তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী
লোকবিশ্বাস, লোকাচার ও লোকসংস্কার লোকজ সমাজের এক প্রাচীন বোধ- যা মানুষ আবহমান ধরে বয়ে চলেছে। বৈরী-প্রকৃতির আনুকূল্য- নির্ভর মানুষ যখন প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তখনই মানুষের মনে বাসা বাঁধে নানা বিশ্বাস ও সংস্কার। মধ্য যুগের মানুষ জীবনের শুভাশুভের পেছনে কল্পনা করতো শুভ দেবতার অনুগ্রহ কিংবা অপদেবতার ক্ষতির ক্রিয়া। এটা তারা কল্পনা করতো ভয়- বিশ্বাস – কল্পনাপ্রসূত এক ধরনের যাদুবিশ্বাস থেকে। আধুনিক সভ্য সমাজেও তার রেশ এখনও মিলিয়ে যায় নি। আজও মানুষ দৈনন্দিন নানা কর্মে শুভাশুভ বিশ্বাস ও আচার-সংস্কার মেনে চলে। যদিও দেশ বা সমাজ ভেদে মানুষের এসব বিশ্বাসে ও কাজে যোজন যোজন ফারাক বিদ্যমান, তব্ওু এসব বিশ্বাস ও সংস্কার আজও মানব সমাজের সাধারণ সম্পত্তি। এসব লোকবিশ্বাস, আচার ও সংস্কার এমন এক বিষয়, যা যুক্তিতর্কের পরোয়া না করে আজগুবি ঘটনা ও কার্যকারণবিহীন বক্তব্যের মাধ্যমে লোকসমাজের অন্ধ আনুগত্যে বংশ পরম্পরায় টিকে রয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশের ভাষা, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক সীমানা অতিক্রম পর্যায়ে এসব ভিন্ন ভিন্নভাবে দৃশ্যমান মনে হলেও মূলত তা এক ও অভিন্ন।
এসবের প্রতি মানুষের আদি বিশ্বাসের ঐতিহাসিক ও বংশিক ধারাবাহিকতায় পরিবর্তন দেখা যায় না। বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের এ যুগেও এমন কোন মানুষের সাক্ষাৎ পাওয়া ভার, যে সচেতন- অবচেতন মনে কম-বেশি আচার মেনে চলে না, কিংবা সংস্কারে বিশ্বাস করে না। লোকবিদ আবদুল হাফিজ মনে করেন,”লোকবিশ্বাস লোক সংস্কারের ক্ষেত্রে একটি স্তরমাত্র। কারণ লোকবিশ্বাসেও কোন বিশেষ বস্তু, ঘটনা বা মানসিক ক্রিয়ার স্বীকৃতি দেয়া হয়। অন্যদিকে লোকবিশ্বাস যদি লোকসমাজের জীবনাচরণে কার্যকরীভাবে প্রকাশ পায়, যদি তা ক্রিয়া ও অনুষ্ঠানে রূপায়িত হয়, তবে তা পরিণত হবে লোকসংস্কারে।” (লৌকিক সংস্কার ও মানব সমাজ -আবদুল হাফিজ,বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিী, ঢাকা,১৯৯৪, পৃষ্ঠা -৬১)। মানুষের ধর্মীয়, পারিবারিক ও সামাজিক প্রথাগুলো ঐতিহ্যনির্ভর লোকসংস্কার হিসেবে বিবেচিত। এতে এমন এমন কিছু বিশ্বাস থাকে, যা শর্তহীনভাবে মানতে হয়। যেমন শাস্ত্রীয় বিধান মতে সুনির্দিষ্ট ধর্মীয় কৃত্যাদি ও আচরণের মাধ্যমে উপাস্যের প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য প্রকাশ করা।
লোকবিশ্বাস হলো মানসিক বিষয়। যতক্ষণ তা মানুষের কাজ- কর্মে প্রতিফলিত না হয়, ততক্ষণ তা বিশ্বাসের পর্যায়ে থাকে। কিন্তু মানুষের কাজ কর্ম অভিব্যক্তিতে বিশ্বাসের প্রকাশ ঘটলে তা হয়ে যায় লোকাচার-লোকসংস্কার। মানুষের জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে কোন না কোনভাবে মানুষের জীবনকে শাসন করে লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার। লোকবিশ্বাস বেশির ভাগই হয়ে থাকে ধর্মানুভূতি নির্ভর। মানুষের ধর্মবিশ্বাস প্রধানত প্রকাশ পায় পূজা-অর্চনায়, আচার- অনুষ্ঠানে, লোকজ সংস্কারে।
লোকাচার লোকজীবনের আজন্ম প্রত্যয় ও বিশ্বাসের অঙ্গ – অভ্যাসগত বিধি-বিধান, আচার- আচরণ, রীতিনীতি; যা অবচেতন মনে লুকিয়ে থেকে মানুষের প্রত্যাহিক কর্মকে প্রভাবিত করে। সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ এর মতে, ‘ব্যবহার ও আচরণের স্বীকৃতি এবং গৃহীত পন্থা- পদ্ধতি হচ্ছে লোকাচার’। লোকাচার প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পরম্পরায় চলতে থাকে। লোকাচারের উৎসমুখ হচ্ছে লোকবিশ্বাস। আমাদের দেশে সত্যিই এমন লোক পাওয়া দুস্কর, যে কোনো ধরনের প্রচলিত লোকবিশ্বাস না মেনেই জীবন পার করেছেন কিংবা কোনো লোকাচার-লোকসংস্কারের ঘূর্ণাবর্তে পড়েন নি! এদেশের লোকসমাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্থান করে নেয়া কিছু লোক বিশ্বাস – সংস্কার নিচে তুলে ধরা হলো–
(০১) (ক) মৃত্যুর পরে আতœা কবরের পাশে ঘোরাঘুরি করে। (খ) আত্মা দেহ পরিত্যাগ করতে পারে, আবার শরীরে পুনর্বার প্রবেশ করতে পারে।
(০২) (ক) মৃতরা ভোজন করে। এজন্য মৃত্যুর পর চিতায়/ গোরে গিয়ে মৃতের উদ্দেশ্যে খাদ্যাদি রাখা হয়। (খ) মৃত্যুর পর মৃত আত্মার মঙ্গলার্থে জন্তু- জানোয়ার বলি দেয়া হতো। আদিম আরবীরা গোরে উট বলি দিত এই ভেবে যে, এতে মৃতের আত্মা উটে চড়ে ঘুরে বেড়াতে পারবে।
(০৩) (ক) আত্মা নিজেকে রূপান্তরিত করতে বা দেহ ধারনে সক্ষম। (খ) মৃতের আত্মা অনিষ্টকারী প্রেতাত্মায়ও রুপান্তরিত হতে পারে। এজন্য মৃত পূর্বপুরুষদের আত্মার পূজা প্রথার প্রচলন রয়েছে।
(০৪) বিধবা মেয়েলোককে যদি কোন অবিবাহিত পুরুষ বিয়ে করে, তবে হাসরের দিন সে লোক তার ঐ বউকে পাবে না। পাবে সেই মেয়েলোকের আগের স্বামী। এজন্য ঐ পুরুষ মারা গেলে তার বুকের ওপর কলাগাছ রেখে তাকে কবর দিতে হয়।
(০৫) কোনো ফলবান বৃক্ষ যদি যথেষ্ট পরিপক্ব হওয়ার পরও এতে কোনো ফল না ধরে, তাহলে সেই বন্ধ্যা বৃক্ষকে কেটে ফেলার ভান করতে হয়। এতে বৃক্ষে ফল ধরে। এক্ষেত্রে একজন কুড়াল দিয়ে গাছটি কাটতে যায়, অন্যরা তাকে বাধা দিয়ে বলে, ‘কাটিস না,কাটিস না। সামনের বছর ফল ধরবে।
(০৬) কোন বাড়িতে মহামারি দেখা গেলে, সে বাড়ি থেকে ভিক্ষা দিতে নেই। ভিক্ষা দিলে ওলা বিবি দ্রুত মহামারি ছড়িয়ে দেয়।
(০৭) মেয়েদের ফাটা বা ভাঙা চুরি হাতে দিতে নেই। দিলে তার অমঙ্গল হয়।
(০৮) কোনো দু’জন কিংবা দুই দল পুরুষ বা স্ত্রীলোক ঝগড়া শুরু করলে, তখন কেউ যদি ‘পাক খায়’। অর্থাৎ সর্বাঙ্গ ঘুরিয়ে বৃত্ত রচনা করে, তাহলে ঝগড়া আরও বেড়ে যায়।
(০৯) রাত না পোহাতে দেখিলাম আঁটকুড়ের মুখ, /
ভোজনে নাই সুখ, কপালে আজ অনেক দুখ।
(১০) গোসল করি যেইবা নারী কেশের আগা চায়, /
উড়াইন্যা বাড়াইন্যা পুত যমেরে বিলায়।
(১১) শিং ভাঙা লুলুইয়া গাই, /
তার থাইক্যা আর কু- যাত্রা নাই।
(১২) চট্টগ্রামের হযরত বায়েজিদ বোস্তামী (রহ.) এর মাজার সংলগ্ন বৃক্ষে বিশেষ নিয়তে (দ্রুত বিয়ে হওয়ার নিয়তে) সূতা বেঁধে রাখা রেওয়াজ আজও একশ্রেণির নারীরা প্রতিপালন করে।
(১৩) কিশোরগঞ্জ শহরের পাগলা মসজিদে কেউ যদি কোন বিশেষ নিয়তে ইট উল্টে রাখে, তবে তার সেই নিয়ত অলৌকিকভাবে পূরণ হয়ে যায়। এটাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘হান উল্টানী’।
(১৪)শিশুর ৬/৭ মাস বয়সে হিন্দু পরিবারের মধ্যে ‘অন্নপ্রাশন’ ও মুসলমানদের মধ্যে ‘মুখে ভাত’ অনুষ্ঠান আজও বেশ কিছু সংস্কার সহকারে পালন করা হয়।
(১৫) গর্ভাবস্থায় পোয়াতি নারীর গোরস্থান- শ্মশান বা রাতে ঘুটঘুটে অন্ধকারে যাওয়া নিষিদ্ধ, তাদেরকে কোন দুঃসংবাদ বিশেষত বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম সংবাদ বা গর্ভপাতের কথা বলতে মানা।
(১৬) নারীরা গর্ভে সন্তান নিয়ে লাউ- কুমড়ো কাটলে ভূমিষ্ঠ সন্তানের গায়ে দাগ দেখা দেয়।
(১৭) কোনো শুভ কাজে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় কেউ যদি হোঁচট খায়, তাহলে সে কিছুক্ষণের জন্য বসে যায়। অন্যথায় তার বিশ্বাস শুভ কাজে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে না।
এ ধরনের বিষয়-আশয় অনেক সময় এমন অদ্ভুত, বিচিত্র ও যুক্তিহীন মনে হয় যে, তা বিশ্বাস করতেও ইচ্ছে করে না। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করতে চাই আর না-ই চাই বাস্তবতা হলো, এদেশের ঘরে ঘরে- বলা যায় তাবৎ দুনিয়ায় আজও লোকবিশ্বাস ও সংস্কারনির্ভর নানা আচার- অনুষ্ঠান ভক্তি সহকারে দাপটের সাথে পালিত হয় ! এসব লোকাচার এসেছে দীর্ঘদিনের প্রথা হিসেবে, মানুষের অজ্ঞতার ফল হিসেবে, ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রাবল্যে। ইতিহাসের কোন্ নির্দিষ্ট পর্যায় থেকে মানুষ এসবে বিশ্বাস স্থাপন শুরু করে, কিভাবে এসব কিছু লোকসংস্কারের অঙ্গে পরিণত হয়ে যুক্তিহীন লোকাচার হিসেবে আজও মানব সমাজে দেদীপ্যমান, তা প্রকৃতপক্ষে আজও আমাদের অজানা! যদিও এ বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। ফ্রেজার, টেইলর, ল্যাঙ, মেলিনোস্কি, ব্রাউন, বেনেডিক্টসহ অনেক নৃতাত্ত্বিক গবেষক এবিষয়ে কাজ করেছেন। তারা সর্বপ্রাণবাদকে এসবের মূল হিসেবে চিহ্নিতও করেছেন। সর্বপ্রাণবাদ বস্তুর মধ্যে নিহিত শক্তির অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। তবে এসব গবেষকদের অনুমানভিত্তিক নানা মতামত আমাদের আলোচনার ভিত্তি হলেও তা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নয়।
তৌফিকুল ইসলাম চৌধুরী, প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কবি