এখন সময়:রাত ১০:২২- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ১০:২২- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

স্বাধীনতা: বাংলাদেশের অর্জন ও প্রাপ্তি

অমল বড়ুয়া

বহু বুকের শোণিতধারার কলকল ধ্বনির রক্তগঙ্গা আর বহু প্রাণের নিভে যাওয়া চেতনার বহ্নিশিখার স্ফুলিঙ্গ থেকে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের আবিলতা মাড়িয়ে দেশপ্রেমিক বাঙালিরা পেটে ক্ষুধা, হৃদয়ে স্বজন হারানোর যন্ত্রণা আর যুদ্ধের দামামায় ধন-সম্পদ হারানোর ক্ষত ভুলে নব উদ্যমে লেগে পড়েন দেশ গড়ার কর্মযজ্ঞে। সীমিত সম্পদ কিন্ত অদম্য মনোবলই বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার পাথেয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে ঠাট্টা করেছিলেন। ধ্বংসস্তুপের বিভীষিকা ঝেড়ে ফেলে দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্ষুধা আর দারিদ্র্যতার নাগপাশ ছিন্ন করে দৃঢ় পদক্ষেপে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশ বর্তমান বিশ্বে নিজের সুদৃঢ় অবস্থানকে জানান দিতে পেরেছে। স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ হেঁটেছে পঞ্চাশ বছরের নাতিদীর্ঘ পথ। এই পথপরিক্রমায় বাংলাদেশ এগিয়েছে অদম্য গতিতে। দারিদ্রতা আর স্বল্পোন্নত দেশের তক্মা ঘুচিয়ে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য এখন আর রূপকথা নয়। বাংলাদেশ নয় এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি। ১৯৭২ সালে ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার অর্থনীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতির আকার ১১ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০৩২ সালে বিশ্বের  বৃহৎ অর্থনীতির ২৫টি দেশের একটি হবে বাংলাদেশ।ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস বলছে, বিশ্বে বর্তমানের ৪১তম অবস্থান থেকে বাংলাদেশের অবস্থান হবে ২৪তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশে। ১৯৭৫ সালে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ যা বর্তমানে ৬ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি। আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশের জিডিপির গড় প্রবৃদ্ধি হবে ৭ শতাংশ। ১৯৭২ সালের ৮৮ শতাংশ দারিদ্র্যের হার বর্তমানে নেমে এসেছে ১০ শতাংশে। দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন ২০২০ অনুযায়ী ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নবম। জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির এলডিসি সংক্রান্ত উপ-গ্রুপের প্রধান টেফেরি টেসফাসো ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জানিয়েছেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। যা স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বড় অর্জন। এখন বাংলাদেশের লক্ষ্য ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে মধ্যম-আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালে উন্নত-দেশে উন্নীতকরণ। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে সমান্তরালে। বিবিএসের তথ্যমতে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৫৫৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। যা আগে ছিল ২ হাজার ২২৭ ডলার। মাথাপিছু আয়ে বাংলাদেশ পেছনে ফেলেছে ভারত (১৯৪৭ মার্কিন ডলার) ও পাকিস্তানকে (১৫৪৩ মার্কিন ডলার)। শিল্পায়নের ক্ষেত্রেও অনবদ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। বিদ্যমান ৮টি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের পাশাপাশি গড়ে তোলা হচ্ছে আরো একশটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এসব অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে আর অতিরিক্ত রপ্তানি আয় হবে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সারা বিশ্বকে ঘোষণা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে যাত্রা শুরু করেন ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর। ডিজিটাল বাংলাদেশ ইতোমধ্যে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের আইটি শিল্পের রপ্তানি আয় দশ কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের তথ্য প্রযুক্তিখাতে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা ৬ লাখ যা শতকরা হারে বিশ্বে ২৭ শতাংশ। এ খাতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশ্বের ৫৭তম দেশে হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৮ সালের ১১ মে যুক্তরাষ্ট্রের কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। সমুদ্র বিজয় বাংলাদেশের বহু অর্জনের মধ্যে অন্যতম। প্রথম সমুদ্র বিজয় ১৪ মার্চ ২০১২ মিয়ানমারের সাথে এবং দ্বিতীয় বিজয় ভারতের সাথে ৭ জুলাই ২০১৪। এই দুই দেশের সাথে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তির পর বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে এক লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটারের বেশি সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে। কর্ণফুলির তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল। দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার অনন্য উদাহরণ পদ্মাসেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেল ও চট্টগ্রামের বঙ্গোপসাগরের কোলে নির্মিতব্য বে-টার্মিনালসহ বহু মেগাপ্রকল্প। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ কৃষিতে অনেক উন্নতি করেছে এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিভাগের হিসাবে দেশে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ধান উৎপাদন হয়েছে ৫ কোটি ২৬ লাখ টন যা বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। জনশক্তি রপ্তানিতেও বাংলাদেশ সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লাখের অধিক কর্মী কর্মরত আছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে প্রবাসী রেমিট্যান্সের ভূমিকা অনন্য। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাস সাড়ে ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে দেশে। রেমিট্যান্সের ওপর ভর করেই বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রথমবারের মতো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৪ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসনীয়। বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪ শান্তি মিশনে কাজ করছে বাংলাদেশ। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিদ্যুতায়নে বাংলাদেশ মাইলফলক স্পর্শ করেছে। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ঘন্টায় ৩৪৮ কিলোওয়াট। বাংলাদেশের বর্তমান ক্যাপটিভসহ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ২৩৫ মেগাওয়াট। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসনীয়। ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে মোট বরাদ্দ ১ লাখ ৭ হাজার ৬২৪ কোটি টাকা। যা বাজেটের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ ও জিডিপির ৩ দশমিক ১১ শতাংশ। বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে হয়েছে ৭২ দশমিক ৬ বছর। মাতৃ-মৃত্যুর হার কমে দাঁড়িয়েছে লাখে ১৬৫ জন। শিশু মৃত্যুর হার অর্ধেক কমে হয়েছে প্রতি হাজারে ২৮ জন। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ এগিয়ে রয়েছে। যার ফলস্বরূপ নারী শিক্ষা প্রসারে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ইউনিসেফের পিস ট্রি পুরস্কার প্রাপ্তি ঘটে। নারী শিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরির জন্য গ্লোবাল উইমেন্স লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ২০২০ সালের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট অনুযায়ী বিশ্বের ১৫৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৫০তম এবং নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সপ্তম। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রপি জয়ের মাধ্যমে ক্রীড়াক্ষেত্রেও সফলতা এসেছে বাংলাদেশের। ২০২০ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের অনূর্ধ ১৯ দলের বিশ্বকাপ জয় দেশের সর্বোচ্চ প্রাপ্তি। ৫০ বছর আগের যুদ্ধবিধ্বস্ত ভঙ্গুর অর্থনীতির বাংলাদেশ আজ বিশ্বমঞ্চে নিজের সামর্থের সবটুকু উজাড় করে দিয়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলছে সম্মুখে উন্নতির অনন্ত দ্রাঘিমায়। বিশ্বের বহুক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। লাল-সবুজের রক্তরাঙা স্বাধীন পতাকা বিশ্ববাসীর কাছে হোক উন্নতি ও অগ্রগতির প্রতীক এই প্রত্যাশা রইল।

 

অমল বড়ুয়া, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে