ড. নূর সালমা জুলি
সে-যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাকো, নারীরা আছিল দাসী!
বেদনার যুগ, মানুুষের যুগ, সাম্যের যুগ আজি,
কেহ রহিবে না বন্দী কাহারও, উঠিছে ডঙ্কা বাজি।
– (কাজী নজরুল ইসলাম)
কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না, বরং নারী হয়ে ওঠে। সমাজে যেভাবে দেখা দেয় স্ত্রীলিঙ্গ মানুষ কোনো জৈবিক, মনস্তাত্ত্বিক, বা আর্থনীতিক নিয়তি তার রূপ নির্ধারণ করে না; সার্বিকভাবে সভ্যতাই উৎপাদন করে পুরুষ ও খোজার মাঝামাঝি এ-প্রাণীটি, যাকে বলা হয় নারী। শুধু অন্য কারো হস্তক্ষেপই একটি মানুষকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে অপর-রূপে।
একদিক থেকে বিবেচনা করলে সিমোন দ্য বোভেয়ার (১৯০৮-১৯৮৬)এর বলা এই কথাগুলো এক চিরন্তন সত্য। নারীকে পুরুষতন্ত্র ‘অপর’ করে রেখেছে, নিজেদের বহুমুখী সুবিধার কারণে। এই ব্যাপারটিকে সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন তিনি তাঁর Second Sex(1949) গ্রন্থে। এই ফরাসি ঔপন্যাসিক, দার্শনিক, নারীবাদী ও সমাজতাত্ত্বিকের ফরাসি ভাষায় লেখা ল্য দ্যজিয়েম সেক্স দুই খ-ের বইটি প্রায় ১০০০ পৃষ্ঠার। এটির নির্বাচিত অংশ দ্বিতীয় লিঙ্গ নামে অনুবাদ করেন বহুপ্রজ লেখক হুমায়ুন আজাদ। অনূদিত গ্রন্থটির ফ্ল্যাপে বলা হয় :
নারীবাদের জননী মেরি ওলস্টোনক্র্যাফ্ট্ ছিলেন নারীমুক্তির জোয়ান অফ আর্ক, আর সিমোন দ্য বোভেয়ার নারীবাদের আইনস্টাইন। সভ্যতাব্যাপী নারীর পরিস্থিতি সম্পর্কে এমন অসাধারণ গ্রন্থ আর লেখা হয় নি, সম্ভাবনাও নেই, অদ্বিতীয় এ-গ্রন্থ; প্রজ্ঞা ও শিল্পী তার অনন্য নিদর্শন দ্য বোভেয়ারের দ্বিতীয় লিঙ্গ, যার পাতা থেকে বেরিয়ে এসেছে বিশ শতকের দ্বিতীয়াংশের নারীবাদ, এবং পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতাকে বদলে দিয়েছে নানাভাবে।
এখানেই বইটির গুরুত্ব। ইতিহাস অনুসন্ধান, দার্শনিকদের মন্তব্য, সাহিত্যের চরিত্র, পুরাণের আখ্যান-এ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন বোভেয়ার। নারীর জন্ম, বেড়ে ওঠা, সভ্যতার বিকাশে তার ভূমিকা, পুরুষতন্ত্রের দৃষ্টিভঙ্গি এগুলোর পাশাপাশি লেখক নারীর শারীরবৃত্তীর ব্যাপারগুলো সামনে এনেছেন সঙ্গে তার মানসিক গঠনের দিকটিকেও আলোচনায় জায়গা দিয়েছেন। পুরুষের নারীকেন্দ্রিক ভাবনাগুলোর খন্ডিত বিষয়গুলো সামনে এনে লেখক বলেন :
সে [পুরুষ] নিজের শরীরের কথা ভাবে পৃথিবীর সাথে এক প্রত্যক্ষ ও স্বাভাবিক সম্পর্ক পাতিয়ে রেখে, এবং মনে করে যে এটা সে অনুধাবন করছে বস্তুগতভাবে; আর সে নারীর শরীরকে মনে করে একটি প্রতিবন্ধকতা, একটি কারাগার। ‘নারী বিশেষ কিছু গুণাবলির অভাবেই নারী’, বলেছেন আরিস্ততল, ‘আমরা মনে করবো যে নারীপ্রকৃতি প্রাকৃতিকভাবেই ত্রুটিগ্রস্ত।’ সেইন্ট টমাস ঘোষণা করেছেন নারী হচ্ছে ‘বিকৃত পুরুষ’, একটি ‘আকস্মিক’ সত্তা। এটাই প্রতীকিত হয়েছে আদিপুস্তক-এ; বোসোর মতে যেখানে হাওয়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে আদমের ‘একটি সংখ্যাতিরিক্ত অস্থি’ থেকে।
এভাবে মানবজাতি হচ্ছে পুরুষ এবং পুরুষেরা নারীকে নারী হিশেবে সংজ্ঞায়িত করে না, করে পুরুষের সাথে তুলনা ক’রে; নারীকে গণ্য করা হয় না কোনো স্বায়ত্তশাসিত সত্তা রূপে। মিশেলে লিখেছেন : ‘নারী, আপেক্ষিক সত্তা…।’ . . . পুরুষের কাছে নারী লিঙ্গ, চরম লিঙ্গ, তার কম নয়। পুরুষের সাথে তুলনা ক’রে তাকে সংজ্ঞায়িত ও পৃথক করা হয়, নারীর সাথে তুলনা ক’রে পুরুষকে সংজ্ঞায়িত করা হয় না। নারী হচ্ছে আকস্মিক, অপ্রয়োজনীয়, যেখানে পুরুষ হচ্ছে প্রয়োজনীয়। পুরুষ হচ্ছে কর্তা, পুরুষ হচ্ছে পরম-নারী হচ্ছে অপর।
এভাবে সৃষ্টির আদিকাল থেকে নারীকে আলাদা করে, ছোটো করে, অপ্রয়োজনীয় করে ভাবা শুরু হয়েছে। সভ্যতার ক্রমবিকাশ এই ভাবনাকে সে অর্থে পরিবর্তন করতে পারেনি। গৃহের মধ্যে আবদ্ধ রেখে নারীকে সংবেদনশীল আর ধৈর্যশীল হওয়ার শিক্ষা দিয়ে তার বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের পথকে রুদ্ধ করে দিয়েছে কৌশলে পুরুষতন্ত্র। ফলে স্বাভাবিকভাবেই নারী পিছিয়ে পড়েছে সমাজের মূল ধারা থেকে। যারা বের হয়ে আসার চেষ্টা করেছে এখান থেকে অর্থাৎ নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে জায়গা করে নিতে চেয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানের রাজ্যে তাদের বিভিন্ন কৌশলে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্লেটোর মতো দার্শনিকও নিজেকে নারী নয় পুরুষরূপে সৃষ্টির জন্য দেবতার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সমাজ এমন ব্যক্তিদের দেখানো পথেই তো হেঁটে চলেছে। বারবার পুরুষতন্ত্র নারীর জন্য কাঠামো তথা ছক তৈরি করেছে তাকে দ্বিতীয় শ্রেণির প্রাণী বানিয়ে রাখার জন্য। সর্বহারাদের সঙ্গে নারীদের একটা মিল রয়েছে। কিন্তু নারী সেই সর্বহারা ও শ্রমজীবী শ্রেণির মধ্যেও ‘অপর’। সেখানেও তাকে নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কেননা ওরাও নারীকে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবে। বোভেয়ার জীববিদ্যা, মনোবিজ্ঞান ও ঐতিহাসিক বস্তবাদে নারীকে যেভাবে দেখা হয় সেটা তাঁর আলোচনায় এনেছেন। নারীকে সমাজ কীভাবে ত্রুটিযুক্ত মানবসত্তা হিসেবে চিহ্নিত করতে সদা তৎপর এমন বিষয়েও আলো ফেলেছেন লেখক।
এখানে একটি বিষয়ের অবতারণা করা যায়-সমাজ হচ্ছে একধরনের শোষণ করায় বৈধ সংগঠন। এখানে স্বস্তি, শান্তি আর নিরাপত্তার নামে চলে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের মনমানি। যারা বিদ্যায়, বুদ্ধিতে ও কৌশলে আর বাকিদের চেয়ে এগিয়ে। এরাই কাঠামো নির্ধারণ করে। অতি সূক্ষ্ম এবং চতুরতায় পূর্ণ এই ছকে মানুষ নিজেদের ভাবতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মূলত রাজনীতির ক্ষেত্রে যে আদর্শিকতাকে সামনে রাখা হয়, সেটাও বলা যায় একধরনের শোষণের প্রক্রিয়া। এখান থেকে এটাই প্রমাণিত হয় পৃথিবীতে শক্তিশালী আর বুদ্ধিমানেরাই জয়ী হয়ে আসছে। সেখানে কম বুদ্ধির পুরুষরাও এক অর্থে পরাজিত। আর নারীর কথা তো বলাই বাহুল্য। পুরুষতন্ত্র সবসময় নিজেদের দৃঢ় অবস্থানকে ধরে রাখতে তৎপর। নারী সেখানে পুরুষের আয়েশের সঙ্গী আর বংশধর সৃষ্টির জন্য একটা হাতিয়ার বিশেষ। লেখক বলছেন :
পিতৃতান্ত্রিক সংস্থাগুলোর উদ্ভবের সাথে পুরুষ ব্যগ্রভাবে দাবি জানায়ে থাকে বংশধরদের ওপর। জন্মদানে মায়ের একটি ভূমিকা স্বীকার ক’রে নেয়াও দরকার হয়, তবে এটুকু স্বীকার ক’রে নেয়া হয় যে সে শুধু ধারণ ও লালন করে একলা পিতার দ্বারা সৃষ্ট সজীব বীজটিকে। আরিস্ততল মনে করতেন ভ্রƒণ উদ্ভূত হয় শুক্রাণু ও ঋতু¯্রাবের রক্তের মিলনে, যাতে নারী সরবরাহ করে অপ্রিয় বস্তু, আর পুরুষ দান করে শক্তি, সক্রিয়তা, গতি, জীবন। হিপ্পোক্রাতিস পোষণ করতেন একই রকম ধারণা; তাঁর মতে বীজ দু-ধরনের, দুর্বল বা নারীধর্মী, সবল বা পুরুষধর্মী।
এই বিষয়গুলো মানুষ আধুনিককাল পর্যন্ত বিশ^াস করেছে। কিন্তু জিনতত্ত্ববিদ্যার জনক জোহান মেন্ডেল (১৮২২-১৮৮৪) দেখিয়েছেন ‘বংশানুক্রমে পিতা ও মাতার ভূমিকা সমান।’ এছাড়া নারী ও পুরুষের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে শারীরিক যে ব্যাপারগুলো রয়েছে সেগুলোতে নারীকে অনেক কঠিন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। নারীর সন্তানধারণ করার ক্ষেত্রেও যে জটিলতার সম্মুখীন হতে হয় পুরুষ তার কিছুই টের পায় না। নারীর শারীরিক গঠন মানসিক বিকাশেও প্রভাব বিস্তার করে। কিন্তু এসব বিষয় পুরুষরা কখনো ভাবে না। জীববিজ্ঞানের সূত্র থেকেই ক্ষান্ত হননি বোভেয়ার তিনি দেখাতে চেষ্টা করেছেন ‘আর্থনীতিক, সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক প্রতিবেশের আলোকে’ নারীকে কীভাবে ‘অপর’ করে রেখেছে পুরুষতন্ত্র।
পুরুষের শিশ্ন এক অর্থে মাংসের উত্থান। এটি যেমন পৌরুষকে নির্দেশ করে ঠিক তেমন তার সীমাহীন ক্ষমতাকেও। যদিও মনোবিশ্লেষকদের এই ধারণা খুব একটা যৌক্তিক নয়। ফ্রয়েড তাঁর পুরো বিশ্লেষণ পুরুষের ওপর করেছেন এবং নারীকে কেবল সেই ধারণার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন। এছাড়া পুংলিঙ্গের বিন্যাসের অনুকরণে নারীকে ব্যাখ্যা করে ‘ইলেক্ট্রাগূঢ়ৈষা’ তত্ত্ব দিয়েছেন। ফ্রয়েড যেভাবে বলেন মানুষের সব আচরণ যৌনতার ওপর নির্ভর করে অ্যাডলার অবশ্য তার বিরোধিতা করেন। তিনি বুদ্ধিমত্তার বিষয়টিকে সামনে আনেন। লিবিডো চেতনা নারী ও পুরুষ উভয়ের মধ্যেই প্রবল। তাই এক্ষেত্রে পুরুষের সুপিরিওরিটির ব্যাপারটি গৌণ হয়ে যায়। মনোবিশ্লেষকরা একারণে নারীকে যৌনসচেতনতার আলোকে ‘অপর’ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন। আসলে একটা বিশেষ মূল্যবোধের ওপর দাঁড়িয়ে নারীকে কূপম-ূক একটা ভাবনা থেকে বেড়ো উঠতে দেওয়া হয়। অবদমন তার চেতনাকে তার চিন্তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। যেখান থেকে সে নিজেকে অবরুদ্ধ ভাবতে থাকে ফলে একভাবে একটা অসম্পূর্ণতার ধারণা নিয়ে সে বড়ো হয়। বলা যায় আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সংগঠনের এটা একটা নেতিবাচক কৌশল নারীর ওপর কর্তৃত্ব করার।
ঐতিহাসিক বস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যদি নারীর বিষয়টি দেখা যায় সেখানে নারীকে নির্ভরশীল একটা প্রাণী হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। লৈঙ্গিক বা জৈবিক বৈশিষ্ট্য সে অর্থে নারীকে ‘অপর’ বানাতে না পারলেও ক্ষমতার দিক থেকে সেটা অনেকটা কার্যকর হয়েছে। সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানা, পরিবারের ধারণা ও নতুন হাতিয়ারের আবিষ্কার, নতুন শ্রমবিভাজন নারীকে গৃহবন্দি করতে উদ্বুদ্ধ করে। এঙ্গেলস্ বলেন, ‘তখনই শুধু নারীর মুক্তি ঘটতে পারে, যখন সে বৃহৎ সামাজিক মাত্রায় অংশ নিতে পারবে উৎপাদনে এবং গৃহস্থালির কাজে অংশ নেবে খুবই কম মাত্রায়। . . .’ বেবেলেরও ধারণা কেবল সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় প্রাচীন পুঁজিবাদী পিতৃসূলভ শাসনের প্রথা ভেঙে যাবে। তখন সমাজে ‘পুরুষ বা নারী থাকবে না, সবাই হবে সমান মর্যাদার শ্রমিক।’ যদিও বোভেয়ার ফ্রয়েডের যৌন অদ্বৈতবাদ ও এঙ্গেলস্-এর আর্থনীতিক অদ্বৈতবাদ প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি মনে করেন এগুলোর অতিরেক কিছু আছে। যাকে তিনি মানবজীবন বলছেন। যার সঙ্গে সবকিছু জড়িয়ে আছে। বোভেয়ারের ধারণার মধ্যে একটা অস্পষ্টতা লুকিয়ে আছে। তিনি সমস্যার গভীরে আলো ফেলতে চেষ্টা করেছেন কিন্তু সেটা অর্থাৎ ভেতরের ব্যাপারটি কতটা প্রত্যক্ষ করেছেন সেটা আলোচনার দাবি রাখে। নারীকে আবিষ্কারের বিভিন্ন প্রপঞ্চ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে প্রায় সবগুলোর মধ্যে অসম্পূর্ণতা লক্ষ করেন তিনি। এটা একটা অস্তিত্বের বিষয়। আর বোভেয়ার অস্তিত্ববাদী দর্শনের আলোকে ব্যাপারটি বিচারের চেষ্টা করেছেন। পুরুষের বিশ্ব এটা আজীবন-এই সত্য আজ সর্বজনস্বীকৃত। মানবজাতিবিদদের মানবসমাজসংক্রান্ত ধারণাগুলো বোভেয়ার বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন :
নারী যতোই শক্তিশালী হোক-না-কেনো বিরূপ বিশ্বের বিরুদ্ধে সংগ্রামে তার প্রজননের দাসত্ব ছিলো একটা ভয়ানক প্রতিবন্ধকতা। গর্ভধারণ, প্রসব, ও ঋতুস্রাব কমাতো তাদের কাজের সামর্থ্য এবং কখনো কখনো খাদ্য ও নিরাপত্তার জন্য তাদের ক’রে তুলতো সম্পূর্ণরূপে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল।
আদিম জীবন যেহেতু অনেক কঠিন ছিল সেহেতু পুরুষ সেখানে তার পেশিশক্তি ব্যবহার করে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছে। জীবনকে বিপন্ন করে গোষ্ঠীর জীবন রক্ষা করেছে। লেখক বলছেন, ‘জীবনকে সৃষ্টি ক’রে নয়, বরং বিপন্ন ক’রে পুরুষ উন্নীত হয় পশুর উদ্ধে [ঊদ্ধের্¦]; এ-কারণেই মানবম-লির মধ্যে সে-লিঙ্গকেই দেয়া হয়েছে শ্রেষ্ঠত্ব, যে-লিঙ্গ জন্ম দেয় না বরং হত্যা করে।’ এটাকেই পুরুষের আধিপত্যের রহস্যের চাবি বলেছেন লেখক। পুরুষ নিজের আধিপত্যকে একটা মূল্যবোধের পর্যায়ে নিয়ে গেছে যার বিপরীতে নারী তার কাজের জন্য অর্থাৎ সৃষ্টি করার ক্ষমতাকে কোনো মূল্যবোধের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেনি।
জীবনসংরক্ষণ পুরুষের জন্যে হয়েছে একটি সক্রিয় কর্ম এবং হাতিয়ার আবিষ্কারের মাধ্যমে একটি কর্ম পরিকল্পনা; কিন্তু মাতৃত্বের মধ্যে নারী, পশুর মতোই, দৃঢ়ভাবে বাঁধা রয়েছে তার দেহের সাথে। পুরুষ চেয়েছে কালপরম্পরায় নিজেকে শুধু পুনরাবৃত্ত না করতে : চেয়েছে বর্তমানকে নিয়ন্ত্রণ করতে এবং ভবিষ্যৎ গড়তে। পুরুষের কর্মকা- মূল্যবোধ সৃষ্টি করতে গিয়ে অস্তিত্বকেই একটি মূল্যবোধে পরিণত করেছে; এ-কর্মকা- আধিপত্য বিস্তার করেছে জীবনের বিভ্রান্ত শক্তিগুলোর ওপর; এটাই পরাভূত করেছে প্রকৃতি ও নারীকে।
এখানে বোভেয়ার খুব সহজভাবে স্পষ্ট করেছেন নারীর পিছিয়ে পড়া আর পুরুষের আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টিকে। এই পুরো ব্যাপারটি অনেকগুলো প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত। বহুবিধ সমীকরণ আর জটিল পথ এর মধ্যে বিদ্যমান। ‘ভূমির আদিকৃষকেরা’ শিরোনামের অংশে বোভেয়ার আদিম মানবগোষ্ঠী থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ ও ইতিহাস পর্যালোচনা করে নারীকেন্দ্রিক ট্যাবুগুলোকে সামনে এনেছেন। আদিম সমাজবিষয়ক এক গবেষণায় লেভি-স্ট্রাউস বলেন, ‘সর্বসাধারণ বা সামাজিক কর্তৃত্ব সর্বদাই থাকে পুরুষের অধিকারে।’ পুরুষের ক্ষমতার উৎস আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন বোভেয়ার। আসলে নারীকে পীড়ন করে, বিধি বানিয়ে তাকে পেছনে রেখে পুরুষ এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে এবং সফল হয়ে নিজেদের গৌরব প্রকাশে উন্মত্ত থেকেছে। গ্রিক নাগরিকরা মনে করত তাদের আত্মার সুখের জন্য গণিকারা আছে। দিমোসথিনিস বলেছেন, ‘কামসুখের জন্যে আছে উপপতœী, এবং পুত্রলাভের জন্যে আছে স্ত্রীরা’। এভাবে নিজেদের খেয়ালি এবং বহুগামী জীবনকে প্রতিষ্ঠা করেছে পুরুষ আর নারীকে বেঁধে রেখেছে নিয়মের বেড়াজালে। নারী যে সবসময় এসব মেনে নিয়েছে তা কিন্তু নয়।
তবে নারীর লড়াইকে পুরুষতন্ত্র কখনোই মহিমান্বিত রূপ লাভের সুযোগ দেয়নি। ফলে সবটাই আড়ালে রয়ে গেছে। নারীর লড়াইয়ের তাই কোনো ধারাবাহিক ইতিহাস সে অর্থে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কিছু সাহসী, প্রজ্ঞাবান এবং সময় ও চেতনার দিক থেকে এগিয়ে থাকা নারীদের সংগ্রামী জীবনের গল্প। পুরুষতন্ত্র প্রথা, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ, লৈঙ্গিক সীমাবদ্ধতা এমনি সব বিষয়ের দোহাই দিয়ে নারীকে অদৃশ্য কারাগারে বন্দি করে রেখেছে। আর নারীও এসবে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। কেননা যে শিক্ষা সমাজ পুরুষকে দিয়েছে নারীকে সেটা দেয়নি। স্বভাবতই নিজের অস্তিত্ব নিয়ে নারীর মাথাঘামানোর মতো মানসিকতা সব ক্ষেত্রে তৈরি হয়নি। দুইশ বছর আগেও পৃথিবীর প্রথম বিশে^র দেশগুলোতে নারীরা ভোটাধিকার পায়নি। ১৮৯৩ সালে নিউজিল্যান্ডে পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম নারীরা ভোটাধিকার পায়। ১৯১৮ সালে ব্রিটিশ নারীরা অনেক চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে ভোটাধিকার পায়। আর এর দুই বছর পর আমেরিকান নারীরা ভোটাধিকার পায়। অন্যদিকে ফ্রান্সের নারীরা ভোটাধিকার পায় ১৯৪৫ সালে। এটা নারীদের রাজনৈতিক অধিকারকে কিছুটা হলেও সংরক্ষণ করে। কিন্তু নারীর আত্মোন্নয়নে এটাই শেষ কথা নয়। তবে আমাদের যেটা বলার বিষয় নারীর সামাজিক স্বীকৃতি যতটুকু হয়েছে তা মাত্র গত একশ বছরে। এর আগে নারীর উন্নয়ন সম্পর্কিত ধারণাতেই পুরুষের অনাগ্রহ, আপত্তি ছিল এমনটা বলা যেতেই পারে।
ফরাসি বিপ্লব সমাজের অনেকক্ষেত্রে পরিবর্তন আনলেও নারীর ভাগ্যে তেমন পরিবর্তন আনতে পারেনি। নি¤œবিত্ত নারীরা নিজেদের মতো করে কিছুটা স্বাধীনতা ভোগ করে থাকে কিন্তু মধ্যবিত্ত নারীকে সবসময় পুরুষের তৈরি করে দেওয়া ছকেই জীবন অতিবাহিত করতে হয়। বোভেয়ার বলেছেন, ‘আধুনিক ফরাসি নারীর দুর্ভাগ্য এই যে তার মর্যাদা স্থির হয় এক সামরিক একনায়কত্বের কালে; নেপলিয়নি বিধি, তার ভাগ্যকে এক শতাব্দীর জন্যে বিধিবদ্ধ ক’রে, তার মুক্তিকে বিপুলভাবে শ্লথ ক’রে দেয়।’ এটা পরম্পরাগত একটি ধারণা। নারীর মাতৃরূপের স্তুতি সমাজ করেছে নিজেদের স্বার্থে। নেপলিয়নও নারীর মধ্যে দেখতে পছন্দ করতেন ‘মা’ নামক সত্তাটিকে। নারীর মর্ষকামিতাকে উৎসাহিত করে নারীর বন্দিত্বকে নিশ্চিত করে আসছে পুরুষতন্ত্র। বালজাক আরো নৈরাশ্যজনক ভাষায় প্রকাশ করেছেন একই বিশ^াস। ফিজিয়লজি দি মারিয়াজ-এ তিনি লিখেছেন, ‘পুরুষের হৃদয়কে স্পন্দিত করাই নারীর নিয়তি ও একমাত্র গৌরব… সে এক অস্থারব সম্পত্তি এবং ঠিকভাবে বললে সে পুরুষের পাশে এক গৌণ জিনিস।’ তবে এসব চিন্তা থেকে আজ সমাজ এগিয়েছে।
বোভেয়ার মনে করেন উৎপাদনশীল শ্রমে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে এবং তাকে প্রজননের দাসত্ব থেকে মুক্তি দিলে তার সামগ্রিক জীবনের একটা বিবর্তন সম্ভব। দেখা যায় জার্মানিতে ‘হিপেল নামক এক ছাত্র ১৭৯০-এ জোরে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন প্রথম নারীবাদী ইশতেহার, . . .।’ এখানে প্রথম বিশ^যুদ্ধে অংশ নেওয়া নারীরা রাজনীতিতে সক্রিয় হলেও হিটলার তাদের ওপর চাপিয়ে দেয় নেপলিয়নের সেই আদর্শ। ‘কাইস, কির্স, কিন্টার– রান্নাঘর, গির্জা, শিশু।’ বিষয়টি আসলে এমনই। দিন বদলেছে, শাসক বদলেছে, কিন্তু নারীর ওপর নিপীড়ন বদলায়নি। পুরুষ বারবার নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য নারীকে ব্যবহার করেছে। কখনো দেবী বানিয়েছে কখনো মা কখনো স্ত্রী কখনো সেবাদাসী। ‘নারীবাদ কখনোই কোনো স্বায়ত্তশাসিত আন্দোলন ছিলো না : অংশত এটা ছিলো রাজনীতিবিদদের হাতের এক হাতিয়ার, অংশত ছিলো একটি অন্তপ্রপঞ্চ, যা প্রতিফলিত করে গভীর সামাজিক নাটককে।’ এই কথাটি অত্যন্ত গুরুত্ববহ। নারী নিজের কথা ভাবলেও সেটা পুরুষের তৈরি করা ছকেই ভেবেছে। শ্রম দিতে গিয়েও সে শোষিত হয়েছে, অর্ধেক মজুরিতে কাজ করতে হয়েছে কিংবা হয় এখনো। ঘরে ও বাইরে তার একই অবস্থা। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চ ‘নারী দিবস’ রুশবিপ্লবকে ত্বরান্বিত করেছে এমনটা বলা হয়। অবশ্য কিছু নারী তো বের হয়ে এসেছে। রোজা লুক্সেমবার্গ, মাদামকুরিÑএরা দেখিয়েছেন নিজেদের সক্ষমতা। যারা বলে নারী মহৎ কিছু সৃষ্টি করতে পারে না তারা এটা ভাবে না যে মহৎ কিছু সৃষ্টি করার জন্য একটা অনুকূল পরিবেশ দরকার। যা নারীদের দেওয়া হয় না।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ্য-পুুরুষ সার্বভৌম ক্ষমতার অধীশ^র হতে গিয়ে ক্রমশ নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েছে। যদিও জয়ের আনন্দে সে এভাবে বিষয়টিকে তলিয়ে দেখে না। নিজেকে বড়ো করে দেখতে ও দেখাতে গিয়ে এভাবে দেখার সুযোগও থাকে না। পিথাগোরাস শুভ নীতিগুলোকে সম্পর্কিত করেছিলেন পুরুষের সাথে এবং অশুভগুলোকে নারীর সাথে। তাই পুরুষ নিজের জয় নিশ্চিত করতে অশুভকে জয় করতে চেয়েছে। আর এখানেই বিরোধের সূত্রপাত। বোভেয়ার মঁতেরলঁ, ডি এইচ লরেন্স, ক্লদেল, ব্রেতোঁ ও স্তেঁদাল-এই পাঁচজন লেখকের লেখায় যে নারীভাবনার প্রকাশ ঘটেছে তা আলোচনায় আনেন। দেখা যায় এদের সকলের ভাবনাই খন্ডিত ও একপেশে। আসলে কেউই নারীর ভেতরে একজন মানুষের অস্তিত্ব স্বীকার করতে চান না। এটা করলে পুরুষ ছোটো হবে না বরং উভয়ের মানসিক দূরত্ব কমে গিয়ে একটা স্বস্তির পরিবেশ তৈরি হবে। এজন্য প্রয়োজন বাল্যকাল থেকে ছেলে ও মেয়ে শিশুর বেড়ে ওঠায় সাম্য সৃষ্টি করা। কিন্তু জন্ম থেকেই একধরনের বৈষম্যের শিকার হয় মেয়ে শিশু। ঘরের এই বৈষম্য সারাজীবন তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। একারণে অনেক মেয়েই ছেলে হতে চায়। ‘হ্যাভলক এলিসের পরিসংখ্যান অনুসারে, একশোর মধ্যে একটি ছেলে পছন্দ করে মেয়ে হ’তে; আর শতকরা পঁচাত্তরজনেরও বেশি মেয়ে পছন্দ করে তাদের লিঙ্গ পরিবর্তন করতে।’ এভাবে নারী নিজেও তার নারীত্ব নিয়ে হীনম্মন্যতায় ভোগে। কেননা সমাজ তাকে বিশ^াস করিয়েছে সে অসম্পূর্ণ, বিকলাঙ্গ, অপর। তাই তার পূর্ণতার জন্য পুুরুষের প্রয়োজন। “আমেরিকায় মহাবিদ্যালয়গুলোতে কোনো সহপাঠিনীর সামাজিক মর্যাদা পরিমাপ করা হয় তার ‘অভিসারী’র সংখ্যা দিয়ে।” এভাবে সমাজ নারীকে মূল্যায়ন করে আসছে। আর এই অভ্যস্ততা থেকে নারীও তার আত্মমর্যাদার প্রশ্নে পিছু হটে এসেছে। আরেকটি বিষয়ও আছে অধিকাংশ পুরুষ সঙ্গী হিসেবে সাহসী, মেধাবী, বুদ্ধিমতী নারী নয় বোকা স্বভাবের নারীকেই বেশি পছন্দ করে। আর নারীও নিজেকে পুরুষের সঙ্গী ভাবতে এমন জীবনকে মেনে নিয়ে আসছে ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক।
বোভেয়ার তাঁর লেখায় নারীর যৌনজীবন, পুরুষের নারীর সতীত্ব সংক্রান্ত মনোভাব, নারীর গার্হস্থ্যজীবন, নারীর মাতৃত্ব, নারীর সাজপোশাক এসব আর এতে পুরুষের প্রতিক্রিয়া, বিবাহিত নারী এবং বেশ্যাবৃত্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত নারীর জীবন, নারীর প্রৌঢ়ত্ব-এমন বহুবিধ বিষয়ের অবতারণা করেছেন। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করেছেন। অনেক অনভিপ্রেত বিষয়ের সামনে এনেছেন। আলো ফেলেছেন প্রণয় থেকে কাম, ঘর থেকে সামাজিক সংগঠন, শরীর থেকে মনের পরতে পরতে। শেষ পর্যন্ত আস্থা রেখেছেন নারীর মুক্তির ব্যাপারে। বলছেন, ‘মুক্ত নারী সবে মাত্র জন্ম নিচ্ছে; . . .।’ নারীকে সুযোগ দেওয়ার সময় এসেছে। সকলের স্বার্থে নারীকে এগিয়ে যাওয়ার পথ ছেড়ে দিতে হবে। নারীকে তার নিজের দায়িত্ব নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। নারীরও উচিত পরনির্ভরশীলতা থেকে বের হয়ে আসা। শেষকথায় বোভেয়ার বলেন :
পুরুষকেই প্রতিষ্ঠা করতে হবে বিদ্যমান বিশ্বের মাঝে মুক্তির রাজত্ব। পরম বিজয় লাভের জন্যে, এক দিকে, এটা দরকার যে পুরুষ ও নারীরা তাদের প্রাকৃতিক পার্থক্যকরণের সাহায্যে ও মাধ্যমে দৃঢ়তার সাথে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করবে তাদের ভ্রাতৃত্ববোধ।
নারীর প্রতি বৈষম্যের মূলে ক্ষমতার ব্যাপারটি একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। এ বিষয়ে অভ্র ঘোষ তাঁর ‘লিঙ্গ-অনপেক্ষা মনুষ্যত্বের চর্চা এবং রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন-
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতা-কাঠামোটি তিলে তিলে তৈরি হয়েছে আবহমান কাল থেকে পুরুষতন্ত্রের মূল্যবোধ নিয়ে, পুরুষতান্ত্রিক সংস্কৃতি-দর্শন-আচারব্যবহার-বিধি-ব্যবস্থা দিয়ে। লিঙ্গ-রাজনীতির চাতুর্যময় ফাঁদ ছিঁড়তে হলে চাই এমন এক ব্যবস্থা যা পুরুষের প্রভুত্ব নয়, নারীর প্রতিস্পর্ধী প্রভুত্ব নয়, চাই লিঙ্গ-অনপেক্ষা মনুষ্যত্বের চর্চা। অর্থাৎ ক্ষমতা-কাঠামোতে পুরুষালি দাপটের বদলে মেয়েলি দাপট বাড়ানোর লক্ষ্য নয়, চাই মনুষ্যত্ব নির্মাণের চর্চা, মানবিকতার সংস্কৃতিচর্চার ¯িœগ্ধ পরিবেশ। এ-রকম এক আকাক্সিক্ষত মানব সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য লিঙ্গ-স্বরূপের তিরোধান কাম্য নয় অর্থাৎ পুরুষ সত্তা আর নারী সত্তার প্রকৃতিগত ভিন্নতাকে অস্বীকার করা নয়, চাই লিঙ্গ-স্বরূপের পুনর্নির্মাণ যাতে কেবল নারীমুক্তি নয়, পুরুষমুক্তি ঘটবে।
এই বিষয়টি অতীব জরুরি। মানসিক বিকাশের পূর্ণতা চিন্তনের ক্ষেত্রকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। এবং এতে দূর হয় তাবৎ কূপম-ূকতা।
Tom Grimwood Zvui “Re-Reading The Second Sex’s ‘Simone de Beauvoir'” শিরোনামের এক আর্টিকেলের উপসংহারে বলেন :
Beauvoir’s question, however, while seemingly intent on a transcendent position of ‘what woman is’, attempting to locate the origin of her oppression and defining her freedom, is frustrated in itself because woman ‘is not’. Man is Being, but woman – and thus Beauvoir herself-is Becoming. This temporal hesitation – a ‘self-resistance’, in Shoshana Felman’s terms-is built into the very movement to fixed identity of the signature. Even before Beauvoir can write on woman, the hesitance centres on the question: ‘Are there women, really?’ ‘The Second Sex is thus engendered by an impulse and a quest that the writing process carries out but that the author does not at first own’ (Felman, 1993, 11). Hence Beauvoir as a woman is not a ‘being’ in the sense that she cannot adopt a transcendent point of existence where she might ask the philosophical questions she attempts.
আসলে বিশ^ পরিভ্রমণ করে সিমোন দ্য বোভেয়ার বহুবিস্তৃতভাবে নারীর ‘অপর’ হওয়ার গল্প আমাদের শুনিয়েছেন। এই গ্রন্থের পাঠ তাই অনস্বীকার্য। আর বোভেয়ার কথিত নারীর ‘অপর’ হওয়ার গল্পটা আসলে পৃথিবীর মতোই পুরোনো। সেখান থেকে বের হয়ে আসার সময় এখন। মানুষকে মানুষ হিসেবে দেখাতেই আনন্দ। বিভেদ কখনো কল্যাণ স্পর্শ করতে পারে না। সম্ভাবনাময় জীবনকে এগুবার সুযোগ দিলেই তো পৃথিবীতে স্বস্তির বাতাস প্রবাহিত হবে। প্রতিযোগিতা হোক মেধার, সক্ষমতার, পারদর্শিতার। লৈঙ্গিক ত্রুটি নির্ধারণ করে বৈষম্য সৃষ্টির অবসান হওয়া প্রয়োজন। এটা কোনো কাজের কথা না। প্রতিযোগিতাময় এই বিশে^ নিজেকে টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে যোগ্যতার প্রদর্শন অপরিহার্য। নারীর ওপর আধিপত্য বিস্তারের পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করা উচিত। নারীরও আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে। নারীকে ‘অপর’ করে রেখে পুরুষ যে জয়ের আনন্দ লাভ করে তা খ-িত। লড়াই হবে সমানে সমানে। পুরুষের মতো নারীও অধিকার রাখে শিক্ষা গ্রহণের, নিজেকে মেলে ধরার, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার। আর এমন হলে সমাজ সমৃদ্ধ হবে। এগিয়ে যাবে মানবসভ্যতা। প্রজ্ঞাবান মানুষের সমাজ হোক, হোক ভেতর থেকে আলোকিত মানুষের সমাজ। নারী ও পুরুষ এমন প্রপঞ্চ থেকে বের হয়ে এসে আমরা ‘মানুষ’ নামক সত্তার চর্চা করি, বিকাশ ঘটাই মানবিকতার। মানুষের গল্পে মুখরিত হয়ে উঠুক এই চরাচর। জীবন কথা বলুক বহুমুখে। আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে অমৃতের সন্তানের যাত্রা হোক বর্ণিল, বৈচিত্র্যময় আর অর্থপূর্ণ।
এবং সংস্কারের কুয়াশা ভেদ করে একদিন আলো আসবেই…
ঋণস্বীকার
১ কাজী নজরুল ইসলাম, ‘নারী’, নির্বাচিত কবিতা, মোহাম্মদ আজম সম্পা. (ঢাকা : আদর্শ, ২০২২), পৃ. ১৩৫
২ সিমোন দ্য বোভেয়ার, দ্বিতীয় লিঙ্গ, হুমায়ুন আজাদ অনূ. (৭ম মু.; ঢাকা : আগামী প্রকাশনী ২০১৯), পৃ. ১৮৩, ১৯, ৩৭, ৩৯, ৫২, ৬৪-৬৫, ৬৯-৭২, ৭৬, ৯০, ১০৮, ১১৬-১১৭, ২০১, ২১১, ৩৯০, ৪০০
৩ আগস্ট বেবেল, নারী অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতে, কনক মুখোপাধ্যায় অনূ. (৭ম মু.; কলকাতা : ন্যাশনাল বুল এজেন্ট প্রাইভেট লিমিটেড, ২০১৮)
৪ অভ্র ঘোষ, ‘লিঙ্গ-অনপেক্ষা মনুষ্যত্বের চর্চা এবং রবীন্দ্রনাথ’, নারীবিশ্ব (কলকাতা : গাঙচিল, ২০০২), পৃ. ৩০৫
৫. Tom Grimwood, “Re-Reading The Second Sex’s ‘Simone de Beauvoir'”, ResearchGate, https://www.rasearchgate.net>, Feb, 2008
ড. নূর সালমা জুলি, শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার
(রাজশাহী কলেজ)