এখন সময়:সকাল ৭:৪৬- আজ: বৃহস্পতিবার-১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:সকাল ৭:৪৬- আজ: বৃহস্পতিবার
১৪ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৯শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

স্বাধীনতা-অভিলাষী পত্রপত্রিকার ভূমিকা (১৯৪৭-৭১)

ইসরাইল খান : যুদ্ধপূর্বকালে যে সকল পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়, তা ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধে সদর্থক মননশীল ভূমিকা পালন করে প্রধানত সাহিত্যিক কার্যাবলির মাধ্যমে। এখানে ঐকালের পত্রপত্রিকার ভূমিকা উপলব্ধির জন্যে মনস্বী মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরীর একটি উক্তি চয়ন করছি। এতে যে সকল মনীষী দার্শনিকের নাম তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁরা সাহিত্যের মাধ্যমে জাতিকে রাজনৈতিক দর্শন প্রচার করে অস্ত্রবিহীন যুদ্ধই করেছিলেন বুঝতে কষ্ট হয় না। তিনি বলেন :

“শুন! সাহিত্যচর্চা বিলাস পরিতৃপ্তি নহে, বিশ্রাম-সময়ের বিশ্রাম্ভালাপ নহে। সাহিত্য জীবনের সাধ, সাহিত্য সাধনা, সাহিত্য আরাধনার ধন ।… সাহিত্য জাতির প্রাণরস, সাহিত্য স্ফূর্তি। চিরদিন মাতৃভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় এবং সাধনায় জাতি উঠিয়াছে, এখনও উঠিবে। …ফরাসি রাষ্ট্রবিপ্লবের যে দাবদাহ ইয়োরোপের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত ধ্বংসের ক্রিয়া অনুষ্ঠান করিয়া দিয়া গেল, ফরাসীর যে জাতীয় শক্তির প্রচন্ড আঘাতে ইয়োরোপের সমস্ত রাজশক্তি চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া গেল, তাহা কিসের শক্তি?… সে শক্তির উন্মেষের জন্য প্রথমেই অপরাজেয় বোনাপার্ট কামান লইয়া আবির্ভূত হন নাই….তাহা সাহিত্যের শক্তি, তাহা রুশো ও ভল্টেয়ারের লেখনীর শক্তি।…মাতৃভাষার চর্চায় সাহিত্যের সাধনায়  কেন প্রত্যেক জাতি এমন করিয়া সাড়া দেয়? তাহার প্রাণের তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে  কেন এমন করিয়া ঝংকার উঠে?” ঝনৎকার ওঠে, কারণ সাহিত্যে মানুষের অন্তরের আকাক্সক্ষাটি অকৃত্রিমভাবে প্রতিধ্বনিত হলে তা পাঠে সহৃদয়-হৃদয়-সংবেদীর অন্তরে সত্য, ন্যায় ও সুন্দরের আকাক্সক্ষা জাগ্রত হয়, স্বাধীনতার চেতনা দুর্বার হয়। আর কামানের শক্তির চেয়ে ‘সাহিত্যের শক্তি’ যে অধিক তা বলাই বাহুল্য। মাও সেতুঙের আরেকটি কথা স¥রণ করছি। তিনি বলেছিলেন : ‘সাহিত্য ও শিল্পকলার জগতে শিল্প-সাহিত্যের আলোচনা হচ্ছে সংগ্রামের অন্যতম উপায়।’পূর্ববঙ্গে বাঙালির ঐতিহ্যিক সংস্কৃতি ও শিল্প-সাহিত্য যখন পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শাসকচক্রের ষড়যন্ত্রে ধ্বংসের সম্মুখীন হলো, তখন সেই গভীর জাতীয় সংকট ও মূল্যবোধের শূন্যতার কালে প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল জাতীয় চেতনাঋদ্ধ সুস্থ বাঙালি-ভাবাপন্ন জাতীয় সংস্কৃতি ও সাহিত্যচর্চার উন্মুক্ত-উপযুক্ত পারিপার্শ্বিকতা। দরকার ছিল সেজন্যে ভাল সাময়িকী ও সংবাদপত্রের। আর সঙ্গীত নৃত্য অভিনয় অঙ্কন প্রভৃতি ধারার সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করার দায়িত্ব ছিল যাদের, তারা কিছুই করতে পারলেন না অর্থাৎ পাকিস্তানী শাসকদের নিষেধাজ্ঞায়, সাবধানী শর্তের ফলে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গড়াল যে বাঙালি সংস্কৃতি ও গণসংস্কৃতির চর্চা গণ্য হতে লাগল রীতিমত নিষিদ্ধ কমিউনিস্ট কার্যাবলী হিসাবে। আর ‘ভারতের দালাল’, ‘পাকিস্তানের শত্রু’, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ ছাড়া যে কেউ বাঙালি-সংস্কৃতির চর্চা করতে পারে, তা ছিল সরকারি  বিবেচনায় তখন অসম্ভব ও অবাস্তব। একে আরও ভয়াবহ করে তুলেছিল পাকিস্তানপন্থী স্বদেশি দালাল কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা। তাঁরা ঘরের শত্রু বিভীষণের মত তখন জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে চরম শত্রুতা ও বিরোধিতা করতে লাগলেন।

এরই মধ্যে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে চলতে লাগল বাঙালি জাতীয়তাবাদের সমর্থক পত্রিকাকর্মীদের কার্যক্রম। এ ধারায় ইত্তেফাক প্রকাশের আগে পূর্বোক্ত কতিপয় রাজনৈতিক সাপ্তাহিকীর সঙ্গে যুক্ত হলো কিছু ক্ষুদ্রাকায় সাময়িকী। প্রধানত একুশের চেতনা সৃষ্টি ও বৃদ্ধিতে আত্মনিয়োগ করে এগিয়ে যেতে থাকে তাঁদের সাংস্কৃতিক কার্যাদি। প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় নারায়ণগঞ্জের ‘কৃষ্টি’র কথা। ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক প্রবন্ধে ১৯৪৭ সনেই মনীষী ডক্টর মুহম্মদ এনামুল হক পাকিস্তানী শাসকদের উদ্দেশ্যে হুঁশিয়াারি উচ্চারণ করে বলেন, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষারূপে মেনে না নিলে পাকিস্তান ভেঙে যাবে।

এ ধারায় একই সঙ্গে একুশের চেতনা সম্প্রচারে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত হয় ‘সীমান্ত’(১৯৪৭-৫২)। স্মরণীয় যে, এই পত্রিকার সম্পাদক মাহবুব উল আলম চৌধুরীই হচ্ছেন একুশের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’র প্রণেতা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাসে প্রারম্ভিক সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হিসেবে খ্যাত হরিখোলার মাঠে অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম শিল্প সাহিত্য সম্মেলনের অন্যতম উদ্যোক্তা। ‘সীমান্ত’ ছিল অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী সাহিত্যিক ও শৈল্পিক ভাবধারা প্রচারের অন্যতম বাহন। বস্তুতপক্ষে এই পত্রিকা এবং এর লেখক সম্পাদকগণ একুশের চেতনার প্রকৃত সুরটি বেঁধে দিয়েছিলেন। তাঁরা যে পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের ফাঁসির দাবী করেছিলেন, ১৯৭১ সনে সেইসব খুনিদের ফাঁসিসম চির-বিদায় পতন-পরাজয় সুনিশ্চিত হয়েছিল।

সীমান্তর ধারায় ফজলে  লোহানী প্রতিষ্ঠিত অগত্যা, আবদুল গণি হাজারী ও মাহবুব জামাল জাহেদী সম্পাদিত মুক্তি, চট্টগ্রামের অন্যতম পত্রিকা মফিজ উল হক গং সম্পাদিত পরিচিতি, ঢাকার যাত্রিক, ইমরোজ, সওগাত, স্পন্দন, সমকাল, উত্তরণ, পূবালী, পূর্বমেঘ, নাগরিক, পলিমাটি প্রভৃতি পুরো পাকিস্তানি শাসনামলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা সঞ্চারে, বাঙালির শোষিত হবার চিত্র উদঘাটন করে একাত্তরের সশস্ত্র স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হবার পটভূমি সার্থক ভাবেই তৈরি করে দিয়েছিল। এই কাজ তাঁরা করেছিলেন সর্বাত্মক ‘স্বাধীনতা’ উপভোগের জীবনপণ যুদ্ধংদেহী মনোভাব নিয়ে।

সাংস্কৃতিক রাজনীতি চর্চার জন্য এই সকল কাগজে প্রকাশিত হয়েছে কবিতা, গান, গল্প, উপন্যাস, নাটক, নক্শা, সাহিত্য-সমালোচনা। স্বাধীনতাযুদ্ধে পত্রপত্রিকার ভূমিকাকে স্পষ্টতর করে তোলার জন্যে এখানে দৈনিক ইত্তেফাক, অবজারভার পত্রিকা বন্ধ ঘোষণা ও সেসবের কার্যালয় ধ্বংসের ইতিবৃত্ত স্মরণ করা যেতে পারে। সকলেই জানেন, সেকালে বাঙালির স্বার্থ রক্ষামূলক বক্তব্য প্রকাশ ও প্রচার করার জন্যে সম্পাদক ও লেখকগণকে কারাগারে অন্তরীণ করা হয়েছে। আইন করে সাজার মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। স্বাধীনতা অর্জনের পরে, জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণমূলক রাজনীতি প্রচার করার কারণে, স্বাধীনতাকে অর্থবহ করার আন্দোলন করার জন্যে কোনো সম্পাদক ও প্রকাশক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মত জেল খাটেননি; আর পত্রিকাও উঠে যায়নি, সাংবাদিকরা হারান নি চাকুরি। এ-কারণেই যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে পত্রিপত্রিকার ভূমিকা তথা অস্ত্রহীন রাজনীতিক যুদ্ধের ধারণাচেতনায় বিকৃতি ঘটেছে বলা হয়েছিল। এবং পত্রপত্রিকার অযথার্থ বেঠিক ভূমিকা পালন করার জন্যই স্বাধীন বাংলাদেশে নিঃরাজনীতিকরণে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়নি।

যাহোক, পাকিস্তান আমলের বাংলা পত্রিকাগুলোর অস্ত্রছাড়া মসীযুদ্ধ পরিচালনার দুটো নমুনা উপস্থাপন করছি। এ থেকে তখনকার পত্রিকাগুলোর ভূমিকা বোঝা যাবে। ১৯৫৮ সনের আইউবী সামরিক শাসনের ফলে সকল নাগরিক ও মৌলিক অধিকার হৃত হলে লেখক শিল্পীরাও ভয় পেয়ে কলম ছেড়ে দেন। পত্র-পত্রিকায় বাঙালির স্বার্থ নিয়ে লেখা হচ্ছে না। বলা বাহুল্য ১৯৪৭ থেকে ৫৮ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাভাষীদের বুঝতে বাকি থাকে না যে তাদের আর এক রাষ্ট্রকাঠামোতে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু শাসক গোষ্ঠীর কারসাজিতে এবং নেতৃবর্গের বোকামির ফলে স্বাধীনতার সম্ভাবনা বারে বারেই তিরোহিত হতে বসেছিল। কিন্তু সমকাল, ইত্তেফাক প্রভৃতি দু চারটে প্রধান পত্রিকার অনলবর্ষী যুক্তিবাদী লেখার কারণেই বাঙালি সঠিক পথটি হারায়নি।

সামরিক শাসকদের শিল্পী তোষণের জন্য গঠিত ‘পাকিস্তান রাইটার্স গিল্ড’ বা লেখক-সংঘের পতাকাতলে একত্রিত হয়ে ক্লীব সেজেছিলেন বাঙলার সেরা লেখক সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরাও। মুনীর চৌধুরী, আনিসুজ্জামান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান হাফিজুর রহমান, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, রফিকুল ইসলাম, মুহম্মদ এনামুল হক, জসীমউদদীন, কে না–সকলেই সরকারি সংগঠনের সদস্য হয়ে নিরাপদ-নির্বীয চিন্তা-চেতনায় আত্মসমর্পণকারী,স্বার্থভোগকারী। এমতাবস্থায় তৎকালীন ছাত্রনেতা এনামুল হক সম্পাদিত ‘উত্তরণ’ শীর্ষক দ্বি-মাসিক সাহিত্যপত্রিকায় মনীষী আবুল ফজল লেখেন আলোড়ন সৃষ্টিকারী একই সঙ্গে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী প্রবন্ধ ‘শিল্পীর স্বাধীনতা’। এই প্রবন্ধের একটি উক্তি প্রবাদের মতো তখন সকলের মুখে মুখে ফিরত যথা ঃ ‘পোষা বাঘ যেমন পুরোপুরি বাঘ নয়, তেমনি পোষা শিল্পীও খাঁটি শিল্পী নয়।’ তিনি বাঙালি সকলকে ‘খাঁটি’ হবার সাধনায় উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মানুষের নিজস্ব বলতে একমাত্র জিনিস হচ্ছে মনের চিন্তা। আর সেই চিন্তা প্রকাশ করতে গিয়ে সব সময় রাষ্ট্রের কর্ণধারদের আরোপিত সুরে কণ্ঠ মিলাতে না পারলেও সব সময় খুব দোষের হয় না, মানুষ রাষ্ট্রদ্রোহী হয় না। তিনি আরও বলেন, যেসব বৃত্তি মানুষকে পশু থেকে পৃথক করেছে, তার মধ্যে সবার সেরা হচ্ছে রিজন বা যুক্তি। যুক্তি তথা রিজন এর চর্চা অব্যাহত রাখতে, আর সমাজকে নৈতিক ও মানসিক দাসত্বের হাত থেকে বাঁচাতে হলে, স্বাধীনভাবে চিন্তা করবার ও সেই চিন্তাকে প্রকাশ ও গ্রহণ করবার অধিকার মানতেই হবে, সমাজকে দিতেই হবে সেটুকু স্বাধিকার। নইলে স্বাধীনতার কোন মানেই থাকে না। সেকালে পাকিস্তানি স্বাধীনতায় যে কোন উন্নতমানের নাগরিক অধিকার ছিল না সেকথা এই রচনাপাঠে বোঝা গিয়েছিল এবং ‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায়  হে’ প্রশ্ন উচ্চকিত করেছিল। সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত ‘সমকালে’ আবুল ফজল লিখেছিলেন ‘সাহিত্যের সংকট’ শীর্ষক প্রবন্ধ। তাতে তিনি লিখেছিলেন ঃ

এ যুগের সাহিত্যিক শিল্পীরা কালের ও রাষ্ট্রের যূপকাষ্ঠে এক রকম বলি বললেই চলে। শহীদ তাঁরা নন, তাঁরা আজ হাঁড়ি কাঠের বলি। স্বাধীনতার পর দেশের যা অবস্থা হয়েছে, সেই অবস্থার যূপকাষ্ঠে সাহিত্যিক শিল্পীরাই হচ্ছেন নির্ভেজাল বলি। স্বাধীনতার পর থেকেই ভাষার উপর চলেছে এক উৎপাৎ। দেশের জন্য ও দেশের মানুষের জন্য সেই আবেগ ও প্রেরণার দেশগত ও জাতিগত ঐক্যবোধ আজ নিশ্চিহ্ন। ফলে আমাদের বাহিরে ও ভিতরে সর্বত্র এক নৈরাজ্য।…আমরা কী লিখলে, কেমন করে লিখলে শাসকদের বিষনজরে পড়ব না তাও আমাদের এক দুশ্চিন্তা।’

এই প্রসঙ্গে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বা অখন্ডতা যে বাংলাদেশের সাহিত্যের জন্য ক্ষতিকর, তাও তিনি বলেন ঃ ‘আমাদের মনের সামনে, চোখের সামনে পাকিস্তান বলে কোন দেশ নেই, আছে পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তান। সমগ্র পাকিস্তানের পটভূমিতে, তাঁর ঐতিহ্য ও মানুষের জীবন নিয়ে কিছু লেখা আজ কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। মন-মানসে আমরা আজ হয় পূর্ব পাকিস্তানি না হয় পশ্চিম পাকিস্তানি ।…‘ইসলাম’ ও ‘পাকিস্তান’ আজ এই ভাবে এঁদের মুখে ম্যাজিক বুলিতে পরিণত হয়েছে।’

এইরূপ অনেক লেখাই সমকাল ছেপেছে। ‘শিল্পীর প্রতি সমাজের কর্তব্য’, ‘লেখকের স্বাধীনতা ও সামাজিক দায়িত্ব’, ‘আমাদের সাহিত্যের ঐতিহ্য’, ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’, ‘মুসলিম-স্বাতন্ত্র্যের পরিপ্রেক্ষিতে রবীন্দ্রনাথ’, ‘মানবতন্ত্র’, ‘আমাদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার’ প্রভৃতি প্রসঙ্গে বহু জিজ্ঞাসা, তাড়না ও জাগরণমূলক নানা লেখায় তিনি পাকিস্তানের অস্তিত্বের মূলে অনবরত আঘাত হেনে চলেছিলেন।

মনীষী আবদুল হকও স্বনামে এবং আবু রায়হান ও আবু আহসান ছদ্মনামে সমকালে যেসমস্ত প্রবন্ধ লিখেছিলেন, তাতে পূর্ববঙ্গের সঙ্গে তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। জাতীয়তার প্রশ্নে ঘুমন্ত বাঙালিকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তোলা হচ্ছিল তাঁর বিভিন্ন রচনায়। তিনি ‘রাজনীতি সাহিত্য ও সংস্কৃতি’, ‘সাহিত্যিক মূল্যবোধ’, ‘ভাষা স্বদেশ সত্তা’, ‘নেতৃত্ব ও গণচেতনা’, ‘বাঙালি মুসলমান ঃ ভূমিকা ও নিয়তি’, ‘পূর্ব পাকিস্তান ঃ বাংলাদেশ’, ‘শিক্ষয়োজন ঃ বৈষম্য ও সংস্কৃতি’, ‘যুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতা’ প্রভৃতি বিষয়ে লিখেছিলেন। সেসবও পাকিস্তানকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। ‘রাজনীতি সাহিত্য ও সংস্কৃতি’ শীর্ষক আলোচনায় আবদুল হক বলেন : আমাদের প্রাক্তন নেতৃসমাজ শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন এবং এই কারণে সুকুমার মনোভঙ্গী এবং দৃষ্টিভঙ্গির অভাব ছিল তাঁদের মধ্যে বড় বেশি । তাঁরা ধর্ম, আধ্যাত্মিকতা অথবা অন্যান্য মহৎ নীতির কথা বলতেন এবং একটু বেশি করেই বলতেন। কিন্তু আসলে তাঁরা ছিলেন– ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিলেন––অবিশ্বাস্য রকমের বস্তুতান্ত্রিক… সূক্ষ্ম চেতনা, চিন্তা মূল্যবোধ তাদের জগতে ছিল একান্তই বিরল। রাজনৈতিক কূটচালের উল্লেখ করব না, সকলেই জানেন এই কূটচালের মধ্যেও সূক্ষ্মতা থাকত না। রাজনীতির বাইরেও সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক সবক্ষেত্রেই তাঁদের চিন্তা ছিল স্থূল এবং বক্তব্য ছিল আরও স্থূল।’

আবদুল হক পাকিস্তানের কর্ণধার, শাসকদের চরিত্র, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট স্মরণে রেখে বিশ্লেষণ করে বলেন, সমাজের সমৃদ্ধিতে ভালো করার চেয়ে মন্দ, ধ্বংস ও বিপর্যয় সাধনেই তাঁদের ভূমিকা বেশি। কারণ ভুল করে হোক, আর ঠিক করেই হোক, সাধারণ মানুষ নেতৃবৃন্দের জীবনধারা অনুসরণ করে থাকে। ‘তাঁদের অনুগ্রহেরও প্রত্যাশী তারা।’

অতএব যে দেশের নেতৃসমাজ নিছক স্বার্থের প্রেরণায় বহুরূপের উপাসক, অধিকন্তু শিল্প ও সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কহীন,  সেদেশের সমাজের মানসিক অধোগতির সীমা থাকে না এবং মানসিক অধোগতি যখন হয়, তখন অন্য অধোগতিই বা ঠেকায় কে? একথাও তো ঠিক, ‘জাতি সেই রকম নেতাই পেয়ে থাকে, যার সে উপযুক্ত।’

১৯৬৫ সনের ২ জানুয়াারিতে অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে মিস্ জিন্নার পরাজয়ের  প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বার্থ সমুন্নত রাখার ব্যাপারে বক্তব্য রাখতে গিয়ে আবদুল হক বলেন, সম্মিলিত বিরোধী দল পরিতাপের বিষয়, পূর্ব পাকিস্তানের নিজস্ব সুবিদিত অভিযোগগুলোর প্রশ্নে, তার প্রতি অবিচারগুলোর প্রশ্নে এবং প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে নির্বাচনী অভিযোগকালে সম্পূর্ণই নীরব ছিলেন। তাঁরা হয়ত নিখিল পাকিস্তান ঐক্যের খাতিরে এবং প্রতিপক্ষের ভয়ে এসব প্রশ্নের ওপর বেশি জোর দেওয়া সঙ্গত ছিল না বলে মনে করেছেন। কিন্তু এখানে এবং এখন, ষ্পষ্ট চিন্তার প্রয়োজন আছে। তা হলো, পাকিস্তান ঐতিহাসিক কারণ পরম্পরায় এক রাষ্ট্র হলেও চোখ বুঁজে বাস্তবকে অস্বীকার না করলে একথা মানতেই হবে যে, রাষ্ট্রের দুই অংশ আসলে সহস্রাধিক মাইল দ্বারা বিভক্ত দুটি স্বতন্ত্র দেশ এবং এই দুদেশের অধিবাসীরাও স্বতন্ত্র মানবগোষ্ঠী।…এই সব কারণে তাঁদের স্বার্থ এক রকম হতে পারে না। এই মৌলিক কথাটা উপলব্ধি না করলে পূর্ব পাকিস্তানীদের দুঃখ কোনকালে ঘুচবে না।

আবদুল হক পশ্চিম পাকিস্তানিদের অভিপ্রায়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পূর্ব পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দের সম্মিলিতভাবে নির্বাচনে অংশ নিয়ে বাঙলার স্বার্থ বিসর্জন দেয়া হয়েছে মর্মে বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন, তারা কি সার্বজনীন ভোটাধিকারের পরিণতি সম্পর্কে অবগত নন? সার্বজনীন ভোটাধিকারের অর্থ পূর্ব পাকিস্তানে ভোটের সংখ্যা বেশি হওয়া। এবং প্রত্যক্ষ নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের অর্থ আজ হোক, কাল হোক, কোনো পূর্বপাকিস্তানি প্রার্থীর নির্বাচিত হওয়া এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাধান্য বর্তমান অপেক্ষা অনেক খর্ব হয়ে যাওয়াা। অতএব ওখানে কিছু গণতন্ত্রমনা লোক থাকলেও অধিকাংশ লোক সার্বজনীন ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন চাইতে পারে না। এই বাস্তব পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করে নিখিল পাকিস্তান ভিত্তিতে নির্বাচনী ঐক্য গড়তে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মৌলস্বার্থকে চাপা দেওয়া হয়েছে এবং তার ফল এখন এই প্রদেশের জনসাধারণকেই ভুগতে হবে।

ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঘটে যাবার পরে সঠিক দিগন্তের পথে বাঙালির সংগ্রামের সময় আবদুল হক সমকালে  ‘নেতৃত্ব ও গণচেতনা’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে বিশ্লেষণ করেছিলেন জনগণের ভূমিকা কী হওয়া উচিত? তিনি বলেছিলেন, জনগণ যেমন নেতৃত্ব কামনা করে বা জনগণ যেমন নেতৃত্ব সৃষ্টিতে সক্ষম তেমন নেতৃত্বই সাধারণত তারা লাভ করে থাকে। তবু কখনও কখনও অসাধারণ ব্যক্তির জন্মলাভ হলে তাঁর দ্বারাও জনগণ সঠিকতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগঠিত হয়ে থাকে। তবে জাতির কল্যাণকামী অসাধারণ ব্যক্তির আবির্ভাব জাতির জন্য সৌভাগ্য। ঠিক প্রয়োজনের সময় আবির্ভূত হওয়া আরও বড় সৌভাগ্য। কিন্তু এইরূপ সৌভাগ্য সচরাচর ঘটে না বলেই জাতিকে শেষ পর্যন্ত তার অন্তর্নিহিত শক্তির উপরেই নির্ভর করতে হয়। এবং এছাড়া গত্যন্তর থাকে না।

কোনো জাতি যদি জনসংখ্যায় যথেষ্ট হয়, যদি তার বিশেষ সত্তা এবং সত্তাচেতনা; বিশেষ ঐতিহ্য এবং ঐতিহ্যচেতনা এবং অস্তিত্ব রক্ষার সংকল্প থাকে; তার জীবনদর্শন ও সামাজিক প্রথা আত্মঘাতি না হয়, যুগপৎ পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান এবং তার নিজের প্রয়োজনানুযায়ী পরিবর্তনের ক্ষমতা যদি তার থাকে, তবে সে বেঁচে থাকতে পারে।

আবদুল হক আরও বলেন, ‘কোনোও জাতির একটি বিশেষ ভূগোলও থাকা আবশ্যক। তবে বিশেষ ভূ ভাগ না থাকলেও উল্লিখিত চারিত্র লক্ষণগুলো থাকলে সে বেঁচে থাকতে পারে। এবং কোনো কোনো সময়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারে ; যেমন ইহুদিরা হতে পেরেছে। –এসব শর্ত পূরণ না হলে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যেতে হয়। অথবা কোনো প্রাগৈতিহাসিক জাতির ধ্বংসাবশেষের নিদর্শনরূপে বেঁচে থাকতে হয়।’ বাঙালির জাতিসত্তা সংরক্ষণের তাগিদে চমৎকার বলেন তিনি : ‘স্বাধীন জাতি অপেক্ষা পরাধীন জাতির বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। বিশেষত যদি সে জাতির নিজস্ব একটা উন্নত ভাষা, সংস্কৃতি এবং নিয়তিচেতনা না থাকে। . . শাসক-জাতির একটা স্বভাব হচ্ছে, তার অধীন জাতির আত্মচেতনায় এবং সংস্কৃতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা এবং তাকে নিজস্ব সংস্কৃতির আজ্ঞাবহ দাস করার প্রয়াাস পাওয়াা। অন্যদিকে জাতি যখন রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন, তখনও সংহতবোধ করতে পারে অবিচল নিয়তি-চেতনায়, প্রার্থিত স্থির লক্ষ্যে আর ঐ গিরীশীর্ষে উপনীত হওয়ার নিরন্তর স্তরে। একেক রকম পরিস্থিতিতে জাতীয়  লক্ষ্য একেক রকমের হতে পারে। স্বাধীনতার, অথবা নিছক-আত্মরক্ষা, অথবা জাতি যখন স্বাধীন, তখন শাসক সম্প্রদায় বা ক্ষমতারূঢ ব্যক্তির সৃষ্ট অবরুদ্ধ পরিবেশ থেকে মুক্তি, সৃষ্টিধর্মী অবাধ মানবীয় সম্ভাবনায় উত্তরণ, বিশিষ্ট মানবগোষ্ঠীরূপে আত্মপ্রতিষ্ঠা, জাতির বৈপ্লবিক রূপান্তর । এরূপ ক্ষেত্রে অসাধারণ ব্যক্তির নেতৃত্বলাভ প্রার্থিত লক্ষ্যের সম্পূরণ নিশ্চিত ও দ্রুত করতে পারে । কিন্তু বাংলাদেশে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব ঘটতে পারে উপযুক্ত সময়ে, সেজন্যে তিনি জনগণের আত্মশক্তিকে জাগিয়ে রাখার জন্যে বলে যান– ‘এমতাবস্থাতেও জনগোষ্ঠীর যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ সচেতন, নিষ্ঠাবান এবং কর্মিষ্ঠ হলে সর্ব-অবস্থাতেই তার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত রাখতে পারে। এবং প্রার্থিত লক্ষ্যের অন্তত আংশিক সম্পূরণ আশা করতে পারে।’

এখানে বিশেষভাবে আবদুল হকের বক্তব্য বিচার্য ১৯৭১ সনের যুদ্ধকালীন নয় মাসের প্রেক্ষিতে যে, জনগণের যথেষ্ট সংখ্যক সচেতন ছিলেন বলেই প্রবাসের বাংলাদেশ সরকারের কেবলমাত্র ইথারে ভেসে আসা নির্দেশ অনুসরণ করে যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলাম আমরা । তখন যুদ্ধ পরিচালনাকারী সরকার প্রধান, যুদ্ধের প্রধান কুশীলব, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে, হাজার মাইল দূরে। বস্তুত সমকাল, ইত্তেফাক প্রভৃতি জাতীয়তাবাদী পত্রিকাগুলো বাংলাদেশের মানুষের মনে মুক্তিযুদ্ধের যে-চেতনা সৃষ্টি করে দিয়েছিল, তার ভিত্তিতেই দীর্ঘ নয় মাস বাঙালির যুদ্ধ পরিচালনার মনোবল অক্ষুণœ ছিল। তদুপরি যুদ্ধকালীন একগুচ্ছ পত্র-পত্রিকার কার্যক্রম তো ছিলই ।

 

ইসরাইল খান : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

হান কাংঃ নৈতিক গল্প বলার নীরব শক্তির বেঁচে থাকা : আধুনিক কোরিয়ান সাহিত্যে হান কাং—এর আখ্যানশৈলী ও স্বায়ত্তশাসনের অন্বেষণ

হামিদ রায়হান হান কাং, দক্ষিণ কোরিয়ার ঔপন্যাসিক ও কবি, নোবেল পুরস্কার লাভের বহুপূর্বে বিশ্ব সাহিত্যে একটি অনন্য স্থান দখল করে আছেন তাঁর দ্য ভেজিটেরিয়ান— উপন্যাসের

সীতাকুণ্ড প্রেসক্লাবের নবনিবার্চিত কার্যকরি পরিষদ‘কে ফুলেল শুভেচ্ছা অব্যাহত 

সীতাকুণ্ড প্রেসক্লাবের দ্বি—বার্ষিক নিবার্চন পরবতীর্ নবনিবার্চিত কার্যকরি পরিষদ‘কে বিভিন্ন শ্রেণি—পেশাজীবিদের ফুলেল শুভেচ্ছা অব্যাহত আছে। প্রতিদিন ক্লাব প্রাঙ্গনে ফুল নিয়ে ভিড় করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক, পেশাজীবি ও

দুঃখিনী কর্ণফুলি, কেমনে তোমারে ভুলি?

প্রফেসর ইদ্রিস আলী উপরে নির্মল নীলাকাশ। দিগন্তব্যাপি উঁচু নিচু মাটি, বৃক্ষ, ঝোপ ঝাড়ের শ্রীমান শ্রীবিষাদের পাহাড় শ্রেণী। উঁচু বিদীর্ণ কাটা পাহাড়ের পাশ দিয়ে আঁকা—বাকা পাহাড়—

তাবুকের বুকে কয়েকদিন : ভবিষ্যৎ নগরী নিওম

মিনহাজুল ইসলাম মাসুম তাবুকের কথা: বিশ্বনবি (সা.)—এর তাবুক অভিযান এবং বর্তমানে নিওম সিটির কারণে তাবুক আমাদের কাছে পরিচিতি লাভ করেছে! অবশ্য এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান