বহুদিন পরে এক দিন
দু’পা ছড়িয়ে ক্ষেতের আইলে বসে আছে চৈতা’র বাপ। হয়তো আগে তার নাম একটা ছিলো তাও বদলে গেল মেয়ে চৈতার জন্মে। মাথায় ভাঁজ করা ঘর্মাক্ত গামছা দু’কাঁধ ছুঁয়ে ঝুলছে, চোখ দুটো দেখছে সামনে তৃষ্ণার্ত মধ্য বয়সী ধানগাছগুলো। দু’এক দিনের মধ্যেই সৃষ্টিকর্তার কৃপা বৃষ্টি না হলে যে কি হবে? চৈতার বাপ আর কিছু ভাবার শক্তি মাথায় নিতে পারছে না। অসংখ্য অশুভ ভাবনা মাথায় শুধুই ঘোরে আর ঘোরে। সেই তো বছর দশক আগে যেনো হঠাৎই পার্থিব কেয়ামত নেমে আসে চৈতার বাপের মাথায়। কোথাকার এক গু-া ছেলে তুলে নিতে এলো তার জানের টুকরা ষোড়শী রাজকন্যাকে। দুর্বল, দরিদ্র মানুষ কিন্তু বাপ তো! ঝাঁপিয়ে পড়ল, পারলো না করতে উদ্ধার। ওরা মেয়েকে নিয়ে গেলো নৃশংস ভাবে। তারপর কত্ত ছোটাছুটি, কত্ত থানা দেন দরবার, কত্ত হাতে পায়ে ধরা! ওরা যে খুব প্রভাবশালী, থানায়ও নিলো না কেস। খালি বাড়িতে পড়ে রয় হৃদয় ভাঙা চৈতার বাপ আর মা। দশ বছর – সে তো অনেক সময়! তাইনা? প্রখর রোদে চৈতার বাপের মাথা আউলা হয়ে যায়। প্রকৃতির বিন্দু বৃষ্টি ফোঁটার মতো শুষ্ক মাথাও চায়, হৃদয়ের কম্পন চৈতাকে ফিরে পাওয়ার শান্তির সিক্ত ফোঁটা। এমনই সময় চৈতার বাপ চমকে উঠে ফিরে অবাক চোখ দেখে ছোট্ট একটা পরী দাঁড়িয়ে। অবিশ্বাস্য কান দুটো শুনছে মিষ্টিসুর – নানুভাই ও নানুভাই, আমাকে কোলে তুলে নেবেনা? আব্বু আম্মু দু’জনেই যে বললÑ তুমি অনেক অনেক আদর করবে! চৈতার বাপের হৃদয়ের উঠে ঝড়- দুটো হাত উঠে কেঁপে, না বুঝেই ফুটফুটে ছোট্ট পরিকে বুকে টেনে নেয় – গভীরে আরো গভীরে। কিছু দূরে কারো দৌড়ে আসার পদধ্বনি শোনে, কিছু বোঝার আগেই জ¦লজ্যান্ত চৈতাও বহুদিন পর বাপের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। চৈতারবাপের হৃদয়ে বইতে থাকে বাঁধভাঙা আনন্দ অশ্রু। আকাশেও হঠাৎ মেঘের গুরুগুরু ধ্বনি উঠে বেজে, আজ চৈতার বাপের হৃদয়ের মতো তৃষ্ণার্ত ধানগুলোও ভিজবে সুখে।
ভয়ংকর মুহূর্ত
আট বছরের হাসু কথা দেয় তার তিন বছরের ছোট্ট ভাইটিকে। সেই কথা রক্ষা করতেই ছোটুকে নিয়ে ভাইজান এসে হাজির, নতুন বর্ষার জলে টইটুম্বুর বিলের সবুজ ঘাসের পাড়ে। ছোটুর পিঠ চাপড়িয়ে দিয়ে বুক ফুলিয়ে বলে হাসু, ছোটুরে, দ্যাখ ক্যামনে এক ডুবে শালুক তুইলা আনি!
শুনেই কোমল ছোটুর চোখ করে উঠে আনন্দে ঝলমল। সে শুধু জানে তার প্রাণের ভাইজান সব কিছুই পারে – যেমনটি দেখেছে সে আগেও কত কতবার। বেশ কায়দা করেই জলে ঝাঁপ দেয় হাসু আর ছোটু দেখে। হঠাৎ হাসুর মাথায় খেলে যায় দুষ্টু বুদ্ধি – ডুব সাঁতারে চলে যায় দূরে জলের ধার ঘেষা বড় গাছটার ওপাশে। দূর থেকে দেখে হতবিহ্বল ছোটুর দৃষ্টির অস্থি’রতা – ঘুরছে এদিক সেদিক। এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত করে যেনো পাড়ি দেয় – অসীম না কাটা সময়। ভাইজানের ভেসে ওঠার কোনো চিহ্ন তো পড়ছে না তার চোখে। কেঁপে উঠে হৃদয়, কেঁপে উঠে ছোট্ট ছোটুর কোমল চোখখানি। ভয়ার্ত দৃষ্টি খুঁজে ফিরে বিলের জলের উপরে বিন্দুবিন্দু জলকণার প্রত্যেকটিতে। অবচেতন মন গুমরে কেঁদে ওঠে প্রাণের ভাইজানের মুখখানি দেখার জন্য। সাঁতার না জানা ছোটু হঠাৎ ঝাঁপ দেয় জলে ভাইজানকে আঁকড়ে ধরবে বলে। দূরে গাছের আঁড়ালে লুকিয়ে থাকা ভাইজানের চোখে উঠে ঝড় – ভয়ের!
হাপর তোলা হৃদয়ে চেঁচিয়ে উঠে – ছোটুরে, এই যে আমি এখানে!
নিয়ে ছোটু ডুবে যায় জলে।
কোনো এক ডাকপিয়ন যুগে
আধুনিক কুরিয়ার সার্ভিসের যুগেও ডাক বিভাগের কিছু কিছু ব্যবহার এখনো বহাল। এখনো ডাকপিয়ন কলিম শেখের মাঝে মাঝেই কাজ পড়ে এদিক সেদিক। তেমনি আজ বত্রিশ বাই চার শান্তিনিবাস ব্যাচেলর মেসের সামনে দাঁড়িয়ে কলিম শেখ ভীষণ আনন্দে তার পার্শ্ব ঝোলায় হাত বুলায়। দিনটিতে সব মিলিয়ে এগারো জনের নামে এসেছে চিঠি। জনপ্রতি দশ টাকা বকশিস তার এখন প্রায় হক হয়েই দাঁড়িয়েছে। এতো আনন্দের মাঝেও মনে কিঞ্চিত নিরানন্দের খোঁচা লাগে হাসান সুজন নামটা তার মনে যেনো একটা অসুখের ছায়া! পূর্বে যতবার চিঠি বিলিয়ে বিগলিত বিনয়ী হাসি দিয়েছে, ততোবার, ঠিক ততোবারই ঐ হাসান সুজন তাকে শূন্য হাতে ফিরিয়েছে। বকশিসহীন শূন্য হাত অসৎ ডাকপিয়নের মনে তোলে প্রতিহিংসা – নৈতিক কর্তব্যে আসে অবহেলা। তাই হাসান সুজনের চিঠি বিলিও হয় অনিয়মিত। তারই রেশ ধরে সপ্তাহ হলো পড়ে আছে একটি চিঠি ঝোলার কোণে। কর্তব্যে অবহেলিত ডাকপিয়ন জানেনা তো অনেক কিছুই – গ্রাম থেকে আশাহত দরিদ্র পরিবারের বড় ছেলেটির কথা। মেসের ভাড়াই ঠিকমতো না দিতে পারা প্রায়ই অভুক্ত ছেলেটির কথা। মাসের পর মাস শুধু একটি চাকুরির নিয়োগ প্রাপ্তির আশার অপেক্ষায়। সেই তো বহু প্রতীক্ষিত এক চাকুরির নিয়োগ প্রাপ্তির চিঠি – যা তখনও পড়ে আছে কলুষিত ডাকপিয়নের ঝোলার কোণে। আর যাতে দুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে যোগদানের শেষ তারিখটিও। হ্যাঁ, দুদিন আগেই শেষ হয়ে গেছে হাসান সুজনের ঘুরে দাঁড়ানোর সুন্দর ভবিষ্যৎটিও।
সৈয়দ মনজুর কবির, গল্পকার