মোস্তফা হায়দার : কবিতার কাছে পাঠক মাত্রই একটু বোকা অথবা বোদ্ধা হয়ে হাজির হয়। কবিতায় এ শক্তিই আজীবন দৃঢ়তা প্রকাশ পায়।
সময়ের একপিঠে একজন কবিকে চিনতে বসে বার বার আশ্চর্য হচ্ছি যে, এ কবি কিভাবে এতোসব বিষয়ের গীত ধরেছে। গীতিকলার যে সব সূত্রাবলি আছে সে সব সূত্রের মাঝে একজন কবি প্রায়শই হেঁটে চলেছেন। বলার চেয়ে বেড়িয়ে চলেছেন। বলাটাই সাহিত্যের সৌন্দর্য।
তিনি কবি, কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক মহীবুল আজিজ। শিল্প – সাহিত্যে একজন ব্যক্তির পরিচয় সে বা তিনি লেখক। লেখক মাত্রই যথাযথ পরিচয়। তারপরও কথা থেকে যেতে বাধ্য- মার্গীয় বিষয়ের নেপথ্যে। মহীবুল আজিজ একজন যতটুকু কবি তার চেয়ে বেশী কথাসাহিত্যিক। কথা সাহিত্যের চাপে তার কবিত্ব হতে চলেছে আড়াল। যদিও তাঁর কাব্যসমগ্র বিশেষ উপহার পাঠকের মননশীলতায়। কবি মহীবুল আজিজ কবিতার দস্তরখানায় কোনো বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে কবিতায় যাপন করার চেষ্টা করেন নি। তাঁর কাব্য একধরণের বৈচিত্রে ভরা। একজন কবি পথিকের পথহারানো থেকে মুক্তির পথ দেখানোটাকে দায়িত্ব মনে করে অনেক ইঙ্গিতের সূত্রাবলি উপস্থাপনে করে না কোনো কসুর। কবির বিশ্বাস আর চিন্তাধারা এক হলেও চর্চায় থাকে বাস্তবতার আদল। কবি মহীবুল আজিজ কিছু কিছু জায়গায় নিজের কবিতাকে দাঁড় করিয়েছেন সূত্রের রুপরেখা দিয়ে। ‘মোম দেখে- দেখে ‘ কবিতাটিতে কবি বলেন-
‘মোম দেখে-দেখে শিখি, মোম থেকে অনেক শেখার আছে
মোমের মূল বিষয় হলো মেরুদ-, যা থাকে মাঝখানে ‘
( মোম দেখে-দেখে — পালাবার কবিতা)
সরল বাক্যে একটি চমৎকার বিশ্বাসের কাছে পাঠককে বসিয়ে দিতে পারাটাই কবির সার্থকতা। একজন কবির কাজ হলো পাঠককে দিকভ্রান্ত না করে পথের দিশা দেয়া। এ কবিতাটিতে মানুষের শিরদাঁড়া সোজা করে তথা অস্তিত্বের পোশাকে দাঁড়ানোর প্রত্যয়কে তুলে ধরতে সচেষ্ট হয়েছেন। পাঠক বা বোদ্ধামাত্রই আশ্রয় খোঁজে। আর কবিদের কাজ হলো একটি দৃঢ় মনোবলের আশ্রয়ে শোকেসকে সাজিয়ে রাখা। অপর দিকে মোমের মত আলো ছড়ানোর কাজও এ মানুষের। দাঁড়িয়ে থাকার দৃঢ়তার কাছে মোমের গাত্র বেড়িয়ে পাওয়া যাবে নতুন কলাকৌশল।
একজন কবির বিশ্বাস ও আস্থায় সময়ের দ্রোণ থাকতে হয়। মানুষের সংসারে মানুষকেই বেঁচে থাকার প্রক্রিয়ায় থাকতে হয়। বের করে নিতে হবে নিত্যসূত্রের প্রক্রিয়া। কবি মহীবুল আজিজ নাগরিক চিত্তে এ দেশের নাগরিক হলেও বিশ্ব পরিমন্ডলে যথাযথ এক পরিব্রাজক। সীমানা না মানা এ কবি যেখানে গিয়েছেন সেখানটাকে রেখেছেন তাঁর কবিতায়। কবিতার এ আশ্রয়ে বৈপরীত্বকে সেঁচে তুলে দাঁড় করানো, একজন মহীবুল আজিজ হয়ত চমৎকার স্লেটে বসে সময় বা প্রজন্মকে দীক্ষা দেয়ার মাঝেই আনন্দ ভাগাভাগি করেন। তাঁর ভাষায়-
টেমসের ওপরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জলের কল্লোল শুনি
খানিকটা ভাঙা বিস্কিট ছুঁড়ে দেবো কিনা ভাবতেই
দেয়াল তুলে দেয় ধোপদুরস্ত বাঁশিওয়ালা কয়জন:
জানো, আমাদের নদীর জল দূষিত করার দায়ে
এক্ষুণি তোমাকে পরাতে পারি হাতকগ!
পৃথিবী- দর্শন (রৌদ্রছায়ার প্রবাস)
আর কবির দেশে যত্রতত্র অপব্যবহারের কারণে সিটির ভেতর হয়ে আছে নোংরা আখড়া। নোংরা শিল্পের কোলঘেষে হতে হয় সদ্য বিয়ে করতে যাওয়া এক যুবকের রথযাত্রা।
একজন মহীবুল আজিজ আপাদমস্তক এক গদ্য লেখক। কবিতায় সে ছাপ পুরোটা বিদিত। ছন্দের চেয়ে গদ্যের চমৎকার সব ঢঙে শব্দের বিন্যাস এবং নান্দনিক গাঁথুনির শৈলিতে পঠনপাঠনে বাঁধে না কোনো বাঁধ। নিয়ত ঝরঝরে পাঠে গতির কোনো কমতি পায় না পাঠক। তবে মাঝে মাঝে কিছু কবিতাকে বেখাপ্প্যা মনে হলেও অন্তর্নিহিত গুরুভাবে হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কবিতার ভেতরাত্মাকে আত্মস্থ করা এক কাব্যিক পুরুষও বটে। তাঁকে পাঠ করতে যথেষ্ট সময় নিতে হলেও কিছু কবিতা পাঠে নিরানন্দ হই। কারণও ছিল। নিজদেশের প্রকৃতি আর অন্য দেশের না দেখা লোকালয়ের উপস্থাপন কিছুটা দ্বিধায় রাখলেও আন্তর্জাতিকতা পেতে সুবিধা হয়েছে। যেমন কিছু বাক্যের কাছে নিয়ে যাচ্ছি আমার আমিকে –
মার্গারেটের এমফিলের বিষয় ছিল বার্ডস নেস্ট। সব পাখি নয়
যে-পাখিরা বাসা বানায় এক ধরণের আঠালো সুস্বাদ লালায়।
পৃথিবীর সবচাইতে মূল্যবান লালার অধিকারী তারা।
(প্রাণীবিদ্যার মধ্যে প্রেমের অনুপ্রবেশ-পৃথিবীর সমস্ত সকাল)
২.
“নাইজারের ঢেউ ভেঙে এসে ভিড়লেন শুভ্রফাদার।স্মিতহাসি
মুখঃ” এই নাও এনেছি দেখো সেন্ট লুকের সুসমাচার”।
ওদিকে যিসাসকে যে ছেলেটি কালো এঁকেছিল তাকে
বের করে দেয়া হল স্কুল থেকে। ঈশ্বর সাদা না
কালো সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না ফাদার ”
(চিনুয়া এ্যাচেবে -সান্তিয়াগোর মাছ)
৩.
পাইনহার্স্ট থেকে বেরিয়ে নিউনহ্যাম হয়ে সোজা ট্রাম্পিংটন
এইটুকু পথ কত কষ্টে ও ধীরে পেরোলে তুমি। অথচ অনায়াসে
বিজ্ঞানকে নিয়ে গেছো কৃষ্ণ বিবরের দরজায়। ঈশ্বরকেও তুমি
দিয়েছো ঠেকিয়ে মস্তিস্কের মহিমায়।
(বেম্ব্রিজে স্টিফেন হকিংকে দেখে- -সান্তিয়াগোর মাছ)
৪.
কিছু মর্চেপড়া বিবেকের থিতুচিত্রকে তুলে ধরতে কখনো সময়, কখন ধর্মের ধ্বজাধারী, কখনো রাস্ট্রের, কখনো প্রকৃতির টুটিচেপে ধরে কথা বের করবার দুঃসাহস দেখাতে সক্ষম হয়েছেন কবি মহীবুল আজিজ। তার বেশকিছু কবিতা আছে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ভিন্ন স্বাদের আমেজ দিবে। ভিন্ন বোধের মানুষ ও রাস্ট্রের দ্বিধায় আঘাত করবে।
একটি কবিতার সলিলে ঢুকে পাঠক বেবাক দাঁড়িয়ে যাবে। কবিতার মধ্যসলিল হলো-
লাল বইগুলো শেলফে সাজিয়ে রেখে
লাল আপেলে ছুরি বসিয়ে
লাল মদ পান করেছি
এখন রক্তের রংও লাল দেখে সভয়ে
সরে এসেছি গন্তব্যের পথ থেকে
কিন্তু তুমিই তো বলে দিয়েছিলে
লাল ভিন্ন বিপ্লবের অন্য কোনো বর্ণ নেই।
(হাইগেটে কার্লমার্কসের সমাধিক্ষেত্র- সান্তিয়াগোর মাছ)
খ)
কবি মহীবুল আজিজ সারাক্ষণ ভাবনায় থাকেন। বড় গল্পের লেখক বলে কবিতাকে এতো ছোটো ছোটো ভাষ্যে পাঠকের সামনে ছেড়ে দিয়ে যেন আদালত গড়ে তুলে দেন। শুনানি চলে কবিতার শব্দের সিঁড়ি ধরে। তাঁর ‘সাম্প্রতিক ‘ নামীয় কবিতাটির আস্তরে চোখ দিলে কান খাড়া হয়ে যায়। মন দিলে বিবেকে খোঁছা খায়। নিদারুণ এক কষ্টের হাসি যেন ছেয়ে গেছে কবিতাটি।
মিথ্যে বলো, গালাগাল দাও, কুৎসা রটাও, তবু
তোমার হাতে থাকতে হবে ফুল।
যারা কাল রাতে বহু-ক্ষণ ধরে
পরখ করছিল ভোঁতা ও ধারাল ছুরির ধার,
আজ ফুল ফুটে আছে তাদের হাতে।
(সাম্প্রতিক – নিরানন্দপুর)
কবি মহীবুল আজিজ সমাজের অন্তর্নিহিত ভবে হাত দিতে সাহস দেখিয়েছেন বেশী। অনেক অনিয়মকে তিনি কাঁচিকাটা করে সমাজ ও সময়ের চিত্রে রাখেন দুপিঠি আয়নার মত করে। যাতে পাঠক বোধের দরিয়ায় চিন্তার ভাঁজরেখা রেখে নিজেদেরকে করে নিতে পারেন সময়ের চাতুর হিসেবে। মুখে গালি থাকলেও হাতে যদি থাকে ফুল তা হলে এ বোকাসময় ভুলে যাবে আঘাতের ক্ষত। যে ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয়েছে বহুসময়। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠের মত ফুল হাতে ফেলেই যদি সব ভুলতে হয়, তা হলে আর থাকে না কোনো ক্লেদ। ধর্ম তাই বললেও বাস্তবতা জটিল।
কবি মহীবুল আজিজ সময়ের যাপনের মত সময়ে ঘটে যাওয়া নিত্য ঘটনাকে শব্দের মালায় গেঁথে রাখতে অনেক সময় রত ছিলেন। এ কবিতাগুলো পাঠ করলে বুঝা যায় নিত্য ঘটমান ঘটনাগুলোতে কখনো তিনি প্রতিবাদের সারথি কখনো স্মৃতির সারথি হয়ে কবিতার গাত্র ঘসে যেতে আলস্য করেন নি। তাঁর এমন কবিতাগুলো কখনো কাওকে নিবেদন করে কখনো উন্মুক্ত পাঠকের ঘাড়ে তুলে দিয়ে কিছু ঘটনার চিত্র জানান দেবার চেষ্টা করেছেন। যেমন-
বিদেশি বোতলে দেশি মদ, বিড়ি পুরিয়ায়
আরবি খমর, কাপড়ের আবরণে অ-পুরুষ কেউ।
(বোবা হোক, কি মধ্যবয়সী কিংবা বুড়ো-ই।)
যতই চেঁচিয়ে তুমি বলো, মেয়েটি তোমার মা,
ওরা বিশ্বাস করবে না।
(মধ্যরাতে তোমাকে ধরেছে- অসুস্থতা থেকে এইমাত্র)
কারণ নির্মমতারা যখন মদের পেয়ালা অথবা নেশার ঘোরে
আক্রান্ত হয়ে ওঠে তখন আর তারা বিবেক নামক জুজুকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতো না অথবা নিয়ন্ত্রণ নামক এ স্রোতকে অবদমন শক্তি হারিয়ে ফেলে অযাচিত ঘটনার মুখোমুখি হতে বাধ্য হত। কবি তাদের সেই দৃঢ় নির্মমতাকে উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন-
“জামিন মেলে না অতি শুদ্ধ পিটিশনেও। ছি সব – ই”
এই একটি লাইনই কবির সময়োত্তম শক্তির কথা। যে কথায় কেঁপে ওঠে একটি মানচিত্রের অবিশ্বাসের পৃথিবী! হারিয়ে যেতে বসা নৈতিকতারা বেঁচে থাকবে এ রকম কবিদের শক্তিময়তা ও সৎসাহসের কাছে। স্তব্ধ সময়ের কোলে বসে কাকময় সময়যাপনের সাথে গা ভাসালে নিজস্ব স্বকীয়তা হারাতে বাধ্য!
মহীবুল আজিজ একজন সময় সচেতন কবিও বটে। সাম্যবাদের ইচ্ছে জাগানিয়া কবি তুলে ধরেন সময়ের অযাচিত বিশ্বাস আর দৌরাত্বের নব্যসব সূর। যে সুরে মানুষ হারায় অনেক সুন্দর এবং জন্ম দেয় বৈষম্যের এক নথিপত্র। মানুষ মাত্রই সমাজের ইচ্ছে নতজানু। কবি তাই জানান দেন ঠিক এভাবে-
এই মা-টি যেমন আমার,
এই দেশটি যেমন আমার,
ঠিক তেমনি এ-রমণীটিও আমার হয়!
শিখতে পারি নি, তাই ডুয়েল না লড়েও
বিজয়কাহিনী লিপিবদ্ধ করে গেছে এক নিধিরাম সর্দার।
(আমার যেরকম প্রস্তুতি- আমার যে রকম প্রস্তুতি)
পৃথিবীতে সব অনিয়মের জন্ম দিনে হলেও কিছু অনিয়মের জন্ম রাতেই হয়। আর রাতে হওয়ার পেছনের সূত্রও আলাদা। মানুষ আর স্রষ্টার মাঝে রাতের অবগাহন আলাদা। রাতের বিশ্বাসে মানুষের ইচ্ছে শক্তি বাড়ে। বাড়ে আড়াল করে রাখা প্রাণের ধ্বংস। কবিদের চোখেও মানুষের যাপিত কলাকৌশল ধরা পড়ে। রুপ পায় কবিতায়। ফলে কবিতা হয়ে ওঠে পূঁজনীয়। কবিতার শক্তির কল্যাণে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। সময় ও সমাজ দেখে নেয় ভবিষ্যতের সূচিপত্র। কবি মহীবুল আজিজ রাত আর আঁধারের কাছে পাঠকের দৃষ্টি নিয়ে খেলতে চেয়েছেন বলে হয়ত এমর কবিতার জন্ম। তার ভাষায়-
————————-, আঁধারে প্রবিষ্ট হয় তীক্ষ্ণ
ছুরিকার ফলা;বহু লোক এখনও নিষ্ঠুরতায় তত ক্রুর
হতে পারে নি, যে জন্যে তারা রাত্রির জন্যে অপেক্ষা করে।
রাত্রে দিনের স্পষ্টতা থাকে না,এখনও এ দেশে দিনের
চেয়ে রাতে সংঘটিত খুন সংখ্যায় অধিক। —-
(দিন চলর যায় – আমরা যারা স্যানাটরিয়ামে)
কবি মহীবুল আজিজ অনেক কথার কাছে নিজেকে সমর্পণের চেয়ে সময়কে ধারণ করার চেষ্টা করেছেন। রাতের এ বিশ্বাসের সামিয়ানায় কবির পূর্বের যাপন হলেও বর্তমানের যাপন আমাদের জানার সুযোগ না হলেও ঘটনারা এখন আর দিন রাত মানে না। খুনের ইচ্ছেরা জাগ্রত হলে দিনকে বেচে নেয়। কারণ দিনের আলো আজ যেন নিরাপদ প্রহরী। যদি তাই না হয়, তা হলে বিশ টাকার সদাই করতে গিয়ে ৭বছরের শিশুটিও ধর্ষিত হয়েই খুনের স্বীকার হয়। খুনিরা দিনের আলো নিয়ে গবেষণা বাড়ায় বলে নিরাপদে দিনেই খুন খারাবি চালিয়ে যায়।
অনিয়মের খেরোখাতা আর বাতুলতার পরিচ্ছদে কত নিয়ম আজ হারিয়ে সম্ভ্রম হারায় নিয়মের। নিয়মকে শিল্প ভেবে চলে না বলে অনিয়মই আজ শিল্পের শোকেস দখলে নেয়। মানুষ হারায় সুন্দরের অহম। কবি দেখে নেয় সেই অহমের ভেতরটুকু। কবি মহীবুল আজিজ আপাদমস্তক কবি। কিন্তু কোন্ দৈব প্রতাপে তার কথা শিল্প দাঁড়িয়ে আছে সম্মুখযাত্রায়। এ যাত্রায়ই তার সুন্দরগুলো কুচি করে সময়যাপন করে বলে কথাসাহিত্যেও তার অবস্থান সুদৃঢ়। তার কবিতার ভেতর শক্তির কাছে পাঠকের দায় থাকলেও কবি সে সব করে চলেছেন আড়াল। তার কবিতায় ছান্দিকতা না থাকলেও মুক্তছন্দের সুরের গতিই প্রাণ এনে দেয় বলে পাঠকের পাঠে বাঁধে না কোনো ছেদ।
একটি অপূর্ণ বাক্যের শিরোনামের কাছে পাঠক হিশেবে আমি থিতু। অবাক হয়েছি। তবে পাঠ শেষে স্থির হয়েছি যে, কবির পক্ষেই সম্ভব। কবিই তো নবীদের দায়িত্বে দাঁড়াতে পারেন। নবীরা সবঅনিয়মের বিরুদ্ধে যেমন বলেছেন তেমনি সমুন্নত করেছেন তার স্রষ্ঠার শ্রেষ্ঠত্ব। কবিরা একটিতে দৃঢ় হয় নিয়ত। অনিয়মের সূত্রাবলি তুলে ধরতে কবিরা বদ্ধ পরিকর। মহীবুল আজিজ সে কাজটি তার কাব্যসাহিত্যের প্রায় জায়গায় দাগ রেখে গেছেন। কোনো বিষয় তার চোখ এড়াতে পারে নি। তার
অপূর্ণ বাক্যটি হচ্ছে -‘ সের দরে সংবিধান বিক্রি’। এ শিরোনামীয় চমৎকার কবিতাটিতে যে সব বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন তার চেয়ে বেশী প্রতিবাদের ভাষ্যে নিজেকে সমুন্নত রেখেছেন দ্যার্থহীন ভাষায়- কবির ভাষায়-
সের দরে সংবিধান বিক্রি দেখে খুব রাগ করেছিলে।
আপাত:দৃষ্টিতে সংবিধান বই বৈ আর কিছু নয়,
তাকে শেল্ফে তুলে রাখতে হয় অথবা গুদামের মেঝেতে
হিসেব করলে প্রতিটি ইঞ্চি স্থানের নির্দিষ্ট মূল্য আছে।
( সের দরে সংবিধান বিক্রি-পালাবার কবিতা)
কতপূর্বে কবি সে সময়ের নাট্যকলায় ক্রোধের তীর ছুড়লেন; তা যেন আজকের সময়ের দাবী নিয়ে হাজির। কে বলবে এ সময়ের বিরুদ্ধে। এখন তো সংবিধান বিক্রি করার মত কিছুই রাখে নি এ সময়। নিষ্ঠুর এ নৃত্যকলার কৃচ্ছাতায় মানুষের নাভিশ্বাস হলেও আজ কবিদের মুখ বন্ধ। কবিরা হয়ে উঠছে রাষ্ট্রচাঁটা একেকটা দাঁতাল শুয়োর। কেউ পদকের ভার নিতে, কেউ আখের গোছাতে মহাব্যস্ততায় প্রগতির লেবাস পরিধান করে প্রগতির বারোটা বাজিয়ে চেতনাকে বিক্রি করে যাপন করছে সময়চিত্র। যা নির্মম পরিহাস!
একজন কবির অন্তর্দৃষ্টির কাছে বার বার কলম দাঁড়াতে বাধ্য না হলে কিসের কবিতা! কিসের শক্তি? মহীবুল আজিজ একটি চকলেট খাওয়া ‘র পরবর্তী ক্রিয়াকলাপে আমাদের যে বিষয়ের প্রতি ইঙগিত দিয়েছেন তা যেন রাষ্ট্রের বুঝবার ক্ষমতাই হারিয়েছে। আহা রাষ্ট্র! কাহার চরণতলায় তোমার প্রাণ যায় যায়! কে শোধাবে তোমায়? “এক অদ্ভুত চকলেট খাওয়া ‘ কবিতাটি আমাকে বিমোহিত করেছে। কবিতাটি যে কোনো রাষ্ট্রের নিরাপত্তা সেক্টরে পাঠ্য বা দেয়াল সেঁটে রাখার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। উজ্জীবিত শক্তির নতুন প্রাণ সঞ্চার হবে। জাগ্রত হবে নিত্য বিবেকের দোলখেলা। কবিতাটিতে চোখ দেই –
চকলেট খেয়ে সাবধানী আর সতর্ক মানুষ গ্রহণের
মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যেই ব্যাকটেরিয়ার ভয়ে মিনিট
দেড়ের নূন্যতম নিয়মে দাঁত মাজে সকালে-বিকেলে
ফ্লোরাইডে ও ফ্লোরাইড ছাড়াও,কখনও মৃদু সেনসোডাইনে
এবং নিজেকে তৈরি করে পরবর্তী চকলেটের জন্য।
এই ভাবে ব্যূহ ঠিক থাকে। প্রতিরক্ষার গায়ে একটুও
পড়ে না টোল,তবে শত্রুরা এগোয় ঠিক-ই সন্তর্পণে।
(এক অদ্ভুত চকলেট খাওয়া- পালাবার কবিতা)
এই হল ভেতর শক্তি হারাবার কৌশল। নিরাময় প্রক্রিয়া বা স্থায়ী কৌশলপ্রক্রিয়া অবলম্বন নেই বলে ঠিকই শক্রুরা সন্তর্পণে হানা দেয়। ভেঙে দেয় দাঁতের পাড়। ভেঙে দেয় দেশের সীমানাদেয়াল। কবি তাই অতন্দ্র প্রহরীদেরকে প্রতিরক্ষাকৌশলের মুখোমুখি দাঁড় করাতে এ কবিতার জন্ম দেন। নিশ্চয় এ কবিতার জন্মের ইতিহাস কবিকে যথেষ্ঠ পীড়া দিয়েছে। কারণ যন্ত্রণার সাতকাহন শেষেই হাসি বা কান্নার স্রোত প্রবাহিত হয়। কবিকে স্যালুট। উপমার আড়ালে নিয়ে কবি যে শিক্ষা দিলেন তা যেন একটু স্কেলে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
কবি মহীবুল আজিজের চোখ এড়াতে পারে নি মেধা পাচারের মত দৃষ্টিও। মেধারা স্ব স্ব দেশের সম্পদ। মেধাবীদের চোখ আঁটকে রাখার মত শক্তি যে দেশের হয়ে ওঠে না সে দেশ অনেক ক্ষেত্রে পুষ্ঠিহীনতায় ভুগবে। অনেক দৈন্যতা গ্রাস করবে। দেশ ও জাতি গোষ্ঠী হয়ে উঠবে রোগাক্রান্ত। কবি তাই বলেন-
শাহানা বিদেশ গেছে,এটা সম্প্রতি জানতে পেলাম
কতমুখ পতাকার তল থেকে দূরে সরে গেল,
মুখচোখহীনও লোকেরাও চলে গেল পাত্তাড়ি গুটিয়ে-
—————————-
শাহানার তো অনেক চোখ;
মুখভর্তি প্রমথ চৌধুরীর চোখেরা জ্বলজ্বল করে।
(শাহানা বিদেশ গেছে -ট্যারানটেলা)
শাহানাদের মত অসংখ্য মেধাবীরা চোখওয়ালারা আজ দেশান্তরিত। তারা বিশ্বাস ও লালন করে অর্থবিত্ত, বহির্সম্মান এবং দেশপ্রেমহীন নিরাপত্তা। কারণ নিজ ভূমিতে তাদের হয়ত ক্বদর হবে না, পাবে না নিরাপত্তা। এ অসম্মানের চিত্রবয়ে মেধাবিরা হারিয়ে যায় দেশান্তের। নিরাপদ দূরত্বে তাদের যাপন বাড়ে। দেশ হয়ে যায় কপর্দক।
গ)
কবি মহীবুল আজিজ মাটি ও মানুষের ভালোবাসায় বাঁচতে চেয়েছেন। বার বার মা, মাটি ও মানুষের কথা নিয়ে কবিতাযাপন করার চেষ্টা করেছেন। কবিতাগুলো নিয়ত মানুষের কথা বলেছে। তাঁর ভেতরের প্রাণের নির্যাস মনুষ্যময়। বিশ্বাসের করিডোরে দেশপ্রেমের ছায়া। জাতির সুন্দর হাওয়া তার কাম্য। নিজেকে আড়াল রেখে চলমান গতিতে চললেও ভেবেছেন তার মৃত্যর কথা। কী হবে তার মৃত্যুর মিছিল শেষে।
কবির ভাষায়-
আমার মৃত্যুর পরে কী হবে সেটা ভেবে আতন্কিত হই।
এইসব হৈ চৈ কোলাহল,ভিড়,নির্জনতা,সব থেকে যাবে,
আমিই ক্রমশ মাটি থেকে আরও মাটি হয়ে যাবো।
কিংবা আমি এক টুকরো
পরিত্যক্ত জমির মতন পড়ে থাকবো কিংবা আর কারো
নীচে চাপা পড়ে প্রাচীনতর হয়ে যাবো কালক্রমে।
(আমার মৃত্যর পরে – আমার যেরকম প্রস্তুতি)
একজন কবির এমনই বিশ্বাস হওয়া বাঞ্চনীয়। কবির বিশ্বাসে
পাঠকের বিশ্বাস বাড়ে। আস্থায় পাঠক খুঁজে সম্মোহনি চিত্র। সাধারণত কবিরা সৃষ্টিতে বেঁচে থাকতে চায়। তবে কিছু কবি শম্মানের প্রেতাত্মা হয়ে বেঁচে থাকতে গিয়ে পাঠকের হৃদয় ভেঙে চুরমার করে দেয়। পাঠক মাত্রই ভক্তে আশেক।
কবি মহীবুল আজিজ নিয়ত নিয়মের কাতারে হাঁটা এক কবি। বিশ্বাসে যাপন করা এক শব্দশিল্পী। কবিতায় বিশ্বাস ছড়িয়ে দিয়ে মানুষের পৃথিবীতে আজীবন বা চিরকালিক শিল্পের আয়নায় রেখে যেতে চেয়েছেন তার সৃষ্টি। বেঁচে থাকার আয়নায় বার বার সুন্দরের সামিয়ানা প্রতিষ্ঠার এক সূত্র খোঁজে গেছেন তিনি। তাই তার ‘প্রার্থনাসঙ্গীত’ নামীয় কবিতাটি ক্ষীণকায় হলেও তার ইচ্ছেশক্তি অনেক বড়। তার ভাষায়-
পরমায়ু দাও অন্তঃত শত বছরের
শক্তি দাও
যাতে পাখা ছড়িয়ে দিতে পারি
সারা পৃথিবী জুড়ে
দৃষ্টির সূক্ষ্ণতা দাও
যাতে সাদা- কালোর পার্থক্য করতে পারি
সহজেই।
কবিকাটি তার সরল বিশ্বাসের জায়গা থেকে আমি দেখছি না। দেখছি দায়বদ্ধতা থেকে। সাদা -কালোর পার্থক্যের প্লেটে তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছেন ন্যায়-অন্যায়ের দ্যুতি। যে দ্যূতিতে তিনি চেয়েছেন নিজের দায়বদ্ধতা কাঁধে তুলে নিয়ে জবাবদিহিতা পরিস্কার করতে। তাঁর বিশ্বাস একদিন জবাবদিহিতার মুখোমুখি হতে হবে। এ বিশ্বাসে তাঁর এ প্রার্থনাসঙ্গীত।
কবি মহীবুল আজিজ জীবনের মিহি স্রোত বেয়ে শিল্পসাহিত্যের সবকটি কলার কাছে এক মহীরুহ হয়ে বেঁচে থাকবেন নিশ্চিত। নির্মোহ এক ধাতবপদার্থও বলা যায় এ কবিকে। কবি তার সৃষ্টিলীলায় মানুষের পক্ষে কথা বলতে বলতে সময়যাপন করে চলেছেন। হেন কিছু বাদ যায় নি তার কবিতায়। ক্ষুদ্রক্ষুদ্র কবিতার হাত ধরে লিখে গেছেন এ বিশ্বচরাচরের কতকথা। কথার পিঠে রেখে গেছেন তাঁর বেঁচে থাকার আকুতি। কাজের মাঝে বেঁচে থাকার বিশ্বাসে কবি মহীবুল আজিজ খুঁজে পেয়েছেন স্বর্গীয় আনন্দ। যে আনন্দবিশ্বাসে কবি লিখেন
মৃত যারা, তারা মরে গিয়ে আসলে আমাদের ভেতর দিয়ে
জীবিত হয়ে ওঠে,এবং তাদের মৃত্যু কখনই নেই আমাদের
স্মৃতিভ্রংশতা ছাড়া। বস্তুত আমরা মৃতদের ধরে রাখি,
এ কথার অর্থ আমরা স্মার্ত ও ইতিহাসপর্যটকও বটে।
(আমরা জীবিত হই- আমার যেরকম প্রস্তুতি)
তাঁর উপরোক্ত বিশ্বাস ভালোবাসবে তাঁর সৃষ্টিকে। যে সৃষ্টির গোড়ারডেরায় রেখে গেছেন শিল্পের রঙে মিশ্রিত যাপন সূত্র।
মোস্তফা হায়দার, কবি ও প্রাবন্ধিক