বাবুল সিদ্দিক : আরজ আলী মাতুব্বর একজন দার্শনিক, চিন্তাবিদ এবং লেখক ছিলেন। তার প্রকৃত নাম ছিল আরজ আলী। পুরুষানুক্রমে আঞ্চলিক ভূস্বামী হওয়ার সুবাদে তার নামের শেষে মাতুব্বর’ যুক্ত হয়। গ্রামের মক্তবে কিছুকালে পড়াশোনা করেন, সেখানে শুধু কোরআন ও ইসলামের ইতিহাসের উপর শিক্ষা দেওয়া হত। তিনি নিজের চেষ্টা ও সাধনায় বিজ্ঞান, ইতিহাস,ধর্ম ,দর্শন সহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। ধর্ম, জগত ও জীবন সম্পর্কে নানামুখী জিজ্ঞাসা তার লেখায় উঠে এসেছে। তিনি ৮৫ বৎসর জীবন কালে ৫০ বৎসর কাটিয়েছেন লাইব্রেরিতে পড়াশোনা করে। জ্ঞান বিতরণের জন্য তিনি গড়ে তুলেছিলেন ‘আরজ মঞ্জিল পাবলিক লাইব্রেরি। তিনি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্য পদ (১৯৮৫), বাংলাদেশ লেখক শিবির হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৮), উদীচী শিল্প গোষ্ঠীর বরিশাল শাখা সন্মাননা (১৯৮২) লাভ করেন। তিনি ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ বরিশাল শের-এ-বাংলা মেডিকেল কলেজে মৃত্যুবরন করেন।
প্রথম জীবন :- আরজ আলী মাতুব্বর ১৯০০ সালের ১৭ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বরিশাল জেলার অন্তর্গত চরবাড়িয়া ইউনিয়নের লামছড়ি গ্রামে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতার নাম এন্তাজ আলী মাতুব্বর। তার মা অত্যন্ত পরহেজগার মহিলা ছিলেন। পরিবারে তারা ছিলেন পাঁচ ভাই বোন। আরজ আলী নিজ গ্রামের সতীনাথ বসাকের কাছে ‘আদর্শ লিপি’ পড়েছেন। এছাড়াও তিনি স্থানীয় মক্তবে কোরান ও ইসলামিক ইতিহাস বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরে এক সহৃদয় ব্যক্তির সহায়তায় তিনি স্কুলের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। সাথে সাথে তিনি নিজের ঐকান্তিক চেষ্টার লেখাপড়া শিখতে থাকেন। নিজের জ্ঞানের পিপাসা মিটাতে তিনি বরিশাল পাবলিক লাইব্রেরির সমস্ত বাংলা বই একজন মনোযোগী ছাত্রের মত পড়তেন। দর্শন ছিল তার প্রিয় বিষয়। কিন্তু পাঠাগারে পর্যাপ্ত বই ছিল না। পরে বি, এম কলেজের দর্শনের একজন শিক্ষক কাজী গোলাম কাদির তার জ্ঞানগর্ভ বিচারিক ক্ষমতা দেখে মোহিত হন এবং তিনি মহাবিদ্যালয়ের পাঠাগার থেকে বই ধার দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এভাবেই তার মানসিক বিকাশ গঠিত হয়। তিনি নিজ চেষ্টা ও সাধনায় ইতিহাস, ধর্ম ও দর্শনসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করেন। ধর্ম, জগত ও জীবন সম্পর্কে নানা মুখি জিজ্ঞাসা তার লেখায় উঠে আসে।
পৈতৃক পেশা কৃষিকাজ দিয়েই তার কর্মজীবন শুরু। কৃষি কাজের অবসরে জমি জরিপের কাজ করে তিনি আমিন পেশায় সুদক্ষ এবং গাণিতিক ও জ্যামিতিক নিয়ম সম্পর্কে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন।
একজন মননশীল দার্শনিক হয়ে ওঠার পিছনে তার এক ভয়ঙ্কর এবং পীড়াদায়ক ঘটনা লুকিয়ে আছে। আরজ আলীর কিশোর বয়সেই তার মা মারা যান। মা মারা যাবার পর তিনি লক্ষ করলেন, মায়ের তো কোন ছবি নাই তার কাছে। আসলে কোন দিন ছবি তোলাই হয় নাই। কিশোর বয়সের আবেগ থেকে তিনি বুঝলেন, মায়ের একটা ছবি তুলে রাখা দরকার। যখন মাকে দেখতে মন চাইবে তখন যেন মাকে দেখতে পারেন। তিনি বরিশাল শহর থেকে ফটোগ্রাফ এনে মৃত মায়ের ছবি তুললেন। এটা ১৯১৫-১৬ সালের দিকের কথা। সেই সময় গ্রামে ধর্মীয় কুসংস্কার, গোঁড়ামি ছিল প্রচন্ডভাবে। ছবি তোলা ছিল ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সম্পূর্ন নিষিদ্ধ। তার উপরে মৃত মানুষের ছবি তোলার তো প্রশ্নই ওঠে না। আরজ আলী মাতুব্বর তার মৃত মায়ের ছবি তুলেছেনÑ এটা মসজিদের ইমাম সাহেব জানতে পারার পর তিনি মৃতের জানাজা পড়তে অস্বীকৃতি জানান। কোন হুজুরই সেদিন জানাজা পড়তে রাজি হন নাই। আরজ আলী প্রশ্ন তুললেন, ‘ছবি তুলে ভুল বা দোষ করে থাকলে তিনি করেছেন, তার মৃত মা তো কোন দোষ করেন নাই। শাস্তি দিতে হলে তাকে দিক, তিনি মাথা পেতে নেবেন। কিন্তু তার মা একজন নামাজি,পরহেজগার মহিলা ছিলেন তার জানাজা কেন পড়ানো হবে না? কিন্তু ঈমাম সাহেব তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। অগত্যা বাড়ির কয়েকজন মুরব্বি নিয়ে জানাজা নামাজের কাজ সমাপ্ত করা হয়।
এই ঘটনা আরজ আলী মাতুব্বরের মনে গভীর ভাবে প্রভাব ফেলে এবং ধর্ম সম্পর্কে জানাতে তাকে উৎসাহী করে তোলে। তারপর থেকেই আস্তে আস্তে অন্ধকার, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁডামির বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন আরজ আলী মাতুব্বর। তার লেখার সবটাই ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামির ও ধর্মের নামে ব্যবসার বিরুদ্ধে।
আর্থিক সংকটের কারণে মাতুব্বর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেন নাই। কৃষি কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি জমি জমা সংক্রান্ত আমিনের কাজ শিখে নেন। এরপর জমি জরিপের কাজকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন। কৃষিকাজের জন্য এভাবে কিছু পুঁজি জমা করেন। নিজের শ্রম, মেধা ও বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে তিনি আর্থিক অবস্থার উন্নতি করেন এবং মহাজন ও জমিদারদের কাছ থেকে বন্ধকিকৃত জমিজমা উদ্ধার করেন।
আরজ আলী মাতুব্বর ২৯ অগ্রহায়ন, ১৩২৯ বাংলা সনে লালমোন্নেসাকে বিয়ে করেন। এই ঘরে তাদের তিন মেয়ে ও এক ছেলে। পরে তিনি পাশের গ্রামের আব্দুল করিম মৃধার মেয়ে সুফিয়াকে বিয়ে করেন। এ সংসারে তার চার মেয়ে ও দুই ছেলে। তিনি দশ সন্তানের জনক ছিলেন।
আরজ আলী মূলত বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরূদ্ধ লেখালেখি করেন। তার রচনায় মুক্তচিন্তা ও যুক্তিবাদী দর্শনিক প্রজ্ঞার ছাপ রয়েছে। মানবকল্যাণ ও বিশ্ব ধর্মের আদর্শে উদ্ভুদ্ধ হয়ে তিনি দরিদ্র ও মেধাবি ছাত্রদের জন্য বৃত্তি প্রদান এ পাঠাগার স্থাপন ও রচনা প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করেন। তিনি মরণোত্তর নিজ দেহ ও চক্ষু মানবতার সেবায় উৎসর্গ করেন। মাতুব্বরের বরিশালের বি,এম কলেজের অধ্যাপক কাজী গোলাম কাদির, অধ্যাপক মুহাম্মদ সামসুল হক সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তার বিশ্বাস, অভিজ্ঞতার কথা তিনি একাধিক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। তার লিখিত বইয়ের মধ্যে সত্যের সন্ধান’সিজের ফুল’ সৃষ্টি রহস্য শয়তানের জবানবন্দী’। আরজ আলী রচিত পান্ডুলিপির সংখ্যা মোট ১৫টি। এরমধ্যে তার জীবদ্দশায় প্রকাশিত হয়েছিল চারটি। এগুলো হল সত্যের সন্ধানে (১৯৭৩) সৃষ্টি রহস্য (১৯৭৭) অনুমান (১৯৮৩) স্মরণিকা (১৯৮৪)। মাতুব্বর তার প্রথম বইয়ের প্রচ্ছদ নিজেই আঁকেন। বইটি লিখেছিলেন ১৯৫২ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে সত্যের সন্ধানে শিরনামে। বইটি তাকে প্রচুর সুনাম এনে দিয়েছিল। মুখবন্ধে তিনি লিখেছিলেন আমি অনেক কিছু ভাবছি। আমার মনে প্রশ্ন ভরপুর কিন্তু এলোমেলোভাবে। আমি যখন প্রশ্নের সংক্ষেপণ লিখতে থাকি, বই লেখার জন্য নয় শুধুমাত্র পরবর্তীকালে মনে করার জন্য। অসীম সমুদ্রের মত সেই প্রশ্নগুলো আমার মনে গেঁথে আছে এবং আমি ধীরে ধীরে ধর্মীয় গন্ডি বের হতে থাকি।
পাকিস্তান সরকার আমলে তার লেখালেখির জন্য তিনি সমালোচিত ও অভিযুক্ত হয়েছিলেন। সে সময় তার লেখালেখি নিষিদ্ধ ছিল।
মরণোত্তর কিছু অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি আরজ আলী মাতুব্বরের রচনাবলির শিরোনামে প্রকাশিত হয়। তার কিছু লেখা ইংরেজিতে ভাষান্তর করা হয়েছে এবং পাঠকসমাজ কতৃক সেগুলো খন্ডাকারে প্রকাশ করা হয়। তাছাড়া তার আরও কিছু অপ্রকাশিত গ্রন্থ রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে – ‘ম্যাকগ্লেসান চুলা’ (১৯৫০ )।
মৃত্যু : – আরজ আলী মাতুব্বর ১৯৮৫ সালের ১৫ মার্চ ৮৫ বৎসর বয়সে বরিশাল শের এ বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মেডিকেল কলেজের শিক্ষাথীদের শিক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্য শের এ বাংলা মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগে তিনি তার মরনোত্তর দেহ দান করে গেছেন।
সম্মাননা : –
# হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার ( ১৩৮৫ বা: )
# বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী কর্তৃক বরণীয় মনীষী
হিসাবে সন্মাননা ( ১৩৯২ )
# বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ কর্তৃক তার স্মরনে আরজ
আলী মাতুব্বর স্মারক’ বক্তৃতার আয়োজন করে
থাকে ।
আমার কথা:- আরজ আলী মাতুব্বরকে আমি চিনতাম এবং তার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। বরিশাল শহরের সদর রোডস্থ দেলোয়ার ভাইর ‘তরুণ লাইব্রেরি’ তে প্রায়ই আসতেন। সে সময় ‘তরুন লাইবেরি’ বরিশালের ছাত্র ও শিক্ষিত মহলে সুপরিচিত একটি বই-এর দোকান ছিল। তরুন লাইব্রেরির মালিক দেলোয়ার ভাইর সাথেও তার সুসম্পর্ক ছিল। ওইখানেই মাতুব্বরের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমি তখন কলেজের ছাত্র। আমার নানা আলহাজ্ব মোহাম্মদ আলী সরদারকে ওনি চিনতেন ও তার সাথে ঘনিষ্টতা ছিল। নানা ছিলেন সদর সাব রেজিস্ট্রারি অফিসের প্রধান সহকারী। সে সুবাদে উনাকে আমি’ নানাভাই‘ বলে ডাকতাম। দেখতাম, তরুণ লাইব্রেরি এক কোনে বসে ঘণ্টার পর ঘন্টা পড়াশোনায় মগ্ন থাকতেন। কথা খুব কম বলতেন। অতি সাধারণ পোষাক পরিচ্ছদ, একদম নিরীহ গোবেচারা মানুষ ছিলেন। তখন জানতাম না, উনি এতবড় একজন মানুষ, পরে তা জেনেছি।
বাবুল সিদ্দিক, প্রাবন্ধিক, নিউ ইয়র্ক প্রবাসী