জয়নুল টিটো : ধড়ফড় করে জেগে ওঠে বিছানায় বসে পড়লো রানু। বুকটা ধুক্ ধুক্ করছে। নাগরদোলায় উপর থেকে গোত্তা খেয়ে খেয়ে নিচে নামলে যেমন লাগে, অনুভূতিটা ঠিক তেমনই। খালি খালি।
মাথার সোজা উপরে হাই স্পিডে ঘুরছে ফ্যান। সাথে মাথার ভেতরটাও। একেকটি নিঃশ্বাস পাথরের মতো ভারি ঠেকছে। ঝিম ধরে বসে আছে রাণু।
বাঁ হাতের কনুইয়ের নিচে ভেসে ওঠা ধূসর শিরায় আংগুল বুলায়। হাতের তালু মুষ্ঠিবদ্ধ করে আবার ছাড়ে।
কোন পরিবর্তন চোখে পড়েনা। কেবল শিরাগুলো ঢেউ খেলে যায়। অদ্ভুত এক অনুভূতি। শিরশিরে। ভেতর বাহির তোলপাড় করা। না ধরা যায়… না ছোঁয়া যায়! না জ্বালা… না সুখ!
এই অদ্ভুত অনুভূতি বহন করে চলেছে রাণু। তিন দশক ধরে। প্রায়ই মাঝরাতে ঘুম ছুটে যায়। ধড়ফড় করে জেগে ওঠে। ঘুমহীন পায়চারি করে পার হয় রাত। একাকী সময়। আজও তেমনটি ঘটলো।
বিছানার একপাশে নাক ডাকছে তমাল। কাবিননামা নামক এ ফোর সাইজের এক টুকরো কাগজ বলছে সে তার স্বামী। পতিধন। সংসারের বটবৃক্ষ।
আচ্ছা, তমাল কি কখনো খেয়াল করেছে ব্যাপারটি!
একটা জলজ্যান্ত মানুষ তার পাশে প্রতিরাতে ধড়পড় করে জেগে ওঠে, বারান্দায় পার করে ঘুমহীন রাত।
খেয়াল করে?
কখনোই না। হিপোক্রেট একটা। শুধু নিজেকে নিয়েই তার যত ব্যাস্ততা। নিজের বেলায় ষোল আনা। পুরোটাই চাই।
রাণুর ও যে ভালোলাগা মন্দলাগা থাকতে পারে, সেটা ভাবার সময় কই তার!
সারাদিন অফিস আর অফিস ।
সংসারের দায় দায়িত্ব বলতে মাঝে সাঝে এক আধটু বাজার আর মেয়েটাকে অফিস যাবার সময় স্কুল অবধি পৌঁছে দেয়া। এ আর কী। এতেই মেজাজ হাই ভোল্টেজ।
রাণুরই যেন ঠেকা পরেছে। সংসারের সিংহভাগ দায় নিয়ে বসে আছে। হেঁশেল থেকে বিছানা। অবশ্য সে তার দায়িত্ব পালনে কোন প্রকার কমতি রাখে না। মায়াবতী। ঘরণী। এই সুযোগটাই বোধকরি তমাল নেয়। তমাল ভালো করেই জানে, রাণু তার সংসার ছেড়ে যাবে না।
এই যে, সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সংসারের সকল ঝক্কি ঝামেলা সে পোহায়, একটু কৃতজ্ঞতাবোধ থাকবে না! সংসারটা কি তার একার?
সবকিছু গছিয়ে দিবে আবার
উল্টো কথায় কথায় দোষ ধরবে। মেজাজ দেখাবে।
ইদানীং মুখের ভাষাটাও চামারের পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে তমাল। কথায় কথায় নোংরা ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে দেয়। রাণু তখন কিছুই বলতে পারে না। বোকারমতো চেয়ে থাকে।
রাণুর এখন ভীষন ঘেন্না লাগে তাকে। অসামাজিক। চামচিকে একটা।
বাচ্চা’দের নিষ্পাপ মুখের দিকে চেয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে সংসারটা কোনমতে টেনে নিয়ে যায় সে। ভালোবাসাহীন দুটো মানব মানবীর রুটিন সংসার।
বিছানা ছেড়ে ঢক্ ঢক্ করে এক গেলাস পানি শেষ করে রাণু। দেয়ালে টিক্ টিক্ করছে আটপৌরে দেয়ালঘড়ি। রাণুর রাতজাগার সাথী। জানান দেয় রাত তিনটা বেজে কুড়ি।
ঘটনাটা কিছুতেই ভুলতে পারছে না সে। দুই হাতের শিরার দিকে তাকায়। ঢোক গিলে। আনমনে আংগুল ছোঁয়ায় কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত ।
তিন দশক ধরে বয়ে বেড়ানো স্মৃতি তাকে ঘুমুতে দেয় না। রাণু কেবলই হাতড়ে বেড়ায়। বারবার ফিরে যায়…।
সময়টা তিরানব্বইয়ের মাঝামাঝি। চট্টগ্রামের মহসিন কলেজে পড়ছে রাণু। ফার্স্ট ইয়ার।
কলেজের পিচঢালা পথ সাপের মতো বাঁক খেয়ে উঠে গেছে পাহাড়ে। পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে ছড়ানো লতাপাতার মাঝে দালান। ওখানেই রাণুর ক্লাস রুম।
ঘাড়ের দু’পাশে বেণী দুলিয়ে রাণু ঐ বাঁকা পথটুকু পেরিয়ে ক্লাসে যায়। সিনিয়র আর সহপাঠিরা আড়চোখে তাকায়। রাণুর চোখ দুটো সুন্দর। গভীর। টানাটানা। সহজেই চোখ আটকায়।
কলেজের পথ ধরে নামতে গেলে স্বভাবতই অনেকগুলো চোখ পিছু নেয় তার। ব্যাপারটা তার ভালোই লাগে। বয়সটাতো এমনি।
হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই রাণু কলেজে আসেনা। বান্ধবীরা খোঁজ নেয়। রাণু অসু¯হ। ভাইয়েরা অ¯িহর।
কী হলো তার?
এমন চটপটে হরিণীরমতো বোনটা কেমন যেন মিইয়ে গেছে। ডাক্তার দেখালে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ আসে।
ভাইয়েরা কোন প্রকার রিস্ক নিতে রাজি নয়। আদরের বোন।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে ইএনটিতে ভর্তি হয় রাণু। থাইরয়েডে প্রবলেম।
রাণুর দিন যায় হাসপাতালের বেডে। চারতলায়।
ভাইয়েরা অফিস কিংবা ব্যবসার কাজের ফাঁকে ফাঁকে পালা করে দেখে যায়। মা অথবা খালা কেউ একজন সাথে থাকেন।
রাণুর দিনগুলো ফিনাইল আর সেভলন ডেটলের গন্ধে বন্দী হয়ে পরে। তার খুব মনে হতে থাকে কলেজের বাঁকা পথ ক্লাসরুম। সারি সারি গাছ। বুনো ফুলের ঘ্রাণ।
আহা! বেণি দুলিয়ে কলেজে যাওয়া হয় না কত দিন!
রাণুর ভেতরে কান্নারা দলা পাকায়। কবে মুক্তি তার?
একদিন সকালে কিছু মানুষ তার বেডের কাছে ফ্লোরে জটলা পাকায়।
নতুন রোগি এসেছে। বেড খালি নেই।
ফ্লোরেই জাজিম দিয়ে বেড পাতানো হয়েছে। একজন বয়সী রোগিনী। তাতে শুয়ে আছেন।
রাণু এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। রোগিনীকে ঘিরে আছে তার স্বজনরা। অসহায় নিরুপায় তাদের চাহনি।
কত অবলিলায় অসহায় মানুষগুলো নিজেদের সমর্পণ করে দেয় ডাক্তার আর হাসপাতালের কাছে। দ্বিধাহীন সন্তর্পণে।
মানুষের ভেতরকার মানুষকে দেখা যায় এখানে।
একজোড়া চোখ পলকহীন তাকিয়ে আছে রাণুর দিকে।
সাদা এপ্রোন, গলায় স্টেথস্কোপ ঝুলানো। বয়স কুড়ি বাইশ হবে হয়তো। মেডিকেলের ছাত্র অথবা ইন্টার্নি।
ফ্লোরে থাকা রোগীনির বেডের পাশে বসা। আত্মীয় টাত্মীয় হবে বোধহয়।
রাণু খুব একটা খেয়াল করেনি। যখন চোখাচোখি হলো, রাণুর খুব অস্বস্তি হয়। চোখ ফিরিয়ে নেয়। কিন্তু ছেলেটা নির্লজ্জের মতো ঠাঁই চেয়ে থাকে।
পরদিন ও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। রাণুর কাছে ব্যাপারটা ভালোলাগেনা। সে বেড ছেড়ে বারান্দায় চলে যায়।
পাশের বেডটি খালি হলে, নিচের রোগিনীর জায়গা মেলে সেখানে।
ছেলেটি রাণুর খালি বেডের কোণে এসে বসে। রাণুর মেডিকেল ফাইল নিয়ে নাড়াচড়া করে। পাশে থাকা সিস্টারকে কি যেন বলে। রাণু বারান্দায় পায়চারি করতে করতে আড়চোখে দেখে।
কি নির্লজ্জ! এভাবে কি কেউ লেগে থাকে?
হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায়। ঝরঝরে নীল আকাশ। মাঝে মাঝে পেঁজা তুলোর মতো সাদা সাদা মেঘ। হাসপাতালের বয়সী গাছে’দের ফাঁকফোকর দিয়ে রাণু আনমনে নীল আকাশ দেখে।
থাইরয়েডের অস্বস্তি খুব বেড়েছে। ডাক্তার বলে গেছে অপারেশন লাগবে। ভাইয়েরা পালা করে আসে। বিকেলে এসে মধ্যরাত অবধি থাকে। রাতে থাকে মা।
বেডে গিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে তার। কিন্তু যায় কি করে! নির্লজ্জ ছেলেটা যে বসে আছে।
Ñ রাণু! আপনার চাকুটা দিবেন? আপেল খাবো।
ভূত দেখার মতো চমকে ওঠে রাণু। ছেলেটি তার পেছনে দাঁড়িয়ে। এমনভাবে কথাটা বললো, যেন কত যুগের চেনা।
Ñ আপনি আমার নাম জানলেন কি করে!
Ñ ফাইল ঘেঁটে জেনেছি। অভদ্রতা ভাবছেন?
Ñ ডাক্তার রোগির ফাইল দেখতে পারে। ফাইলে দেখলাম নামের জায়গায় ‘রাণু’ লেখা।
রাণু কিছুই বলেনা। হাতের ইশারায় চাকু দেখিয়ে দেয়।
ছেলেটি বেডের কাছে গিয়ে আপেল কাটে। মুখে দেয়। রাণুর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে, খাবে কিনা!
রাণু কিছুই বলেনা। মনে মনে হাসে।
পরদিন বিকেলে পাঁচটা নাগাদ ডাক্তার ছেলেটি তার এক বন্ধুসহ আসে। আত্মীয় রোগিনীর খোঁজখবর নেই।
আড়চোখে রাণুর দিকে তাকায়। রাণুর এ দৃষ্টি সহ্য হয়না। যতবারই তাকায়, রাণু মুখ ঘুরিয়ে নেয়। আশপাশের রোগিদের সাথে কথা বলার ভান করে।
ছেলেটি তার বন্ধুকে নিয়ে রাণুর বেডের কাছে আসে।
পরিচয় করিয়ে দেয়। চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসিতে পড়ে।
ভাবখানা এমন, যেন রাণু জানতে চেয়েছে।
রাণু বুঝতে পারে, এটা কথা বলার ছুঁতো। রাণুর দিকে তার তাকানোর ভঙ্গিটা নতজানু টাইপের। মুনিবের সামনে হাঁটু গেড়ে বসা ভৃত্যের চোখের চাহনির মতো এ দৃষ্টি।
সন্ধ্যেবেলায় বড় ভাইয়া বললো কাল অপারেশন।
রাণু মোটামুটি প্রস্তুতই বলা যায়। হাসপাতালে এডমিট হওয়ার আগেই ডাক্তার বলেছিল, অপারেশন লাগবে।
ডাক্তার ছেলেটা বোধহয় জানতো। বেডের পাশে এসে রাণুর ভাইদের বলে,
Ñ চিন্তা করবেন না। আমি থাকবো।
কথাটা কি ছেলেটা রাণুর ভাইদের বলেছে! না রাণুকে? সেটা অবশ্য রাণু ঠিকই বুঝতে পেরেছে। বড় ভাইয়া আড়চোখে তাকিয়েছে একবার। এপ্রোন পরা দেখে কিছু বুঝতে পারেনি।
রাত্তিরে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোতে অন্যরকম পরিবেশ বিরাজ করে। নিরিবিলি।
রোগীর সাথে রয়ে যাওয়া নিকট’জন বেডের শিয়রে বসা। নার্সরা এসে রুটিনমাফিক পথ্য সাজিয়ে দেয়। সিট না পাওয়া কিছু রোগী ফ্লোরেই শুয়ে থাকে।
রাণুর কাছে পরিবেশটা দমবন্ধ হওয়ার মতো। চারপাশে ঔষুধের গন্ধ। রোগীদের গায়েরও যে একধরনের অভিন্ন গন্ধ থাকে, সেটা এখানে না এলে বুঝা যেতো না।
ডিউটি ডাক্তার বলে গেছে আর্লি ঘুমাতে। কাল সকাল ন’টায় অপারেশন। মা শিয়রে বসে মাথায় হাত বুলান। রাণু চোখ বন্ধ করে থাকে। তার কেন জানি বারবার ডাক্তার ছেলেটার কথা মনে হয়।
কি আশ্চর্য! নামটা ও জানা হলোনা। কাল যদি ওটি থেকে ফেরা না হয়, তাহলে কি একটা মানুষের নাম না জেনেই তাকে চলে যেতে হবে!
ছেলেটি অবশ্য দেখতে বেশ। মাঝারি গড়ন। মায়ামায়া চোখ। রাণু’কে এমন করে কি দেখে সে!
পরদিন সকাল আটটায় ওটি’র দরোজায় তিন সহপাঠি ডাক্তারসহ দাঁড়িয়ে থাকে ছেলেটি।
রাণু ট্রলি থেকে আড়চোখে তাকালে, কাছে এসে বলে-
Ñ একদম ভয় পাবে না। আমরা আছি।
রাণুর ভাই আর মাকে গিয়ে সাহস দেয়। ভয় নেই।
অপারেশন চলাকালীন রাণুর রক্তের দরকার হয় ।
ভাইয়েরা ছুটোছুটি করে। ব্লাড ব্যাংকে খোঁজ নিতে যায় কেউ।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে ডাক্তার ছেলেটি রাণুর মা আর ভাইদের বলে,
Ñ তার রক্তের গ্রুপ একই। সে রক্ত দিবে।
ভাইয়েরা আপত্তি করলেও শেষতক রাজি হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
ডাক্তার ছেলেটা রক্ত দেয়।
রাণু নতুন করে চোখ মেলে।
অপারেশন শেষে রাণুকে ওয়ার্ডে শিফট করা হয়।
রক্তের কথাটা মা তাকে প্রথম বলে ।
শুনে রাণু কেমন যেন ঝাঁকি খায়। তার শরীরটা কেঁপে কেঁপে ওঠে।
তার দু’চোখ বেডের চারপাশে, দরোজায় কাকে যেন খোঁজে।
তিনদিন পর রাণুর রিলিজ হওয়ার দিন আসে। খুব সকালে ওয়ার্ডের দরোজায় এসে দাঁড়ায় ছেলেটি।
রাণু বেডে একা। মা ডাক্তারের রুমে।
ছোট্ট একটি ছেলে আসে রাণুর কাছে। সম্ভবত আয়ার ছেলে টেলে হবে।
একটা চিরকুট এগিয়ে দিয়ে দরোজার দিকে দেখায়।
রাণু দরোজায় দেখে, ডাক্তার ছেলেটি ইশারায় চিরকুটটি নিতে বলছে। রাণুর চোখ চিরকুটে।
Ñ রিদোয়ান। বাসা-ফিরিঙ্গিবাজার।
ছোট্ট ছেলেটি কলম আর টুকরো কাগজ এগিয়ে দেয়,
Ñ ভাইয়া আপনাকে ঠিকানা দিতে বলেছে।
রাণু অবাক হয়। ডাক্তার ছেলেটির কা-কারখানা পাগলাটে।
Ñ উনাকে চিনি না। ঠিকানা কেন দেবো?
দরোজার পাশ থেকে হাত ইশারা করে। কেমন জানি আদেশের ভঙ্গিতে।
রাণুর ভেতরে কী যেন ঘটে যায়।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো লিখে দেয় ঠিকানা।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে রাণু হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। দীর্ঘ্য সময় ধরে চান করে। নিজের প্রিয় রুমের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে শ্বাস নেয়।
বারান্দার গ্রিলে জড়িয়ে থাকা মানিপ্ল্যান্টের পাতা হলদেটে হয়ে গেছে। শরীরে রাজ্যের ক্লান্তি।
বিশ্রাম দরকার। ঘুম। টানা ঘুম।
রাণু এলিয়ে পরে নিজের প্রিয় বিছানায়।
দশ দিন পর কলেজে যায় রাণু। প্রিয় ক্যাম্পাস। প্রিয় রাস্তা, গাছের সারি, পুরোনো দালান, ক্লাসরুম।
ডাঙ্গায় ছটফট শেষে নতুন জল পেয়ে মাছ যেমন খলবলিয়ে ওঠে, ঠিক তেমনি খলবলিয়ে ওঠে রাণু।
হাসপাতালের দুঃসহ দমবন্ধ সময় সে ভুলে যেতে চায়।
একদিন ক্লাস শেষে কলেজ গেটে দেখা হয় ডাক্তার ছেলেটির বন্ধুর সাথে। কুশল জানতে চায়।
অথচ, কী আশ্চর্য!
একবার ও ডাক্তারের কথা জানতে চায়নি সে।
জানতে চায়নি কথাটা বোধহয় ঠিক নয়। আসলে রাণু নিজ থেকে জানতে চেয়ে ছোট হতে চায়নি।
বাসায় ফিরতে ফিরতে রিকশায় মায়ের কথাটা মনে পড়ে
Ñ ছেলেটি নির্দ্ধিধায় তোকে রক্ত দিল।
রাণু আনমনে নিজের হাতের দিকে তাকায়। এ শরীরে তবে কি সে দুটো সত্বা বহন করে চলেছে?
পরদিন কলেজ গেটে ডাক্তার ছেলেটি তার বন্ধুসহ দাঁড়িয়ে থাকে। রাণু দেখেই সালাম দেয়।
ছেলেটি কেমোন মায়াভরা চাহনিতে চেয়ে থাকে। রাণুর অস্বস্তি হয়।
Ñ আমাকে কখনো প্রয়োজন হলে আমার বন্ধুকে বলবে। আমি ছুটে আসবো।
Ñ চলো, কোথাও বসি।
রাণু সাঁয় দেয়না। দ্রুত বিদায় নেয়। ঘটনাটা আর বাড়াতে চায় না সে।
এরি মধ্যে কলেজ বন্ধ হয়ে গেল। গ্রীষ্মের বেশ লম্বা ছুটি। একদিন বড় ভাইয়া রুমে এসে বলে,
Ñ ডাক্তার ছেলেটি এসেছিল আমাদের বাড়ির গেটে। ভেতরে আসতে চাইলো। আমি না করেছি। চলে গেছে।
মনটা কেমন যেন করে ওঠে রাণুর। কেন এসেছিল? কি বলতে চায়? কেনইবা সে ওভাবে তাকায়?
কিছুই বলতে পারেনি ভাইয়াকে। শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তার কিছুই করার ছিল না।
কিছুদিন পর ভাইয়েরা বাসা পাল্টিয়ে ফেলে। নতুন ঠিকানা। ডাক্তার ছেলেটাকে নতুন ঠিকানা জানিয়ে লিখতে পারতো সে। লেখেনি।
বলা যায় যেঁচে ছোট হতে চায়নি। যেঁচে ছোট হতে গেলে নারীত্বে লাগে।
নতুন বাসায় মন আলুথালু করে। রাতে ঘুমুতে গেলে চোখের সামনে সাদা এপ্রোন দাঁড়িয়ে থাকে।
তার খুব ছুটে যেতে মন চায়। শরীরের শিরায় বয়ে যাওয়া রক্ত খলবলিয়ে ওঠে।
দিন যায়। মাস যায়। একসময় সবই স্বাভাবিক হতে থাকে। রাণুর কলেজের পার্ট শেষ হয়।
ভার্সিটিতে ভর্তি হয় সে। অন্য জগত। অন্য জীবন।
একদিন পুরোনো ব্যাগ ঘাঁটতে গিয়ে পকেটে খুঁজে পায় টুকরো কাগজটি। দলা পাঁকানো। লেখাগুলো চুপসে যেতে বসেছে।
Ñ রিদোয়ান। বাসা-ফিরিঙ্গিবাজার।
বুকের ভেতরটা ঘাঁই দিয়ে ওঠে। দু’হাতের শিরায় রক্তের স্রোত বয়ে যায়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে,
ওটির দরোজা।
ছোট্ট ছেলের হাতে কলম, কাগজ, চিরকুট।
বাসায় এসে স্থির থাকতে পারেনা রাণু। কাগজ কলম নিয়ে বসে যায়।
একটানে লিখে যায় ফেলে আসা গল্প।
গল্পের শেষে ঠিকানায় লেখেÑ
“রাণু, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।’’
লেখাটি ডাক্তারের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয় রাণু। তারপর এক অদ্ভুত কা- করে বসে।
ঠিকানা সম্বলিত চিরকুটটি ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে উড়িয়ে দেয় হাওয়ায়।
আর কোন ঠিকানা জানা থাকলো না তার।
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে রাণু চলে যায় ক্লাসে।
তারপর, কোন এক দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলঘেরা স্টেশন চত্বরে এলোমেলো ঘুরতে দেখা যায় ডাক্তার ছেলেটিকে। সাথে বন্ধুটিসহ। এদিক ওদিক কাকে যেন খোঁজে তারা।
একটা বিশের শাটলের জানালার ফাঁক দিয়ে এ দৃশ্য দেখে রাণু।
নাহ! আজও সামনে যায়নি সে। যেঁচে কেন যাবে?
যেঁচে উনার কাছে যেতে তার যত আপত্তি। শাটল এগোয়।
ধীরে ধীরে অদৃশ্য হতে থাকে ডাক্তার। একসময় চোখের আড়াল হয়ে যায়।
রাণু, জীবনের চরম ভুলটি করে ফেলে।
ইগো! নারীত্বের অহম!
তাকে এক ঝটকায় ছিটকে ফেলে দেয় জীবন থেকে।
ভুল। এতো ভুল কী করে করতে পারলো সে?
সেদিনের পর থেকে আর কোথাও দেখা যায়নি ডাক্তারকে।
রাণু, কেবল দেখতে পায় তার দু’হাতে ভেসে থাকা শিরা। যার উপশিরায় সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো আছড়ে পরে রক্ত স্রোত। বয়ে চলে অস্বস্তি। ঘুরে বেড়ায় রিদোয়ান, ফিরিঙ্গি বাজার।
বেসিনে গিয়ে মুখে জলের ঝাপটা দেয় রাণু। শরীরের পরতে পরতে নাড়া দেয় ফেলে আসা স্মৃতি।
সময়।
ভুল।
পায়ের তালু থেকে ঘাড়ের শিরায় খলবলিয়ে ওঠে রিদোয়ান, ফিরিঙ্গিবাজার।
ব্লাড পেইন। এই পেইন থেকে মুক্তি নেই রাণুর।
অন্যদিকে বিছানায় চিৎ হয়ে ঘুমায় তমাল।
ব্লাড কিংবা রাণু…কেউই তাকে ছুঁতে পারে না…।
জয়নুল টিটো, গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক