বাবুল সিদ্দিক
কয়েক বছর ধরেই লক্ষ করছি একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক পরের দিন পাগলটাকে দেখা যায় শহরের অলিতে গলিতে, এ রাস্তায় ও রাস্তায়, এ মোড়ে ও মোড়ে, ডাস্টবিনের পাশে, নর্দমার ধারে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চষে বেড়ায় শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে।
সকাল বেলা কৌতূহল বসত জিজ্ঞাস করলাম,
“ তোমার নাম কি ? “
ও বলল , “ রফিক “
দুপুরে দেখলাম, পোস্ট অফিসের সামনে, ডাস্টবিনে হাত ঢুকিয়ে কি সব খুঁজছে।
বললাম, “ রফিক, কি খুঁজছ ?”
উত্তর দিল, “ আমি রফিক নই, আমি শফিক”
অবাক হলাম।
বিকেলে দেখা পার্কে কোনে।
বললাম, “শফিক, চা খাবে ?”
ও বলল, “আমি শফিক নই, আমি বরকত”
আর কোন উত্তর না দিয়ে হন হন করে হেটে গেলো বড় রাস্তার দিকে কাঁধে একটি বস্তা নিয়ে।
সন্ধ্যের মুখে বড় রাস্তার মোড়ে জটলা দেখে থমকে দাঁড়ালাম।জিজ্ঞাস করলাম,
“কি হয়েছে ?”
ভিড় থেকে একজন বলল, “একটা চোর ধরা পড়েছে।“
ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম, ল্যামপোস্টে বাঁধা সকালের
রফিক, দুপুরের শফিক, বিকেলের বরকত।পাশে মাল বোঝাই বস্তা, যা ছিল সকালে খালি।
একজন বলল, “ঐ বস্তায় আছে চুরি করা জিনিস।”
খটকা লাগল, জিজ্ঞাসা করলাম, “চুরি করেছ ? “
ও নির্বিকার, কোন উত্তর দিল না, মাটির দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি বস্তার মুখের বাঁধন খুলে মাটিতে ঢেলে দিলাম, বেরোল টুকরো টুকরো কাগজে ছাপার অক্ষর অ, আ, ক, খ, ছেঁড়া ফাটা, দুমড়ানো, মোচড়ানো, কাগজের ও কাপড়ের যত লাল, সবুজের জাতীয় পতাকা, ভাষা শহীদদের কিছু ছবি আর শহীদ মিনারের ছবি। রাস্তা, ডাস্টবিন, নর্দমা থেকে কুড়িয়ে ভরেছে বস্তায়।
মুহূর্তে ভিড় হলো অদৃশ্য। ভিজে চোখে বাঁধন খুলে দিলাম পাগলের। আমার মুখের দিকে তাকাল একবার, তারপর মৃদুস্বরে বলল,
“দেখো, কেউ যেন পা দিয়ে মাড়িয়ে না যায়।”
তারপর আবার অক্ষরগুলো, পতাকাগুলো আর ছবিগুলো বস্তায় ভরে নিয়ে চলে গেলো দূরে বহু দূরে, আমার দৃষ্টির আড়ালে।
আমি দাড়িয়ে রইলাম স্তব্ধ হয়ে, অপার বিস্ময় আর একরাশ যন্ত্রনা বুকে নিয়ে।
বাবুল সিদ্দিক, নিউইয়র্ক প্রবাসী লেখক