শহীদ ইসলাম
১.অজগ্র প্রেমে প্রেমিক প্রেমিকার ভান্ডার গড়ে তুলেছেন কিন্ত চিরকুমার ছিলেন। একটার পর একটা রাজ্য জয় করেছিলেন, একটার পর একটা অসুরের পরাজিত করেছিলেন কিন্তু কোনো ক্ষমতা নেন নি, দুনিয়ার কোনো গদিই যাকে ধারণ করতে পারে নি, তিনি-ই হযরত শাহজালাল।
পরিচিত নাম হযরত শাহজালাল (রহ.)। পুরো নাম শায়ক শাহজালাল কুনিয়াত মুজাররদ। খাদিমগণ ও অনুসারীদের প্রাপ্ত পারসী ভাষায় ফলকলিপি অনুযায়ী ১৩০৩ ইংরেজি সনে তিনি অধুনা বাংলাদেশের বর্তমান সিলেট অঞ্চলে এসেছিলেন। তখন উনার বয়স সবেমাত্র ৩২ বছর। ইতিহাস মোতাবেক সিলেটে ইসলাম ধর্মের প্রচার -পসার ব্যাপক আকারে তৈরি হয় হযরত শাহজালাল (রহ.) এর আগমনের পর।
অনেক বির্তক আছে, সিলেটে হযরত শাহজালাল আগে নাকি ইসলাম আগে এই নিয়ে নিছক বিতর্ক থাকলেও সবচেয়ে মজার কথা হচ্ছে শাহজালালের আগেই ইসলাম ছিল তা অবশ্যই ঠিক আর নাহলে বোরহান উদ্দিন আসল কেমন করে? এখন কথা হচ্ছে, হযরত শাহজালাল কেনইবা এই রাজা গৌরগোবিন্দের এলাকা সিলেটে এসেছিলেন? উনি কি রাজ্য বিজয়, শাসনের নেশা নাকি ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্য এসেছিলেন? উপমহাদেশের সকল ইতিহাসবেত্তাগণ দুটো ভাগে ভাগ হয়ে একভাগে বলেন যে শাহজালাল ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে সিলেটে আগমন করেছিলেন, আরেকভাগ দাবি করেন রাজনৈতিক প্রচারের খাতিরে এসেছিলেন। তর্কের খাতিরে আপাতত আমি মনে করি শাহজালাল (রহ.) দুই কারণেই সিলেটে এসেছিলেন। ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ মনীষীরা যতনা কাজ তারচেয়ে প্রচারে বড়। এটা উপমহাদেশ বলে কথা নয় পুরো দুনিয়ায় একই চিত্র। শাহজালাল (রহ.) কে ঘিরে নানান রকমের কথা, গালগল্প, উপকথা, কাহিনি ইত্যাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। অনেক বইয়ে দেখলাম শাহজালাল (রহ.) কে ইয়ামেনী দাবি করে অনেকেই তুরস্কের দাবি করেন। অনেকেই লিখেছেন শাহজালাল (রহ.) স্বপ্ন দেখেছেন সিলেটে রাজা গৌরগোবিন্দ কর্তৃক মুসলিম নির্যাতন। এই কথা শাহজালাল রঃ বলেছিলেন নাকি আর কেউ বলেছিলো এসব নির্ভেজাল তথ্য আমরা কোথাও পাই না। শাহজালাল (রহ.) এসেছিলেন মূলত ভারতবর্ষে। প্রখর মেধা, সততা, সাহসিকতাও বিনয়ের ভারে ভারত এসেই অল্প ক’টা দিনের মধ্যে ২৪০ জন সাথী পেয়েছিলেন। বর্তমান সিলেটে আসার সময় অনেকেই ৩৬০ জন সাথী বা অনুসারীর কথা প্রচার করলেও ৩৬০ কারা কারা এবং এদের কবর কোথায় কোথায় এসবের কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই। হতেই পারে আবার নাও হতে পারে। তারপরও আমরা ৩৬০ জন ধরে নিয়ে সিলেট তথা বাংলাদেশকে ৩৬০ আওলিয়ার পবিত্র ভূমি বলি।
যাহোক এসব কথা। শাহজালাল (রহ.) এসেই সিলেটে এসে সাথে সাথে রাজা গৌরগোবিন্দের সাথে যুদ্ধ শুরু করেন নি। আগে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলেন, সঙ্গী সাথী বাড়ালেন। রাজার অত্যচারও নির্যাতনের চিত্র অবগত হলেন। গৌরগোবিন্দ রাজার সময় জৈন্তিয়া নামক রাজ্যও শাসন হতো জৈন্তারানী দ্বারা।
জৈন্তিয়া বাংলাদেশের একটি প্রাচীন স্বাধীন ও সমৃদ্ধশালী নারী রাজ্য হিসেবে পরিচিত। একে বিশ্বের সর্ব প্রথম নারী রাজ্য বলে ধারণা করা হয়। [১] অচ্যুতচরণ চৌধুরী জৈন্তিয়া রাজ্যকে মহাভারত সময় কালের বলে বর্ণনা দিয়েছেন। মহাভারত সময় কালে জয়ন্তীয়া রাজ্যের অধীশ্বরী ছিলেন প্রমীলা। মহাভারত ও অন্যান্য শাস্ত্র গ্রন্থের বরাতে বলা হয়; কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ বিবরণীতে মহাবীর অর্জুনের স্ত্রী রাজ্য গমনের যে বর্ণনা পাওয়া যায় তাহা এই জয়ন্তীয়া রাজ্য। মহাবীর অর্জুন যুধিষ্ঠির “অশ্ব মেধযজ্ঞে” জয়ন্তীয়া রাজ্যে এসেছিলেন। বীর নারী প্রমীলা কর্তৃক অশ্বমেধ বেঁধে রাখার কারণ অর্জুনের সাথে রাণীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। গৌরগোবিন্দের রাজার মা ছিলেন অন্নপূর্ণা জৈন্তিয়া। আর তৎকালীন জৈন্তার রাণি ছিলেন গৌরগোবিন্দের খালা। জৈন্তাপুরে গেলে অনেকেই জৈন্তারাণীর আশ্রম, মন্দির, কূপ ও বিভিন্ন রকম ঐতিহাসিক চিহ্ন দেখবেন। জৈন্তারাণী এবং গৌরগোবিন্দ মিলে প্রজাদের বর্ণনাতীত নির্যাতন করতেন। জৈন্তিয়া রাজ্যে নারীগণ এত স্বাধীন ছিল যে, নারী চাইলে যেকোনো পুরুষে যে ক’টা পুরুষের সাথে মেলামেশা করতে পারতো কিন্তু পুরুষ চাইলে যেকোনো নারীকে পারতো না।
মনে রাখা দরকার তখন সনাতন ধর্ম থাকলেও দেব দেবী পুজো হতো না। রাজা গৌরগোবিন্দ ও জৈন্তিয়া রাণীরা প্রকৃতি উপাসনা করতেন। রাজা গৌরগোবিন্দ পশু পুজো মানে গো/ গরু পুজো করতেন। রাণী জৈন্তিয়া করতেন নরবলি পুজো। ইতিহাসে আছে নরবলি পূজোর জন্য মৌসুমের আগে মুসলিমদের ধরে নিয়ে আসতেন। বলি দেওয়ার উদ্দেশ্যে যারা মানুষ খোঁজ করত তাদের বলা হতো খোঁজকর। বিশেষ করে মুসলিম নরদের ধরে এনে কুয়োর পাশে খড়ম দিয়ে ঢাকঢোল বাজিয়ে উৎসব করে নরবলি দিয়ে পুজো সারতেন। কুয়োর মধ্যে লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলে দিতেন। বোরহান উদ্দিন (রহ.) যিনি একমাত্র পুত্র গুলজারে আলেম এর ‘জন্মশোকরিয়া’ গরু জবাই করলে খবর যায় গৌরগোবিন্দের রাজার কাছে। গৌরগোবিন্দ হযরত বোরহান উদ্দিনের পরিবার ধরে নিয়ে আসেন। হযরত বোরহান উদ্দিনের হাত কেটে নেয় এবং শিশু গুলজারে আলেমকে হত্যা করে। গৌরগোবিন্দকে ইতিহাসে অত্যাচারী শাসক বা রাজা হিসেবে আখ্যা দিলেও তারও অনেক ঐতিহাসিক ঐতিহ্য এখনো আছে। শাহজালাল (রহ.) রাজা গৌরগোবিন্দকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য রাজার বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেন। রাজার আস্তানায় রাজাকে গলাটিপে ধরেছেন কিন্তু মেরে ফেলেন নি।
২. গৌরগোবিন্দ রাজার আস্তানা ছিল বর্তমান টিলাগড়ের টি এন্ড টি অফিস। সিলেটে এখনো ছোটবড় শত শত টিলা বিদ্যমান। যাহোক গৌরগোবিন্দ রাজা পাশের মণিপুরী রাজ্যে পালিয়ে গেলেন আর ফিরে এলো না। পরবর্তী হজরত সুফি শাহজালাল (রহ.) অফুরন্ত ভালোবাসায় দলে দলে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হতে লাগলেন। এর কয়েকবছর পর জৈন্তিয়া রাণীও ক্ষমতাচ্যুত হন। শাহজালাল (রহ.) এর জীবদ্দশায় একে একে অনেকগুলো রাজ্য মুসলিম শাসনে চলে আসে। অত্যন্ত সুখের বিষয় ও বিস্ময়কর কথা হচ্ছে, একটা রাজ্যের শাসনভারও সুফি শাহজালাল (রহ.) গ্রহণ করলেন না। ক্ষমতার সামান্যতম লোভও খায়েশ হজরত শাহজালাল (রহ.) কে স্পর্শ করেন নি। আসলে করেন নি কেন? হ্যাঁ, শাহজালাল (রহ.) আরো একটা রাজনীতি পেয়ে গেছেন। সেটা কি? সেটা নৈতিকতা, বা ইপোটিসিজম, শূন্যতাবাদ, সুফিবাদ, সৃষ্টিকর্তার সততাবাদ, বা নৈতিকতাবাদ। সৃষ্টির আরাধনা, সততা ও নৈতিকতার স্পর্শ যে কত বড় রাজনীতি একমাত্র সুফিবাদী মহামানবরাই জানে। শাহজালাল (রহ.) গৌরগোবিন্দ রাজার কাছ থেকে ক্ষমতা থেকে তাড়িয়েও নিজে দুনিয়াবি ক্ষমতা নেন নি। তৎকালীন সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ নিয়োজিত উজির সিকান্দার খান গাজীকে ক্ষমতা গ্রহনের আমন্ত্রণ জানান। এতবড় সহসা পদ পেয়েও বিলিয়ে দেন। দুনিয়াবী ক্ষমতা সবার জন্য নই, একথাই শাহজালাল (রহ.) বুঝিয়েছেন। দুনিয়ার রাজনীতি সাময়িক সৃষ্টিকর্তার বাদশাহী আজীবন বয়ে যাবে। একথা একমাত্র সুফিরাই জানে। অনেকেই মনে করেন সুফিরা যুদ্ধ জানে না, সুফিরা বিপ্লব জানে না, সুফিরা মন্দকে ভয় বা ধমক দিতে জানে না। শাহজালাল (রহ.) দেখিয়ে দিয়েছেন সুফীরা ক্ষমতায় অসৎ ও অত্যাচারী স্বৈরশাসকের ঘাড় মটকাতে জানে, ক্ষমতার পালা বদল ঘটাতেও জানে। আবার দুনিয়ায় সামান্য পদলোভে লোভাতুর নাহয়ে বিলিয়েও দিতে জানেন। হজরত সুফি শাহজালাল (রহ.) কে সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ দূত মারফত ক্ষমতা গ্রহণের বিরাট প্রস্তাব পাঠায়। কিন্তু শাহজালাল (রহ.) সবিনয়ে গ্রহণ করেন নি। উনি জানতেন দুনিয়ার পদবির রাজনীতিতে আল্লাহ বাদশাহী বরবাদ হয়ে যেতে পারে।
সুফিরা দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা অনেক বড়মানুষের কাজ হলেও ক্ষমতা গ্রহণ করা অনেক বড়মাপের কাজ নয়। যুগ যুগ ধরে শত শত বছর ধরে শাহজালাল (রহ.) কে দুনিয়ার মানুষ যত চেনে এই সুফিবাদী রাজনীতির কারণেই। এই খোদায়ী বাদশাহী রাজনৈতিক কারণেই। এটাই সুফিবাদের মহান রাজনীতি, তোষামোদ বা পেটনীতি নয়। কোনো ধরনের মিছিল মিটিং সভা সমিতি সমাবেশের আয়োজন না করেই, কোনো পোস্টারিং কোনো ব্যানারিং করেন নি। এসব না করেও শত-শত বছর ধরে শাহজালাল (রহ.) এর রাজনীতি বুকে বয়ে বেড়াচ্ছে বাংলার কোটি কোটি মানুষ। এতবড় রাজনীতিবিদ ছিলেন, এতবড় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন যে পদ পদবির জন্য দুকথা বলেন নি তারপরও টিলার ওপর মাটিতে শুয়ে রাজনীতি চালিয়ে যাচ্ছে আর অনুসারীরা সেখান থেকে আস্বাদন গ্রহণ করেই যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ঢাকাতে নেমে এক ব্রিটিশ এমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবক উক্তি করেছিলেন, “আমি বাংলাদেশ দেখছিনা সর্বত্র শাহজালালকে দেখেছি, ডযড় রং ঃযব ঝযধযধলধষধষ, ও উড়হ’ঃ শহড়ি নঁঃ বাবৎুযিবৎব রং ঝযধযধলধষধষ”
শাহজালাল (রহ.) ছিলেন বিরাট মাপের প্রেমিক। এতবড় প্রেমিক হওয়ার কারণে আর বিয়ে করা হয়নি, চিরকুমার ছিলেন। হজরত শাহজালাল (রহ.) কেন বিয়ে করেন নি, কেন কোনো নারীর প্রেমে মজেন নি, কেন কোনো সম্পর্ক হয়ে উঠেনি? বর্তমান বিখ্যাত মালিনীছড়া চা বাগান, সিলেট বিমানবন্দর রোডের পাশে, যেখানে গরীব চার মেয়ে নিয়ে বসবাস করত এক গরীব কাঠুরে পরিবার। একদিন শাহজালাল (রহ.) এর টিলার উপরে দরবারে এসে বললেন, “আমার চার মেয়ে একটাও বিয়ে হয় নি, মেয়েগুলো রঙে কালো এবং বাবা কাঠুরে বলে” শাহজালাল (রহ.) উপস্থিত সবাইকে ডেকে ঘোষণা দিলেন কাল সকাল থেকে আমরা (অনুসারীসহ) টিলার ওপরে কাঠ কাটতে যাবেন। সকাল থেকে অনুসারী দল-বল বিয়ে টিলার উপর কাঠ কাটলেন, খাওয়া দাওয়া সব করলেন। বিকেলে ঘোষণা দিলেন, “আজ আমরা সবাই কাঠুরে এতে কোনো সন্দেহ আছে কিনা?” সবাই সমস্বরে জবাব দিলেন নাই। শাহজালাল (রহ.) বললেন, “তাহলে কাঠুরে কেন নিচুজাতের হবে, আমরাও তো কাঠুরে, এখন চাইলে আমাদের মাঝে কেউ এই কাঠুরিয়ার কন্যাকে শাদি করা যাবে” একে একে চারজন বিয়ে করতে রাজি হয়ে গেলে কাঠুরিয়ার চার মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলো। ঐ জায়গাটার নাম বর্তমানে ‘লাক্কাতুরা’ মানে লাখড়িতুলা থেকেই আসছে। প্রতিবছর ঐ দিনকে স্মরণ করে দুইদিন ব্যাপী সিলেটে ‘লাকড়িুলা’ উৎসব এখনো পালন করা হয়।
শাহজালাল (রহ.) ছিলেন এমন প্রেমিক এবং প্রেমে এত মজেছিলেন যে একাদা কোনো নারীর প্রেমে মজতে পারেনি। দুনিয়াবী ক্ষুদ্র ক্ষমতা যেমন বড় ক্ষমতাকে গিলিয়ে ফেলে তেমনি ক্ষুদ্র প্রেম বৃহৎ প্রেমকে বিনাশ করেই ছাড়ে। একথা শাহজালাল (রহ.) ভালো করেই বুঝেছিলেন। উনার ৭৪ বছর জীবন পার হলেও নারীকে নারী হিসেবে দেখেন নি। পুরুষদের পুরুষ হিসেবে দেখেন নি। দেখেছেন সবাই সমান মানুষ। সব মানুষই উনার প্রেমিক বা প্রিয়তমা। উনি এমন এক প্রেমে মশগুল ছিলেন যেটা বাকি সব প্রেমও প্রেমিককে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন। অনেক অনুসারী শাহজালালকে বিয়ের কথা বললেও শাহজালাল (রহ.) প্রতিউত্তরে বলতেন, ‘নারী কই নর কই সবি তো মানুষ দেখি” আসলে উনার চোখে নর নারীর কোনো পার্থক্য খুঁজে পেতেন না। বড় রাজনীতির প্রজ্ঞাবান মহা মনীষীরা মানুষকে মানুষের পাল্লায় মাপে অমানুষকে অমানুষের পাল্লায় মাপে, কোনো নর-নারীর পাল্লায় মাপেন না।
শহীদ ইসলাম, প্রাবন্ধিক