এখন সময়:রাত ৯:৪২- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ৯:৪২- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

শফীউদ্দিন সরদারের উপন্যাস ও তাঁর বিষয় বৈচিত্র্য

মিনহাজুল ইসলাম মাসুম

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশি ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন কথাসাহিত্যিক শফীউদ্দিন সরদার (১৯৩৫-২০১৯)। তিনি শেকড় সন্ধানী লেখক হিসেবে খ্যাত। নাটোর জেলার হাটবিলা গ্রামে জন্মগ্রহণকারী লেখক অনেকটা শেষ বয়সে এসে সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন। এ অঙ্গনে তাঁর পরিচয় খুব-একটা বেশি ছিল না। যেহেতু তিনি দীর্ঘদিন শিক্ষকতা ও প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছিলেন। শফীউদ্দিন সরদার ১৯৫০ সালে ম্যাট্রিক পাশ করার পর রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে আইএ, বিএ অনার্স এবং এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর তিনি লন্ডন থেকে ডিপ্লোমা-ইন-এডুকেশন ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি কর্মজীবন শুরু করেন নিজ গ্রামের স্কুলে প্রধান শিক্ষক হওয়ার মধ্য দিয়ে। এরপর রাজশাহী সরকারি কলেজ ও সারদা ক্যাডেট কলেজে অধ্যাপনা এবং বানেশ্বর কলেজ ও নাটোরের রাণি ভবাণি সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত তিনি প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এক সময় যাত্রাসহ মঞ্চ নাটকে অভিনয় করেন তিনি। বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী এ লেখক শেষ জীবনে এসে ঔপন্যাসিক হিসেবে বাংলা সাহিত্যকে আলোকিত করেন।

ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তাঁর লেখালেখির জন্য টার্নিং পয়েন্ট। কারণ প্রথম লেখা সামাজিক উপন্যাস ‘চলনবিলের পদাবলী’র পা-ুলিপি নিয়ে তিনি প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কোনো প্রকাশনা সংস্থা দায়িত্ব নিয়ে ছাপাতে চায়নি। তাই তিনি ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখার ‘গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত’ নিয়েছিলেন। ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির বঙ্গবিজয়ের কাহিনি দিয়ে তাঁর উপন্যাস লেখা শুরু। দৈনিক ইনকিলাবে ‘বখতিয়ারের তলোয়ার’ উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হওয়ার পর সুধীজনের দৃষ্টিতে আসেন তিনি। মাসিক মদিনা সম্পাদক মাওলানা মুহিউদ্দিন খান ইসলামি ভাবধারায় তাঁর লেখা দেখে মুগ্ধ হন। বিদগ্ধজনের পক্ষ থেকে অনুপ্রেরণায় সিক্ত হন। একে একে রচনা করতে থাকেন ‘বখতিয়ারের তলোয়ার’, ‘গৌড় থেকে সোনারগাঁ’, ‘যায় বেলা অবেলায়’, ‘বিদ্রোহী জাতক’, ‘বার পাইকার দূর্গ’, ‘রাজবিহঙ্গ’, ‘বারো ভূঁইয়া উপাখ্যান’, ‘প্রেম ও পূর্ণিমা’, ‘বিপন্ন প্রহর’, ‘সূর্যাস্ত’, ‘পথহারা পাখি’, ‘বৈরী বসতি’, ‘অন্তরে প্রান্তরে’, ‘দাবানল’, ‘ঠিকানা‘, ‘ঝড়মুখী ঘর’, এবং ‘রোহিনী নদীর তীরে’সহ অনেকগুলো জনপ্রিয় ঐতিহাসিক উপন্যাস। তিনি ঐতিহাসিক ও সামাজিক উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, নাটক, রম্য রচনা ও কল্প কাহিনিসহ ৬০টির বেশি গ্রন্থ রচনার অধিকারী।

বাংলা সাহিত্যে ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস খুব বেশি নেই। হাতে গোনা কয়েকটা মাত্র। মীর মশাররফ হোসেনের ‘বিষাদ সিন্ধু’, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজীর ‘রায় নন্দিনী’, শহীদুল্লাহ কায়সারের ‘সংশপ্তক’, হুমায়ূন আহমেদের ‘মাতাল হাওয়া’, ‘বাদশাহ নামদার’, ও ‘দেয়াল’, আল মাহমুদের ‘কাবিলের বোন’; সেলিনা হোসেনের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’, আনিসুল হকের ‘মা’ ও ‘যারা ভোর এনেছিল’-এ ধরনের কিছু কিছু উপন্যাস রয়েছে। অথচ এই দেশ ও জাতির দীর্ঘ সংগ্রামী ইতিহাস রয়েছে বিধায় আরও অনেক ঐতিহাসিক উপন্যাস থাকার প্রয়োজন ছিলো। শফীউদ্দিন সরদার জীবনের শেষপ্রান্তে এসে তা সম্পন্ন করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর অবদান অপরিসীম। এদিকে উর্দু সাহিত্যে কথাসাহিত্যিক নসীম হিযাজীও অনেকগুলো ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখেছেন। এর মধ্যে অনেকগুলো বাংলায় অনূদিত হয়েছে। ‘মুহাম্মদ বিন কাসিম’, ‘হেযাযের কাফেলা’. ‘আধাঁর রাতের মুসাফির’, ‘শেষ প্রান্তর’, ‘সীমান্ত ঈগল’, ‘মরণজয়ী’, ‘শেষ বিকালের কান্না’, ‘ভারত যখন ভাঙল’, ‘ভেঙে গেল তলোয়ার’, ‘কিং সায়মনের রাজত্ব’, এবং ‘ইউসুফ বিন তাশফীন’ অন্যতম। মুসলিম জাতির ইতিহাস, স্পেন বিজয়, সিন্ধু বিজয়, ইসলামের ইতিহাসের নানা যুদ্ধ এবং মুসলমানদের শৌর্যবীর্যের কাহিনি নসীম হিযাজীর উপন্যাসের মূলবিষয়। তিনি পুরো বিশ্ব মুসলিমের প্রান্তরে প্রান্তরে সংঘটিত ইতিহাসগুলো উপন্যাস আকারে তুলে ধরেছেন। পক্ষান্তরে শফীউদ্দিন সরদার উপমহাদেশের গ-ীর মধ্যেই বিচরণ করেছেন। তবে দুজনেরই চিন্তা-ভাবনা উম্মাহর শান্তি, কল্যাণ ও অগ্রগতি। চেতনা ও শিল্পরূপ বৈচিত্র্যে দুজনেরই মিল লক্ষণীয়।

শফীউদ্দিন সরদারের ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোর নাম ও বিষয়বস্তু পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি একাধারে বাংলাদেশের পূর্বাপর প্রায় সকল ইতিহাস নিয়ে কলম ধরেছেন। প্রথম উপন্যাস ‘বখতিয়ারের তলোয়ার’ লিখেন ১২০৪ সালে লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে তরুণ তুর্কি ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজীর বঙ্গবিজয় নিয়ে। ‘গৌড় থেকে সোনারগাঁ’ লিখেন বাংলায় স্বাধীন সুলতানি আমল প্রতিষ্ঠার বিচিত্র কাহিনি নিয়ে। ‘যায় বেলা অবেলায়’-এর কাহিনি হচ্ছে গিয়াস উদ্দীন আযম শাহের রাজত্বকাল সম্পর্কিত। ‘বিদ্রোহী জাতক’ হিন্দু রাজা গণেশের রাজত্বকালের কথা। ‘বার পাইকার দুর্গ’ সুলতান বারবাক শাহ্ ও দরবেশ ইসমাঈল গাজীর সময়কাল নিয়ে রচিত হয়েছে। ‘রাজবিহঙ্গ’ উপন্যাসের মূল কাহিনি সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহের রাজত্বকাল সর্ম্পকিত। ‘শেষ প্রহরী’ দাউদ খান কররানী ও কালা পাহাড়ের সময়কালকে ধারণ করে রচিত। ‘প্রেম ও পূর্ণিমা’র প্রতিপ্রাদ্য বিষয় সুবাদার শায়েস্তা খানের সময়কাল। যার শাসনামলে টাকায় আট মণ চাউল পাওয়া যেতো। ‘সূর্যাস্ত’ পলাশীতে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে ষড়যন্ত্র করে পরাজিত করার মর্মান্তিক ঘটনা নিয়ে।  ‘বখতিয়ারের তিন ইয়ার : বখতিয়ার খিলজীর সাথে আসা তিনজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর জীবন নিয়ে কথা। ‘বিপন্ন প্রহর’ নবাব মুর্শিদ কুলি খান ও সরফরাজ খান এর রাজত্বকাল। ‘পথহারা পাখি’ ফকির মজনু শাহ্ ও সন্ন্যাস আন্দোলন। ‘বৈরী বসতি’ সৈয়দ আহমদ বেরেলভী ও মীর নিসার আলী তিতুমীর প্রমুখের আন্দোলন। ‘দাবানল’-এ রয়েছে সিপাহী বিদ্রোহের শুরু ও শেষ নিয়ে অমর কাহিনি। ‘ঈমানদার’ দাক্ষিণাত্যের একজন প্রভাবশালী মুসলমানকে নিয়ে রচিত। ‘রোহিনী নদীর তীরে’র মূল উপজীব্য বিষয় সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদে স¤্রাট আকবরের ভূমিকা অবলম্বনে। ‘ঠিকানা’ ১৯৪৭ এর দেশবিভাগ ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে নিয়ে। ‘দীপান্তরের বৃত্তান্ত’ আন্দামান দ্বীপের বন্দীদের খুন ও নির্যাতন নিয়ে লেখা হয়েছে। ‘বার ভূঁইয়ার উপাখ্যান’ বাংলার বার ভূঁইয়াদের কাহিনি অবলম্বনে। ‘অন্তরে প্রান্তরে’ হাজি শরীয়ত উল্লাহর ফরায়েজী আন্দোলনের কাহিনি। ‘রুপনগরের বন্দী’ সম্রাট শাহজাহানের পূত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ ও স¤্রাট আওরঙ্গজেবের মোঘল সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও অধিকার নিয়ে রচিত। ‘ঝড়মুখী ঘর’ দেশবিভাগ পরবর্তী সময় থেকে ভাষা আন্দোলন ও আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত ঘটনা নিয়ে। ‘অবৈধ অরণ্য’ স্বাধীনতা যুদ্ধোত্তর সময়কালের জ্বলন্ত চিত্রকে সাথে নিয়ে রচনা এবং ‘দখল’ ১৯৭১ সালের পরবর্তী সময় থেকে আশির দশক শুরু পর্যন্ত কাহিনি। কবি আল মাহমুদের ভাষায়, ‘শফীউদ্দিন সরদার বাংলাদেশের সমকালীন সাহিত্যে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। যিনি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম বীরত্বগাঁথার মহান উপস্থাপক। তিনি আমাদের সবচেয়ে বিশ্বস্ত কথাশিল্পী। আমি উপন্যাসিক শিল্পীর একজন ভক্ত।’

 

বিশিষ্ট লেখক মাহমুদ ইউসুফ বলেন, ‘তাঁর উপন্যাসের ভাব-ভাষা-ভঙ্গি ও সুষমার সমন্বিতরূপ ক্লাসিক্যাল মর্যাদায় অভিষিক্ত। ধ্রুপদী মানে উত্তীর্ণ এসব উপন্যাস সব সময়ের, সব যুগের, সব মানুষের উপযোগী। মানুষের আত্মার সাথে সম্পৃক্ত এ ধরনের শিল্প-সাহিত্য বাংলা ভাষায় খুব কমসংখ্যক লক্ষ্যণীয়। শফীউদ্দীন সরদার এক্ষেত্রে অতুলনীয়। তাঁর নির্মাণ-কলা ও শিল্পোৎকর্ষের চমৎকার নিদর্শন উপন্যাসগুলো। ভারতের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী গোলাম আহমাদ মোর্তজা যাকে বলেছেন, ‘ইতিহাসের ইতিহাস বা চেপে রাখা ইতিহাস।’ জাতীয় প্রয়োজনেই এসব লুপ্ত ইতিহাসের মনিমাণিক্য ও গুপ্তধন ভা-ার উদ্ধার হওয়া দরকার। আর এ কাজটিই করেছেন শফীউদ্দীন সরদার তাঁর কথারাশির ছত্রে ছত্রে।’ পরিশেষে এটাই বলতে চাই, তাঁর উপন্যাসগুলো কেবল বাঙালি মুসলমানদের জন্য নয়, বিশ্বসাহিত্য ও মুসলিম উম্মাহর জন্য ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এটা ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, এদেশে ইসলাম এসেছে বঙ্গবিজয়েরও বহু আগে। কিন্তু শাসক হিসেবে বিজয়ীর বেশে এসেছিল ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজির হাত ধরে। মুসলমানদের প্রায় আটশো বছরের গৌরবময় ইতিহাসকে উপন্যাসের মোড়কে তিনি তুলে দিয়েছেন বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের হাতে। পাঠক তাঁর বক্তব্য উপস্থাপনা, বিশ্লেষণ, তৎকালীন সময়কালকে ধারণ ও ভিন্নমাত্রিক উপন্যাসের স্বাদ পেয়েছেন। ধারাবাহিকভাবে তিনি সাহিত্য ভা-ারে একে একে যুক্ত করেছেন ২৭টি উপন্যাস-যা এককভাবে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিরল। শেকড় সন্ধানী ঔপন্যাসিক হিসেবে শফীউদ্দিন সরদারের সেখানেই সার্থকতা!

 

মিনহাজুল ইসলাম মাসুম, সম্পাদক, ইদানীং (লিটলম্যাগ)

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে