আলম খোরশেদ :
আমাদের দেশটি-যে অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র একটি দেশ, এটা নতুন কোনো কথা নয়। এবং এই দুঃসহ দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য দেশে বিগত বছরগুলোতে সরকারি বেসরকারি নানাবিধ উদ্যোগের ফলে এর হার বেশ অনেকটাই কমে এসেছে, অন্তত করোনাকালের আগ পর্যন্ত; এটাও তেমন নতুন কোনো খবর নয়। কিন্তু এর বিপরীতে দেশজুড়ে-যে নানাবিধ অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের মাত্রা বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে, সে-বিষয়ে সচেতনতা তেমনটা চোখে পড়ে না; বিশেষ করে আমাদের রাষ্ট্রপরিচালনাকারী ও নীতিনির্ধারক মহলে। কেবল কয়েকটি বামপন্থি দলের নেতাকর্মী ও কিছু প্রগতিশীল লেখক, চিন্তককেই এ নিয়ে মাঝেমধ্যে সরব হতে দেখা যায়। সমাজে বিদ্যমান এই উৎকট বৈষম্যের চিহ্নগুলো বাহ্যিকভাবে হয়তো চট করে চোখে পড়ে না, কিন্তু একটু গভীরভাবে লক্ষ করলে কিংবা অভিনিবেশ সহকারে ভাবলেই কিন্তু এর অস্তিত্বটুকু স্পষ্ট টের পাওয়া যাওয়ার কথা। অবশ্য মাঝেমধ্যে দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতেও এ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপা হতে দেখি আমরা। যেমন, গেল বছর একটি জাতীয় ইংরেজি দৈনিকে করোনাকালের মধ্যেও বিশ্বে কোটিপতিদের সংখ্যাবৃদ্ধির চাঞ্চল্যকর একটি খবর দেখেছি, যার উৎস সুইজারল্যান্ডভিত্তিক একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত গ্লোবাল ওয়েল্থ রিপোর্ট ২০২১। এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও, এর আগের দুই বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে আট হাজার, যাদের একেকজনের মোট সম্পদের পরিমাণ কমপক্ষে দশ থেকে পঞ্চাশ কোটি টাকা। পাশাপাশি, এই করোনাকালেই দেড়, দুই কোটি মানুষের নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার খবরও আমরা পড়েছি কোনো কোনো কাগজে ও অনলাইন পোর্টালে। দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের দুই প্রান্তের এই দুই বিপরীতমুখী প্রবণতা আর কিছু নয়, আমাদের সমাজ-অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান বৈষম্যেরই জোরালো একটি সূচক। এই কিছুদিন আগে খোদ পরিকল্পনা মন্ত্রীই তাঁর নিজের মুখে আমাদের সমাজে এই বৈষম্য বৃদ্ধির কথা স্বীকার করেছেন।
পরিসংখ্যানের ভাষায় এর অবশ্য একটি বৈশ্বিক নাম রয়েছে: জিনির সূচক। বিখ্যাত ইতালীয় সমাজতাত্ত্বিক ও পরিসংখ্যানবিদ র্করাডি জিনি উদ্ভাবিত এই সূচকের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পরিমাপ করা হয়। ০ থেকে ১ এর মাপকাঠিতে পরিমেয় এই সূচকের শতাংশসংখ্যা যত কম বৈষম্যের পরিমাণও তত কম হবে এবং এই সংখ্যাটির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে একটি দেশের বৈষম্যবৃদ্ধিরও পরিমাপ মেলে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটি ছিল ৩৩% এর মতো। বৈষম্য-বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সংখ্যাটি ৪০% এর ওপরে থাকার অর্থ, সেই দেশে বা সমাজে গভীর বৈষম্য বিদ্যমান এবং তা যেকোনো সময় নানারকম সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংকট সৃষ্টি করতে পারে। সেই মানদ-ে আমরা হয়তো এখনও কিছুটা স্বস্তির মধ্যেই আছি, অন্তত আফ্রিকা মহাদেশের অনেক দেশের তুলনায়, যাদের জিনি সূচক প্রায় ৬০%। কিন্তু খেয়াল রাখতে হবে যে, এটি সাত বছর আগের তথ্য এবং এর মধ্যে এই সূচক আরও বেড়ে যাওয়া ছাড়া কমার কথা নয়। এছাড়া, এইসব সরকারি পরিসংখ্যানের ওপর সবসময় শতভাগ আস্থা রাখারও কোনো উপায় নেই আমাদের। বিগত অর্থবছরে আমাদের জাতীয় উৎপাদনের বাৎসরিক প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান নিয়ে বিতর্কের পর, যেকোনো পরিস্থিতিতে নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রদানের জন্য সচেষ্ট হতে উক্ত প্রতিষ্ঠানটির প্রতি মাননীয় পরিকল্পনামন্ত্রীর আহ্বানটুকুর কথা আমরা এই প্রসঙ্গে স্মরণ করতে পারি বৈকি। অর্থাৎ, শুধু শুকনো পরিসংখ্যান নয়, এর জন্য খোলা চোখ ও খোলা মন নিয়ে সমাজের আসল চেহারা ও তার গতিপ্রকৃতিটুকু গভীরভাবে নিরীক্ষণ করাটাও জরুরি।
আমি অর্থনীতিবিদ নই, একজন সচেতন নাগরিক ও চিন্তাশীল সামান্য লেখক মাত্র। এই লেখাটিতে তাই সেই সাধারণ দৃষ্টিতেই আমাদের সমাজের বিদ্যমান বৈষম্যের স্বরূপটুকু বোঝার চেষ্টা করব। প্রথমেই আসা যাক সমাজ-কাঠামোর একেবারে তলার দিকের মানুষদের মাথাপিছু আয় তথা উপার্জনের বিষয়টিতে। আমরা প্রায়শই গর্ব করে বলে থাকি বাংলাদেশ দরিদ্র দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে এখন উন্নয়নশীল তথা মধ্য আয়ের দেশের খাতায় নাম লিখিয়েছে, আমাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় দুই হাজার ডলারেরও বেশি, বেকারত্বের হার ৫ শতাংশর নিচে ইত্যাদি ইত্যাদি। এগুলো সবই সত্য, কিন্তু এইসব পরিসংখ্যান দিয়ে আর যা-ই হোক সমাজের নি¤œবিত্ত মানুষের প্রকৃত আয় কিংবা অর্থনৈতিক অবস্থার সঠিক পরিচয় পাওয়া যায় না কিছুতেই। আমাদের তাই দেখতে হবে তারা আসলে ঠিক কী ধরনের কাজ কিংবা অর্থনৈতিক কর্মকা-ের মাধ্যমে নিজের ও পরিবারের জীবনজীবিকা নির্বাহ করে। আমরা তখন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করব যে, বাংলাদেশের নি¤œ মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত জনগোষ্ঠীর বিপুল অধিকাংশ মানুষেরই মূলত কোনো ভদ্রগোছের আনুষ্ঠানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কর্মসংস্থানেরই নিশ্চয়তা নেই। এরা প্রধানত রিকশা কিংবা ঠেলাচালক, বাস-টেম্পুর কন্ডাক্টর/হেল্পার, ভাসমান ফেরিঅলা, দোকান কর্মচারী, বাসাবাড়ির পরিচারিকা-দারওয়ান-ড্রাইভার, বেসরকারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ফুটফরমাশ খাটা নামমাত্র বেতনের চাকুরে, এনজিওসমূহের মাঠপর্যায়ের কর্মী, স্বাস্থ্যকর্মী, পোশাকশ্রমিক ও নানাবিধ ছোটখাটো কলকারখানার মজুর, নির্মাণ শ্রমিক, গতরখাটা মৌসুমী কামলা, খেতমজুর, ইটভাটা ও জাহাজভাঙা শিল্পের শ্রমিক ইত্যাদি। এই বিশাল জনগোষ্ঠীটির জীবনজীবিকার আর্থিক ভিত্তিটি-যে কতটা নাজুক ও অনিশ্চিত তার একটি করুণ, অমানবিক চিত্র আমরা গেল করোনাকালে লকডাউনের সময়েই দেখতে পেয়েছি। এহেন ’দিন আনি দিন খাই’ অবস্থার চাপে ক্রমাগত পিষ্ট হওয়া এই মানুষজনের কাছে নিজের ও পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাটা বিলাসিতা মাত্র। অদূর ভবিষ্যতে উন্নত বিশ্বের সারিতে পা রাখার স্বপ্ন দেখা বাংলাদেশের মতো একটি দ্রুত উন্নয়নশীল দেশে এরকম নিদারুণ আর্থিক বৈষম্যের চিত্র কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না।
পাশাপাশি দেশের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে তাকালে সেখানেও আমরা ব্যাপক বৈষম্য ও শ্রেণিবিভাজনের দৃশ্য দেখতে পাব। বড় শহরগুলোর বিত্তবানের ছেলেমেয়েরা সব ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে লেখাপড়া সেরে ঝটপট দেশের বাইরে পাড়ি জমাচ্ছে; সচ্ছল এবং মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরাও মোটামুটি মানসম্পন্ন সরকারি, বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছে। সেখান থেকে পাশ করে তারা প্রকৌশল, মেডিকেল, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিশেষায়িত পেশাজীবনে কিংবা বিসিএসের মাধ্যমে লোভনীয় সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়ে উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণে ব্রতী হচ্ছে। অন্যদিকে নি¤œবিত্ত, অসচ্ছল, গরিবগুর্বোর বাচ্চাদের কপালে রয়েছে পাড়ামহল্লার কিংবা গাঁওগেরামের যত ভাঙাচোরা প্রাথমিক বিদ্যালয়, এনজিওদের পরিচালিত ছিন্নমূলের ইশকুল, নয় তো কওমি মাদ্রাসার মতো পশ্চাৎপদ প্রতিষ্ঠান; যেসব জায়গায় না আছে ভালো শিক্ষক, না আছে প্রকৃত শিক্ষার কোনো আয়োজন। একারণে এইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা-যে অন্তত লেখাপড়াটুকু শিখে ভদ্রগোছের একটা চাকরি কিংবা ব্যবসাপাতি করে কালক্রমে তাদের আর্থিক অবস্থার বদল ঘটাবে, সেই সম্ভাবনাও থেকে যায় সুদূর পরাহত। ফলত এই হতভাগ্য জনগোষ্ঠীটির দুরবস্থা ও দুর্ভাগ্যের কোনো পরিবর্তনই ঘটে না; তারা যে-তিমিরে ছিল, সে-তিমিরেই রয়ে যায় গোটাজীবন। একই অবস্থা দেশের স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও। স্বাস্থ্যব্যবস্থার নির্বিচার ও জবাবদিহিহীন বেসরকারিকরণের প্রভাবে, শিক্ষার মতো স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টিকেও এখন আর সর্বসাধারণের মৌলিক অধিকার বলার সুযোগ নেই; সেটি একটি সাংঘাতিক ব্যয়সাপেক্ষ পণ্যে পরিণত হয়েছে, যা কেবল সমাজের ক্ষুদ্র একশ্রেণির বিত্তবান মানুষেরই উপকারে লাগছে। নি¤œবিত্ত মানুষদের জন্য ঘুরেফিরে সেই জরাজীর্ণ, আধুনিক সুযোগসুবিধাবঞ্চিত সরকারি হাসপাতালগুলিই শেষ ভরসা, মাত্রাতিরিক্ত রোগীর চাপে প্রায়শই নাভিশ্বাস ওঠার যোগাড় হয় যাদের। এইভাবে, অসহায় গরিব মানুষেরা অর্থের অভাবে আর চরম ব্যয়বাহুল্যের কারণে যথাযথ চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপচিকিৎসা কিংবা ¯্রফে বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে মরে।
সবশেষে, আমাদের উন্নয়ন মডেলের আরেকটি উৎকট বৈষম্যের কথা না বললেই নয়। সেটি হচ্ছে রাজধানীর সঙ্গে অন্যান্য শহরগুলোর ন্যাক্কারজনক পার্থক্যের মাত্রাটুকু। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশ বুঝি একটিমাত্র নগর তথা ঢাকাকেন্দ্রিক দেশ, যেখানে তার সব উন্নয়ন, আধুনিকতা, নাগরিক সুযোগসুবিধা, জৌলুস ও চাকচিক্যকে উজাড় করে ঢেলে দেওয়া হয়। বাকি শহর, নগর, গ্রামবন্দর পড়ে থাকে অতল অন্ধকারের তলায়। ঢাকার সঙ্গে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগর ও বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামেরই যে-রকম দৃষ্টিকটুরকম তফাৎ, সেখানে অন্যান্য জেলাশহরগুলোর কথা তো কহতব্যই নয়। রাজধানী কিংবা প্রধান প্রধান নগরকেন্দ্রিক এই কেন্দ্রীভূত উন্নয়ন মডেল আর দেশের অন্যান্য অঞ্চলগুলোর মধ্যে এহেন বৈষম্যের বিস্তার ও তার ভয়ংকর পরিণাম বিষয়ে টমাস পিকেটি কিংবা মাইক স্যাভেজের মতো বৈষম্য-গবেষক, সমাজতাত্ত্বিকেরাও কঠোর সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছেন তাঁদের বইপত্রে। দেশের সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপরিচালনাকারী, রাজনীতিবিদ, নীতিনির্ধারক, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নবিশেষজ্ঞ সবাইকেই এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে যে, কেবল দারিদ্র্য বিমোচন নয়, পাশাপাশি সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত এবং সমাজের দুই মেরুর মানুষের মধ্যেকার বিপুল বৈষম্য দূর করাটাও সমান জরুরি। আর এর জন্য সঠিক ও সুপরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ এবং উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। এর অভাবে আমাদের অর্থনীতির যত উন্নয়নই হোক না কেন, সেটা যথার্থ টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী তো হবেই না, বরং বিদ্যমান সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্যের ভারে তা যে-কোনো মুহূর্তেই মুখ থুবড়ে পড়তে পারে।
আলম খোরশেদ, প্রাবন্ধিক, গবেষক