বাবুল সিদ্দিক:
অস্থিরভাবে পায়চারী করছিলেন রাজা। বড্ড হতাশ লাগছে তার। মানুষই যদি বিরোধিতা করে তা হলে তিনি লড়বেন কাদের নিয়ে ? ধুস্, আর লড়াই করে লাভ নাই।
এমন সময় দারোয়ান এসে বলল, ‘একজন গেঁয়ো ব্রাহ্মণ দেখা করতে চাইছে।’ একটু বিরক্ত হয়ে তিনি বললেন, ‘এখন আমার সময় নাই বলে দে।’ দারোয়ান বলল, ‘কিন্তু উনি কিছুতেই দেখা না করে যেতে চাইছেন না। ‘ রাজা বললেন, ‘ পাঠিয়ে দে।’
এক ব্রাহ্মণ ঘরে ঢুকলো, খাটো ধুতি, গায় নামাবলি, মাথায় টিকি। টিকি দেখলেই রাজার মাথা গরম হয়ে যায়। রুক্ষ কন্ঠে বললেন, ‘কি চাই ? ‘ ব্রাহ্মণ বলতে শুরু করলেন,
‘আমি নদিয়ার মহাদেব ভট্টাচার্য।’ একটু থামলেন। বোধহয় গুছিয়ে নিলেন একটু। আবার শুরু করলেন, ‘জানেন সেদিন বৈশাখ মাস। টোল থেকে ফিরতেই অপর্না এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো কোলে। জল দিলো, গামছা দিলো, বাতাস দিল পাখা দিয়ে। আমার জন্য তার যত চিন্তা। বাপে-মেয়ে আদর খাচ্ছি। তখন ওর মা ডাকলো ঘর থেকে। ভেতরে যেতে বলল, ‘মেয়ের তো সাত বৎসর বয়স হলো, আর কতদিন ঘরে বসিয়ে রাখবে। পাড়ায় যে কান পাতা যায় না।’ আমি বললাম, ‘পাত্র পাচ্ছি কই? যার কাছে যাই ১০০০ টাকার কমে নেবে না কেউ।’ মন্দিরা ফিস ফিস করে বলল, ‘ সবার কপাল তো সমান হয় না। কিন্তু জাত-ধর্ম তো রাখতে হবে। কাল নদী পথে একজন কুলীন ব্রাহ্মণ এসেছেন। বয়সটা একটু বেশী। ৭০ এর ঘরে হবে। কিন্তু উঁচু বংশ । ৫০ টাকায় কন্যা উদ্ধার করেন তিনি। অপুকে ওর হাতে গৌরি দান কর।’ আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, না, না, এ হবে না।‘ কিন্তু সমাজের চাপ তো বুঝি, বুঝি সংসারের চাপও। নিজের সঙ্গে অনেক লড়াই করে অপুকে বিবাহ দিলাম বুড়ো ব্রাহ্মনের সঙ্গে। লাল চেরি, গয়না, আলতা, সিঁদুরে মেয়েকে দেবীর মত লাগছিল ! সে কি রূপ, কি আর বলব !
পরদিন মেয়েকে ছেড়ে জামাই বাবাজী আবার পাড়ি জমালেন নদীপথে আন্য কারোর কন্যা উদ্ধার করতে। বলে গেলেন, আবার আসবেন পরের বছর।
আমাদের বাপ-মেয়ের আনন্দের জীবন চলছিল বেশ। সারাক্ষণ আমার পিছনে পিছনে। সকল কাজ শিখে গেলো। পারত না শুধু রান্না করতে। একদিন হাতে ফোস্কা পরে কি অবস্হা ! আমি ওর মাকে বলে দিলাম, ওকে রান্নার কাজে লাগাবে না। আগুনে ওর কস্ট হয়। কি খুশি সেদিন মেয়ে। আমাকে জড়িয়ে ধরে কত আদর।
আশ্বিন মাস গড়িয়ে যায়। পুজো আসছে। চারিদিকে সাজো সাজো রব। আমি হাট থেকে মেয়ের জন্য লাল টুকটুকে শাড়ি, আলতা, এসব নিয়ে এলাম। মেয়ে খুব খুশি। বলল, এখন সে পড়বে এসব।
“বাবা, আমাকে রানীর মত লাগবে, বলো ?” আনন্দে আমার চোখ ভিজে উঠলো। অভাবি সংসারে সুখ উপচে পড়লো।
ঠিক তার পরের দিন, জানেন ঠিক পরের দিন, সকাল দশটা হবে। মেয়ের শ্বশুর বাড়ি থেকে লোক এলো পত্র নিয়ে, গতকাল নারায়ন বন্দ্যোপাধ্যায় দেহ রেখেছেন। যথাবিহিত বিধি অনুসারে কন্যাকে সতী করার নির্দেশ দিয়েছেন। ভেবেছিলাম পত্র ছিঁড়ে ফেলবো। কিন্তু পত্র বাহক গ্রামের মোড়লদের জানিয়ে এসেছে আমার বাড়িতে। কোন উপায় ছিল না।
রাজা বলে উঠলেন, “তারপর ?”
তারপর মেয়েকে সাজালাম , নতুন লাল শাড়ি, গয়না, আলতা, সিঁদুরে মেয়ে সেদিন অপরূপা। গ্রামে উৎসব, ঢাক বাজছে। এ ও এসে সবাই ওর মাথায় সিঁদুর, পায়ে আলতা দিচ্ছে। আর মেয়ে নিজে কি খুশি সেজেগুজে। ওর পছন্দের দধি, মিষ্টি এসেছে ঘরে। জানেন তার মধ্যেও সে সেসব আমাকে খাওয়াবে বলে ব্যাস্ত। কথা বন্ধ হয়ে আসছে ব্রাহ্মনের। চোখ মুছে আবার শুরু করলেন, ‘খালি সে বুঝতে পারে নি, উৎসবটা কিসের ? ‘
এরপর খবর এলো। নদীর তীরে চিতা সাজানো সমাপ্ত। সতিমাতাকে নিয়ে যাবার নির্দেশ দিলেন কুলীন সমাজ। মেয়েকে কোলে নিয়ে চললাম। কাঁদিনি একটুও। ওকে বুঝতে দিতে চাই নি কিছুই। চিতার পাশে সমস্ত আনুষ্ঠানিক কাজ মিটলো। মেয়ে অবাক হয়ে দেখছিল সব।আগুন দেওয়া হলো চিতায়। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো চিতা। মেয়ে বলল, “বাবা, বাড়ি চলো, আগুনে আমার বড় ভয়।”
আমি বললাম, “ আমার গলাটা একটু ছাড়, মা।”
কচি হাতদুটো গলাটা ছাড়তেই ছুঁড়ে দিলাম অগ্নিকুন্ডে। আগুনের মধ্যথেকে একটা রিনরিনে গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “ বা- – -বা- – – আ- – – আ- – – আ- -”
সেই ডাক আমি ভুলতে পারি নি।তারপর থেকে একদিনও রাতে ঘুম হয় নি। উঠতে, বসতে খেতে, শুতে শুধু একই আওয়াজ শুনি “বা- – -বা – আ- – – আ- – – আ- – – “
‘আমি পারি নাই তাকে বাঁচাতে। আপনি পারেন। পয়ে ধরি আপনার, মেয়েগুলোকে বাঁচান। কত মেয়ে ঘরে আপনার মুখ চেয়ে আছে। আমরা মেয়ের বাপ-ময়েরা বলতে পারি না সমাজের ভয়ে কিন্তু আপনি পারবেন।’
উঠে দাঁড়ালেন রাজা রামমোহন রায়। বললেন, “ আমায় আপনি শক্তি দিলেন। পারতে আমাকে হবেই। এখানে না হলে ব্রিটেনে যাব। প্রিভি কাউন্সিলে দরবার করবো। কথা দিলাম আপনাকে।”
বাকীটা ইতিহাস। সেই যুগে দাঁড়িয়ে আর সেই লড়াই কতটা কঠিন ছিল তা বোঝানো যাবে না। কলকাতার রাজ পরিবার থেকে ভারতের পন্ডিত সমাজ সকলেই ছিল তার বিরূদ্ধে। কম নিন্দা আর অপমানের ঝড় বয়নি তার উপর দিয়ে। কিন্তু বটবৃক্ষের মত অটুট ছিলেন তিনি।
রামমোহন রায় যিনি সচারাচর রাজা রামমোহন রায় বলে পরিচিত (জন্ম ২২ মে, ১৭৭২Ñমৃত্যু ২৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৩৩) বাংলার নবজাগরণের অগ্রদূত। তিনি প্রথম ভারতীয় যিনি ধর্মীয়, সামাজিক পূনর্গঠন আন্দোলন ব্রাহ্মসমাজ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।তিনি একজন বাঙালী দার্শনিক। তৎকালীন রাজনীতি, জনপ্রশাসন, ধর্ম এবং শিক্ষা ক্ষেত্রে তিনি উল্লেখযোগ্য প্রভাব রাখতে পেরেছিলেন।তিনি সবচেয়ে বেশী বিখ্যাত হয়েছিলেন সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করার প্রচেষ্টার জন্য। ভারতে দীর্ঘদিন যাবত নারীদের স্বামীর চিতায় সহমরণে যেতে বা আত্মহুতি দিতে বাধ্য করা হতো।
রাজা রামমোহন রায় একেশ্বরবাদে বিশ্বাস করতেন। তিনি হিন্দু ধর্মালম্বীদের মূর্তি পুজার বিরোধী ছিলেন। এই বিশ্বাস থেকে তিনি ব্রাহ্মসমাজ ও ব্রাহ্মণ ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি হিন্দু ধর্মালম্বীদের আচরনীয় ধর্মীয় আচার অনুস্ঠান মানতেন না ও তা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতেন। তিনি মনে করতেন, এ সকল ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। রামমোহন রায় বেদের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে তার বক্তব্য প্রমান করেন।
জন্ম, বেড়ে ওঠা ও কর্মময় জীবন: ১৭৭২ সালের ২২ মে রাজা রামমোহন হুগলী জেলার রাঁধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রপিতামহ কৃষ্ণকান্ত সম্রাট ফারুখ শিয়রের আমলে বাংলার সুবেদারের আমিনের কাজ করতেন। কৃষ্ণকান্তের কনিষ্ঠ পুত্র ব্রজবিনোদ রামমোহনের পিতামহ। তার পিতার নাম রামকান্ত।
পনেরো ষোল বৎসর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থান ভ্রমন করেন। কাশিতে ও পাটনায় কিছুকাল অবস্থান করেন। এছাড়াও তিনি নেপালে গিয়েছিলেন। সুপ-িত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের সহযোগীতায় রামমোহন সংস্কৃত ভাষায় পান্ডত্য লাভ করেন। বারানসী থেকে প্রথাগত সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষা শেখেন। পরে তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষা শেখেন।
তরুন বয়সে তিনি কোলকাতায় মহাজনের গদিতে কাজ করতেন। ১৮০৩ থেকে ১৮১৪ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী ছিলেন। ১৮১৫ সাল থেকে রামমোহন কোলকাতার স্থায়ী বাসিন্দা হন। এখান থেকেই তার সংস্কার কাজ শুরু হয়।
বেদান্ত-উপনিষদগুলি বের করার সময়ই তিনি সতীদাহ অশাস্ত্রীয় এবং নীতিবর্হিভুত প্রমাণ করে পুস্তক লেখলেন ‘প্রবর্তক ও নিবর্তকের সম্বাদ ‘প্রতিবাদে পুস্তিকা বের হয় ‘বিধায়ক নিষেধের সম্বাদ ‘তার প্রতিবাদে দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুস্তিকা বের হয়।
সতীদাহ প্রথা কি ?
তৎকালীন ভারতবর্ষে হিন্দু ধর্মীয় বিভিন্ন কুসংস্কারের মধ্যে একটি প্রধান এবং ভয়ঙ্কর প্রথা ছিল সতীদাহ প্রথা। এই প্রথাটি ছিল খুবই অমানবিক এবং নির্মম একটি রীতি। এই প্রথা বা রীতির বৈশিস্ট ছিল, কোন ব্যাক্তি যদি তার স্ত্রীর পুর্বে মৃত্যুবরণ করেন তবে তার পতœীকে স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় সেচ্ছায় আত্মহুতি দিতে হত। স্বাভাবিকভাবে এমন মৃত্যু কোন মানুষ মানতে চায় না তাই তাদেরকে বেঁধেছ জোরপূর্বক চিতায় নিক্ষেপ করা হত।
রাজা রামমোহন রায় এই জঘন্য প্রথার বিরূদ্ধে সঙ্গবদ্ধ ঐক্য গড়ে তোলেন এবং তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকদের দৃস্টি আকর্ষণ করেন। তার তৎপরতা ও প্রচারের ফলে ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ পারলামেন্টে সতীদাহ প্রথা রদ করে আইন পাস হয়।
রাজা রামমোহন রায়ের জন্যই লক্ষ লক্ষ নারীর জীবন বেঁচে যায়। পরবর্তীকালে গোঁড়া ব্রাহ্মণদের চাপে এই আইনটি পরিবর্তনের চেস্টা করা হলেও ব্রিটিশ মহলে রামমোহনের জনপ্রিয়তার কারণে সেটা সম্ভব হয় নাই। গোঁডা হিন্দুদের অপচেষ্টায় বাঁধা দেয়ার জন্য বিলেত যেতে প্রস্তুত হলেন রামমোহন। এ ব্যাপারে তাকে আর্থিক সহায়তা দান করেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। মোঘল সম্রাট ২য় আকবর তার দাবী ব্রিটিশ সরকারের কাছে পেশ করার জন্য তিনি রামমোহনকে ‘ রাজা ‘ উপাধি দিয়ে বিলেত পাঠান।
১৮৩০ সালে ১৯ নভেম্বর রাজা রামমোহন কোলকাতা থেকে বিলেত যাত্রা করেন। ১৮৩১ সালের ৮ এপ্রিল রামমোহন লিভারপুলে পৌছান। তিনি ব্রিটিশ ‘ প্রিভি কাউন্সিলে ‘ সতীদাহ প্রথার বিরূদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষন দেন যার ফলে ভারতের গোঁডা ব্রাম্মনবাদী হিন্দুদের সতীদাহ প্রথা পূন:প্রবর্তনের সকল অপচেষ্টায় ব্যর্থ হয়।
১৮৩২ সালের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন। সেখানে ফরাসি সম্রাট লুই ফিলিপ কতৃক সংবর্ধিত হন। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলে বসবাস করতে থাকেন। ১৮৩৩ সালে মেনিনজাইটিস্ রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ৮ দিনের জ্বরে ভুগে ২৭ সেপ্টেম্বর ৬১ বৎসর বয়সে ইংল্যান্ডের ব্রিস্টলেই তার মৃত্যু হয় এবং সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়।
বাবুল সিদ্দিক, নিউইর্য়ক প্রবাসী লেখক