লিয়াকত হোসেন
আজও জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি চারদিক সাদা তুষারে ছেয়ে আছে।
তুষারপাত হয়েছে রাতে। ভোরের রোদে চিক চিক করছে চারপাশ। ফ্যাকাশে আপেল গাছে পাখির আনাগোনা নেই। শীতের প্রকোপ বেড়ে গেছে। পাখিরাও আশ্রয় নিয়েছে কোথাও। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভাবছি তোমার কথা আব্রাহাম। যোগাযোগ নেই অনেক দিন, মোবাইল নাম্বারটাও হারিয়ে ফেলেছি তাই মেইল লিখছি তোমায়। অনেকদিন থেকেই একটা প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। সেই প্রশ্নটাই করবো তোমায়। তবে প্রশ্নে যাবার আগে কিছু বলবো, কিছু ব্যাখ্যা দেবো তাই মেইল শেষ না হওয়া অবধি ধৈর্য ধরতে হবে, ধৈর্য ধরে মেইলের শেষ বিন্দু পর্যন্ত যেতে হবে।
তোমার হয়তো মনে নেই কখন কবে সোনিয়া আমাদের সঙ্গে ক্লাশ শুরু করেছিল।
আমার মনে আছে। আমাদের সাহিত্য ক্লাশের দ্বিতীয় সপ্তায়। সে ক্লাশে এসেই চারপাশটা দেখে নেয়। ওর সাগর নীল চোখ দুটি আমিই প্রথম দেখেছিলাম। আমার প্রথম দেখা। প্রথমদিন ক্লাশে সে হয়তো নার্ভাস ছিল। আমার চোখ দুটো ওকেই দেখছিলো, কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না শুধু সোনিয়াকে ছাড়া। তুমি এসব খেয়াল করনি, করার কথা নয়।
আমি শুরু থেকেই বলতে চাই।
কারণ এর সঙ্গে তোমার আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সোনিয়ার প্রতি দূর্বলতা ভালোবাসা পেল্লবতায় জড়িত। ছোটবেলা থেকেই তুমি আমি একই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছি, বড় হয়েছি যদিও আমাদের ভিন্নতা ছিল তবে বন্ধুত্ব ছিল অভিন্ন। তোমার কি মনে আছে আমাদের প্রথম পার্টির কথা? এলভিরা পার্টির আয়োজন করেছিল ওর বাসায়। ক্লাশের অনেকেই গিয়েছিল। একই সঙ্গে গিয়েছিলাম আমরা। আমরা গোল হয়ে বসে লটারি খেলছিলাম। আমাদের মাঝে ছিল একটি কাগজের বাক্স। বাক্সের ভেতর ছিল ছোট ছোট চিরকুট। এক একজন এক একটা চিরকুট তুলছিলো আর সে অনুযায়ী অভিনয় করছিলো। তোমার চিরকূটে উঠেছিলো, উপস্থিত যে কোন মেয়েকে তুমি চুমু খেতে পার। খুব মজার ছিল খেলাটা। তুমিও মজা পাচ্ছিলে। মেয়েরা সবাই এসেছিল সেজেগুঁজে আকর্ষনীয়া হয়ে। ওরাও হাসছিলো। তুমি এগিয়ে গেলে লুইসার দিকে। লুইসা কপোটনেত্রে তাকিয়ে ছিল তবে বাঁধা দেয়নি। আমার চিরকুটে ছিল, কে বেশী সুন্দরী তা বলা। মনে হয়েছিল এর থেকে কঠিন কিছু আর নেই। আমি তাকিয়ে ছিলাম নীল চোখের সোনিয়ার দিকে তবে কিছু বলিনি। মনে আছে আব্রাহাম সেই দিন গুলোর কথা? আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে তুমি সেদিন সোনিয়াকেও দেখেছিলে।
এরপর লুইসার সঙ্গে তোমার সর্ম্পক হল। লুইসা থেকে এলভিরা। এলভিরা থেকে জেনি। তুমি যেন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলে। আমি আটকে ছিলাম সোনিয়াতেই। লুইসার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পর ওর অঙ্গ নিয়ে তুমি খুব বাজে মন্তব্য করেছিলে। ঐ মন্তব্যে আমি সতর্ক হলাম। তুমি খেলাধুলা আর পার্টি নিয়ে মেতে উঠলে আর আমি সময় দিলাম পড়াশোনায় কারণ ইঞ্জিনিয়র হবার ইচ্ছে ছিল আমার। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা ছিন্ন হল। এরপর তোমার সঙ্গে আবার দেখা হল যখন আমরা একই কলেজে এসে ভর্তি হলাম। স্কুল থেকে কলেজে এলেও তোমার ভেতর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই তুমি নারী পরিবেষ্টিত ও খেলাধুলায় চৌকার্য। এলভিরার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা আবার জোড়া লেগেছে আর গড়িয়েছে বিছানা অবধি। এসবের ধারে কাছে আমি যেতে পারিনি এমনকি সোনিয়ার কাছেও। তবে সোনিয়ার বিষয়টা তুমি জানতে, আমার পছন্দের কথা জানিয়েছিলাম।
তোমার কি মনে পরে অক্টোবর মাসের কথা?
ম্যাডাম বোর্ডে অংক করাচ্ছিলেন। অংকটা ঠিক হয়েছে কি না সবার মতামত জানতে চেয়েছিলেন ম্যাডাম। ক্লাসের ভেতর একমাত্র সোনিয়া অংকে ভুল আছে বলে হাত তুলে ও ম্যাডামের আহ্বানে বোর্ডে যেয়ে সংশোধন করে। ক্লাস থেকে বেড় হয়ে আমার দুকাঁধে হাত রেখে বলেছিলে,‘মেয়েটা খুব সুন্দরী, ওকেইতো তুমি পছন্দ কর ? পছন্দের কথা জানিয়েছ?‘ সোনিয়াকে তখনো মনের কথা বলিনি, অনেক দ্বিধার মধ্যেও বলা হয়নি, তবে বলব। এরমধ্যে স্টুডেন্ট এক্্রচেঞ্জ প্রোগ্রামে সুযোগ পেয়ে আমি অস্ট্রেলিয়ায় মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই। এক্্রচেঞ্জ প্রোগাম ছিল এক বছরের।
ফিরে আসার পর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হল।
আমন্ত্রণ জানালে বাসায়, বললে সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। বেডরুমে যেতে বললে, দেখি সোনিয়া তোমার বিছানায়। জীবনে অনেক চমক পেয়েছি কিন্তু এমন চমকের সম্মুখীন হয়নি। যে চমক হতাশার জন্ম দেয়। যে চমক ক্রোধের জন্ম দেয়। যে চমক নি:স্ব করে দেয়। সোনিয়া কি করছে তোমার বিছানায়? শরীরের সব রক্ত জমা হল মাথায়। কিছু একটা করতে ইচ্ছে হল কিন্তু না, বেরিয়ে এলাম তোমার ঘর থেকে।
তোমার মনে আছে আব্রাহাম ?
পড়ার ফাঁকে ফঁকে আমরা সামারজব করতাম। আমার ইঞ্জিনিয়রিং তখনো শেষ হয়নি। টার্মিনের ফি জোগাতে কবরস্থানে কাজ পেলাম। আমাদের কাজ ছিল বিশাল কবরস্থানের ঘাস পরিষ্কার করা। কবরের পাশের ফুল গুলো সাজিয়ে রাখা। ফুল গাছে জল দেয়া। ছিমচাম নির্জন পরিবেশে কাজ করতে ভালোই লাগতো। শহর থেকে দূরে পাইন বনের ভেতর কবরস্থান। নাম লেখা পাথরের ফলকের পাশে কত শত মানুষ শুয়ে আছে, পরিবেশটাই আলাদা। আমার মতো অনেকেই পালা করে কাজ করতো। ওখানেই দেখা হল সরার ও তার ছোট বোন লীর সঙ্গে। দুজনেই দুটি কলেজে পড়তো। কথায় কথায় সরা জানাল লির সাথে তোমার ভালোবাসার কথা। শুনে চমকে গেলেও বিশ্বাস হয়নি। তাহলে সোনিয়া? সরা আরো অনেক কিছু বললেও বুঝেছে আমি ওকে বিশ্বাস
করিনি কারণ আমি ওভাবে তোমাকে দেখতে চাইনি।
দিন তিনেক পর
সরা এসে জানালো তুমি লির সাথে দেখা করতে এসেছো।
আমিও দূর থেকে দেখলাম কবরস্থানের এক পাশে যন্ত্রপাতি রাখা টিনের ছাউনি দেয়া গুদাম ঘরে লিকে ভেতরে নিয়ে গেলে। চোখ দুটো বিশ্বাস করেনি। কিন্তু সত্য বড় কঠিন। সত্য বড় নির্দয়।
আমি আমার মেইলের শেষ প্রান্তে এসে গেছি আব্রাহাম। তুমি জেনে শুনে সোনিয়াকে আমার থেকে নিয়ে গেছ। বন্ধু হয়েও তুমি এটা করেছ। আমাকে কষ্ট দিয়েছ রাতের পর রাত দিনের পর দিন। এখন দিচ্ছ সোনিয়াকে। এখন তোমায় প্রশ্ন করা যায়, ‘আমি কি সোনিয়াকে লির কথা জানাবো?‘
সুইডিশ লেখক মাগনুস লিনগ্রেনের গল্পের ছায়া অবলম্বনে।
লিয়াকত হোসেন, গল্পকার, সুইডেন প্রবাসী