মুস্তফা হাবীব
স্রষ্টার আঠারো হাজার মাখলুকাতের মধ্যে মানুষই শ্রেষ্ঠ। মানুষের সুখ সমৃদ্ধির জন্য যতো উপাদান প্রয়োজন তার সবটাই অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে বিদ্যমান এবং মানুষের অধীন। মানুষ আকৃতিগতভাবে দুশ্রেণীতে বিভক্ত,পুরুষ ও নারী। পুরুষ নারীর মহাসম্মিলনেই পৃথিবী এতো সুন্দর! পৃথিবীতে এতো মানুষ! একজনের সঙ্গে অন্যজনের রূপের হুবহু কোনো মিল খুঁজে পাওয়া না। স্রষ্টার নির্মাণশৈলী অপার ও অনন্ত। নারীর রূপে পুরুষ মুগ্ধ আবার পুরুষের রূপে নারী মুগ্ধ যা বলাই বাহুল্য। তবু বলছি, কোনো কোনো নারীকে স্রষ্টা এমন রূপমাধুর্ষ দান করে পৃথিবীতে পাঠান যা অবলোকন করে অতিমাত্রায় রূপপাগল পুরুষমানুষ ভেবে ভেবে বিনিদ্র রজনী পাড় করেন অসংকোচে।
এখানে আলোচনার প্রতিপাদ্য বিষয় ‘সংসার জীবনে নারীরূপের বৈচিত্র্য। সম্পর্ক বিবেচনায় নারী কারো মেয়ে, কারো স্ত্রী, কারো বোন, কারো মা এবং কারো প্রেমিকা। বিবাহপূর্ব নারী ও পুরুষের বিলাসী ভাবনা, নান্দনিক চিন্তা ও স্বপ্নদর্শন এক একজনের এক একরকম। সংসার জীবনে প্রবেশ করার পর রূপ পাল্টায় নানা কারণে। অনেকেই বিরূপ পরিবেশ, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং অনাকাক্সিক্ষত বাধা বিপত্তিতে পূর্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারে না।
সংসার মানেই বিবাহ পরবর্তী জীবনে নানা চাহিদা পূরণে বহুমাত্রিক ক্রীড়া সম্পাদনের মাধ্যমে নারী পুরুষের একত্রে বসবাস। একই সংসারের অঙ্গীভূত অপরাপর যারা বসবাস করেন তাদের আচার আচরণ আবর্তিত হচ্ছে সম্পর্কের মাপকাঠিতে। সর্বক্ষেত্রেই তাদের আলাদা ভাবমূর্তি প্রতিভাত হয়ে আসছে আদিকাল থেকে বর্তমান।
সে যা হোক এখানে নারীর রূপ নিয়ে কথা। সংসারে নারীর রূপের ধারা ঋতু বৈচিত্রের তাল লয় মেনে নদীর মতো বহমান। নারীর রূপরহস্য নিয়ে কবি, সাহিত্যিক দার্শনিক, মনোবিজ্ঞানী, গবেষক নানা ব্যঞ্জনায় আপন অভিমত ব্যক্ত করে আসছেন যুগে যুগে। অভিমত ব্যক্ত করেছেন নারীর স্বভাব নিয়েও। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন কবিকূল। এমন কোনো কবি আছেন বা ছিলেন কিনা যিনি নারী রূপ অঙ্গসৌষ্ঠব নিয়ে কবিতা লিখেননি তা আমার জানা নেই। এখানে আমার রচিত বহুল প্রচারিত ‘নিসর্গ রমণী’ কবিতাটি সন্নিবেশ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। তাই ——
‘দোপাট্টার শাসন না মানা যুগল পদ্মকোরক সুষমা অবয়ব,
দেখে নেচে উঠি পুলকানন্দে – হৃদয়ের বাঁকে তাজা অনুভব।
রূপঝর বাংলার গোলাপ বরণী কন্যা আমার কাক্সিক্ষত চারুলতা
বাঁকপ্রতিম সব মোমের নির্মাণ, অধর ফেটে ঝরে শুভ্রকথা।
পদ্মশ্রী হাত চুল তার মেঘের পালক পিঠ বেয়ে মৃত্তিকামুখি,
দেবদারু হিজল তমাল বনে হেঁটে যায় একা যেনো চিরসুখি।
হরিয়াল শালিক চেয়ে থাকে অপলক, চোখ বুঝি অশান্ত সাগর,
অনন্ত ভাবনায় ডুবুডুবু আমি, চারু কেমন করে এমন হয়েছে ডাগর!
দখিনা বায়ুর আদর পেয়ে উড়ছে তার খোঁপাভাঙা চুল,
খসে যায় বুটিদার শাড়ির আঁচল, দেখি যুগল হলুদাভ ফুল।
বলল চারুলতা, যদি থাকে গোলাপ পাথরে আজন্ম মিল,
নিসর্গের আলপনা মেখে দুজন হবো জোড়া শঙ্খচিল। ‘
নারী সংসারে প্রবেশ করার আগে অহংকারী মনোভাব ও রূপের বড়াই প্রদর্শন করতে দ্বিধাহীন। ভাব-ভঙ্গিমা এমন, তাকে নাগালের মধ্যে পাওয়া দুঃসাধ্য ব্যাপার। যেনো সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপাড়ে তাদের অবস্থান। আকাশ ছোঁয়া মনোভাব, চালচলনে আভিজাত্যের রঙ – দ্যোতনা মূর্তমান। তবে যার শরীরের রঙ, গঠন আকৃতি মোহনীয় নয় এবং যিনি নিজে তা উপলব্ধি করতে পারেন তার আচার আচরণ সাবলীল, ব্যবহার কোমল ও আকর্ষণীয়। আবার ব্যতিক্রমধর্মী স্বভাবের এমন নারীও আছেন যারা অতিসুন্দরী হয়েও বংশমর্যাদা অক্ষুণœ রেখে সব শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে স্বাভাবিকভাবে মিশতে সচেষ্ট। সমাজে এই শ্রেণীর নারীদের কদর বেশী।
নারীর স্বভাব, আত্মগৌরবের নানাদিক বিচার্য আমার কাজ নয়। নারীর নেতিবাচক কোনো ভূমিকা নিয়েও কথা বলতে চাচ্ছি না। খামোখা বিরাগভাজন হয়ে লাভ ই বা কি! ঋতুভেদে বৃক্ষের রূপের যেমন তারতম্য ঘটে দৈনন্দিন জীবনে নারীর রূপেরও তেমনি তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। শীতে বৃক্ষের পাতাঝরা অবয়ব, বসন্তে সবুজ পাতায় ছাওয়া অবয়ব এবং বর্ষায় বৃষ্টিভেজা বৃক্ষের অবয়বের মতো নারীর রূপ পাল্টায় ।
আমি সংসার জীবনে নারীর নানা কাজের সঙ্গে রূপের যে তারতম্য ঘটে তা আপন দৃষ্টি দিয়ে দেখার চেষ্টা করব মাত্র। এ ক্ষেত্রে চারটি পর্ব বিবেচনা করা যায় :
১ . ঘুম থেকে ওঠার পরের রূপ ২. রান্নাঘরে অবস্থানকালীন রূপ। ৩. স্নান করার পরের রূপ ও ৪. বাইরে কেনাকাটা বা ভ্রমনকালীন রূপ।
ঘুম থেকে ওঠার পরের রূপ :
সারাদিনের কর্মচঞ্চল প্রহর শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে সব মানুষ ঘুমিয়ে পড়ে। নির্বিঘœ ঘুম শেষে ভোরবেলা যখন জেগে ওঠে তখন প্রত্যেককেই সজীব সতেজ মনে হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে নারীর রূপে দেখা যায় অপূর্ব পরিবর্তন। শান্ত-শুভ্র মুখোবয়ব, কণ্ঠে থাকে না কর্কশ শব্দাবলি। ভাসা ভাসা মুখোম-লে নেমে আসে প্রশান্ত আবহ। শুধু মুগ্ধতা ছড়ায়। প্রভাতে নারীর এ রূপ হয়তো সবার দৃষ্টিগোচর হয় না। একমাত্র সৌন্দর্যপিয়াসী নিসর্গভেদী পুরুষদের চোখেই এই পরিবর্তিত রূপের দোলা ধরা পড়ে।
রান্নাঘর থেকে বের হবার পরের রূপ :
দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যেক নারী সংসারের নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। প্রথমমতঃ ছোট ছেলেমেদের পরিচর্যা, হাতমুখ ধোয়ানো, প্রাতঃরাশ শেষে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নাস্তার আয়োজন করা, বাসাবাড়ি ঝাড়পোছ করা এবং মধ্যাহ্নভোজের জন্য প্রয়োজনীয়খাবার প্রস্তুত করার যাবতীয় কর্ম নারীকেই করতে হয়। শুধু উচ্চবিত্ত দাবীদার নারীকে এ হেন কাজ তেমন করতে হয় না। তারা অধিকাংশই হোটেলের খাবার খেতে অভ্যস্ত। ফরমায়েশ মাফিক হোটেল থেকে সরবরাহ করা খাবার খায়। আবার নি¤œবিত্তদের সংসারজ্বালা আরো বেশী তীব্র। প্রতিদিনকার রান্না করার জ্বালানী বন থেকে সংগ্রহ করাও কাজের অংশ। এসব কাজও নারীরাই করে থাকে। এখানে মধ্যবিত্ত সংসারের নারীদের নিয়ে কথা বলাকে শ্রেয় মনে করছি।
দুপুর বেলা যখন রান্না থেকে বের হয় তখন যে রূপের অবতারণা তা দৃষ্টিনন্দন নয়। শাড়িতে জড়ায় ময়লা, শরীরের বিভিন্ন অংশ কালোধুয়ার আবরণে মাখামাখি। তখন নারীর কর্মক্লান্ত মলিন মুখোবয়ব দেখে শুধু করুণার উদ্রেক করে। লাবন্যহীন শ্রী দেখে কারো মনে শিহরণ জাগে না।
স্নান শেষে নারীর রূপ
রান্নাঘর থেকে বেরুবার পর যতোই শ্রান্ত- ক্লান্ত মনে হোক না কেনো তা সাময়িক। স্বাভাবিকভাবেই নারী দুপুরে স্নান করে থাকে। সাধারণতঃ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নারীর রূপ পরিচর্যার সুযোগ থাকে না। এ সময়টাতেই নারী সংসারের সঙ ধারণ করে তার কর্মনৈপূণ্য প্রদর্শন করতে সচেষ্ট হন।
যাহোক দুপুরে স্নানপর্ব শেষ করে নারী যখন ভাঁজকরা শাড়ি বা সেলোয়ার কামিজ পরিধান করেন, গামছায় চুল ঝেড়ে চিরুনি দিয়ে বিন্যস্ত করেন তখন তাকে আর শ্রান্ত-ক্লান্ত মনে হয় না। মুখোমন্ডলে ভিড় করে সজীবতা, সারুল্য। দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষে বিছানায় গড়াগড়ি যাওয়া অনেক নারীর অভ্যাস। বিকেলে তাকে দেখে আর বুঝার অবকাশ থাকে না তিনি কতটা সাংসারিক!
বৈকালিক ভ্রমণে নারীর রূপঃ
ভ্রমণবিলাসী নারী কখনও অবসর সময়ে চার দেয়ালে বন্দী থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। যারা অঢেল টাকার মালিক, নিজস্ব গাড়ি রয়েছে তারা দূরে কোথাও ঘুরতে বের হন, আবার যাদের সামর্থ্য নেই দূরে যাবার তারা বাড়ির কাছাকাছি বাজার, নদী, পার্কসদৃশ সবুজ মাঠে বেড়াতে যান। বাড়ি থেকে বেরুবার আগে সাজ করেন। কপালে লাল টিপ, ঠোঁটে লিপিষ্টিক, মুখোবয়বে পাউডার এবং শরীরে পারফিউম মাখেন। শাড়ির রঙের সঙ্গে মিলিয়ে ব্লাউজ, জুতা পরেন। যেসব নারীর গায়ের রঙ ফর্সা তারা মুহূর্তেই হয়ে ওঠেন আরো রূপসী। পড়ন্তবেলায় ঘর থেকে যখন বের হন তখন পশ্চিমে হেলেপড়া সূর্যের আলোয় ঝিকমিক করে শরীর।
কথিত আছে যে নারীরূপে মুগ্ধ হয়ে ইংল্যান্ডের রাজা অষ্টম এ্যাডওয়ার্ড রাজত্ব ছাড়েন। নারীর জন্যই লঙ্কা পুড়ে ছাড়খার হয়ে যায়। নারী ছাড়া সংসার হয়না। যে পরিবারে রূপসী নারীর উপস্থিতি নেই সেই সংসার খাঁ খাঁ জলশূণ্য ধুসর মরুভূমি।
মুস্তফা হাবীব, কবি