মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন : রুচির দুর্ভিক্ষ নেই কোথায়! সমাজের সর্বত্রই তা দেখা যায়। গত কিছুদিন থেকে রুচির দুর্ভিক্ষের কথাটি কেবল টক অব দ্যা টাউনই নয়, টক অব দ্যা কান্ট্রিও। নাট্যকার মামুনুর রশীদের কল্যাণে এই কথাটি এখন সুধী সমাজের সর্বত্র আলোচনার বিষয়বস্তু। কাজ না থাকলে কী করা – বসে বসে গাল মারা! লোকভাষায় যাকে বলে- নেই কাজ, খই ভাজ! মামুনুর রশীদ রুচির দুর্ভিক্ষের কথাটি উত্থাপন করেছিলেন হিরো আলমের উত্থানকে উপলক্ষ করে। তারপর কে পায় আর! সারাদেশ পক্ষে-বিপক্ষে সমালোচনায় সোচ্চার! কিন্তু সেসব সমালোচনায় কোথায় ‘সম’ ‘আলোচনা’? চোখে পড়ে বেশিরভাগই চনা! যে কোনো সমালোচনা তখনই হয় স্বাস্থ্যকর, যদি তা হয় আবেগবর্জিত, প্রজ্ঞাপ্রসূত ও যুক্তিনির্ভর। কিন্তু সে সবের সাক্ষাৎ কোথায়! দেখা যায়, সবকিছু আবগের প্রাবল্যে ভেসে যায়। ফলে সত্য থেকে যায় আড়ালে – সবাই নাচতে থাকে তালে তালে। কেউ কেউ না বুঝে গড়ে হরিবোল! কেউ বা বাজাতে থাকে প্রচারের ঢোল। যে কারণে অধিকাংশ আলোচনায় – আলোর অভাবটা অধিক দেখা যায়। কেউ কেউ সেই দুর্ভিক্ষ দূর করার অভিপ্সায় – বসে বসে রুচি চানাচুর চাবায়!
ওপরেই উল্লেখ করেছি, রুচির দুর্ভিক্ষ কথাটি এসেছে ইউটিউবার হিরো আলমকে কেন্দ্র করে – নাট্যকার মামুনুর রশীদের হাত ধরে। ব্যক্তি হিরো আলমকে নিয়ে কিছু বলতে চাই না আমি। কেননা তা হবে ব্যক্তির বিরুদ্ধে বেহুদা বদনামী। সে ক্ষেত্রে যারা তাকে চায় ছোট বা খাটো করতে, আমি তা সমর্থন করি না কোনো মতে। কিন্তু আমার বলার বা সমালোচনার ক্ষেত্রটি অন্য জায়গায়, যেখানে তার কাজ বা পেশার প্রসঙ্গটি প্রসঙ্গত এসে যায়। কারো নাম রাজা হলেই যেমন সে রাজা হয়ে যায় না, তেমনি কারো নাম হিরো হলেই সে হিরো হয়ে যায়না। বাংলা সিনেমার রাজ্জাকও হিরো, হিরো আলমও হিরো। উভয়ের হিরো হওয়ার ক্ষেত্রে নেই কারো হাত। কিন্তু অভিনয়-গুণের বিচারে দুজনের মধ্যে বিশাল তফাৎ! হিরো আলম অভিনীত আছে কি এমন কোনো ছবি, যা স্মরণে রাখার মতো বলে কেউ করতে পারবে দাবি। ইউটিউবে লাফালাফি আর অভিনয়- এক জিনিশ নয়। এ প্রসঙ্গে কাউয়ার প্রসঙ্গটি প্রবেশ করে। কোনো এক অতীতে ময়ূরের নাচে মুগ্ধ হয়ে এক কাউয়ার- সাধ জাগে তারও ময়ূরের মতো করে নাচবার। কিন্তু চাইলে তো আর হয়না। সব কাজ তো সবার দ্বারা হয়না। তার জন্য প্রতিভা প্রয়োজন – সাথে সাধনার গুণ। চাইলেই কি কাক পারবে তা? সে তো জানেই কেবল কা কা! ময়ূরের মতো করে নাচটাও শিখতে পারলো না সে – নিজের নাচটাও গেলো ভুলে অবশেষ! নৃত্যকলাকে দেখিয়ে কলা – সেই থেকে নাকি কাকের ঝাপ দিয়ে দিয়ে চলা!
হিরো আলম কবিতা লিখে বলেও শুনেছি। লিখতে পারে। কে বাধা দেয় তারে! হলো কি হলো না, সে তো করেনা তার বিচার – সে তো চায় শুধু নিজের প্রচার! এহেন মানসিকতা যার, তখন কে তাকে করবে উদ্ধার? কবিতার সাথে কস্মিনকালেও কানেকশন নেই যার – ফেসবুকের কল্যাণে সেও সাধনা করছে কবিতার। এদের সংখ্যাও বেশুমার। কোনো কিছু লিখলেই
তা হয়ে যাবে কবিতা – মাথায় যাদের সমস্যা আছে তারাই পারে বলতে এমন কথা! সাহিত্য বিচারে এহেন বলাটা পাপ! কবি অরুণ মিত্রের মতে যাকে বলে ‘পাঁজর ভাঙা চাপ’ ; তা চলে, কবিতা লিখতে গেলে। কবিতা যে কেউ লিখতে পারে, কিন্তু দেখতে হবে টিকবে কিনা কাব্যবিচারে? দেখতে হবে, তা কবিতা কতটুকু হয়েছে, কিংবা আদৌ হয়েছে কি না! হুমায়ুন আজাদ একসময় তাঁর এক কলামে বর্তমান বাংলা কবিতার বেহাল দশা সম্পর্কে যে কথাটি ব্যক্ত করেছিলেন, তা এ প্রসঙ্গেও প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন- “আমরা সবাই মিলে যেন একটি কবিতাই লিখছি, যার নাম ব্যর্থতা।” ফেসবুকের কল্যাণে এখন তো সবাই দাবী করে কবি। কিন্তু অধিকাংশজনের ক্ষেত্রে দেখা যায় ব্যর্থতার ছবি। বরং জিজ্ঞাসা জাগে- কবিতা এখন কই? জবাবও জুৎসই- যার কাছে গাই গরু নাই, সে বেছে দই! হিরো আলমের ক্ষেত্রে কথাগুলোর সত্যতা কতটা বেশি ও সর্বনাশী, সে কথা যদি কেউ বুঝতে না চায় – তাকে বোঝাতে যাবে, কে পড়েছে ঠেকায়!
হিরো আলম রবীন্দ্র সংগীতও গায়! গাইতে তো নিষেধ নাই, কিন্তু তার আগে তো সুর-তাল সম্পর্কে জ্ঞান থাকা চাই। তার কাছে তা আছে কি? যদি না থাকে, তাহলে তা কি হবেনা পান্তা ভাতে ঘি! সে সংগীত বলে যা গায়, সেখানে সংগীত কোথায়? সংগীত থেকে ‘গীত’ তো কবেই গায়েব – মঞ্চে রঙ দেখায় ‘সঙ’ সাহেব! পুরান পাগলে পায় না ভাত – নতুন পাগলের উৎপাত! অভিনয়, কবিতা কিংবা গান – কোনটাতে আছে তার জ্ঞান? মেধা আর গাধা যদি হয় সমান, তাহলে কোথায় যাবে শিল্পের বা সৃষ্টির মান? মান ঠিক থাকলে মানুষের মুখে মুখে একদিন হবেই হবে নাম। কেউ তখন আর করতে পারবে না তার বেহুদা বদনাম।
তাই যে কাজটাকে করি আমি ভয়, তা হলো আবগে কাউকে হিরো বা জিরো বানানো ঠিক নয়। কিংবা হেয় কিংবা শ্রেয়। বানালেও কি হয়? থেকে যায় ভয়। ইউটিউব বা ফেসবুকের ফাজলামি বলি যারে – টিকবে তো তা কালের ও কলার বিচারে? যদি না-ই টিকে, তবে তো তা টিকটক! তাহলে পাগলের মতো কেন বেহুদা বকবক!
কেউ যদি তার প্রতিভাকে প্রমাণ করতে চায়, তবে – পরীক্ষার মধ্য দিয়ে তাকে আসতে হবে। প্রথমে শিক্ষা, তারপর পরীক্ষা। পরীক্ষায় যদি পাস হয়, তখন লোকে তাকে কামিয়াব কয়। এর বিপরীতটা হবে যখন, তা হবে সৃষ্টিশীলতার পতন। আমার কথাকে যবে মনে হবে মূল্যহীন ও মিছা – তবে তা হবে অন্ধের শহরে আয়না বেচা!
হিরো আলম যদি তার প্রতিভাকে প্রমাণ করতে চায়, তাহলে সময় এখনো হয়নি শেষ – করুক পেশ। পেশ না করে পাস – তা তো হবে সাড়ে সর্বনাশ! তা কেউ করেনাও আশ। যদি কঠোর কঠিন সাধনা ও পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সে আসতে পারে – সাধ্য নেই কারো পেছনে ফেলবে তারে। প্রতিভা হচ্ছে সূর্যের মত – মেঘ করলেও ষড়যন্ত্র শত – পারবে না আড়াল করতে তাকে – সত্য উদ্ভাসিত হবে সূর্যের আলোকে।
কিন্তু জগতে কিছু লোক আছে- জনপ্রিয়তার জোরে বা জোয়ারে নাচে। প্রতিভা না থাকলেও তারা নির্লজ্জ ও ডেমকেয়ার! তারা বোঝে শুধু নিজের প্রচার। প্রচার ছাড়া বোঝে না কিছু আর। কিন্তু প্রতিভার পরিমাপ বা পরীক্ষা প্রচার দিয়ে হয় না। শিল্প তা সমর্থনও করেনা। সেক্ষেত্রে যতোই থাকুক নাম, তা দেবেনা কোনো কাম। কারো নাম রাজা হলেই সে যেমন রাজা হয়ে যায়না, তেমনি কারো নাম হিরো আলম হলেই সে হিরো হয়না। জনপ্রিয়তা কি কুদ্দুস বয়াতীরও কম? অথচ সংগীত বিচারে সে তো শিল্পের যম! অশুদ্ধ উচ্চারণে যে গায়, কোমর দোলায়, আর বাতেসে লম্বা চুল উড়ায়, তাকে যদি কেউ সংগীত শিল্পীর কাতারে দেয় স্থান, তাহলে কী থাকে শিল্পী বা শিল্পের মান? মান যদি না থাকে মুল্য নেই তার কিছু। তার চেয়ে তো বেহতর মানকচু! অথচ সুদীর্ঘকাল সংগীত সাধনায় নিবেদিত – এমন শিল্পী আছে কত কত, খুব কম লোকই চেনে যাদের, তাই বলে কি মূল্য নেই তাদের?
কী সাহিত্য, কী সংগীত, কী অভিনয় – কোনো কিছুই জনপ্রিয়তা বা আবেগের নিরিখে বিচার্য নয়। যদি তেমনটা হয়, তাহলে যত ভয়। সবকিছু হয়ে পড়ে বেকার। বিচারের স্থান দখল করে বিকার। রুচির দুর্ভিক্ষের মতো এটাও চিন্তার দুর্ভিক্ষ বটে! এমনটা যদি সমাজে সর্বক্ষেত্রে ঘটে, বুঝতে হবে, সুরুচির উদ্বোধন ছাড়া এ দুর্ভিক্ষ কভূ দূর না হবে।
রুচির দুর্ভিক্ষ নিয়ে সম্প্রতি আমিও লিখি একটি কবিতা। বলছি না কবিতা হয়েছে তা! তারপরও পাঠকদের ভালোবাসা পাবার আশায়, সেটি উদ্ধৃত করে নিচ্ছি বিদায় –
রুচির নাকি চলছে দুর্ভিক্ষ,
তাইতো আগাছা যতো আছে-
নিজেদেরকে দাবি করে বৃক্ষ!
রূপালি পর্দায়-
জিরো দেখো হিরো হয়ে যায়,
পরি এসে নেচে নেচে
কোমর দোলায়!
অঙ্গের তরঙ্গ দেখে তার
বুড়োও জোয়ান হতে চায়!
এহেন স্বপ্নের ঠেলায়,
মধ্যরাতে অনেকের
ঘুম ভেঙে যায়!
জোরে জোরে বেজে ওঠে-
‘ফাইট্যা যায়, ফাইট্যা যায়’!
রুচির দুর্ভিক্ষের মোকাবেলায়-
না দেখে কোনো উপায়,
কেউ কেউ বসে বসে
রুচি চানাচুর খায়!
মুহাম্মদ নিযামুদ্দীন, প্রাবন্ধিক ও গবেষক