রুদ্র সুশান্ত:
কবিতা শাসকের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবচেয়ে শক্তিশালী এবং সুদৃঢ় প্রতিবাদী হাতিয়ার। কবিতা মানুষের জীবনকে শেষ রাত্রির উজ্জ্বল তারার মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে শেখায়, কবিতার ¯্রােত মানুষকে চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে শেখায়, কবিতা মানুষের মৃত্তিকামূলে আপন জাতিসত্ত্বাকে শাশ্বতরূপে চিনতে শেখায়। কবিতা মানুষের চিন্তার বিবর্তন সাধন করে। কবিতার ধ্বজাতলে জীবনের বীজ অঙ্কুরিত হয় এবং তা মানুষকে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা দেয়। প্রেম এবং দ্রোহের শক্তিকে কবিতা বহুমাত্রিকরূপে পূর্ণিমার আলোর প্রভাবের ন্যায় প্রভাবিত করে। একজন কবি তাঁর পরিপক্ব লেখার মাধ্যমে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সামগ্রিক চিত্র উপস্থাপন করেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক পরিস্থিতি, সমাজের দ্বন্দ্ব, পারিবার সৌহার্দ্যপূর্ণ অবস্থা, মানুষের জীবন চলার প্রবাহ, প্রেম-ভালোবাসা-প্রণয়, মানুষের বহুমাত্রিক সুখ-দুঃখ, জীবনযাপনের আনন্দ-বেদনা, প্রান্তিক মানুষের চলন-বলন-ফিরন, আজন্ম ভালোবাসার প্রার্থনা কবিতার বুকে সগর্বে ফুটে উঠে। একজন কবি কবিতায় শিল্পকে গায়ত্রী মন্ত্রের মতো মহাপবিত্ররূপে বর্ণনা করেন। মানুষের প্রবল প্রণয়, অনুরাগ, ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা, প্রেম, ভালোবাসা, স্মৃতি-বিস্মৃতি থেকে ছন্দ এবং পরবর্তী ছন্দের সম্মিলিত বহিঃপ্রকাশ হলো কবিতা। মলয় রায় চৌধুরী শব্দকে হাতুড়িপেটা করে ভেঙেছেন আবার প্রয়োজনে শব্দের সুনির্মল বুনন করেছেন কবিতার স্তবকে স্তবকে। তিনি একজন প্রতিবাদী কবি, ১৯৬৪ সালে নব্বই লাইনের জলবিভাজক একটি কবিতা হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হলে- সাহিত্য অশ্লীলতা ও তরুণ প্রজন্মকে বিপথগামী করার দোষে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। (হাংরি শব্দটি মলয় রায় চৌধুরী নিয়েছিলেন কবি চসারের “ওহ ঃযব ংড়ৎিব যঁহমৎু ঃৎু সব” লাইনটি থেকে) অবশ্য এই মামলায় মলয় রায় চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন কবি ও কথাসাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সাহিত্যিক তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিত দত্ত। অগ্নিঝরা শব্দ কবিতায় প্রয়োগে চমৎকার পারদর্শী ছিলেন মলয় রায়চৌধুরীর। “প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতায় লিখেছেন-
“সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও
চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আর আমি পার্ছিনা, অজ¯্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
আমি যানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
প্রতিটি শিরা অশ্রু¯্রােত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে…”
(কবিতা-প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার)
এই কবিতাটি লেখার পর তাঁকে কতো দুর্বিষহ জীবন যাপন করতে হয়েছে সেটার কিঞ্চিৎ বর্ণনা সোনালী মিত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আমরা দেখতে পাই। ছিন্নমূল জীবনের চিত্র তুলে ধরতে মলয় রায়চৌধুরী বলেন- “ওটা ছিল মূলত দ্রুতির কবিতা; আক্ষেপানুরাগের কবিতা। ওই কবিতার দরুন পঁয়ত্রিশ মাস ধরে আদালত-উকিল-চাকরি থেকে সাসপেনশানের কারণে অর্থাভাব ইত্যাদির ফলে দ্রুতির রেশ আক্রান্ত হয়েছিল। কলকাতায় তো আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, কেননা আমরা তখন পাটনায় থাকতুম। সুবিমল বসাক ছাড়া অন্যান্য বন্ধুরাও কলকাতায় তাদের আস্তানায় রাতে থাকতে দিত না। উত্তরপাড়ার আদিবাড়ির খ-হরে রাতে থাকলে সকালে কলকাতা আদালতে যাবার জন্যে প্যাসেঞ্জার ট্রেন, যার সময়ের ঠিক ছিল না। ইলেকট্রিক ট্রেন তখন সেরকমভাবে আরম্ভ হয়নি। সে কি দুরবস্থা। টয়লেট করতে যেতুম শেয়ালদায় দাঁড়িয়ে থাকা দূরপাল্লার ট্রেনে ; রাত কাটাতুম সুবিমলের জ্যাঠার স্যাকরার এক-ঘরের দোকানে, বৈঠকখানা পাড়ায়। একই শার্ট-প্যাণ্ট পরে দিনের পর দিন কাটাতে হতো ; স্নান রাস্তার কলে, সেগুলোও আবার এতো নিচু যে হামাগুড়ি দিয়ে বসতে হতো। কবিতা লেখার মতো মানসিক একাকিত্বের সময় পেতুম না মাসের পর মাস।” (১) সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে সোনালী মিত্র জানতে চেয়েছেন – হাংরি আন্দোলন নতুন ধারার কবিতার জগতে বিপ্লব এনেছিল। কিছুদিন ফুল ফুটবার পরেই রোদের তাপে মিইয়ে গেলো! মতপার্থক্য জনিত কারণেই কি আন্দোলন শেষ হয়ে গেলো? মলয় রায়চৌধুরী প্রাণবন্ত সাবলীলভাবে উপস্থাপন করে চমৎকার উত্তর দিলেন- “পৃথিবীর সব আন্দোলনই একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে গড়ে ওঠে; তার কাজ হয়ে গেলে মিলিয়ে যায়; আন্দোলন মাত্রেই সমুদ্রের আপওয়েইলিং। হাংরি আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় একের পর এক কতোগুলো আন্দোলন হয়ে গেছে বাংলা সাহিত্যে। তারা মিডিয়া প্রচার পায়নি বলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছিলুম, যে কারণে এই মাস তিনেক আগেও বিবিসির প্রতিনিধি এসে একটা প্রোগ্রাম তৈরি করে নিয়ে গেলেন আর প্রসারণ করলেন। গত বছর আমেরিকা থেকে অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় এসে একটা ফিল্ম তৈরি করে নিয়ে গেলেন ; হাংরি আন্দোলন নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বক্তৃতা দেবার সময়ে ওনার কাজে লাগে ফিল্মটা। হাংরির পর তো কবিতার আর গদ্যের ক্রিয়েটিভ ধারাই পালটে গেছে ।” (১)
তিনি “প্রচ- বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতাটি ১৯৬৩ সালে লিখেন এবং ১৯৬৪ সালে ‘হাংরি বুলেটিনে’ প্রকাশিত হয়। তখন তাঁর শিরায় শিরায় প্রতিবাদের অগ্নি জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। কবিতাটা ১৯৬৪ তে হাংরি আন্দোলনের মুখপাত্র হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত হলে তখনকার পশ্চিমবঙ্গ সরকার ভারতের আদালতে ১২০বি (রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র), ২৯২ (সাহিত্যে অশ্লীলতা) এবং ২৯৪ (তরুণদের বিপথগামী করা) মামলা করেন। (২) মামলার ফলে মলয় রায়চৌধুরীসহ অন্যান্য যাঁরা সংখ্যাটিতে লিখেছিলেন তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। কলকাতার পুলিশ মলয় রায় চৌধুরীসহ মোট ছয়জনকে গ্রেফতার করে।
এই মামলায় ১৯৬৫ সালের মে মাসে সবাইকে জামিন দেয়া হলেও মলয় রায় চৌধুরীকে জামিন দেয়া হয়নি। তাঁর বিরুদ্ধে ২৯২ ধারায় চার্জশীট প্রদান করা হয় এবং ৩৫ মাসব্যাপী এ মামলা চলে। মলয় রায় চৌধুরীর কবিতায় তখনকার সরকার এতোটা নাখোশ ছিলো যে গ্রেফতার করে মলয় রায় চৌধুরীকে হাতকড়া পরিয়ে, কোমরে দড়ি বেঁধে দুই কিলোমিটার হাঁটিয়ে আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। (৩) কবিতায় তিনি শাসকগোষ্ঠীর ভিত এতটাই নাড়িয়ে দিয়েছিলেন।
তাঁর কবিতার শব্দ যেনো চন্দনমাখা কুসুম, কবিতায় শব্দের পুষ্প মেঘমালার সাথে ময়ূরীর ঝুম বৃষ্টির গল্প করে। তাঁর কবিতার ভেতর শক্ত লোহার তীব্রতা আছে। কবিতায় মাটির ধুলো জড়িয়ে থাকে শব্দেরা, কুয়াশার স্পন্দনে স্পন্দনে নক্ষত্রের রাত নামে, মদ খেয়ে মাতাল হয় সবুজ ঘাসের দল। শরতে ধানের ক্ষেতে ঢেউ খেলে যাওয়ার মনোরম মনমুগ্ধতা এবং আত্মতৃপ্তি আছে, কবিতার স্তবকে স্তবকে নতুন সৃষ্টির উদ্দীপনা আছে, পৃথিবীর নষ্ট সভ্যতার সুসজ্জিত লোহিত বর্ণনা আছে। কবিতায় সহজ-সরল ভাষার প্রয়োগে ছোট ছোট শব্দের ভেতর দিয়ে তিনি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন। শব্দে শব্দে অনর্থক বিতর্ক কবিতায় আনেননি, মাছরাঙার ঠোঁটে তুমুল আন্দোলন কবিতার পরতে পরতে। তাই প্রেমের ঘ্রাণে মাতাল হয়ে শিশিরমাখা নয়নে কবিতার ঘোর এঁকেছেন এভাবে-
“ভরপুর সন্ধ্যায় তোকে দেখলুম অবন্তিকা প্রেমের মৌতাতে ঝিমিয়ে/
চুয়াল্লিশ বছর আগের ধুলো আর শুকো ঘাস আজও তোর বুকে-পিঠে/
সারা গায়ে দাগড়া-দাগড়া চাঁদের দোষ, আহা, পূণ্যের ফল/
ঢেউ তুলে কাঁপছিস পেটে হয়তো কৃমির জটিল ঘূর্ণির পাক”
(কবিতা-প্রেম ফেরে, ফেরে না)
অথবা
“পাপড়ির ফুল” কবিতায় তিনি লিখেছেন-
“বোঁটায় তোর গোলাপ রঙ, অবন্তিকা/
শরীরে তোর সবুজ রঙ, অবন্তিকা/
আঁচড় দিই আঠা বেরোয়, অবন্তিকা/
চাটতে দিস নেশায় পায়, অবন্তিকা/
টাটিয়ে যাস পেট খসাস, অবন্তিকা”
(কবিতা- পাপড়ির ফুল)
মেদহীন নির্ভেজাল প্রেমের স্বাভাবিক চিত্র আপাদমস্তক সুনিপুণভাবে এঁকেছেন ষোড়শী যুবতীরূপে। এ যেনো মনোহরিণী প্রিয়ংবদা নিখুঁত প্রেয়ষীর আসমুদ্রহিমাচল আকাঙ্ক্ষা অঙ্গ প্রত্যঙ্গে আবালবৃদ্ধবনিতার মনোরূপ চয়নে দেবতার রাজসভায় যাবজ্জীবন পা-িত্য ভজনা করেছেন কবিতার বন্দনায় বন্দনায়। বাংলা সাহিত্যে তাঁর কবিতা আন্দোলনভিত্তিক দিক-বদলে বিরাট ভূমিকা রাখে। কবিতায় তাঁর শব্দ প্রয়োগ কুমড়ো ফুলে নুইয়ে পড়া গর্ভবতী লতার মতোন, শব্দেরা ছুটে ছুটে এসেছে পাঠকের হৃদয়ে।
১৯৬১ সালে এক ইশতেহার প্রকাশিত হয় পাটনায়। সেই থেকে শুরু হয় হাংরি আন্দোলন। যা ক্রমেই ছড়িয়ে পড়ে বঙ্গসাহিত্যের আনাচে কানাচে। হাংরি জেনারেশনের বাংলা কবিতা আন্দোলনের রাজাধিরাজ বলা যায় মলয় রায়চৌধুরীকে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী সেই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল মূলত মলয় রায় চৌধুরীর হাত ধরেই। আবহমান ভারতীয় কবিতার স্রোতবতী শব্দের মাঝেও স্বতন্ত্র মূর্ছনায় উচ্ছ্বল হয়ে উঠেছিল হাংরি আন্দোলন। তাই তো ভারতীয় কাব্য সাহিত্যের বির্বতনের ইতিহাসে এক অনস্বীকার্য নাম হিসেবেই উচ্চারিত হবে মলয় রায় চৌধুরীর নাম। (৪) আন্দোলন, বিপ্লব আর সংগ্রামের মধ্যে ছিলো কবিতার বুকে আত্মমগ্ন হওয়ার নিদারুণ ব্রত। সংগ্রামে সংগ্রামে কবিতায় শব্দের আত্মমর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি জাগ্রতচিত্তে শিল্পীর রঙের তুলিতে সময়ের বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন-
“ভোর রাতে দরোজায় গ্রেপ্তারের টোকা পড়ে/
একটা কয়েদি মারা গেছে তার স্থান নিতে হবে/
জামাটা গলিয়ে নেবো ? দু-মুঠো কি খেয়ে নেবো ?/
পিছনের ছাদ দিয়ে পালাবো কি ?”
(কবিতা -অস্তিত্ব)
ক্রমান্বয়ে নান্দনিকতার উৎকর্ষে সমকালীন সময়ে সমধিকভাবে উচ্চারিত হয়েছে তাঁর কবিতা। দক্ষ শিল্পের কারিগরি নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর অভিজ্ঞতালব্ধ লোকের সাথে মিলেমিশে আন্দোলন সংগ্রামের পথসমূহ নির্ণয় করেছেন কবিতার পরতে পরতে।
তাঁর কবিতায় স্ফুলিঙ্গ আছে, বারুদ আছে, আগুনের ফুলকি আছে, উত্তাপ আছে, সমাজ ও মানুষকে আলোকিত করার আলো আছে, কবিতার মাঝে জ্বলজ্বল করা তারা আছে, পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় তামাটে সোনারোদ আছে। জীবনকে জীবনের মতো করে পাঠ করার ব্যাপক স্তুতি তাঁর কবিতার উপাদান। কবিতায় তিনি জীবনের জয়গান গেয়েছেন লক্ষ্মীর পাঁচালীর মতোন। কবিতায় প্রেমের স্লোগান নিয়ে এসেছেন চুপি চুপি, কবিতার মাঝে তিনি প্রেমের ঝুমুর নাচ নেচেছেন, নটরাজ শিবের মতোন মগ্ননৃত্য করেছেন আবার কখনো রাত্রিকালীন আসরে সন্ন্যাসীবেশে নিজের মস্তিষ্ককে মহাত্মা প্রেমে ভাসিয়েছেন। যেমন-
“প্রিয়াংকা বড়–য়া তোর/ঠোঁটের মিহিন আলো/আমাকে দে না একটু/
ইলেকট্রিসিটি নেই/বছর কয়েক হল/আমার আঙুলে হাতে/
তোর ওই হাসি থেকে/একটু কি নিভা দিবি/আমার শুকনো ঠোঁটে”
(কবিতা- প্রিয়াংকা বড়ুয়া)
অথবা বৃন্দাবনের বংশীধারীর মতোন প্রেমের আকুতি জানিয়ে লিখেছেন-
“মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যতœ করে রেখো/
মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, “চলুন পালাই”/
ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই/
নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন/
ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ/
সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট/
তুমি ঝড় তুলেছিলে, বিদ্যুৎ খেলিয়েছিলে, জাহাজ ভাসিয়েছিলে/
তার সব চিহ্ণ পাবে কাটা মাথাটায়, চুলে শ্যাম্পু করে পাঠিয়েছি”
(কবিতা- মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যতœ করে রেখো)
কবিতা হলো একজন কবির আত্মার বিশুদ্ধ সংস্করণ। কবি মলয় রায়চৌধুরী “মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যতœ করে রেখো” কবিতায় নিজস্ব আঙ্গিকে প্রেমিকার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। দিবানিশি কবিতার প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন কবি। আত্মাকে মৈথুন করে কল্পনাপ্রসূত শব্দকে কাগজে-কলমে প্রকাশ করার শৈল্পিক চিত্র তুলে ধরেন একজন কবি। মনের পবিত্র উচ্চারণ এবং কলমের কালিতে শিল্পীর রঙের মতো কবিতায় নিজস্ব ভাবনা, চেতনা জাগ্রতবোধ, সমসাময়িক চিন্তাধারা, রাজনৈতিক অবস্থা, দেশপ্রেম, প্রকৃতি, যৌবনের তীব্র আকাক্সক্ষা, জীবনের ধারনা, সমাজ সংস্কারের প্রয়োজনবোধ, জীবন চেতনাবোধ এবং সংসারের প্রত্যাহিক চিত্র তুলে ধরেন। কবিতা সকল ভাবনার একত্রিত কেন্দ্রবিন্দু, কবিতা নাওয়া খাওয়া কবিতা জ্ঞান কবিতা ধ্যান, কবিতা-ই একমাত্র প্রার্থনা।
প্রজাপতি প্রজন্মের নারী তুই চিত্রাঙ্গদা দেব কবিতায় কবি মলয় রায়চৌধুরী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে প্রশ্ন করেছেন-
“রবীন্দ্রনাথ, এটা কিন্তু ভালো হচ্ছে না।/
চিত্রাঙ্গদা বলছিল আপনি প্রতিদিন/
ওকে রুকে নিচ্ছেন, আপনাকে সাবান/
মাখাবার জন্য, বুড়ো হয়েছেন বলে/
আপনি নাকি একা বাথরুমে যেতে/
ভয় পান, আর হাতও পৌঁছোয় না/
দেহের সর্বত্র, চুলে শ্যাম্পু-ট্যাম্পু করা-/
পোশাক খুললে, আসঙ্গ-উন্মুখ নীল/
প্রজাপতি ওড়ে ওরই শরীর থেকে/
আর তারা আপনার লেখা গান গায় !”
(কবিতা- প্রজাপতি প্রজন্মের নারী তুই চিত্রাঙ্গদা দেব)
কবিতাকে ভালোবেসে মলয় রায়চৌধুরী তাঁর যৌবন কবিতার জন্য উৎসর্গ করে দিয়েছেন। কবিতা একজন কবির কাছে সত্য ও সুন্দরের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচন করে, কবিতার কল্পনায় কবি নিজস্ব সম্রাজ্য প্রতিষ্টা করেছেন।
কবিতার মাঝে মানবতার জয়গান তুলে আনেন কবি। তিনি চরম দুর্ভিক্ষের মধ্যে দাঁড়িয়ে, চরম প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সন্মুখে দাঁড়িয়ে তিনি উচ্চকণ্ঠে সত্য প্রতিষ্ঠা করেছেন। একজন কবি হলেন সমাজের আলোকবর্তিকা, তিনি সমাজকে পথ প্রদর্শন করেন, মলয় রায়চৌধুরী আন্দোলন সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে সমাজকে পথ দেখিয়েছেন। কবিতার রহস্যময় ছন্দে তিনি যুগসন্ধিক্ষণের নৈতিক ভাবনাকে মানুষের সম্মুখে তুলে ধরেন। নৈতিক অবক্ষয় থেকে সমাজকে পুনরুদ্ধারের জন্য কবিতায় সুসজ্জিত অলংকার প্রতিষ্ঠা করে প্রথম যুবরাজের মতো সম্মুখে এগিয়ে এসেছেন। কবি লেখার মাঝে রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন-
“আজ দেখি অ্যালুমিনিয়াম বাক্সে গোছ করা আমারই মড়া/
অর্ধেক পাঁজর পুড়ে গেছে রাবার জ্বালানো আঁচে/
আমাকে ক্ষমা করো/
মানুষের মগজ নষ্ট হোক আমার/
আমার নখ-দাঁত নষ্ট হয়ে যাক/
হাতির আঁদুয়া দিয়ে বেঁধে রাখো আমায়/
দেখতে চাই রক্তের ভেতর হাঙর আফানি দেয় কি না/
লাথি লেগে ভাতের থালার ওপর জলের গ্লাস উলটে পড়ুক/
আমাকে ক্ষমা করো”
(কবিতা- রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা)
তাঁর কবিতায় মনের নিজস্ব ভাব, মন মন্দিরে আশ্রিত শব্দকে শিল্পের পরমাত্মিক পর্যায়ে রূপায়ণ করেছেন। কবিতার ললাটে শব্দের কোম্পানি খুলেন তিনি, শব্দেরা পৈতৃক পরিচয় ভুলে কবিতায় আসন নেয় নবপুত্রের সাজে। হারিয়ে ফেলা কোন কিছুকে স্বতঃসিদ্ধভাবে নিজস্ব প্রেমে বশীভূতকরণের বহিঃপ্রকাশ হলো কবিতা এবং তিনি কবিতায় তা-ই করে দেখিয়েছেন।
কবিতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। এটি সাধনার জিনিস, কবিতাকে সাধনার জায়গায় রাখতে হয়। আত্মকেন্দ্রিকতা কবিতার ব্রহ্মত্ব নষ্ট করে। কবিতার মঙ্গলচরণে একজন কবি ঘোর অমাবস্যার মধ্যেও শব্দের অমুদ্রিত কল্পনায় পূর্ণিমার অপরূপ এবং মনমুগ্ধকর রূপশ্রী কল্পনাচিত্তের অনিবার্য স্পষ্টতায় প্রতিফলন ঘটান তাঁর লেখাতে। কবিতা মলয় রায়চৌধুরীকে কল্পনার সাগরে ভাসিয়েছে। তাঁর কবিতায় সুস্পষ্ট মিলনের উপস্থাপনা আছে। কবিতার প্রতিটা শব্দ কবির কাছে মনিমুক্তার মতোন। শব্দকে দারুণভাবে উপভোগ করে আলিঙ্গন করেছেন, আবার শব্দে মাধ্যমে তিনি পাঠকের হৃদয় ছুঁয়েছেন অত্যন্ত সোপাদ্যপূর্ণভাবে ও কোমলতায়। তাই তিনি ছোট ছোট শব্দে কবিতায় বলেছেন-
“বিদ্যুতের তার ঝড়ে ছিঁড়ে ঝুলে আছে/
এতো কী ভাবছো বাজে সারাদিন ধরে/
যাও ছুঁয়ে দাও গিয়ে মাথা ঠিক রেখে/
মুঠোর ভেতরে নাও তীব্র জ্যোতিরেখা
একটা ঝলকে স্নেহ রক্তে ঢুকে যাবে/
দেখে নাও মাটিতে পা থাকা কত ভুল/
মাটি ও তোমার মাঝে দরকার ছিল”
(কবিতা- উৎপাদন পদ্ধতি)
হাংরি আন্দোলন শুধু কবিতার আন্দোলন ছিলো না। এই আন্দোলনে বাংলা গদ্য কীভাবে বাঁক বদল হবে এবং ছবি আঁকার আন্দোলনও ছিলো। হাংরি আন্দোলনের মূলত কোনো একক নিয়ন্ত্রণ ছিলো না। হাংরি আন্দোলনের সাথে সংযুক্ত যে কেউ যেখান থেকে ইচ্ছা সেখান থেকে বই প্রকাশ করার স্বাধীনতা ছিলো। বিহারের পাটনাতে ২৯ অক্টোবর ১৯৩৯ সালে জন্মেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী।
গত ২৫ অক্টোবর ২০২৩ ইংরেজি তারিখে বুধবার সকালে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার একটি হাসপাতালে এই মহান কবির জীবনাবসান ঘটেছে। তিনি বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ছিলেন।
তাঁর কবিতায় প্রকাশভঙ্গির নিজস্ব রাজত্ব আছে। নিজস্বতা বজায় রেখে কবিতা নিয়ে তিনি নিঃসন্দেহে আন্দোলনে সার্থক ছিলেন। কবিতায় তিনি কখনো বৈরাগ্য বেশে মান্ধাতার আমলের শব্দ প্রয়োগ করেছেন আধুনিক রূপে। অক্ষরে অক্ষরে দেশপ্রেম আর সংগ্রামের কাহিনী লিখেছেন, আবার যুবক প্রেমিকের মতো বৈষ্ণব পদাবলীর মাধুর্যতা এনেছেন কবিতায়। তাঁর শব্দের ক্ষুরধারা মানুষের মনে আন্দোলনের মহামন্ত্র জাগিয়েছে সবসময় নির্দ্বিধায়, নিঃসংশয়তা ও দ্বিধাহীনভাবে । মলয় রায় চৌধুরী বাংলা সাহিত্যের একজন সফলতম কবি।
তথ্যসুত্র
১. সোনালী মিত্র নিয়েছেন মলয় রায় চৌধুরীর সাক্ষাৎকার। লিংক-
৩. হাংরি জেনারেশন’র কবি মলয় রায়চৌধুরী মারা গেছেন, দৈনিক ইত্তেফাক, ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ইংরেজি ।
৪. হাংরি কিংবদন্তি মলয় রায়চৌধুরী আর নেই, দৈনিক ভোরের কাগজ , ২৬ অক্টোবর ২০২৩ ইংরেজি
রুদ্র সুশান্ত
কবি ও প্রাবন্ধিক