আবু তৈয়ব : চুলকানোতে সুখ আছে, আপাতত ঝালমুড়ি খাওয়ার মত। খাদ্যের পুষ্টিমান নেই বললেও চলে কিন্তু মুখ-জিহ্বায় ঝাল লাগায়। জিহ্বাকে নাড়িয়ে দেয়, সক্রিয় করে। বেশি হলে আবার বিপদ। আবার ঝালমুড়ি না থাকলেও তার শূন্যতা কারো নজরে পড়ে না। তেমনি ঝালমুড়ির ও চুলাকানির মত কিছু ইউটিউবার অসাস্থ্যকর চলমান সংস্কৃতির দেহের কোথাও কোথাও রুচিহীনতার রোগ সংক্রমিত করে দিচ্ছে,ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই সব মুক্ত মিডিয়ায় কোয়ারেন্টাইন প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা (রোগ সংক্রামণ প্রতিরোধ) না থাকায় তা ছড়িয়ে পড়ে আরও আস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরী হতে থাকে। আর তার প্রভাবে মিডিয়াব্যক্তি ও সমাজের মধ্যে রোগের নানা উপসর্গ দেখা দেয়। আবার বুঝে হউক বা না হউক কেউ কেউ নিরাময়ের আশায় বেশি চুলকাতে গিয়ে কারো কারো রক্তক্ষরণ করে ফেলে।
এসব তো রোগের লক্ষণ মাত্র। রোগের গোড়ায় না গিয়ে বা রোগের কারণ না খোঁজে চিকিৎসা করলে হয় না। বরং তাতে হিতে বিপরীত হয়। শুধু চুলকিয়ে রোগ সেরেছে তার তো নজির নেই। তাতে একটু ভাল লাগতে পারে মাত্র।
অনুমোদনপ্রাপ্ত হউক বা না হউক যে কোন মিডিয়ায় যারা যান তাদের ন্যূনতম কিছু শর্তপূরণ করতে হয়, যোগ্যতা থাকতে হয়, যাতে দর্শক-শ্রোতার উপর নেতিবাচকতার কোন প্রভাব না পড়ে। ব্যক্তির আয় রোজগারের জন্য যে কোন বৈধ ও সৎ পরিশ্রমকে সুস্থ সমাজে সম্মানের চোখে দেখা হয় কিন্তু তার কাজে যদি ব্যক্তি লাভের চেয়ে সামষ্টিক ক্ষতি হয় তা হলে তাকে থামাতে হয়, চীন দেশে কিন্তু থামানোর চেয়ে আরও বেশি কিছু করে, ক্ষতিকর ব্যক্তি বা টেক্সটকে উৎপাটন বা নির্মূল করে দেয়। আগাছার নেতিবাচক প্রভাব যাতে দর্শক বা প্রজন্মের উপর না পড়ে। বরং তাদের বা তাদের সৃষ্টিকর্মের দ্বারা ইতিবাচক পরিবর্তন হয় মত, মিডিয়ায় যাওয়ার বা থাকার শর্তগুলো পূরণ করে ন্যূনতম যোগ্যতা অর্জন জরুরি।
তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমরা ডিজিটিলাইজড বান্ধব পরিবেশে থাকলেও তার মুক্ত ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে আমাদের জীবনাচারের সৌন্দর্য বাড়ানোর পরিবর্তে নেতিবাচক প্রভাবকারি নানা বিষয় আমাদের সাধারণের উপর চাপিয়ে বসা শুরু হয়েছে।
যেমন ভাষা নিয়ে কিছু বলার সুযোগ আছে। আপনি কয়েক বছরের মধ্যে ভাষা শিখতে পারেন, আপনার মস্তিষ্কে ভাষা শিখার জন্য সক্ষম একটি মানবীয় ও সর্বজনীন কাঠামো র রয়েছে বলে। যে কোন ধরনের মানুষ, সে গরীব হউক বা ধনী হউক সে ভাষা শিখবেই সমাজের উঁচু নিচু যেখানেই থাকুক না কেন। যদি সে মানুষের মাঝে বসবাস করে। তাই ভাষা জানা গৌরবের মত কিছু না। কিন্তু জানা ভাষাটি কোথায়, কখন, কিভাবে ব্যবহার করতে হবে তা জীবনব্যাপী নানা অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে শিখে যেতে হয়, সেই শিখার মধ্যে কিছু গৌরব বা মর্যাদা অর্জিত হয় বলা যেতে পারে । কিন্তু ভাষার এই দক্ষতা অর্জনের জন্য সংস্কৃতির সুস্থতার প্রয়োজন। প্রয়োজন এই জন্য যে সংস্কৃতি নামক প্রক্রিয়ায় মানুষের পাশবিক ও জৈবিক সত্তাকে মানবিক ও সামাজিক সত্তায় পরিণত করে। আর মানবিক ও সামাজিক গুণাবলীর তথা চিন্তা-চেতনার আধার হল ভাষা। আর সেই মানুষ যখন মিডিয়ায় যায় তখন তিনি ‘মডেল’ শিখনের উপযোগী ভূমিকা রাখতে পারে । অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় হতে পারে । এই জন্যও গণমাধ্যম।
সমাজের সুস্থ সংস্কৃতি প্রক্রিয়াই যখন ভেঙে পড়ে বা ত্রুটিপূর্ণ হয়ে পড়ে তা হলে সেই প্রক্রিয়ায় উৎপাদিত দ্রব্যও খারাপ হয়। অপ-সংস্কৃতিতে অসামাজিক, দানব ও অপ-মানুষ তৈরী হয়। দূষিত জলবায়ুর অকর্ষিত ভূমিতে ভাল ফলন যেমন আশা করা যায় না, বন্য গুল্ম ঝোপঝাড়ে ভরে যায় তেমননি ‘রুচির দুর্ভিক্ষতে’ পড়া সমাজ ও সংস্কৃতিতে ভাল কিছু গড়ে ওঠে না। বরং আগের যা ভাল কিছু ছিল তাও লতাগুল্মের চাপে পড়ে যায়। চাপে পড়াদের আর্তচিৎকার শুনার লোকও তখন পাওয়া যায় না। পাবে কোত্থেকে? তখন তাদের মত মুষ্টিমেয়দের কথা বোঝার বা অনুধাবন করার মানসিকতা আমজনতার কারো থাকে না। এমন অবস্থা থেকে শুরু হয় একে অপরকে প্রত্যাখান করার কাল, অস্বীকৃতি করার কাল, আত্মস্বীকৃতি লাভের কাল। আর অপরকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার কাল। অমুক আবার কিসের অভিনেতা বা শিল্পী ! বলার কাল। এখানে রোগের চিকিৎসার তৎপরতার চেয়ে রোগীকে নিয়ে টানা হেছড়ায় মেতে উঠতে দেখা যায়। ফলে সব ধরনের প্রচেষ্টা ও শ্রম প-শ্রমে পর্যবাসিত হয়। প্রকৃত শিল্পী তারাই যারা তার উপস্থাপনা শৈলী বা কর্ম দিয়ে অপরের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তনের তাড়না সৃষ্টি করে বা করার চেষ্টায় থাকে। সেই বিবেচনায় শিল্পীকে বা শিল্পী হয়ে উঠার বিষয়টি তখন আর ব্যক্তিগত বিষয় থাকে না, সামাজিক বা সামষ্টিক বিষয় হয়ে উঠে। তখন সেখানে শিল্পীর দায়বদ্ধতার বিষয়টি চলে আসে। আপনার সুযোগ আছে বলে বা আপনি সুযোগ পেয়েছেন বলে মিডিয়ায় আপনি হেঁড়ে গলায় গান গেয়ে যাবেন, আপনার ব্যক্তি লাভের জন্য মিডিয়ায় যা ইচ্ছা তা করে যাবেন তা তো হয় না, হতে পারে না। আপনার প্রচেষ্টা, শ্রম, ধৈর্য ও মহৎগুণের প্রতি অবশ্যই সবার সম্মান থাকে, কিন্তু মিডিয়া উপযোগী প্রস্তুতি না নিয়ে, যা নিয়ে যাচ্ছেন তা মিডিয়ার উপযোগী কিনা তা যাচাইবাছাই করবেন না, তা হয় না। সমাজ ও দর্শকের উপর সুদূরপ্রসারী কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে কিনা তা যাছাই না করে মিডিয়ায় বিষয়টি দিয়ে দেয়া এক ধরনের ক্রাইম। তা প্রতিরোধে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজ তথা সুধী সমাজের বড় ভূমিকা থাকে। এ ব্যাপারে সচেতনমহলের প্রতিরোধ জোরালো হতে হয়। কারন সে অশৈলীভাবে উপস্থাপন করা বিষয়ের নেতিবাচক প্রভাব ব্যক্তি ও সমাজের ওপর পড়ে। এখন নাটকের সংলাপ বল, কাহিনি বল সব কিছু যেন আমাদের বিগত অর্জনের বিপরীতে । শুধু সস্তা মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য। যেখানে মোলায়েম কন্ঠ দেয়ার কথা সেখানে ষাঁড়ের মত চেঁচামেচি, যে বিষয়টা আড়ালে রাখা উচিত সে বিষয়কে স্থূলভাবে সামনে আনা ইত্যাদির মত নানা বিষয় দিয়ে এমন অরুচির পরিচয় দিচ্ছে সচেতন মহল সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এটা তো সমাধানের কথা না। নিরবতাও তখন এক ধরনের ‘ক্রাইম’ হয়ে ওঠে। নীরবতার এই সুযোগে তারা অন্য পথ ধরে। পতিত ভূমিতে তখন অনাকাক্সিক্ষত বিষবৃক্ষ জন্মানো শুরু করে। সেই বিষবৃক্ষ হল এখন পোষ্ট করা বিষয়ে ‘লাইক’ সংখ্যা। এখানে আপনার ভোটার হওয়ার যোগ্যতা না থাকলেও ভোট দিতে পারবেন। ডাক্তার না হলেও চিকিৎসকের ভোট বা লাইক দিতে পারবেন। মুক্তবাজার অর্থনীতির মত ‘লাইক: এর সংখ্যা বিষয়টি এখন কারো কারো কাছে নির্ণয়ক বা সূচক হয়ে ওঠেছে। লাইক সংখ্যাই প্যারামিটার হয়ে ওঠেছে। এখানে ‘লাইক’ এর সংখ্যা ক্রিপ্টোক্রারেন্সির মত কাজ করে। বেশি বা কম সংখ্যক লাইকের উপর তথাকথিত শিল্পীর হর্ষে-বিষাদ নির্ভর করে। এখানে ব্যক্তি বা শিল্পীর ফেসবুকে দেয়া তার টেক্সটের গুণগত মানের চেয়ে লাইকের সংখ্যাই শিল্পী বা ব্যক্তি হালকা না ভারি, দামি না সস্তা তার মাপকাঠি হয়ে যায়। ফলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের রুচি স্থায়ীভাবে বদলে দিতে পেরেছে। মননশীলতার পরিবর্তে চটুলতা আর ‘আমাকে দেখুন’ টাইপের আত্মপ্রদর্শন এখন মুখ্য হয়ে ওঠেছে। যার জন্য এখানে লাইকের সংখ্যা দেখে কনটেক্সট বা বিষয়কে বিবেচনা করে সত্যিকারের শ্রেষ্ঠ বা নিকৃষ্ট, জনপ্রিয় বা অজনপ্রিয় বিচার করা যায় না। এভাবেই সংস্কৃতির গায়ে পচন ধরে, দুর্গন্ধ ছড়ায়। এর চিকিৎসা তো জরুরি, সামষ্টিকভাবে। এককভাবে এর চিকিৎসা করা যায় না। শুধু জল/বৃষ্টি দিয়ে জলবায়ু হয় না, আরও কিছু নিয়ে জলবায়ু, জলবায়ুর অন্য নানা উপাদানও আছে। তাই সমষ্টিগতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। কারা আসবে, কীভাবে আসবে তা তো জানা কথা। সুধীসমাজ, সমাজের বিবেকবান মানুষ, তাঁরা বিবেকের তাড়নায় অপ-সংস্কৃতি রোধে ডাক দেবেন, সংস্কৃতিকর্মীরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বেন, প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। তখন তরুণরা তাদের ও জাতির অমূল্য সম্পদ ‘তারুণ্য’ শক্তিকে মহৎ কাজে ব্যয় করে তারা নিজেরাই মহৎ ও সুনাগরিক হয়ে উঠার ক্ষেত্র পাবে। ভাষা ও সংস্কৃতির মাধ্যমে স্থান-কালের প্রতিসরণ ঘটিয়ে মানুষ অতীত বা ভবিষ্যৎ বাস্তবতাকে আরেক জায়গায় বিমূর্তভাবে হলেও তৈরি করতে পারে। আমরা এই জন্য মামুষ, তাই সমাজকে ক্রম উন্নতির দিকে নিয়ে যেতে পারি, সমাজও মানবদেহের মত সুস্থভাবে প্রগতিশীলতা অর্জন করে এগিয়ে চলে। আমাদের সচেতন থাকতে হবে যাতে সেই সমাজের সুস্থতা ও প্রগতিশীলতা দূষিত না হয়, নষ্ট না হয়। ভবিষ্যমুখীতা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে।
আমাদের ভাবতে হবে ভবিষ্যতে আমরা কেমন সংস্কৃতির কেমন প্রজন্ম তৈরী করতে যাচ্ছি তার আগাম প্রস্তুতি নেয়ার বিষয় নিয়ে। তার জন্য সকল স্তরে এই বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরী করার জন্য কাজ করতে হবে,প্রত্যেককে এগিয়ে আসতে হবে। না হয় মিডিয়ার দূষিত জলবায়ু পরিশোধিত করা যাবে না। কোরেন্টাইনের ব্যবস্থাহীন গণমাধ্যমের কারণে সমাজ ব্যাধিতে ভরে উঠবে। ব্যাধিতে ভরা গেলে অপ-টেক্সট ও অপ-মানুষের কাজকে প্রতিরোধ করা যাবে না, নির্মূল করা যাবে না।
এভাবে তো চলতে দেয়া যায় না। ভেঙে পড়া বা কদর্যে ডুবু ডুবু সাংস্কৃতিক প্রক্রিয়াকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে, সাংস্কৃতিক ভাঙ্গা সেতু মেরামত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। সংস্কৃতি শুধু মানুষ নামক এই প্রজাতিরই থাকে। সংস্কৃতি মানুষকে সামাজিক করে, সক্রিয় রাখে। সংস্কৃতি নিয়ে মানুষকে বাঁচতে হয়। সংস্কৃতিহীন মানুষ দিগম্বর মানুষ। তখন তার মানুষ বলে দাবি করার কিছু থাকে না। তাই জলবায়ু দূষণে বৈশ্বিক মানব সমাজ যেমন ঝুঁকিতে তেমনি রুচির দুর্ভিক্ষপীড়িত অপ-সংস্কৃতিও আমাদের মানবিক ও সামাজিক গুণাবলীকে গ্রাস করে নিচ্ছে, মানবিক জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে। আমরা চুপ থাকতে পারি না। প্রজন্মের স্বার্থে, সুস্থ সমাজের স্বার্থে। তার জন্য জাতপাত, এলিট-ননএলিট নির্বিশেষে প্রত্যেক স্তরের সুধীসমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। অপ-সংস্কৃতির নানা বিষয় ও অপ-মানুষের প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। যাতে রুচির দুর্ভিক্ষের হাত হতে সমাজ ও প্রজন্মদের রক্ষা করা যায়। না হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না।
আবু তৈয়ব, প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ, অধ্যক্ষ-খলিলুর রহমান মহিলা ডিগ্রি কলেজ, পটিয়া