এখন সময়:সন্ধ্যা ৭:৫৮- আজ: শনিবার-১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৭:৫৮- আজ: শনিবার
১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-৩০শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

শহীদ সাবের ও তাঁর জসুভাবী : আর্থসামাজিক রাষ্ট্রীয় অমানবিকতার শিকার

শহীদুল ইসলাম :

মূর্খ পাকিস্তানিরা যুদ্ধোত্তর সময়ে অনেক কিছেই ধ্বংস করেছে, ছারখার করে পুড়িয়ে মেরেছে অনেক কিছুই। সেই ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনা বাহিনী শহীদ সাবেরের নির্বিকার কায়াটাকেও পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছে। ইসলাম ধর্মমতে এই মহান মানুষটি শহীদ হয়েছেন। মহান সংগ্রামী লেখক সাংবাদিক শহীদ সাবেরের কালে আমার জন্ম হয়নি। সেকারণে বোধহয় এই মহান শিল্পীর জীবনচলা ও যাপিত জীবন নিয়ে বেশিকিছু বলা বা বেশিকিছু লেখা দুঃসাহসিক ব্যাপারের মতন হতে পারে। শহীদ সাবেরের জিন্দাকালে লিখিত চৌহদ্দিও তফসীল মোতাবেক আমার বর্তমান গ্রামের বাড়ি ও উনার বাড়ি প্রায় পাশাপাশি পর্যায়ে পড়ে। এই হিসাব মতে শহীদ সাবের আমার কাছের প্রতিবেশী আত্মীয়। উনার কালে আমার জন্ম হয়নি। এসময় জন্ম হয়নি বলেই উনাকে নিয়ে দু’কথা বলতে চাইলে বা দুকলম লিখতে গেলে উনার রচনা, লেখালেখি ও শহীদ সাবেরের উপর লেখা বর্ষীয়ান বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও লিখিয়ে জৈষ্ঠ ভাইবোনদের দ্বারা লিখিত বিভিন্ন রকম সংগ্রহের উপর শহীদ সাবেরকে খুঁজে নিতে হয়। এসবের উপর নির্ভর না করে আমিও শহীদ সাবের সম্বন্ধে কেমনি বলি। এক্ষেত্রে আমি পরনির্ভরশীল হয়ে যাই। বাস্তব অর্থে অন্যের দেখার উপর আমাকে নির্ভর করতে হয়, অন্যের লেখার উপর আমাকে শহীদ সাবেরকে খুঁজে নিতে হয়। এই উপযুক্ত সত্য মেনে নিয়েই  আমাকে শহীদ সাবেরকে নিয়েই লিখতে হলো।

 

শহীদ সাবেরকে বুঝবার চিন্তা মাথায় রেখে উনার রচনাগুলো যেরকম গভীর মনসংযোগ ঘটিয়ে পড়েছি।  অনুরুপভাবে যেকোনো সমঝদার পাঠক তার  নিজস্ব পাঠ্যচিন্তা দ্বারা শহীদ সাবেরকে বেশকম বুঝে নিতে পারেন।

এই মতানুসার হাতে রেখে শহীদ সাবেরকে অল্পবিস্তর কল্পনা করে সাবেরের  চিন্তা চরিত্র ও ভবিষ্যৎ আঁকতে আমার বেশি বেগ পেতে হয়নি। আমি প্রারম্ভিকতায় শহীদ সাবেরের পাঠকদের একটা প্রশ্ন রেখে গেলাম। সেটা হচ্ছে শহীদ সাবেরকে পাকিস্তানি হায়েনারা মেরে ফেলছে নাকি আর কেহ মেরেছে, উনি যদি ট্র্যাজেডির শিকার হয় সে ট্রাজেডি কারা তৈরী করেছিল? যখনই শহীদ সাবেরকে পড়ি তখনি এই প্রশ্ন আমার চিন্তায় ঘুরপাক খায়। এই প্রশ্নটাই আপনাদের জন্য রেখে গেলাম।

সত্যকথা হচ্ছে সহিহভাবে শহীদ সাবেরকে বুঝতে হলে উনার লেখালেখি বুঝতে হবে, শহীদ সাবেরকে বুঝতে হলে উনার পাগলামিটাও বুঝতে হবে, সাবেরকে বুঝতে হলে উনার অসুস্থতাও বুঝতে হবে, সাবেরকে বুঝতে হলে উনার জীবদ্দশায় উনি বেঁচে থাকার সমাজকে বুঝতে হবে, সাবেরকে বুঝতে হলে আবহমান দেশীয় সামন্তবাদকে বুঝতে হবে, সাবেরের সময়ে রাষ্ট্রিয় নির্দয়তা, ও অমানবিক প্রেক্ষাপটকে বুঝতে হবে। শুধু সেকেলের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা বুঝলে হবেনা এইকালের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাও বুঝতে হবে।

শহীদ সাবেরের প্রতিটি রচনা, প্রতিটি সংগৃহীত লেখা একেকটা সমাজ, সামাজিক সামন্তবাদ ও রাষ্ট্রীয় অমানবিক দৃশ্য। উনি ডায়রি লিখেছেন, গল্প, কবিতা, অনুবাদ ও স্বরচিত গল্প লিখেছেন এবং সাংবাদিকতা করেছেন। শহীদ সাবেরের ছোট ছোট উনার জীবনের ডায়েরি থেকে নেয়া স্বরচিত  রচনাগুলো হচ্ছে,  ‘এক টুকরো মেঘ’, ‘বিষকন্যা’  ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ ‘জসু ভাবীর জন্য’ ‘দেয়াল’ ‘যে গল্প কেউ বলেনি’ ‘যৌবন’  ‘চালচুলো’ ‘ছেলেটা’  ‘শেষ সংবাদ’। আমি উনার জসুভাবীর জন্য রচনাটির দিকে বিস্তার দৃষ্টিতে খেয়াল করেছি। আমার মনে হল এই বাস্তব রচনায় উনার সমাজ ও রাষ্ট্রের সামন্তবাদী চরিত্রের বেশকিছু উপাদান আছে।

 

শহীদ সাবেরের ‘জসু ভাবীর জন্য’ লেখায় নাতিদীর্ঘ যে বাস্তব চিত্র তিনি ধারণ করেছেন তা আদৌও কোনো গল্প নয় গল্পেরও অধিক, শুধু বাস্তব নয় বাস্তবতারও অধিক বলা যায়। সাবের তাঁর এই লেখাটিতে তাঁর জীবনের চিত্র সামজিক অসন্তোষ পুরোটাই ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাঁর জীবনীতে পাই, ‘মা শফিকা খাতুনের নিস্পৃহতা অথবা অন্য যেকোনো কারণেই হোক পিতা সালামত উল্লাহ সাহেব আবার বিয়ে করেন। বাবা ও মা’র পারিবারিক জীবনের উত্তাপ তার ভাগ্যে ছিলনা।’ এই কথাটার ভিতর যত প্যাঁচ। তাঁর মা জমিদার কন্যা জনাবা শফিকা খাতুন সাবেরের বাবা সরকারি কর্মচারী সালামত উল্লাহর কাছে কেন যেতে পারেনি সেটাও একটা প্রশ্ন।

 

প্যাঁচটা আরো মহতভাবে খুলতে হলে সাবেরের ‘জসুভাবীর জন্য’ লেখায় মূল চরিত্র জসুভাবীর কাছে যেতে হবে।

‘সরকারি দপ্তরে চাকরি করতেন বাবা। ছুটি হলেই চলে আসতেন সোনাপুকুর গ্রামে মায়ের কাছে। মায়ের নিজস্ব একটা বড় বাড়ি ছিল মামাদের লাগালাগি। তাতেই আমরা থাকতাম।’ ‘মামারা ডাক সাইটে জমিদার। জমকালো বাড়ি দাসদাসী, ক্ষেত খামার, সারি সারি গোলা সবই রূপকথার মতই কারুকার্যময় আনুষ্ঠানিক গাম্ভীর্যপূর্ণ মনে হতো। অবাক বিস্ময়ে সবকিছু তাকিয়ে দেখতাম আমি। কাছারি ঘরে মামা সভাসদ পরিবেষ্টিত হয়ে বিচারে বসতেন। আমি দুয়ারে লুকিয়ে সবকিছু দেখতাম সবকিছু হয়ত বুঝতাম না। দুয়ারে দাঁড়িয়ে আ-ভূমি নত হয়ে প্রণাম করত যে লোকটি তার দিকে চেয়ে আমি চোখ ফিরিয়ে নিতাম। কখনো মামার ক্রদ্ধ হুঙ্কারে সমস্ত ঘরটা কেঁপে উঠত। আমি দরজার আড়ালে থর থর কেঁপে উঠতাম। তারপর দেখতাম একটি লোকের প্রাণান্ত অনুনয়, মামার পায়ের তলায় এসে লুটিয়ে পড়ত সে। মামা তাকে উঠতে বলতেন। বলতেন যা এবার মাফ করে দিলাম। বয়েস আমার তখন আট কি নয়, কিন্তু পথে ঘাটে বেরুলে লোকে আমাকে সালাম করত। বলত, আমাদের জমিদার মিয়ার ভাগ্নে, অমুক মিয়া। আমার লজ্জা হতো না। বরং কেউ যদি আমায় যথেষ্ট সম্মান না দেয় তাহলেই আমার রাগ হত। মিয়ার ভাগ্নে  বলে স্কুলে শিক্ষকও সম্মান করত সহপাঠিরাও সমীহ করে চলত।”

এখানে ধরা পড়ে তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থা, ব্রিটিশ আমলে বেনিয়াদের তৈরি করা জমিদারদের খাছিয়ত-নসিহত, সাধারণ মানুষের উপর তাদের  খায়েসমতে নির্যাতন ও সামন্তবাদী প্রচেষ্টা। তৎকালীন জমিদার পরিবারের ভিতর থেকেই তৈরি হতো মিয়া, খান, সমাজের সর্দার, বাহাদুর। পরবর্তীতে এইরকম জমিদার পরিবার থেকে বের হতো মেম্বার চেয়ারম্যান। শহীদ সাবেরের মামাকে আমি জিন্দাকালে না

 

দেখলেও সাবেরের মামাত ভাইদের বৃহত্তর অবিভক্ত ঈদগাহ ইউনিয়নের চেয়ারম্যানি শাসন করতে দেখেছি। শিশুকালে এই জমিদারের খানদানি অহমিকা ছোট্ট সাবেরকেও পেয়ে বসেছিল তা সত্য কিন্তু বাবা ছালামত উল্লাহ যদি তাঁকে কলকাতায় নিয়ে না আসতেন হয়ত সাবেরও ঐ জমিদারি ধাঁচে, জমিদারি মেজাজে বড় হতেন। শহীদ সাবেরকে কলকাতায় এসে বলতে শুনি,  ”এত দেখিনি জীবনে। জানতামই না এতও আছে পৃথিবীতে।” এরই মধ্যে সাবেরকে দেখি দশবছর কেটে ফেলতে। এরই মাঝে সাবের ঘটনা অনেক ঘটিয়ে ফেলছেন। এখন শিক্ষায় অগ্রসর শহুরে ছেলে, চিন্তার জগতেও অনেক অগ্রসর হয়েছেন। এরই মাঝে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রের সাহিত্য রচনা, আর গোর্কি, হুগো, ভলতেয়ার, টলস্টয় রচনা সাবেরের কাছে অপরিচিত নয়।

শহীদ সাবেরের বয়স তখন বিশ। এরই মধ্যে দু’মাসের জন্য আবার বাড়ি আসেন। কত স্মৃতি বুকে নিয়ে তৃতীয় চোখ দৃশ্য ধারণ করে চলে যান। ঠিক দুবছর পর আবার মামাবাড়ি বেড়াতে আসেন। মামাবাড়ি বলতেই নিজের গ্রামের বাড়ি, গ্রামের বাড়ি বলতেই মিয়ার বাড়ি। তাঁর আগমন দেখে সাবেরের জমিদার মামা বাড়ির গোলাম করম আলিকে সোনাপুকুরে দীঘির জলে সকালে মাছের জাল ফেলতে নির্দেশ দেন এবং মামা জমিদার বাড়ির আরেক গোলাম রহমতকে হরিণ শিকারের আদেশ দিয়ে রাখেন।’

এই আগমনেই শহীদ সাবেরের সাথে পরিচয় হয় জসুভাবীর। জসুভাবী শুধু মামার বড়ছেলে মানে সাবেরের মামাত ভাইয়ের বউ নয়, তাঁর ছোট বেলার খেলার সাথি ও চড়ুই ভাতির বন্ধুও বটে। জসুভাবীকে যুবক সাবের চিনতে পারেন। কত স্মৃতি ছোটবেলায় এই জসুকে নিয়ে। সাবেরের ভাষায়, ‘বৈশাখের খররোদ্দুরে আমি নাকি একদিন চুপিচুপি ঘুম শয্যা ছেড়ে, মার পাশ থেকে উঠে এসে, মস্ত একটা ছিপ হাতে ভেতরের পুকুরে মাছ ধরতে গেলে জসু নামে একটি মেয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল পুকুরজলে। আমি উঠতে না পারলে সে আমাকে বলেছিল ঘাস ধরে উঠে আসতে।

এই জসুই জওসন আরা, শহীদ সাবেরের জসুভাবী। ‘দুইবছর আগে যখম সোনাপুরে আসি তখন মাস দুই ছিলাম। আর এই দুইমাসের প্রত্যেকটি মুহূর্ত প্রায় কেটেছে জসুভাবীর সঙ্গে।’  শহীদ সাবের এক ফোঁটা গালি না দিয়ে এক শব্দ মামাবাড়ির সমালোচনা নাকরেও, কাউকে ভাল খারাপ না বলে সামন্তবাদী জমিদার চিত্র কিভাবে আমাদের সামনে তুলে দিলেন তা অভাবনীয়। সাবের ও তাঁর মামা দুপুরে খানা খেতে বসলেন।

‘এই সময় হঠাৎ উপস্থিত হলো কাজের লোক রহমত। শিকার ফেরত লোকটা মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে রইলেন। “বেতন কাটা গেল তোর এমাসের”।  ‘অবাক হয়ে গেলাম। বনের হরিণ। পাওয়া না পাওয়া মানুষের হাতে কতখানি সেটুকু বিবেচনার শক্তি তাঁর নিশ্চয় ছিল। দূঃখ হলো লোকটির দিকে চেয়ে। মামাও চলে গেলেন। এক গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। হাঁকে ডাকে লোকে লোকারণ্য। দেখি খালপারের জসুদের বাড়িটা জ্বলতেছে আগুনে দাউ দাউ করে। কেউ ছুটোছুটি করছে আগুন নেভানোর জন্য, কিন্তু বেশিরভাগই লোকে দাড়িয়ে আছে। মামার সঙ্গে জসুর বাবার সেকি ঝগড়া। শেষ পর্যন্ত মামা দোনলা বন্দুক বার করলেন।’

 

বিপদে বাঙালি যে এখনো পরিবর্তন হয়নি সেটাই তার প্রমাণ। শহীদ সাবেরের মামার দেওয়া আগুনে জসুর বাবার বাড়ি পোড়ানো আগুন যেমন দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া কেউ নেভায়নি এই যুগেও মোবাইলে ভিডিও ছাড়া তেমন কেউ আসেনা। আরেকটা চিত্র টানতে পারি চাইলে। সেটা হচ্ছে সমাজে জমিদার বাড়ির নারী নির্যাতনের চিত্র। আবহমান কাল ধরে সমাজে নারীদের পিঠে বেতমারা থামেনি। নারীকে আজীবন নারীই মনে করে, নারীকে আজ পর্যন্ত পুরুষ সমতুল্য মনে করতে পারেনি সমাজ। সকল নারী মুখ বুঝে সহ্য করত সে সময় যেমন এখনও তেমনই আছে। ‘গভীর রাতে ঘুম ভাঙলো। শুভ্র চন্দ্রালোকে সমস্ত পৃথিবী অপরূপ হয়ে উঠছে। সেই অপরূপকে খান খান করে ভেসে আসল কোনো এক নারী কন্ঠের চাপা ক্রন্দন ভাবীর? কান্নার শব্দ তার ঘর থেকেই আসছে। কিন্তু কেন? কেন এই ক্রন্দন, ভাবিয়ে তুলল আমাকে সেসব প্রশ্নে।’

শহীদ সাবেরের জানা হলো তাঁর জসুভাবীকে তাঁর মামা বাড়ির কেউনা কেউ নির্যাতনমূলক বেদম প্রহার করতেছে। সাবের ঘুমাতে পারেনি সেইদিন। জসুভাবীর প্রতি সাবেরের ভালোবাসা ছিল শুভ্র নির্ঘাত স্বর্গীয় ও পবিত্র। তার পরের দিন সাহস করে জসুভাবীর ঘরে জসুকে দেখতে যান। জসুভাবী বসতে দিলেন পালঙ্কের একপাশে। স্তম্ভিত হলো জসুভাবীর মুখের দিকে চেয়ে। শ্রাবণ আকাশের সমস্ত ঘনঘটা, বর্ষণ-পূর্ব আকাশের সমস্ত জমাট অন্ধকার যেন একসঙ্গে জমা হয়েছে জসুভাবীর মুখে। সাবের জিজ্ঞেস করলেন কি হলো ভাবী?

‘ভাবীর চোখ দুটো ছলছলিয়ে উঠল হঠাৎ। মুখের সেই ভাব গোপন করার জন্যই হয়ত তিনি হঠাৎ আমার দিকে পিছনে ফিরে ঘুরে বসলেন মাথাটা ঝুঁকিয়ে। পিঠের ব্লাউজটা আলগা করে বললেন, ‘দেখ। ভাবী হঠাৎ আমার গায়ের উপর চোখ রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। পরের দিন এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবী সামনে এলেন, বললেন, ‘যেদিন থেকে এই বাড়িতে বউ হয়ে এসেছি তার পরের দিন থেকে শুরু হয়েছে এ শুধু

 

জিজ্ঞেস করলাম কে ভাবী কে? ভাবীর জবাব আমার পরম পূজ্যপাদ শশুর সাহেব।’ ‘মামা! আমি চমকে উঠলাম।

‘হাজী শরীফ, সুলাতান শরীফ, আমার শশুর।’ গুম হয়ে রইলাম অনেকক্ষণ, কতক্ষণ জানিনা।’

সাবেরের জসুভাবী ছিল অসাধারণ একটা প্রতিভা, অসাধারণ একটা বাঙালি মেয়ে। প্রতিভা হলেইবা কি না হলেইবা কি, সমাজ এইসব প্রতিভাবানদের খুন করতে পিছপা হয় না। জসুভাবী গান করতে পারতেন।  অস্বাভাবিক গায়কী গলার ঢং। এটা সাবেরের কথাতেই পাওয়া যায়। ‘সকালে চা খেতে খেতে ভাবী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘নতুন গল্প টল্প কি লিখলে বলতো। সেইদিন তুমি যে একটা শুনিয়েছিলে ভারী সুন্দর লেগেছিল সেটা। আচ্ছা এত গল্প লেখ; আমাকে নিয়েই নাহয় একটা লিখে ফেল না।’

কি লিখব আপনাকে নিয়ে? ‘

আসলেই শহীদ সাবের কি গল্প লিখবে জসুভাবীকে নিয়ে। অসম্ভব সত্য হলেও বাস্তব চিত্র নিয়ে ইতিহাস হয় গল্প বানানো কঠিন কাজ। সেটা সাবের ছাড়া কে’বা বুঝে।

জসুভাবী শুধু মিয়া-র বাড়িতে জসুভাবী নয়, লক্ষ লক্ষ জসুভাবী নানা জমিদার বাড়িতে সুন্দর প্রতিভা নিয়েও খুন হয়েছে, নির্যাতীত হয়েছে এই বাংলায়। তার কিছু প্রমাণিত আর কিছু অপ্রমাণিত।

তখনো যেমন সমাজ নারীদের দেনাপাওনা বুঝিয়ে দেয়নি এখনো দেয়না। নারীরাও রক্ত মাংসের মানুষ ছিলেন। তারাও আদর ভালবাসা চাইতেন, তাদেরও সংস্কৃতি আছে। কিন্তু এই সমাজ মেনে নিতে চায়নি কখনো। জসুভাবীর ছিল অসম্ভব সুন্দর গায়কী কন্ঠ।  শহীদ সাবের বায়না ধরলেন ভাবীকে গান করার।

‘তারপর ভাবী নিচু গলায় গান ধরলেন। গানে আজ মন নেই। মনে নেই কি ছিল গানটা। তবুও কানে বাজছে তার গানের কয়েকটি কথা, ‘আমার সকল দূঃখের প্রদীপ তুমি নিভিয়ে দিবে কবে.।’ ভাবীও দেবরের এমন গান ধরার দৃশ্য ধরা পড়ে সাবেরের মামির। এটাই পরবর্তীতে জসুভাবীর কাল হয়। সে কথা মামাতবোন জুলেখাকে চিঠি দিয়ে গোপনে সাবেরকে জানিয়ে দিয়েছে। মামাত বোন জুলেখার সেই চিঠি পড়ে দেখি তখন, কিন্তু চিঠিটি পেয়ে শহীদ সাবের রাগে দূঃখে ক্ষোভে অপমানে কাঁপতে থাকে। ‘আমাদের এমন অনাবিল পবিত্র সম্পর্কে এমন কলঙ্কের কালি লেপে দিল এরা’।

পরের দিন পুকুর পাড়ে দাঁতে মাজন দিতে দিতে ঘাটে গেলে শহীদ সাবের বুঝতে পারে তাঁকে জসুভাবী থেকে গান শুনার গুরুদ-। সাবের বুঝতে পারলেন জসুভাবী আর নেই। গলায় কলসী বেঁধে কে বা কারা জসুভাবীক সোনাপুকুরে আঁধার কালো জলে ডুবিয়ে দেয়। যে পুকুরে ছোট্ট জসু ধাক্কা মেরে সাবেরকে বলেছিল পারের ঘাস ধরে উঠে এস সেই পুকুরের পানিই গ্রাস করেছে তাকে।

শহীদ সাবের জসুভাবীকে সমাহিত করে একদিনও থাকেন নি আর। আসার জন্য জাহাজ ধরে। জাহাজে উঠেই

হাতে সিগারেট ধরে।  জসুভাবীর দেওয়া চিঠিটা  কোটের পকেট থেকে টেনে পড়তে থাকেন। চিঠিতে লেখা ছিল, ‘ভাই,  কাল গান গাওয়াই হয়েছে আমার কাল। তোমাকে দেখা দিতে পারব না। মা নিষেধ করেছে। আমার দূঃখের কথা বলে শেষ করা যাবেনা। তোমাকে আমি বলেছিলাম আমাকে নিয়ে একটি গল্প লিখতে। তাই বলছি, শোন, আমার বাবা ছিলেন এই গ্রামেরই জমিদার। তোমার মামার সঙ্গে বংশানুক্রমিক রোষ। সেই রোষের শিকার এই নিরীহ আমি। বাবা বেঁচে থাকতে তোমার বাবা লোক দিয়ে মানুষের ঘর পোড়ানো ছাড়া কিছু করে যায় নি। প্রতিশোধ নিতে আমাকে বাড়ির বউ করে নিয়ে আসে। বাবাও বেঁচে নেই। তাতে সমস্যা আরো কঠিন হয়ে গেছে।

শুনেছি এরা ছেলেকে আবার বিয়ে করাবে। কন্যাও ঠিক, শুধু সতীনের উপর মেয়ে দিতে চাচ্ছে না। জানিনা, এদের মনে কি আছে। আমার ক্ষুদ্র জীবনটার উপর পরপর হামলা হলো। এদের প্রতিহিংসার আগুন কত জ্বলতে পারে তুমি ধারণাই করতে পারো না। বড্ড ভয় করছে, যন্ত্রণায় আছি। আমি ত মরতে কভু চাইনা। আমার সবকিছু ত জানলে তুমি বিদ্বান লোক।’

এইভাবেই শেষ হয় জসুভাবীর জীবন। যে দূঃখে জসুভাবী খুন হয়, সে দূঃখে মানসিকভাবে শহীদ সাবেরও নিঃস্ব হয়। শহীদ সাবেরকে জীবনে সুখ দেয়নি সামন্তবাদ, জমিদারি অহম। জমিদারি অহমিকার কারণে জমিদার কন্যা সাবেরের মা সাবেরের বাবা ছালামত উল্লাহ থেকে পৃথক করেছে। পিতা সালামত উল্লাহর সবকিছু গ্রহণ করতে পারেনি।

আদর ভালোবাসা পায়নি। কি মা, কি বাবা, কি সৎমা, সৎ ভাই, বোন, কেউ সাবেরকে ভালোবাসা দিয়ে এক বুক আঁজলা করে নিতে পারেনি। অহরহ প্রেম আসত, প্রেমের চিঠি আসত, সাবের গ্রহণ করতে পারেনি। স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে সরদার ফজলুল করিম লিখেন, একবার ময়মনসিংহ এক ফুফির বাসায় যান সাবের। দরোজা বন্ধ করে সব চিঠিগুলো পুড়িয়ে ফেলেন। তারপর কিছুই না বলে ফুফির বাসা থেকে চলে আসেন।’ এটা সাবেরের ফুফার কাছ থেকে সরদার ফজলুল নিয়েছিলেন।

পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় অনাচার শহীদ সাবেরকে হ্যাামলেটের মতন মানসিকভাবে হত্যা করে। হয়ত সেন্স ছিল শুকনা কায়া ছিল। জসুভাবীকে যেমন তিল তিল করে কষ্ট দিয়ে সামাজিক অনাচার, সামন্তবাদী চিন্তা চেতন জমিদারি অহম খুন করে ফেলে, দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়। অপরদিকে সাবেরও পারিবারিক ও সামাজিকভাবে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে রাষ্ট্রের রোষানলে পড়ে। কারাগারে যেতে হয়। চারটা বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে হীন দিনাতিপাত করে। নিঃস্ব সমাজে সমাজ যেমনি ছিল তেমনি আছে। জমিদার সামন্ত মানসিকতা রূপান্তরিত হয়ে নব্য ধনিক ও বনিক শ্রেনীর আভির্ভাব ঘটেছে। সাবের হতে চেয়েছিল তা হতে পারেনি, যা করতে চেয়েছিল তা করতে পারেনি। অবশেষে ৩১শে মার্চ ১৯৭১ সাল কালরাত্রিতে সংবাদ অফিস ঘুমন্ত অবস্থায় শহীদ সাবেরকে শেষ বারের মতন পাকিস্তানি হায়েনাদের দেওয়া আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হতে হয়।

যুগ যুগ প্রতিভা এভাবে নিঃশেষ হয়। এই হওয়াতে সমাজ খুশি। শতদল ফুটতে না দিলে সমাজ পদ্ধতি আগের মতই পোষাকের ভুমিকায় থাকতে পারে। জসুভাবী যেমন গায়কী কন্ঠ থাকার পর গান গাইতে পারেনি, অন্দরমহলে গান গাইতে গিয়ে খুন হতে হলো, ঠিক সামন্তবাদী আতœঅহমিকা চেতনা শতদলবাসিনীদের অবরোধবাসিনী করে রাখতে চায়। জসুভাবীরা কালে কালে এখনো আছে, শহীদ সাবেরও ঘুরে ফিরে আবার আসবে। আবার খুন হবে আবার আগুনে পুড়িয়ে অঙ্গার করে ছেড়ে দিবে। বিশেষ দ্রষ্টব্য হিসেবে নিরীহ পাঠককুলকে শেষে দুটো সত্যি কথা বলে ছেড়ে দিই। শহীদ সাবেরের উল্লেখিত জসুভাবী সম্বন্ধে পাশের বাড়ির মোহাম্মদ ইউসুফ নবী, বয়স (৮৬) যিনি আমার পরিবারের অন্তঃপ্রাণও আমার মরহুমা মায়ের দুঃসময়ের আপন, চতুর্থদিকে দশ পাড়ার বিপদের বন্ধু, চলন্ত অভিধান, কবিও সমালোচক মনির ইউসুফের পিতা, উনার বর্ণনা মোতাবেক যা পাই, তা হলো, জসুভাবীকে উনার শশুর মানে শহীদ সাবেরের মামা মিয়াও চেয়ারম্যান সাব নিজের পাশিবন্দুক নিয়ে রুটি পিঠা বানার সময় পাকঘরেই মেরে ফেলেছে। জনাব ইউসুফ মনির মতে, ঐ সময়কালে জমিদার, মিয়া, সিকদার, মাতবর, চেয়ারম্যান সবাই একে অপরের বিরুদ্ধে অহমিকার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতো। এসব পরিবারে জমিদারী ছিল বলেই জমিদারী পতনে কেউ বাঁধা হলেই খতম করে দিতো। প্রতি রাতেই এক জমিদারের পাইক পিয়াদা আরেক জমিদারের ঘর পোড়াতো। এসব রেষারেষিতে সাধারণ নিরীহ বা প্রজারাও যে আক্রোশের স্বীকার হওয়া ছিল মামুলি ব্যাপার। জসুভাবীও যে জমিদারের কন্যা উনাকেও এই রেষারেষির স্বীকার হতে হয়েছিল।

 

শহীদুল ইসলাম, প্রাবন্ধিক ও গবেষক

 

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে