কাজী জহিরুল ইসলাম
১.
যে কোনো ঘটনার একটি “চালিকা নীতি” থাকে, ইংরেজিতে আমরা প্রায়শই এটাকে গাইডিং প্রিন্সিপাল বলে থাকি। বিপ্লবকে চূড়ান্ত লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যায় একটি স্বপ্ন। কোটা সংস্কার আন্দোলন হিসেবে আন্দোলনটি শুরু হলেও মানুষের মধ্যে বৃহৎ একটি স্বপ্ন সুপ্ত অবস্থায় ছিল, যা ক্রমশ এই আন্দোলনকে এবং এমন আরো বহু আন্দোলনকে ঘিরে প্রস্ফুটিত হচ্ছিল। কিন্তু অন্য কোনো আন্দোলনে সেই স্বপ্নটি পুরোপুরি বিকশিত হয়নি, ছাত্র—জনতার জুলাই আন্দোলনে তা পূর্ণতা পেয়েছে, অর্থাৎ একটি সফল বিপ্লব সংগঠিত হয়েছে। কেন জুলাই বিপ্লব সফল হয়েছে আর সেই স্বপ্নটাই বা কী ছিল? এই বিষয় নিয়ে আজ কিছু কথা বলি।
প্রতিটি কাজের পেছনে যে একটি “চালিকা নীতি” থাকে তা আমরা কখনো টের পাই, কখনো টের পাই না। বাংলাদেশের মানুষের বুকের ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে যে স্বপ্ন অঙ্কুরিত হয়েই মরে যাচ্ছিল সেই স্বপ্নটি হচ্ছে “বৈষম্যহীন সমাজ” প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে মানুষ পূর্ণ স্বাধীন, কেউ কাউকে দাবিয়ে রাখতে চেষ্টা করবে না, প্রত্যেকে তার মেধা ও পরিশ্রমের সঠিক মূল্য পাবে, কেউ কাউকে ঠকাবে না। কিন্তু এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ৫৩ বছরের বাংলাদেশে ঘটেনি। জুলাই আন্দোলনে আমাদের ছাত্ররা সেই স্বপ্নটিকেই আবার সামনে নিয়ে এসেছেন।
এই স্বপ্নের তারা একটি “চালিকা নীতি” বা গাইডিং প্রিন্সিপাল ঠিক করেছেন, সেটি হচ্ছে “রাষ্ট্র সংস্কার”। বাংলাদেশের মানুষ হঠাৎ চমকে উঠেছে এই শব্দ দুটি শুনে। ঠিকই তো, নষ্ট হয়ে যাওয়া, ঢিলে হয়ে যাওয়া, ভেঙে যাওয়া রাষ্ট্রটিকে সংস্কার করতে পারলেই কেবল আমরা সেই কাঙ্খিত স্বপ্নের বেদীতে পৌঁছাতে পারবো।
যেহেতু তারা অসুস্থ রাজনীতির ঘোড়ায় চড়ে আন্দোলনের মাঠে আসেননি, মানুষ তাদের বিশ্বাস করেছে। তারাই পারবে নষ্ট হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রকে মেরামত করতে। তখন সকলের চাওয়া একটি বিন্দুতে গিয়ে মিশেছে। বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে মৃত্যুকে তুচ্ছ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ফ্যাসিস্ট সরকারকে উৎখাত করতে।
বিপ্লব কোনো প্রচলিত সংবিধানের আলোকে হয় না। ফ্যাসিস্টরা এমন একটি সংবিধান তৈরি করেন যেখানে বিপ্লব প্রবেশের কোনো রাস্তা থাকে না। সংবিধানের প্রাচীর দুমড়ে মুচড়ে দিয়েই বিপ্লব আসে। বিপ্লব ঘটে যাওয়ার পর নতুন সংবিধান রচিত হয়, যে সংবিধানে বিপ্লবের মূল স্বপ্ন প্রতিফলিত হয়।
বিপ্লবের পরে গঠিত হয় বিপ্লবী সরকার কিন্তু জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে যে সরকার গঠিত হয়েছে তা প্রচলিত অন্তর্বতীকালীন সরকারের আদলে তৈরি হওয়ায় অনেকেই হতাশ হয়েছেন, আমিও হয়েছি। আমি এটিকে একটি ‘মাইনর মিস্টেক’ হিসেবেই দেখতে চাই এবং এই সরকারকেই বিপ্লবী সরকার মনে করি। এখন এই সরকারের কাজ হবে বিপ্লবী জনতার মূল যে দাবী, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা, তা নিশ্চিত করা।
ফ্যাসিস্ট সরকারের সকল অবকাঠামো ভেঙে দিয়ে জনতার প্রত্যাশা অনুযায়ী নতুন অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। “বৈষম্য বিরোধী” বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে বৈষম্যগুলো সঠিকভাবে শনাক্ত করতে হবে। এই কাজের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের মত একটি শক্তিশালী এবং কার্যকর “বৈষম্য দমন কমিশন” গঠন করতে হবে। পাড়ায়, মহল্লায়, গ্রামে বিপ্লবী ছাত্র—জনতার সমন্বয়ে বৈষম্য বিরোধী কমিটি গঠনের কথা ড. পিনাকী ভট্টাচার্য বলেছেন, আমি মনে করি এটি একটি অসাধারণ প্রস্তাব। এই কাজটি করার জন্য সরকার যেন ছাত্র—জনতাকে উৎসাহিত করে এবং সহযোগিতা করে। এই কমিটির কাজ হবে সমাজের সকল স্তরের বৈষম্য শনাক্ত করা এবং তা নিরসনের জন্য “বৈষম্য দমন কমিশন” এর নজরে আনা।
২.
সব বিপ্লবের পরেই প্রতিবিপ্লবের কিংবা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা থাকে, কোথাও কোথাও তা ঘটেও যায়। বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের পরেও এইরকম কিছু প্রচেষ্টা হয়েছে। একটি সেনা অভ্যন্তর থেকে, অন্যটি বিচার বিভাগ থেকে। এই দুটিকে প্রতিবিপ্লব না বলে বরং অভ্যুত্থান—প্রচেষ্টা বলাই ভালো। সেনা বা বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থান দুই রকমের হয়ে থাকে। কখনো স্বৈরাচারের অবসান ঘটাতে হয় আবার কখনো স্বৈরাচারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য হয়। আমাদের এখানে স্বৈরাচারকে পুনর্বহাল করার জন্য এই অপচেষ্টা করা হয়েছিল যা সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় ছাত্র—জনতা নস্যাৎ করে দিয়েছে। এই সাফল্য থেকে আমাদের ছাত্র—জনতা নিশ্চয়ই এই শিক্ষা নেবে যে আমাদের প্রতি মুহূর্তে সজাগ থাকতে হবে, এমনি করে সকল অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দিতে হবে।
পুলিশ কর্মবিরতিতে গিয়েছিল, আবার ফিরে এসেছে। কর্মবিরতিতে যাবার যে কারণ তারা উল্লেখ করেছিল তা মূল কারণ ছিল না। মূল কারণ ছিল ‘ভয়’। তারা ফ্যাসিস্ট হাসিনা—সরকারের নির্দেশে ছাত্র—জনতার ওপর যে অত্যাচার—নির্যাতন করেছে, যেসব হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে তার পাল্টা আঘাতে তাদের জীবন বিপন্ন হতে পারে এই আশঙ্কাটাই কাজ করেছে বেশি। কর্মবিরতি আনুষ্ঠানিকভাবে বাতিল করলেও বহু পুলিশ সদস্য, যারা সরাসরি গুলি, লাঠিচার্জ ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা হুকুম দিয়েছিল, তারা শেষ পর্যন্ত ফিরে আসবে না এবং দেশ ছেড়ে পালাবার চেষ্টা করবে। একটা শূন্যতা তৈরি হবে। তবে এটি খুব ছোটো একটি সমস্যা। ছাত্র—জনতা রাজপথে নেমে যেভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করেছে, যেভাবে বিপ্লবের সময় নোংরা হওয়া রাস্তাঘাট সাফ করেছে তাতে এটা খুব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে দেশ গড়ার একটা জাগরণ পুরো দেশের মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে, জাগরণের এই স্রোত যে কোনো সমস্যাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবে এবং সমাধানের পথ দেখাবে।
দেশ গড়ার এই জাগরণকে উজ্জীবিত রাখতে হবে। ভালো কাজের প্রশংসা করে তাদের উৎসাহ দিতে হবে। কবি, লেখক, শিল্পীদের এগিয়ে আসতে হবে, তাদের নিয়ে গান, কবিতা রচনা করতে হবে। অভিভাবকদের রাজপথে নেমে এসে তাদের মুখে পানি, জুস, খাবার তুলে দিতে হবে। যারা স্বেচ্ছাশ্রম দিতে পথে নেমে এসেছে তাদেরকে ভবিষ্যতে চাকরি বা উচ্চতর শিক্ষার জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভতির্র ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে। গাড়িচালক, গাড়ির মালিকদের দেশের প্রচলিত আইন মেনে চলতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে গত ১৫ বছরে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রায় প্রতিটি যন্ত্রাংশ নষ্ট করে দিয়েছে ফ্যাসিস্ট সরকার। সকলে মিলে সেইসব নাট—বল্টু টাইট করতে হবে, মেরামত করতে হবে।
সবাই সব কাজ করবে না, আমাকেই ঠিক করতে হবে আমি কী করতে পারি। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী দেশ গড়ার এই গণস্রোতে, আনন্দস্রোতে সবাইকে অংশ নিতে হবে। আজ যা করলাম প্রতিজ্ঞা করতে হবে কাল যেন এর চেয়ে একটুও কম না করি, পারলে একটু বেশি করি। এই আত্মবিশ্বাস অর্জন করতে হবে, আমিও পারি, তাহলেই লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবো। যে ভয়ঙ্কর দানবকে আমরা বধ করেছি এর পরে আর এ জাতির পক্ষে অসম্ভব বলে কিছু নেই। এই দেশ সকলের। কে কী পেলাম সেই চিন্তা বাদ দিয়ে ভাবতে হবে কে কী দিলাম। আজ আমরা সবাই দাতা, গ্রহীতা শুধু বাংলাদেশ, আর কেউ নয়। এই মানসিকতা নিয়ে আমাদের রাষ্ট্র মেরামতের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
রাষ্ট্র সংস্কারের এই সুবর্ণ তিথির নেতৃত্বে রয়েছেন এমন একজন মানুষ যার কারণে পুরো পৃথিবী ক্রমশ আমাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, দাঁড়াবে। প্রবাসী ভাই বোনেরা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে দেশকে ভালোবাসেন, তারা কঠোর পরিশ্রম করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেন সেইসব অর্থ ব্যাংকিং চ্যানেলে দেশে পাঠাতে শুরু করেছেন। আসুন তাদের স্বাগত জানাই ভালোবাসা জানাই। এই অমূল্য সম্পদ বৈদেশিক মুদ্রা যেন পাচার হয়ে না যায় সেদিকে সতর্ক নজর রাখতে হবে।
বাংলাদেশে প্রতিবেশি দেশের যে ২৬ লক্ষ মানুষ কাজ করে তারা প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যায়, এই বিষয়টা যথাযথ নিয়মের মধ্যে আনতে হবে। বিদেশি শ্রমিকেরা কি বৈধভাবে কাজ করেন? তারা কি আসলেই আমাদের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন? তারা কি তাদের আয়ের ওপর কর দিচ্ছেন? এগুলোকে আরো কঠোর নিয়মের মধ্যে আনতে হবে, যেসব ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে আমাদের নিজস্ব কর্মশক্তি কাজে লাগানো সম্ভব সেসব ক্ষেত্রে বিদেশিদের নিয়োগ বাতিল করতে হবে, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে ভূমিকা রাখবে এবং দেশের কর্মক্ষম বেকারদের কর্মসংস্থান হবে।
৩.
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ হচ্ছে চূড়ান্ত লক্ষ্য। সেই লক্ষ্যে পৌছানোর রাস্তাটির নাম রাষ্ট্র সংস্কার। এই সংস্কারের মধ্য দিয়েই আমাদের তীর্থে পৌঁছুতে হবে। সেই রাস্তার প্রবেশ মুখ এতোদিন বন্ধ ছিল। ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ছাত্র—জনতা রাস্তার মুখে স্থাপিত পাথরের দেয়ালটি ভেঙে দিয়েছে, এদেশের ১৮ কোটি মানুষ এখন সেই কাক্সিক্ষত রাস্তায়, আমাদের স্বপ্নের রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। তারা কি ঠিক পাথর সরিয়েছে, ঠিক দেয়ালটি ভেঙেছে? বাংলাদেশের মানুষ কি ঠিক রাস্তায় উঠে এসেছে?
উত্তর হচ্ছে হ্যঁা, বাংলাদেশের ছাত্র—জনতা জুলাই বিপ্লবের রক্তনদী পেরিয়ে সঠিক রাস্তায় উঠে এসেছে। বাংলাদেশের মানুষ সর্বার্থেই বৈষম্য ভেঙে দিচ্ছে। যেসব উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের আদুরে ছেলেমেয়েদের এখনো মা মুখে খাবার তুলে খাইয়ে দেয়, জীবনে কখনো যারা ঘর ঝাড়ু দেয়নি সেইসব ছেলে—মেয়ে আজ রাস্তায় নেমে এসে ধুলো—ময়লা সাফ করছে। দুই হাতে তারা এমন পরম মমতায় বাংলাদেশের রাস্তা, বাংলাদেশের আবর্জনা সাফ করছে দেখে মনে হয় যেন তরুণী মায়েরা তাদের প্রথম সন্তানকে স্নান করাচ্ছে, তার মুখে লেগে থাকা এঁটো সাফ করে দিচ্ছে। অথবা সন্তানেরা তাদের অসুস্থ পিতা—মাতার দেহ থেকে মমতার স্পর্শ দিয়ে উষ্ণ জলে ভেজানো তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছে, ঘাম, রক্ত, পুঁজ মুছে দিচ্ছে। এই যে স্বচ্ছল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে—মেয়েরা রাস্তা ঝাড়ু দিচ্ছে এর মধ্য দিয়ে তারা বুঝিয়ে দিচ্ছে কোনো কাজই ছোটো নয়, সকলেই সব কাজ করতে পারেন, বৈষম্য ভাঙার কাজ তো এভাবেই শুরু করতে হবে। ছেলে—মেয়ের বালাই নেই, কোনো বৈষম্য নেই, সকলেই নেমে এসেছে রাজপথে, কী সুন্দরভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। শুধু কী তাই? কেউ নিয়ম ভাঙলে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে শাস্তি হিসেবে ৩০ মিনিট রাস্তায় কাজ করানো হচ্ছে। দেখলাম এক ভদ্রলোক সিটবেল্ট বাঁধেনি, তাকে থামিয়েছে এক তরুণী। শাস্তিটা কি শুনবেন? ভদ্রলোক সেই তরুণীকে শিখিয়ে দিলেন কীভাবে গাড়ির কাগজ—পত্র পরীক্ষা করতে হয়, কী কী চেক করতে হয়। ব্যাস, হয়ে গেল প্রশিক্ষণ। কী অভিনব না ব্যাপারটা? কোনো ঘুষ নেই, অনৈতিকতার ছিটেফোঁটাও নেই কোথাও, এই শুদ্ধতার চর্চা যদি এদেশের মানুষ অব্যাহত রাখতে পারে এদেশকে আর কেউ পেছনে ঠেলে দিতে পারবে না। দামী দামী গাড়ির ধনী মালিকেরা যখন শাস্তি হিসেবে রাস্তায় নেমে সহাস্যে ট্রাফিক কন্টে্রাল করেন তখন বৈষম্যের দেয়াল ভাঙবেই। শুধু কি তাই, সেনাবাহিনী ডাকাতদের ধরে শাস্তি হিসেবে “আমার সোনার বাংলা” গান গাওয়াচ্ছে। আমরা শুধু একটি মহান বিজয়ই অর্জন করিনি, সৃষ্টি করেছি একটি সৃজনশীল কাল, জন্ম দিয়েছি দেশপ্রেমের এক অনিন্দ্য সকাল।
বাংলাদেশ যে একটি প্রকৃত অসা¤প্রদায়িক দেশ এর সবচেয়ে বড়ো প্রমাণ হলো ভারত—পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশে আজ অবধি কোনো ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় আসতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে ম্যান্ডেট দেয়নি। ব্রিটিশ তাড়িয়ে ভারতবর্ষ আজ তিনটি স্বাধীন দেশে বিভক্ত। সেই তিনটি দেশের দুটিই মৌলবাদীদের দখলে চলে গেছে কিন্তু বাংলাদেশ আজও অসা¤প্রদায়িকতার ঝাণ্ডা উড়িয়ে সদর্পে দাঁড়িয়ে আছে। আওয়ামী লীগ সরকার যখনই ক্ষমতায় আসে তখন একবার হিন্দু স¤প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর দখল হয়, তাদের ওপর অত্যাচার নির্যাতন হয়, আবার যখন তারা ক্ষমতা থেকে চলে যায় বা চলে যেতে বাধ্য হয়, তখনও একবার এইরকম বর্বরোচিত আক্রমণ চলে। মূলত এটি তাদেরই কাজ, অন্য অনেক অনৈতিক ও অসৎ উদ্দেশ্যের মতো এটিও তাদের একটি পুরনো খেলা, তারা বাংলাদেশকে অস্থির এবং এদেশে মৌলবাদের উত্থান দেখাতে চায়, এটা দেখিয়ে তারা ভারতের অনুকম্পা পেতে চায়। বোকা ভারতও প্রতিবারই তাদের ফাঁদে পা দেয়।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল শশী থারুর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “উল্টো দিকটাও আমাদের দেখতে হবে, বাংলাদেশের মুসলিম জনগণ হিন্দুদের নিরাপত্তা দিচ্ছে, পাহারা দিচ্ছে”। হ্যাঁ এটিই বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র। ১৯৭১ সালেও বাংলাদেশের মুসলমানেরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হিন্দুদের বাঁচিয়েছেন। আজও তারা একই কাজ করছেন। বাংলাদেশে হিন্দু—মুসলমান পাশাপাশি বাড়িতে, পাশাপাশি ফ্ল্যাটে বসবাস করেন, কখনো মুসলমান প্রতিবেশির মাথায়ই আসে না পাশের বাড়ির ভাইটি, বা তার বউটি হিন্দু। এই দেশের কবিরা, শিল্পীরা সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির জন্য হাজার হাজার গান, কবিতা রচনা করেছেন, গেয়েছেন, আবৃত্তি করেছেন, যার চেতনা বাংলাদেশের মানুষের রক্তে প্রবহমান। বাংলাদেশের মুসলিম সংগঠনগুলো, যেমন হেফাজতে ইসলাম, জামায়াতে ইসলামী এই আগস্টে যেভাবে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িঘর, সম্পদ পাহারা দিয়েছে তা পৃথিবীর মানুষের কাছে অসা¤প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেও বাংলাদেশে এটি অতি স্বাভাবিক ঘটনা।
তার মানে কি হিন্দুদের ওপর কোনো আক্রমণ হয়নি? হ্যাঁ হয়েছে, যেসব হিন্দু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের কর্মী ছিলেন, নেতা ছিলেন, সুবিধাভোগী ছিলেন এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর অত্যাচার—নির্যাতন করেছেন তাদের ওপর মুক্তিকামী মানুষ চড়াও হয়েছে, যেমন হয়েছে মুসলমান আওয়ামী লীগারদের ওপর। দ্বন্দ্বটা এখানে ধর্মের নয়, রাজনীতির। এর বাইরেও নিরীহ হিন্দুদের ওপর কিছু পরিকল্পিত আক্রমণ হয়ে থাকতে পারে যেটি করা হয়েছে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডের নির্দেশে বাংলাদেশে “হিন্দুরা নিরাপদে নেই” এই স্ক্রিপ্টের আলোকে। তবে তাদের স্ক্রিপ্ট এতটাই দুর্বল ছিল যে বিবিসির মত দক্ষ মিডিয়াগুলো তা ধরে ফেলেছে। এ ছাড়া সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার প্রচুর ফেইক সংবাদ ভারতের মিডিয়া বুঝে বা না বুঝে প্রচার করছে। বাংলাদেশের এক টিভিতে দেখলাম, একজন হিন্দু তার বাড়িঘর ভেঙে ফেলেছে অভিযোগ করায় সাংবাদিক তার বাড়ির ঠিকানা জানতে চাইলেন কিন্তু লোকটি তার বাড়ির ঠিকানা, এমন কী থানার নামও বলতে পারছে না। বলছে, “থানার নামটা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না”।
আজ বাংলাদেশের মূল চালিকা শক্তি তরুণ সমাজ যেমন বিত্তের বৈষম্য ভেঙে দিচ্ছে, ঠিক তেমনি ধর্মের, মতবাদের সকল বৈষম্য ভেঙে দিয়ে একটি বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। যথাযথ রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব হয়ে উঠবে। তবে আরো বহুদিন তরুণ সমাজকে রাজপথ পাহারা দিতে হবে, কোনো অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠলেই সেই মাথা ভেঙে দিতে হবে।
আরেকটি কথা বলেই শেষ করি, এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতার শীর্ষে ড. ইউনূসের আসীন হওয়া যেমন সবচেয়ে অধিক বয়সী সরকার প্রধান হওয়ার রেকর্ড হলো ঠিক তেমনি নাহিদ এবং আসিফের উপদেষ্টা হওয়াও সবচেয়ে কম বয়সী মন্ত্রী হওয়ার রেকর্ড হলো। এটি সর্বার্থেই একটি ব্যতিক্রমী সরকার এবং এই ব্যতিক্রমী সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশাও অন্য সকল সরকারের চেয়ে ব্যতিক্রম কিছু।
ছাত্র—জনতার প্রত্যাশা পূরণে এই সরকারের ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। প্রধান উপদেষ্টা এবং ১৬ জন উপদেষ্টার সমন্বয়ে গঠিত প্রথমে কয়েকদিন পরে আরো চারজন দেশবরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে মোট ২১ জন উপদেষ্টা পরিষদ বা মন্ত্রী পরিষদই সরকার নয়। এটি সরকারের মাথা। সেই মাথার চোখ দুটি হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের দুই প্রতিনিধি নাহিদ ও আসিফ। আর সরকারের পুরো দেহটা এখনো রাজপথে, ছাত্র—জনতাই সেই দেহ। সেখানেই আছে হৃদয় যা সরকারের মাথায় রক্ত সরবরাহ করে। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে সরকার গঠিত হয় সেই সরকার বঙ্গভবন বা গণভবনে থাকে না, সেই সরকার থাকে রাজপথে, একথা আমরা সরকারের মাথাটিকে বারবার মনে করিয়ে দিব।
কাজী জহিরুল ইসলাম,
হলিউড, নিউইয়র্ক। ১২ আগস্ট ২০২৪