের প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত ভালোবাসে, মান্য করে। তাছাড়া এমন মানুষকে ভালো না বেশে পারে!
সে যাই হোক, এখন কমলার মা কী করবে! অন্ধকার ঘরে শুধু কেঁদে কী লাভ ? চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। মন একটু হালকা হলেও বুকের ভেতর কেমন খচখচ করতে থাকে। আজ দশ/বারো বছর ধরে এখানে কাজ করছে, কেউই কোনো দোষ-ক্রটি ধরতে পারলো না। রান্না সময়মত-খেতে দেওয়া বা আচার আচরণ অথবা পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতায় কমলার মা আগাগোড়া একেবারে পরিপাটি। তবে আজ কি হলো তার! স্কুলের সেক্রেটারি-হেডমাস্টার থেকে শুরু করে সমস্ত মাস্টার-ছাত্ররা জানবে আজ, কমলার মা একটা চোর! এমনকি ফেরেস্তার মতো মানুষ প্রেসিডেন্টের কানে যাবে তার কীর্তির কথা। সবাই কি ভাববে তাকে নিয়ে ? কমলার মা এতোকাল চুরি করে আসছে তাদের ছাত্রাবাসের মাছ-মাংস-আনাজ। ছাত্রেরা আলোচনা করবে, কমলার মা তাদের হকের খাওয়া মেরে দিতো এতোকাল। চুরির অপরাধে হয়তো কাজটা চলেও যাবে।
পুরানো কাজ হাতছাড়া হওয়া মানে মাথায় হাত! কী এখন করবে, কিছুই ভেবে পায় না। সমস্ত ভাবনা তালগোল পাঁকিয়ে যায় মুহূর্তে। অনেকক্ষণ স্তব্ধ বসে থাকে। চোখে অন্ধকার দেখে। কিছুই ভালো লাগে না। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়েছে, তাকে কীভাবে সরাবে। নাকি এভাবে আকাশ মাথার ওপর চেপে বসে থাকবে।
একসময় সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে কমলার ওপর। মেয়েটা এভাবে তাকে মারবে, কে বা জানতো। মেয়ে নয় যেন আস্তো নাগিন! যদি ওই সর্বনাশা কাজ না করতো, তাহলে তো তাকে মাছ চুরি করতে হতো না আজ। চোরের শাস্তি তো একটা হবেই। কিন্তু তারপর মুখ দেখাবে কীভাবে সে। রাজ্যের মানুষ আঙুল তুলে দেখিয়ে বলবে, স্কুলের ছেলে-পুলের মাছ-মাংস চুরি করার অপরাধে কাজ হারিয়েছে কমলার মা… ছি-ছি-ছি কি লজ্জা! কি লজ্জার বিষয়! ধনী-গরিবের সবারই মান-অপমান বলে তো একটা কথা আছে। সেটা আর থাকলো না তার। যার যায় এভাবেই যায়।
তারা গরিবের চেয়েও গরিব মানুষ। গরিবের মতো একবেলা খেয়ে আর একবেলা পেট খালি রেখে উপুড় হয়ে পড়ে থাকতো। গরিবের যা হয়, সে রকম যা হোক একটা ব্যবস্থা হতো তার। কিন্তু কী দরকার ছিলো, বড়লোকের ছেলের দিকে ওমন হ্যাঙলার মতো হাত বাড়ানো। সে কি জানে, গরিবের ঘোড়ারোগ থাকতে নেই। গরিব হয়ে জন্মানো পাপ, মহাপাপ! চোখ দিয়ে একসময় দড়দড়িয়ে পানি পড়ে কমলার মায়ের। অতোগুলো মানুষের সামনে কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে সে। ভেবে কোনো কূল খুঁজে পায় না।
মিনসেটাও আজ মাস তিনেকের বেশি হলো মাজা ভেঙে পড়ে আছে। রাগে কথাগুলো একবার ভেবে আবার একটা নিঃশ^াস ফেলে। মনে-মনে বললো, যা হয় হবে… শাক দিয়ে তো আর মাছ ঢাকা যায় না। কিন্তু এটাও তো সত্য, কাজটা চলে গেলে কী খাবে এতোগুলো মানুষ। উপোস করে চার চারটে মানুষ ঘরের কোণে ক’ দিনই বা পড়ে থাকবে। মিনসেটা তেঁতুল ছাড়িয়ে নারকোল গাছ ঝুরিয়ে, শীতের সময় খেঁজুর গাছ কেটে রস বিক্রি করেও তারপর বাকি রস দিয়ে যা গুড় তৈরী করতো, মুনীশ খেটে যা হোক কিছু তো আনতো দিন শেষে! কাজীদের নারকোল গাছ ঝুড়তে গিয়ে এমন করে আচমকা পড়ে কোমর ভেঙে বিছানায় এখন মানুষটা। উঠতে-বসতে পারে না। সারাদিন রাত্রি শুধু কঁকিয়ে মরে। সময় একটু পেলে, মন টন ভালো থাকলে কমলার মা রসুন পিষে করে একটু লবন দিয়ে সরিষার তেল গরম করে, তারপর মালিশ করে দেয়। অমল কবরেজ বলেছে, কোমরের হাড় ভেঙে গেছে…
সপ্তাহ কয়েক ওকে গাছ-গাছড়া শেকড়-বাকড় খাওয়াতে গিয়ে ঘটি-বাটি সব বন্ধক গেছে এলাকার টাকাওয়ালা মানুষদের কাছে। আলফাডাঙা থেকে হানিফ মুন্সীর তিন নম্বর বউ ছমিরন কাঁকড়া-বিছের তেল এনেছিলো সেবার। বেশ নাকি কাজে লাগে তেলটা, কষ্ট একটু কমে। তাও শেষ হয়ে গেছে। কান্নাটা দলা পাকিয়ে যাচ্ছে বুকের মধ্যে। নিজেকে বড় অসহায় লাগে কমলার মায়ের।
কয়েকজোড়া চড়ুই প্রাচীরের ওপর বসে আছে। একটা কাক দূর কোনো গাছে বসে ডাকছে একটানা। মেয়ের কা-, স্বামীর ওমন আকস্মিক দুর্ঘটনা, আবার আজ একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়লো মাছ নিয়ে! কী যে করবে সে! ভেবেই পায় না কিছু। রফিকুদ্দি লোকটা একটু অন্যরকম প্রকৃতির, বাড়িতে স্ত্রী আছে, ছেলে-মেয়ে আছে, তবুও মনটা তার ছ্যাঁকছ্যাঁক করে, মেয়েদের দিকে কেমন- কেমন করে তাকায়। নিজে বাজার করতে গিয়ে এদিক-ওদিক করবে, তার বেলায় কিছু নয়, অথচ অপরের বেলায় রাজ্যের অপরাধ। কমলার মায়ের পেছনে লেগেছিলো অনেকদিন থেকেই, কিন্তু কোনোভাবেই বেকায়দায় ফেলতে পারেনি।
একবার বলেছিলো, টাকা-পয়সার দরকার থাকলে নিয়ো আমার কাছ থেকে…
কমলার মা সাফ-সাফ জবাব দেয়।—টাকার দরকার নেই…
Ñআহা ওমন করে রাগছো কেনো গো!
Ñএমন কথা আর বলবেন না…
Ñঠিক আছে বলবো না, কিন্তু আমার কথা যে…
Ñআপনার সঙ্গে আমার কোনো কথা নেই।
Ñতা কি হয় মনা, তুমি আর আমি হলাম এই ছাত্রাবাসের…
Ñআমি কাজের মেয়ে আর আপনি!
Ñথাক-থাক ওমন কথা বলে ভেদাভেদ করো না, বরং বলো, আমরা কলিগ। সঙ্গে-সঙ্গেই কমলার মায়ের হাতটা সেদিন ধরেই বসে।
অকস্মাৎ কমলার মা কোনোদিকে না তাকিয়ে ডান হাত তুলে মারে একটা মোক্ষম চড়। মানে-মানে সরে যায় সে মুহূর্তে। কমলার মায়ের অগ্নিমূর্তি দেখার আগেই পালিয়ে বাঁচে সেদিন। চিৎকার করে জানায়, এরপর আর কোনোদিন যদি… হাটে হাড়ি ভেঙে দেবো।
তারপর থেকে রফিকুদ্দি একেবারে ভেজা বেড়াল। চোখ তুলে তাকায় না। শুধু মাটির মধ্যে কেঁচোর মতো সেঁধিয়ে থাকে আর বুঁনো শুয়োরের মতো ঘ্যাঁতঘ্যাঁত করে।
কমলার মায়ের ঠোঁটে হাসি একটু এলেও আজ হাঁড়ে-হাঁড়ে বোঝে সেদিনের শোধ নেবে। কখনো ভাবেনি এভাবে শোধ নেবে কড়ায় গ-ায় রফিকুদ্দি। এতোদিন তাহলে এ’ আশায় ছিলো। সেদিনের জন্য একটু অনুশোচনা হয়। বুক ঠেলে একটা নিঃশ^াস বের হয়। কষ্টেরও যে কষ্ট আছে বুঝতে পারে এ’ মুহূর্তে।
মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা আজ। কী দূর্গতিই না তার এ’ কয়েকমাস ধরে হচ্ছে। চার মাস ধরে মেয়েটাকে নিয়ে তো একের পর এক জ¦ালা সইতে হচ্ছে তার। ঝি-গিরি করেই খেতে হয় তাদের। মা-মেয়ে বাপে রোজগার না করলে চলবে কী করে সংসার। আর তাই নিজেদের পেটের ধান্দা নিজেদেরই করতে হয়। খন্দকার বাড়িতে দু’ বেলা শুকনো কাজ করতো। তিনজনের রোজগারে দুবেলা চাট্টি ভাত জুটে যেতো তাদের। এভাবেই দিন যাচ্ছিলো এককম।
কমলার মা ভেবেছিলো, এবার একটা বিয়ে দেবে কমলার। মনে-মনে দেখাশোনার কাজটাও চালায়। একটু ভালো ঘর খুঁজছিলো। আত্মীয়-স্বজন পরিচিত সবাইকে বলেও রেখেছিলো, একটা পাত্র দেখে দেওয়ার জন্য। গোবরডাঙার বিনু মাঝি কমলাকে দেখে একপ্রকার পছন্দ করে সেবার হাতিগঞ্জের চৈত্রসংক্রান্তির মেলায়। তার একমাত্র ছেলের জন্য নাকি বেশ মানাবে, কথাটা জানায় কমলার মাকে।
ওদিকে আবার হরিদাসপুরের ভেঁদো স্যাঁকড়া কমলার বাপকে ধরে, তার বাপ মরা ভাইপোর সঙ্গে বিয়ের জন্য। আর কালনার আবুল বয়াতির নাতি তেঁতলে বয়াতিও দু’চারজন ছেলে-ছোকরা নিয়ে দেখে গেছে কমলাকে। সবাই বেশ পছন্দ-টছন্দও করে। চেহারা-সুরোত দেখে, সুখ্যাতি করেছে সবাই একবাক্যে। কিন্তু সেই একটা জায়গায় থেমে যায় তারা। দেন-দরবার ব্যাপারটা বড় গন্ডগোল পাঁকিয়ে দেয়। সাইকেলÑঘড়ি-টেলিভিষন এবং সে সঙ্গে নগদ টাকা… এতো চাহিদা, কোথায় পাবে বুঝে উঠতে পারেনি। টাকা নাহয় সাহায্য-টাহায্য বা ধার-দেনা করে দেওয়া যায়। কিন্তু বরপক্ষের রাক্ষস মুখ বন্ধ হয় না।
হাত উঁচিয়ে বলে কি না, রোজ তো আর নিতে আসছি না। আর দেবেও না, একবারই তো দেবে…
মেয়ে যখন একটা দুহাত ভরে দিতে কী এমন! দিতে কার বা বাঁধে। সবাই চায় মেয়ে-জামাই সাজিয়ে দিতে। কিন্তু কমলার মা কোথায় পাবে! এতো টাকা এক সাথে জীবনে কোনোদিন দেখেনি সে। কথাবার্তা চলছিলো এমন। অনেক জায়গা থেকে সন্ধান আসছিলো পাত্রের। আর ঠিক এমন সময় বজ্রপাত মাথার ওপর। মেয়েটা এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বসবে, কে বা তা জানতো।
অনেক বকাবকি গালাগালি এবং চাপাচাপির পর নামটা বলেই ফেলে কমলা। মেজো খন্দকারের ছোট বউয়ের সেজো ছেলে কবিরের কা-। স্কুল পাস করে সবে কলেজে ঢুকেছে। কেলেঙ্কারির ভয়ে প্রথমে চাপা দিতে চেয়েছিলো কমলার মা-বাপ। বড়লোকের ছেলেদের দোষ খোঁজা একরকম অপরাধ গরীবদের। সে কারণে মুখ বঁজে থাকে। ঠিক করেছিলো অমল কবরেজ কিংবা সাইদ ডাক্তারের কাছে নিয়ে একটা ব্যবস্থা করবে। অমল কবরেজ আবার মুখ পাতলা মানুষ আর সে কারণে মনস্থির করে সাইদ ডাক্তারকে দিয়েই খালাসের কাজটা সারবে। থানা হাসপাতালের বড় ডাক্তার সে। বাড়িতে এসব করে গোপনে, লোকমুখে প্রচার। শহরে নাকি আজকাল এসব কোনো ব্যাপারই না। কথাটা পড়শি ভারি জয়তুনের কানে একদিন তোলে কমলার মা। যতো সুখ-দুঃখের কথা ওই জয়তুন ভাবির কাছে বলে মনটাতে হালকা করে।
ঘটনা শুনে একটু কী ভেবে আচমকা বলে ওঠে, কী লাভ পেট ফেলে… যা হয়েছে ভালো তো হয়েছে রে, তাছাড়া মেয়েও বিয়ের যুগ্যি ছেলেও তো—
কমলার মা মুখে হাত দিয়ে বসে থাকে। আবার জয়তুন ভাবি বললো, ওদের বিয়ে দিলেই তো সব সমস্যা চুকেবুকে!
অকস্মাৎ চমকে ওঠে কমলার মা। একি বলছো ভাবি! বড় বাড়ি, বড়ঘরের ছেলে, ঝিয়ের মেয়েকে বউ করে ঘরে তুলবে কেনো ?
জয়তুন ভাবি গলার স্বর ব্যঙ্গ করে জানালো, যাহ, বকিস না, কিসের বাড়ি-ঘর, তুলবে না কেনো বাছাধন!
কমলার মা স্বাভাবিক ভাবে বললো, না মানে রাজপুত্র ছেলে, বাপ টাকার কুমীর, যদি না মানে কমলাকে। ঘরে কি তুলে নেবে ?
উচ্চঃস্বরে হেসে ওঠে জয়তুন ভাবি। নেবে না মানে, রামরাজ্য পেয়েছে নাকি ব্যাটা! ওর বাপ নেবে দাদা নেবে চৌদ্দগুষ্টি এসে পায়ে ধরে নিয়ে যাবে—
কমলার মা একটা দীর্ঘশ^াস ছেড়ে বলে, আমার কিন্তু বেশ ভয় করছে, না জানি হিতে বিপরীত…
জয়তুন ভাবি এবার রেগে যায়। ভয়! কিসের ভয় রে! এই বেশি চালাক সাজিস না, ওদের পাপ ওদের ওপর ছেড়ে দে, নেবে না মানে…
কমলার মা বড় চিন্তায় পরে যায় এসময়। কী বলবে আর! জয়তুন ভাবি আবার বলে, চিন্তা করে লাভ নেই। ওরা ঠিক নেবে, নিজেদের ছেলে ওমন টুকটুকে মেয়েকে পেট ফুলিয়ে ঢোল করেছে, আর এখন বউ মানবে না, মগের মুল্লুক নাকি!
কমলার মা মাথা নিচু করে। জয়তুন ভাবি খিস্তি করেই কথা বলে বরাবরই। কমলার মাকে ভালোবাসে। আর বড়লোকদের সহ্য করতে পারে না। কিন্তু যতো সহজ ভাবে কথাটা বললো, আসলে বাস্তব বড়ই কঠিন।
কিছুসময় চুপ থেকে আবার জয়তুন ভাবি বলে, দেশে এখনো আইন আদালত আছে গো! বেশি বাড়াবাড়ি করলে—
কমলার মা চমকে ওঠে বললো, কী বলছো ভাবি!
জয়তুন ভাবি এবার আরো রেগে যায়। কমলার মা চুপ করে থাকে। থাম্ তো মাগি! ভেঙেছে কলসির কোণা, তাই বলে কি প্রেম দেবে না… শুনে রাখ্ থানা-কোর্ট আছে, একটা মামলা ঠুঁকে দিলেই বড়বাড়ির বারোটা বেজে যাবে। যাক ওসব সাতপ্যাঁচ না ভেবে আগে একবার বলেই দেখ্ না, যদি না মানে, তখন সারা গাঁয়ে…
জয়তুন ভাবির কথা শুনে মনের মধ্যে একটু আশা অর্থাৎ সুখের আশা ঝিলিক দিলেও, জড়ো হয় ভয় নামের এক অদৃশ্য ব্যাপার! কমলার মা তবুও কিছু ভেবে পায় না। কি হয়, না হয়, এমন একটা আশংকা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। মন যেন থির থাকতে পারে না। কাতর কন্ঠে একবার শুধু জানালো, ওদের অনেক টাকা, ওরা দিনকে রাত, রাতকে…
জয়তুন ভাবি সর্প নাগিনের মতো ফস্ করে ক্ষেপে ওঠে। তাতে কি রে সতীন! ওদের টাকা ওদের থাক্। তোর ভাবনার কিছু নেই —
কমলার মা তৎক্ষণাৎ বলে, না মানে ভাবছি, কী হতে কী যে হয়! মাথার ওপর তো…
জয়তুন ধমক দিয়ে ওঠে। আজো চালাক হতে পারলি না। কমলার পেটের বাচ্চাকে তো আর রাতারাতি হাওয়া করে দিতে পারবে না। তবে হ্যাঁ ওকে একটু চোখে-চোখে রাখবি, একটা ফয়সালা না হওয়া…
কমলার মা আবার ভয়ে-ভয়ে অন্যমনস্ক হয়ে বললো, পানির মধ্যে বাসা বেঁধে কুমীরের সঙ্গে লড়াই!
জয়তুন ভাবি দাঁত খিটমিট করে ওঠে। চাপা কন্ঠে বলে, কুমীর কে কুমীর কে রে মাগি!
তারপর যা হয়, তাই হলো শেষঅবধি। ছেলের বাপের সে কী হম্বিতম্বি। কাল গোখরার মতো চেহারা তখন। নিজের পায়ের তলার মাটি নেমে গেলে যেমন হয়, তেমনি আর কি! চোরের বাপের বড় গলা।
অস্তিত্ব রক্ষা করার জন্য মরিয়া হয়ে মুখের ওপর জানালো, তার ওমন ছেলের নামে এমন ডাঁহা মিথ্যে অপবাদ দেওয়ার জন্য আদালতে মানহানিকর মামলা করবে। গাঁয়ে তাদের হেস্তন্যাস্ত করার সাধ মিটিয়ে দেবে…
ঠিকঠিক তার কয়েকদিন পর কমলার বাপের কাছে লোক পাঠায় খন্দকারেরা। শাসিয়ে যায়, গ্রামে শালিসি বসিয়ে তাদের কঠিন বিচার করবে। হয়তো গ্রামছাড়া হতে পারে। কমলাকে জুতোর মালা পরিয়ে যাচ্ছেতাই রকমের হেনস্ত করবে। প্রয়োজনে জীবন শেষ করে দেবে কমলার।
যথাসময়ে বিচার বসে। ছেলে এক বাক্যে স্বীকার করলো। কমলাকে সে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায় সবাইকে জানালো আবার। ছেলের বাপের তাবৎ অহংকার বেলুনের মতো চুপসে যাওয়ার আগে গর্জে ওঠে আরেকবার। বিয়ে করবি ওই চাকরানীর মেয়েকে। আমি ত্যাজ্য করবো তোকে…
গ্রামের সবাই মাথা নীচু করে মজলিশ ছেড়ে যে যার কাজে চলে যায়। কবিরকে তখন বিশ^জয়ী সেনাপতির মতো লাগছিলো দেখতে। কী মহাবিপদ থেকে তাদের বাঁচালো! স্বয়ং ফেরেস্তার মতো মনে হয়েছিলো কবিরকে, কমলার মায়ের কাছে। আল্লাহ নাকি মানুষের মধ্যে ফেরেস্তাকে কখনো-সখনো পাঠায়। তখন মানুষ আর ফেরেস্তার মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। আল্লাহ’র সৃষ্টি দুটো যেন এক হয়ে যায়। কমলার মা অবাক চোখে সেদিন শুধু কবিরকেই দেখেছে, সে যেন শুধু কবির নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানব সন্তান। সেদিনই কবিরের বাপ বাড়ি থেকে বার করে দেয় ছেলেকে। বাপের টাকা-বিষয়-সম্পদ জমি-জিরাত আভিজাত্যে লাথি মেরে কমলাদের বাড়ি চলে আসে সে।
ওমন সোনার টুকরো ছেলে, এতোটুকু দোষ ছাড়া তো আর কোনো দোষ কেউই দেখেনি তার। কথাবার্তা লেখাপড়া সব কিছুতেই সে ভালো। চেহারাখানা বেশ খানদানি বংশের ছাপ স্পষ্ট। আল্লাহ কি সুন্দর একখানা মুখ একেবারে নিজ হাতে তৈরী করেছেন প্রতিমা বানানো কুমোরদের মতো। জোড়া ভ্রƒ-টলটলে শরীর স্বাস্থ্য দেখে যে কারো ভালো লাগে। কমলার চেহারাও আহামরি! সোনার পরী গরীবের ঘরে এলে ঘর আলো হয় ঠিকই, কিন্তু সঠিক মূল্য পায় না কোনোদিন। কমলার ক্ষেত্রে এ’কথা বেশ জুতসই। এ’ ব্যাপারে গ্রামের লোকেরা কেউ কেউ বলাবলি করে, কমলার বাপে একবার যাত্রা দেখতে গিয়েছিলো, সখীপুরের প্রেমতলীর মাঠে। কে বা যেন বলেছিলো, যাত্রাদলের নতুন নায়িকা যেন বা বেহেস্তের হুর।
কমলার বাপ সে হুর দেখে বলেছিলো, আমার মা কমলার পায়ের কাছেও ঘেঁষতে পারবে না নায়িকা।
চেহারা কাকে বলে, কমলাকে দেখলে মানুষ অন্তত অনুমান করতে পারে। গরিবের ঘরে ডানাকাটা পরি! এ’ যেন এক আশ্চর্য ব্যাপার। কমলার বয়স পনেরো গিয়ে ষোলতে পড়েছে মাত্র, অনেকে বলে, সিনেমার হিরোইন।
জয়তুন ভাবীই একদিন বলেছিলো, কমলা যদি গ্রামের গরিবের ঘরে না জন্মে শহরে বড়লোকের বাড়ি জন্মাতো, তাহলে টেলিভিশনে বা সিনেমার হিরোইন হয়ে যেতো। মডেল তো হতোই। এমন সুনয়না উর্বশী পেলে লুফে নেবে বৈকি! শুনে কমলার মায়ের বুক গর্বে ভরে যায়।
সুজানগরের বরকত চাকলাদারের বড় ছেলে আমান দেখে গিয়েছিলো একবার কমলাকে। পছন্দও করে, কিন্তু বাপ বরকত টাকার লোভী এক জানোয়ার। কমলার বাপ যৌতুক দিতে পারবে না জেনে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি। অথচ ছেলে আমান একেবারে বদ্ধ উন্মাদ! কমলাকে না পেলে জীবন রাখবে না, এমনও কথা জানিয়েছিলো। অবশেষে কবির বাপের বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। তারপর বিয়ে করে ওদের বাড়ি থেকে যায়। সেই থেকে ঘরজামাই হয়ে আছে কবির। কলেজ যাওয়া বন্ধ, কাজকর্মও জোটাতে পারলো না কিছু।
এমন সময় ছাত্রাবাসের ছেলেরা হৈ-চৈ করে গোসল করতে ছুটে যায় সামনের পুকুরে। চমক ভাঙে অকস্মাৎ কমলার মায়ের। ঝোলটা অনেকক্ষণ ধরে হচ্ছে, হয়তো ধ’রে গেছে নিচে! মাছ রান্নার জন্যও গাল-মন্দ খাবে আজ। কপাল খারাপ হলে সবদিক দিয়ে বিপদ হাতছানি দেয়।
বিকেলে উনুনে ভূষি গাঁদতে-গাঁদতে রান্নাঘর থেকেই কমলার মা দেখতে পায়, হেডমাস্টার আর সেক্রেটারি কী সব বলতে-বলতে এদিকে আসছেন। স্কুলের পলাশ গাছে কৃষ্ণচূড়ার গাছে ঘরে ফেরা পাখিদের কলকাকলি। হলুদ সূর্যটা পশ্চিমাকাশে কাত হয়ে শুয়ে এখন। হয়তো বা আরেকটু পরেই চোখের আড়ালে হারিয়ে যাবে। মনে-মনে কমলার মা আন্দাজ করে ফেলে, কাজটা তার থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। কারণ হেডমাস্টার প্রচ- কড়া ধাতের মানুষ। তার ওপর রফিকুদ্দি যে কি বুঝিয়েছে সেটাও একটা কথা!
হেডমাস্টার যদি একবার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে কমলার মাকে রাখবে না, তাহলে হাজার চেষ্টা করেও কথার নড়চড় করানো যাবে না। আর কাজটা চলে গেলে, না খেয়ে মরতে হবে সবাইকে। কেউ এসে বলবে না, একবেলা খেয়ে যাও তোমরা। অথবা কেউ বলবে না, দশটা টাকা নাও। সমাজের মানুষগুলো শুধু বড়-বড় কথা বলতে পারে। সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় না কারো দিকে।
একটু পরে বকুল এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরের দরোজার কাছে। ছেলেটা ছাত্রাবাসে থাকে, ক্লাস নাইনে পড়ে। স্কুলের মাঠে ফুটবল খেলছিলো। হেডমাষ্টারের আদেশ পেয়ে ছুটে এসেছে।
—খালা, বড়স্যার ডাকছেন আপনাকে। রফিকুদ্দি চাচার ঘরে বসে আছেন।
কমলার মা এবার মহাচিন্তায় পড়ে। কী হবে আজ তার। এতোক্ষণ যেমন যা ভেবেছিলো, তেমনই ঘটতে যাচ্ছে তাহলে। গরিবের দুঃখ-কষ্ট কেউ বোঝে না। এমনকি ওপরওয়ালাও গরিবের দিকে একটু মুখ তুলে তাকায় না। কাউকে হয়তো আল্লা দেয় তো বান্দা দেয় না। আবার কাউকে বান্দা দেয় তো আল্লা দেয় না। কঠিন অংক! কমলার মাকে আল্লাও দেয় না, বান্দাও দেয় না। তাবৎ পৃথিবীর সবাই যেন মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে আজ। হঠাৎ আল্লার ওপর একটু রেগে যায়। সমস্ত অনাসৃষ্টি তো ওই একজনই করে, আর তার ফল ভোগ করতে হয় গরিবদের। মস্ত একটা গাল বের হয়ে আসে মুখ দিয়ে। গরিব করে কেনো রাখলো, আর যদি গরিব করেই রাখলে তো এমন হতচ্ছাড়া স্বপ্ন-সাধ কেনো গুঁজে দিলে আবার। বুক ভেঙে যায় কষ্টে। এভাবে কি মানুষ বাঁচে! না কি এই বাঁচাকে বাঁচা বলে। মুহূর্তে জয়তুন ভাবির কথা মনে পড়ে যায়। এই জয়তুনই তাকে ডুবালো। নিজের ওপর খানিক রাগ হলো তার। কেনো যে সেদিন জয়তুন ভাবির কথায় মাতলো। অমল কবরেজ বা সাইদ ডাক্তারকে দিয়ে ওটা ফেলে দিলেই সব সমস্যা চুকে-বুকে যেতো। এমনভাবে তাকে আজ হেনস্থ হতে হতো না।
বালতি থেকে এক মগ পানি তুলে নালাটার কাছে হাত দুটো ধুঁয়ে নেয়। তারপর কাপড়ে হাত মুছতে-মুছতে রান্নাঘর থেকে বার হয়। বুকের মধ্যে ভয় নামের পাথরটা বড় চেপে বসে আছে। শ^াস ফেলতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে এখন কমলার মায়ের। সময়ে-সময়ে মনে হচ্ছে হয়তো শ^াসটা এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। আর কোনোদিন নিঃশ^াস নিতে পারবে না সে। আস্তে-আস্তে রফিকুদ্দির ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘরের ভেতর রফিকুদ্দি-হেডমাস্টার-সেক্রেটারি বসে। সেক্রেটারী কোথায় যেন জিয়াফৎ খেতে যাবে, সেই গল্প করছে এখন। রফিকুদ্দি গল্প জুড়িয়ে দিয়েছে, অনেকদিন আগে এক কুটুম্বের বাড়ি জিয়াফৎ খেতে গিয়ে খাজেনদারী করতে হয়েছিলো এবং খাজেনদারী করতে কী কী বিপদে পড়ে, সে সমস্ত গল্প পেড়ে বসেছে সবার সামনে। হেডমাষ্টার একমাত্র শ্রোতা। খুব আগ্রহ সহকারে দুজনের গল্প শুনছে শুধু।
কমলার মায়ের সাড়া পেয়ে কিছুক্ষণ পর হেডমাস্টার বললো, কমলার মা, এসো ভেতরে…
কমলার মায়ের শরীরের রক্ত এবার শুকিয়ে যেতে থাকে। চৌকাঠ পেরিয়ে দরোজার পাল্লায় আলতো ঠেস দিয়ে মাথা নীচু করে দাঁড়ায়। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে সেক্রেটারী একটু গম্ভীর কন্ঠে বললেন, রফিকুদ্দি কী বলছে, তুমি নাকি কয়েক মাস ধরেই…
কমলার মায়ের কানে যেন কেউ গরম সীসা ঢেলে দিলো মুহূর্তে। কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না কিছুই। মুখ ফুটে কোনো উত্তর সরে না তার এখন। উত্তর বা ভাষা যেন সব হারিয়ে গেছে। মুহূর্তে বোবা জানোয়ার ভাবে সে নিজেকে।
আপদমস্তক আর একবার ভালো করে দেখে হেডমাষ্টার বলে ওঠেন, তুমি তো জানো, এটাকে চুরি বলে—
রফিকুদ্দি একধাপ এগিয়ে এসে বললো, আর চোর যদি একবার ধরা পড়ে হাতেনাতে, তাহলে তাকে কি আর কোনোদিন বিশ^াস করা যায়, না কি রাখা যায়…
ঘরময় এখন নীরবতা খেলা করে। কারো মুখে একটুও কথা নেই। রফিকুদ্দির ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসির রেখা। এই হাসিটুকু যে প্রতিশোধের হাসি কমলার মা বোঝে তা এখন। চোখ অন্যদিকে তার। মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে জানালার দিকে। পুরানো রাগ আজ তাহলে মিটালো এভাবে।
অনেকক্ষণ নিশ্চুপ থাকার পর সেক্রেটারি বললো, এই কাজটা যদি তোমার কাছ থেকে…
কমলার মায়ের বুকটা কেঁপে ওঠে থরথর করে। তবুও মুখ ফুটে কোনো শব্দ বের হলো না তার। একবার ভাবলো, হেডমাষ্টার- সেক্রেটারীর পায়ে ধরে ক্ষমা চেয়ে নেবে। রফিকুদ্দি আবার বিস্তারিত বিবরণ দিলো সবার সামনে। রাশভারী দুজন লোকের সামনে ভয়ে সিঁটিয়ে রইলো কমলার মা।
গম্ভীরকন্ঠে একসময় হেডমাষ্টার বললেন, তোমার তো এমন স্বভাব ছিলো না কখনো! আজ দশ/বারো বছর এখানে কাজ করো, কিন্তু এমন একটা পাপ কাজ তোমার মাথার মধ্যে…
কমলার মা নিজেকে এবার আর বেঁধে রাখতে পারে না। হু-হু করে কেঁদে ফেলে। অস্ফুট স্বরে বললো, এবারের মতো ক্ষমা করে… আর কোনোদিন এমন হবে না। আমি কমলার কসম….
হেডমাষ্টার ডান হাতে চশমা খুলে বাঁ হাতে রুমাল দিয়ে গ্লাস মুছতে-মুছতে বলে ওঠেন, কিন্তু তুমি হঠাৎ এ’ কাজ…
কমলার মা আবার প্রচ- আঘাত পেলো। বুকের হাঁড়গোড় যেন বা সব একত্রে ভেঙে যায় একনিমেষে। তবুও নিজেকে একটু সামলে নেয়। চোখ মুছে একবার সেক্রেটারি একবার রফিকুদ্দি আর একবার হেডমাস্টারের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে থাকলো। মিনতিভরাকন্ঠে কমলার মা জানালো, আমার জামাই কবিরের জন্যে…
হঠাৎ সমস্ত ঘর যেন বা কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। কমলার মায়ের জামায়ের ঘটনা সবার জানা। কবির এ’ স্কুলেরই ছাত্র ছিলো। কবিরের বাপ স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই যেন কমলার মায়ের কোথায় কষ্ট, তা এককথায় বুঝে গেছে। অনেক পরে সেক্রেটারি মৃদুস্বরে বলে, ঠিক আছে কাজে যাও— রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় রফিকুদ্দির সঙ্গে একবার দেখা করে যেও…
কাতর চোখ মেলে কমলার মা সবার দিকে তাকায় একবার। মুহূর্তে লজ্জায় তার মাথা কাটা যায়। এতো লজ্জা জীবনে কখনো সে পায়নি। এ’ লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। মনে-মনে কমলার মা ভেবে নেয়, তাহলে কাজটা আর থাকছে না। মরিয়া হয়ে হাত জোড় করে কেঁদে ফেলে। এবারের মতো আমাকে…
রফিকুদ্দি বললো, বললেন তো সব কথা পরে হবে…
রান্নাঘরের কাজকর্ম সারতে-সারতে দশটা বেজে যায়। প্রতিদিন রাত্রি এমনই হয়। আজো তাই হলো কমলার মায়ের। দরোজা লাগিয়ে কমলার মা এসে দাঁড়ালো রফিকুদ্দির ঘরের দরোজার সামনে। ধরুন এই চাবি… ম্লান কন্ঠে বললো সে।
রফিকুদ্দি সিগারেট টানছিলো এতোক্ষণ। কমলার মাকে দেখে একটু হেসে বলে ওঠে, এসো ভেতরে, টেবিলে রাখো! তারপর কিছুক্ষণ মাথা নিচু রেখেই বললো, সেক্রেটারি-হেডমাস্টার এবারের মতো তোমাকে ক্ষমা করেছেন… একটু থেমে আবার জানালো, তবে এও বলেছেন যেন আর এমন না হয় আগামীতে…
বুকের ওপর থেকে একটা পাষাণ পাথর নেমে যায় কমলার মায়ের। চোখ দিয়ে আনন্দে পানি ঝরে পড়ে কয়েক ফোঁটা। বড় হালকা এবং ফুরফুরে লাগে নিজেকে হঠাৎ-ই। মুহূর্তে মনে হলো সে কতো স্বাধীন। বুকভরে শ^াস নিলো এবার। দূরের শিরীষগাছের ওপর থেকে একটা টিয়াপাখির ডাক সোনা যায় অস্পষ্ট। কমলার মায়ের মনটা হারিয়ে যায় কোথায়! কমলার বাপে যেদিন তাকে বিয়ে করে প্রথম ঘরে এনেচিলো, সেই টুকরো ছেঁড়া ছেঁড়া স্মৃতিগুলো আজো মনের পদ্মায় ভেসে ওঠে কদাচিৎ। সেদিনের কথা ভোলা যায় না। লোকটার মনটা ছিলো আকাশের মতো বিশাল আর নদীর মতো অবারিত এবং স্বচ্ছ। সেই মনের উঠোনে সহজেই ডেরা বাঁধে কমলার মা। আচমকা মনে পড়ে, কমলার জন্মের সময় আকাশটা ছিলো ধবধবে এমন পরিপাটি। ঝলমলে রোদের আবীরে কমলা খলবল করে হেসে উঠেছিলো পৃথিবীর বুকে। পাড়ার সবাই দেখে হতবাক! একবাক্যে শুধু বলেছিলো, গোবরে পদ্মফুল যে গো! সেই পদ্মফুলের নাম দেওয়া হলো কমলা।
বড় ভ্যাপসা গুমোট আজ দুপুর থেকেই। গরমে অতিষ্ঠ মানুষ প্রকৃতি। গাছের পাতাগুলো নির্বাক হয়ে তাকিয়ে। নড়াচড়া ভুলে গেছে যেন বা। আকাশটাকে বড় বেশি অপরিচিত লাগছে আজ। কি একটা পাখি ডেকে ওঠে ওপাশে। গতকালের কথা মনে পড়ে কমলার মায়ের। সাত আসমান ভর্তি লজ্জা এসে গ্রাস করে তাকে। সেক্রেটারি হেডমাস্টার রফিকুদ্দির সামনে মাথা হেট করে দাঁড়িয়ে থেকেছে চোরের মতো। চোরের মতো কি আবার! চোরই তো সে। চুরি ধরা পড়লে চোর হয়।
রাস্তায় বের হয়ে কমলার মা দেখতে পায় পশ্চিমাকাশে কালো কুচকুচে মেঘ ঝুলে আছে মৌচাকের মতো। বিদ্যুৎ ঝিলিক দিচ্ছে থেকে- থেকে। বোঝা যায়, আজ রাত্রে আকাশ ভেঙে প্রচ- বৃষ্টি হবে। অনেকদিন বৃষ্টি হয়নি। আজকের বৃষ্টিতে মাঠ-ঘাট ভিজবে হয়তো। কমলার মা এবার দ্রুত হাঁটতে থাকে পা চালিয়ে। মুহূর্তে যদি বৃষ্টি আসে কোথায় আবার দাঁড়াবে তখন। কমলারা বড় চিন্তায় থাকবে অকারণে। কমলার বাপে সুস্থ থাকলে বৃষ্টি মাথায় বের হতো খুঁজতে তাকে। লোকটা আজব মানুষ বটে। প্রচ- ভালোবাসতো। কোনোদিন কড়া দু’কথা বলেনি। সমাজে এতো মানুষ দেখেছে কিন্তু কমলার বাপের মতো এমন মানুষ চোখে পড়েনি তার। বৃষ্টি নামলে সহজে থামবে বলে মনে হয় না। হোক-হোক আজ একটু ঝেঁড়ে বৃষ্টি নামুক। বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ মাসের এই মাঠ ফাটা গরম আর সহৃ হয় না। গরমে রাত্রে বেচারা জামায়ের ঘুম হয় না আজকাল। ছটফট করে সমস্ত রাত্রি শুধু। বড় ঘরের আদরের ছেলে গরীবের ঘরে এসে বড় কষ্ট পাচ্ছে। দিনটা কোনোভাবে কাটিয়ে দেয় কিন্তু সারারাত্রি জেগে বসে কাটায়। অথচ মুখ ফুটে কিছুই বলে না। কোনো অভিযোগ নেই তার কারো বিরুদ্ধে। এমন শান্ত মিষ্টি রাজপুত্রের মতো ছেলেকে কমলার মা যে একমাত্র মেয়ে কমলার জামাই করে পেয়েছে, এও কি কম গর্বের কথা! যা হবার হয়েছে যদি কবিরের বাপ কমলাকে বউমা বলে একবার স্বীকার করে নিতো। তাহলে কতো ভালো হতো আজ। কমলার মায়ের জন্য এর চেয়েও আর কি আনন্দের আছে? আজ বড় খুশিতে ঘরে ফেরে সে। সব চুপচাপ। মৃতদের বাড়ি মনে হচ্ছে। কবরস্থানের মতো শান্ত নিঝুম। দুয়ারের এক কোণে লণ্ঠনটা জ¦লছে মিটমিটি। বাতাসের মৃদু শব্দ সোনা যাচ্ছে এখন। আবছা আলোতে ছাতার মতো ঘাড় কুঁজো করা ডালিম গাছটার ছায়া পড়েছে উঠোনের কোণে। কেমন একটা ভূতুড়ে-ভূতুড়ে লাগছে। ডানদিকের ঘরটা মোটামুটি একরকমের। কমলা আর কবির থাকে এখন। সে ঘরটাও কেমন সুনসান। অথচ মাত্র কয়েকমাস আগেও ঘরটা সারারাত্রি জেগে থাকতো। এবং অদৃশ্য আনন্দে ভরে যেতো তাবৎ ঘর। যখনই ঘুম ভাঙতো কমলার মায়ের, ও ঘরের মৃদু শব্দ চাপা কথাবার্তা কানে আসতো তার। কখনো বা ডুকরানো হাসি। মনে-মনে কমলার মায়ের বড় সুখ অনুভব হতো। দু’হাত তুলে আল্লার কাছে প্রার্থনা করতো। ওরা সারাজীবন জোড়া হয়ে থাক… কিন্তু কি যে হয়েছে, ছেলেটা হবার পর থেকেই দুজনে কেমন হয়ে গেছে। আর কবির যেন সাতকালের বৃদ্ধ, কঁচি লাউডগার মতো কমলার শরীর খসে যাচ্ছে যেন বা। আগের মতো সেই মুখে আর হাসি নেই। কথাগুলোও হারিয়ে গেছে দুজনের মুখ থেকে। সব সময় কেমন চুপচাপ গম্ভীর। সারাদিন কী যেন সব ভাবে?
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রাস্তার বড় অশ^ত্থগাছটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সকাল দুপুর কোনো খেয়াল নেই তার। আগে এককবার একটু আধটু বিকেল বা সন্ধ্যোর দিকে বেড়াতে যেতো খালগ্রাম বাজারে অথবা থানার মোড়ে কিংবা সোনাপুর সিনেমায়। এখন ঘর থেকে তেমন বের হয় না। পৃথিবীর যতো চিন্তা যেন তার ওপর। চাঁপাফুলের মতো লাল ফর্সা রঙ কেমন বিবর্ণ আর কালটে হয়ে গেছে আজ। ইদানিং চোখ দুটো ঘোলা লাগে, শরীর শুকিয়ে যাচ্ছে একটু একটু।
এই ছেলের মুখের দিকে তাকিয়েই তো মাছ সড়াতো ছাত্রাবাস থেকে কমলার মা। প্রতিদিন কেনার মতো সামর্থ নেই তাদের। আল্লাহ গরিবকে চারদিক থেকেই মারে। ওমন তরতাজা সোনার টুকরো ছেলেকে চোখের সামনে দিন দিন শুকিয়ে যেতে দেখলে কেউ কী আর ঠিক থাকতে পারে? এক ফোঁটা দুধও কিনতে পারেনি ছেলেটার জন্য। ওমনভাবে শুকিয়ে মরলে কার বা কি! তারই তো সর্বনাশ! দরোজা ঠেলে একসময় ঘরে ঢোকে কমলার মা। দেখতে পায় কমলার বাপ মেঝেতে ঘুমোচ্ছে অঘোরে। এই একটা আজব মানুষ! গাছ থেকে পড়ে অবধি কেমন ছোট ছেলে হয়ে গেছে একেবারে। কমলার মা দরোজায় হুড়কো লাগিয়ে শুয়ে পড়ে।
মাঝরাত্রের দিকে গোঁ-গোঁ করে একটা শব্দ ভেসে আসে। শব্দটা ক্রমশ কেমন ভয়ংকর হয়ে ওঠে। ঝড় উঠেছে বোঝা যায়। প্রচ- বেগে বাতাস বইছে এখন। পৃথিবীর সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যাবে। গমগম করে ঘন ঘন মেঘ ডাকছে। অকস্মাৎ মরিচ পটকার মতো ছড়ছড়িয়ে টিনের চালে বৃষ্টির পানি শব্দ তুলে নামে।
বেশ আওয়াজ ওঠে। কমলার মা ধড়ফড়িয়ে ওঠে বসে। তারপর দরোজা খুলে হাঁক দেয়, কমলা-কমলা জানালা বন্ধ করে দে মা! ঝড়-বৃষ্টি এসেছে…ঝমঝমাঝম বৃষ্টি ঝরছে অথচ মানুষটা মরার মতো ঘুমিয়ে এখনো। কোনো সাড়া শব্দ নেই।
কমলার মা আর বেশিক্ষণ ঘরে থাকতে পারে না। বৃষ্টি এখন ঝরছে একেবারে তুমুল বেগে। ঘন-ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, কাস্তের মতো বাজ পড়ছে দূরে কোথাও অথবা কাছেপিঠে। এ’ বৃষ্টি আজ থামবে না। সারারাত্রি বৃষ্টি ঝরবে বোঝা যায়। কমলার মা আকাশ দেখে। সিঁদুরে আকাশ বুঁনো শুয়োরের রূপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দূরে। কর্কশ আওয়াজে কানের ভেতরের সমস্ত যন্ত্রপাতি যেন বিকল হয়ে যাবে। নুহের প্লাবনের মতো আর একটা প্লাবন নামতে যাচ্ছে এখন। প্রতীক্ষার এই বৃষ্টি, আনন্দের এই বৃষ্টি সারারাত্রি একভাবে ঝরবে। হঠাৎ কমলার মায়ের শরীরে অজানা একটা শিহরণ লাগে। এই প্রলয় না থামুক, এই বৃষ্টিতে ভেসে যাক তামাম পুকুর দীঘি বিল ডোবা নালা। ভেসে যাক সমস্ত অন্যায়-অবিচার ধনী গরিবের ভেদাভেদ। এমনকি হয় না কখনো কোনোদিন। পায়ে-পায়ে কমলার মা এবার দুয়ারের ওপাশের বাঁকারির বেড়ার দিকে যায়। বাঁশের বাঁকারির মাথায় ঝুলিয়ে রাখা অনেককালের ছেঁড়া জালটা এবার হাতে নিয়ে বৃষ্টির মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। বছরের প্রথম বৃষ্টি। পুকুর দীঘি বিল ডোবা নালা থেকে কই মাগুর সিঙি মাছ খলবল করে ওঠবে… কলকল করে জাওলা দিয়ে যতো পানি নামবে, মাছও ভীড় করবে। কমলার মা বজ্রপাতের মধ্যে পুকুরের ডোবার পাড়ে জাওলার মুখে আসে। আজ অমাবস্যার কালো কুঁচকুঁচে রাত্রে, জামাইয়ের জন্য মাছ ধরবে সে। অনেক অনেক মাছ… অনেক অনেক স্বপ্ন চোখে-মুখে তার। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ভেজা সপসপে কমলার মাকে দেখে মনে হয় রাত্রের প্রেতœী।
আশরাফ উদ্দীন আহ্মদ, গল্পকার