অমল বড়ুয়া
হলভর্তি মানুষ। লাইটের আলো ঝলমল করে ঘুরপাক খাচ্ছে মঞ্চে স্থাপিত বৃত্তবদ্ধ বলয়ের ওপর। আধো-আলো আঁধারির তারল্যে বিমিশ্রিত হয়ে সারিবাঁধা চেয়ারে বসে আছেন শ’ দুয়েক মানুষ। দুর থেকে স্পষ্ট বুঝার উপায় নেই কার চেহারা কোনটি। তবু সবাই চেনা জানা; পরিচিত। প্রতীক্ষার দুর্ভেদ্য অস্থিরতার মিহি আলো আঁধারেও খেলা করছে সবার চোখে মুখে। অপেক্ষার বিস্বাদ দহন মাড়িয়ে মঞ্চের আলোরা ক্ষীণ থেকে প্রসৃত হতে লাগল। সামনে বসে থাকা দর্শকরা নড়ে-চড়ে বসলেন। দর্শকবৃন্দ আবার যেন-তেন সাধারণ মানুষ নয়। শহরের বিদগ্ধ সুধিজন। দেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিগণ। যাদের হাতে ইতিহাস ঐতিহ্য সাহিত্য সংস্কৃতি শিল্প হয় উর্বর। ঋদ্ধ হয় দেশ-কাল-সমাজ। যাদের চেতনার অগ্নি-স্ফুলিঙ্গে জাগে জাতি। যাদের বোধে আক্রান্ত হয় সমাজ।
যাদের বয়ানে অনুপ্রাণিত হয় লোকজন। মাইক্রোফোন বেজে উঠল। প্রতীক্ষার দগ্ধ সময় পেছনে ফেলে উঠে দাঁড়াল দর্শকগণ। হলভর্তি করতালির কম্পমান ঢঙ্কা আর মাইক্রোফোনের ঝাঁঝালো শব্দের জয়জয়কার। শব্দের গায়ে শব্দ লেগে স্ফুরিত হচ্ছে সহনসীমার বেড়া ডিঙিয়ে।
বিচ্ছুরিত আলোর হাস্যোজ্জ্বল দ্যুতির মতো মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন হিরন্ময়। এতক্ষণে শান্ত হয়ে এসেছে হাততালির উন্মত্ত শব্দরা। কানের ভেতর শুধু বাতাসে ফিসফাস করছে মাইক্রোফোনের যান্ত্রিক শব্দ।
‘আমি দুঃখিত, আপনাদেরকে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষায় রাখার জন্য……..’
শব্দের ভেতরে নীরবতা। হলের আলোগুলো এখন আরো ক্ষীণ হয়ে এসেছে।
কেবল মঞ্চের শে^তশুভ্র আলোটা আরো বিস্তৃত ও প্রশস্ত হয়ে জ¦লছে। পিনপতন নীরবতায় হলের পলেস্তারায়, চেয়ারে, আইলসে, বাতানুকূলতায়, দর্শকদের অন্তর-বাইরে জমাট বাঁধতে শুরু করেছে।
‘আমার এই পথচলা কখনো মসৃণ ছিল না’ – তিনি বলা শুরু করলেন –
‘অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে পারি দিতে হয়েছে জীবনের এতোটা পথ। আর আমার সামান্য প্রাপ্তিতে আপনারা সংবর্ধনার আয়োজন করেছেন। তাই আপনাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। অভিবন্দনা পেতে সবার ভালো লাগে। কী মানুষ ! কী দেবতা ! কী সেলিব্রেটি ! কী জনতা ! আমিও মানুষ। তাই আমারও ভালো লাগছে। জীবনে সবার একটু-আধটুু সাধ আহ্লাদ থাকে সম্মানিত হবার। প্রশংসা পাবার। নিজের গুণগান শোনার। এর জন্য মানুষ কতো কিছু করে। মেধা, শ্রম, সময়, ধৈর্য, অর্থবিত্ত কতো কিছুই ব্যয় করে। অনেকে তো পুরো জীবনই নিঃশেষ করে ফেলে। তবুও কী সেই আকাক্সিক্ষত সম্মান কিংবা প্রশংসা লাভ করতে পারে ! অর্থ-বিত্তের মতো খ্যাতির পেছনে ছোটাও মানুষের আজন্ম লালিত সাধনা।’ শব্দরা ঘুরপাক খাচ্ছে হলময়। চেয়ারের হাতলে নিজের হাতের শক্ত বন্ধন রচনা করে বসে আছেন নীলরতন। হিরন্ময়ের কথাগুলো তার খুব ভালো লাগছে ঠিক তা না। ভব্যতার খাতিরে তিনি আনমনে মনোযোগী হয়ে শুনে যাচ্ছেন। অরুচি নিয়েও গিলছেন গোগ্রাসে। কারো কারো নড়া-চড়ার ক্ষীণ শব্দও নীলরতন বাবুর কান স্পর্শ না করে যাচ্ছে না। হিরন্ময়ের প্রতি তার একটু উন্নাসিকতা আছে। চল্লিশ বছর ধরে তিনি সাহিত্য সমাজকে নিজের মতো করে গড়ে তোলেছেন। তিনিই হচ্ছেন এই শহরের বিদগ্ধ সাহিত্যিক আর সাহিত্য সংগঠক। তার হাত ধরে কতো অজমূর্খ নিজের প্রতিভার দ্যুতি ছড়িয়ে এই শহরের সাহিত্য জগতে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের খ্যাতি লাভ করেছে ! তার সাথে যারা পথ হাঁটছেন, তার কথা মতো চলছেন তারা শহরের সাহিত্য সমাজে দেদীপ্যমান হয়ে বেঁচে আছেন। তাদের জন্য সব সুযোগ সুবিধা। অন্যরা সব অপাক্তেয়।
হিরন্ময়ও সেই সব অপাঙ্ক্তেয়র দলে। নিজের অধ্যবসায় ও শ্রম আর দৃঢ় সংকল্পের কারণে হিরন্ময় আজ সাহিত্য সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি। তিনি ‘ওয়ানম্যান আর্মি’র মতো সব বাধা পায়ে ঠেলে নিজের কর্মপ্রচেষ্টায় দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নিজের সুদৃঢ় অবস্থান তৈরী করতে পেরেছেন। তিনি সাহিত্য লেজুড়বৃত্তির তোড়াই কেয়ার করেন।
তিনি বলেন, ‘নিজের মধ্যে মেধা আর অধ্যবসায় থাকলে একদিন না একদিন বিজয়ী হবই।’
তিনি আজ সত্যিই বিজয়ী। তিনি সাহিত্য-লেজুড়বৃত্তির তোয়াক্কা না করে একাই পথ হেঁটেছেন আপন দৃঢ়তায়। তার কথা হচ্ছে, ‘নিজের ওপর যার বিশ^াস নাই সে কিছুই অর্জন করতে পারে না। বোধ-বৃদ্ধি আর বিবেকহীন মানুষেরা অন্যের করুণার ওপর নির্ভর করে সাহিত্য সাধনা করে মাঝ পথেই হারিয়ে যায়।’
তিনি সবসময় নিজের শক্তিতে বলীয়ান। তিনি সমমনাদেরকে ঠিক তাই বলেন, ‘নিজের মধ্যে সার কিছু না থাকলে অন্যের অনুগ্রহে বেশি দূর যাওয়া যায় না। নিজের ওপর বিশ^াস রেখে সামনের দিকে এগোতে পারলেই একটা অবস্থানে পৌঁছানো সম্ভব।’
ইদানীং কেউ কাউকে পাত্তা দেয় না। সবাই হুজুগের পেছনে দৌঁড়ায়। রাতারাতি জনপ্রিয় হতে চায়। শর্টকার্ট পন্থায় বিখ্যাত হয়ে উঠতে চায়। নিজের শক্তিতে না পারলে আরেকজনের শক্তিতে শক্তিমান হয়ে হলেও এগিয়ে থাকতে চায়। খয়ের খা জীবনযাপনের কোনো মূল্য হয় না। নিজের মেধাহীন সত্তায় অন্তত কখনো ভালো শিল্প হয় না। মানুষের আত্মবোধহীনতা-বুদ্ধিহীনতা পীড়া দেয় হিরন্ময়কে। তিনি নিজেকে আত্মবোধ ও রুচিসম্পন্ন বিবেকবান মেরুদ-ী মানুষ হিসেবে ধরে রাখতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আত্মপ্রকাশে তিনি নিঃসংকোচ।
‘একটা লেখা প্রকাশের জন্য অনেকের কাছে গিয়েছি। অনেককে অনুরোধ করেছি। কেউ কেউ তো এমন উন্নাসিক ছিলেন যে পাত্তাই দেয়নি। অনেকে বিরক্ত হয়েছেন। কেউ লেখা দেখে বলেছে, ‘কাগজের ওপর কলম চালালেই লেখা হয় না। দু’চারটে লাইন শব্দ দিয়ে টেনে-টুনে লম্বা করলে লেখক হওয়া যায় না। একরাশ দীর্ঘশ^াস আর হতাশার হেমলক বিষে নিজেকে চুবিয়ে নেমে পড়েছিলাম পথে। হেঁটেছি অনন্ত পথ অন্যমনস্কতায়। তবু লক্ষ্যহীন উদ্দেশ্যহীন হইনি’- বলে যাচ্ছেন হিরন্ময়।
মিলনায়তনের শে^ত আলোরা আগের চেয়ে আরো ক্ষীণতর হয়ে উঠেছে। বিচ্ছুরিত বিকিরণের ষড়রশ্মিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে অবাঞ্চিত কথামালারা। শব্দেরা হৃদয় ছুঁয়ে শরীরে বেত্রাঘাত করে যাচ্ছে অনবরত। অমিয় ইন্দ্রজালে শব্দতীর মনকে বিদ্ধ করছে এ ফোড় ও ফোড়। নীলরতনের মধ্যে অস্বস্তি বাড়ছে। তার মনের ভেতর চলছে সকরুণ যুদ্ধ। তার নিজের কাছে নিজের কথার প্রতিধ্বণি হচ্ছে, ‘এগুলো কি ছাপার যোগ্য? তোমার লেখা ছাপা হবে না। যত্ত সব উজবুকের দল। দু’কলম লিখেই লেখক হতে চলে এসেছে।’
হিরন্ময়ের বিধ্বস্ত মনের ব্যথা বুঝতে পেরে মনোরঞ্জন স¯েœহে বলেছিল, ‘লেখক হতে দু’চার পয়সা খরচ করতে হবে। তুমি সদস্য হয়ে যাও। ল্যাঠা চুকে যাবে। লেখাও ছাপা হবে।’ হিরন্ময়ের মনে আশারা বাসা বাঁধে। চোখের অশ্রুতে দৃঢ়তা বাড়ে। পিচঢালা তপ্তপথের দহনে সংকল্পরা শাণিত হয়।
একজন লেখকের কাছে তার লেখাটা সন্তানের মতো। সন্তান প্রসবের বেদনা আছে। আছে কষ্ট আর ধৈর্য। আছে আনন্দ আর সৃষ্টি সুখের উম্মাদনা। একটা লেখার প্রকাশ মানে একজন লেখকের আত্মপ্রকাশ। লেখার মাধ্যমে হয় একজন লেখকের পুনর্জন্ম। নতুন করে নিজেকে চেনায়। নতুন পরিচয়ে পরিচিত হয়। নবতর রূপে আখ্যা লাভ করে।
‘তুমি লেখে যাও। ছাপা হলো কি হলো না তা চিন্তা করার কিছু নাই। তুমি দু’ একটা লেখা আমাকে দাও। আমি ছাপিয়ে দেবো।’ কাঁধে হাত রেখে অনুপ যখন কথাগুলো বলছিল তখন হিরন্ময় কৃতজ্ঞতায় নত হয়ে পড়েছিল। তারপর থেকে অনুপের বদান্যতায় হিরন্ময়ের কতেক লেখা ছাপানো হলো দৈনিক পত্রিকায়। শহরে সাহিত্য পাড়ায় হিরন্ময় রাত-দুপুরে কারো কারো নূপুরের শব্দ হচ্ছিল। কারো কারো ক›েঠ ‘সাবাস’ শব্দটি উঠছিল। কারো কারো শক্ত হাতের পিঠ চাপড়ানো বাহবা পাচ্ছিল। আস্তে আস্তে লেখাটা তার জীবনের প্রাত্যাহিক কাজের অংশ হয়ে উঠল। অতঃপর লেখাটা তার জগতটাকে গ্রাস করে ফেললো। সে এখন লেখার সমুদ্রমাঝে ডুবে থাকে। সাঁতার কাটে। জলকেলি করে। রাগ-অনুরাগ, মান-অভিমান করে। দুঃখ-সুখের গল্প করে। হিরন্ময় আজ অনেক অর্জনের দ্বারপ্রান্তে। সাহিত্যের সুখে সুবাসিত।
তিনি বলে চলছেন, ‘মহাসমুদ্রের অজ¯্র জলকণা ভাসমান জাহাজকে ডুবাতে পারে না, যদি না তার ভেতর পানি প্রবেশ করে। তেমনি একজন মানুষ এ মহাপৃথিবীতে হীন হয় না, যদি না তার ভেতর অহংকার থাকে। অহংকারী মানুষ পৃথিবীর বোঝা। তাদের কারণে কতো প্রতিভার অপচয় হয়। কতো মেধা নষ্ট হয়। তাদের আমিত্বের কারণে জাতি-ধর্ম ও সম্প্রদায় বিপদগ্রস্ত হয়। অহংকার অগ্নির মতো সব জ¦ালিয়ে ছারখার করে দেয়।’
নীলরতন বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছেন। মাথাটা খুব ধরেছে। কান-জিহ্বা ভারী হয়ে আসছে। চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে আসছে। শব্দরা আস্তে আস্তে অবলুপ্ত হতে শুরু করেছে। হিরন্ময়ের কথা এখনো হলের নিস্তব্ধতা ভেঙে ভাসছে বাতাসের মোলায়েম শরীরে –
‘নিজের আসন হারানোর ভয়ে কিংবা নিজের সমকক্ষ হয়ে উঠবে এই ভয়ে অনেকে অন্যদের সুযোগ দিতে চায় না। এটা তাদের হীনমন্যতা বৈ আর কিছু নয়। আপনি জ্ঞানী, মহাজ্ঞানী। দেশ-কাল-সমাজে আপনার অবদানকে মূল্যায়ন করার জন্য তো একজন উপযুক্ত সহচর কিংবা ছাত্র কিংবা বন্ধু দরকার। আপনি যদি সেই বন্ধু বা সহচর সৃষ্টি করে না যেতে পারেন তাহলে আপনার জীবদ্দশায় অথবা মৃত্যুর পর আপনাকে তুলে ধরার আর কেউ থাকবে না। আপনার হীনমন্যতা ও অহংকারের কারণে, ভয়ের কারণে আপনি কালের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবেন। এক জীবনের সব অর্জন বৃথা ও ব্যর্থ পড়ে রবে…’
বিকট শব্দে চেয়ার থেকে পড়ে গেলেন নীলরতন। মাইক্রোফোন ছেড়ে ছুটে আসছেন হিরন্ময়। অন্ধকারে খেই হারিয়ে পড়ে গেলেন। বন্ধ চোখ খুলে দেখলেন ঘুমঘোরে খাট থেকে মেঝে পড়ে আছেন হিরন্ময়। বাইরে প্রচ- বাতাস আর অঝরধারায় বর্ষিত হচ্ছে বৃষ্টি। বাতাসের প্রচ-তায় জানালার কপাট ভেঙে পড়েছে। জানালার ফাঁক গলে বৃষ্টির পানিতে সয়লাব ঘরের মেঝ। বাতাসে উড়ে টেবিলে থাকা হিরন্ময়ের লেখারা পানিতে ভিজে একাকার। সব লেখা খেয়ে নিয়েছে বর্ষার জল। সব হারানোর বেদনা নিয়ে সদ্য ঘুম ও স্বপ্ন ভাঙা বিস্বাদ বদনে নিরস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জলে ভেজা ছিন্ন-ভিন্ন লেখা কাগজের তলিয়ে যাওয়ার দিকে। বজ্র হাওয়া আর বৃষ্টির পানি ধুয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছে তার লেখক হওয়ার আজন্ম লালিত স্বপ্ন …………….
অমল বড়ুয়া, প্রাবন্ধিক ও গল্পকার