এখন সময়:রাত ১০:৪৯- আজ: রবিবার-৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

এখন সময়:রাত ১০:৪৯- আজ: রবিবার
৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ-২৪শে ভাদ্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ-শরৎকাল

স্মৃতি ৭১

দেবাশিস ভট্টাচার্য

আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সে রক্তাক্ত সময় অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ছিল। ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুলক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা সুদীর্ঘ নয় মাস সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে এ দেশ স্বাধীন করেছিলাম। যুদ্ধের ভয়াবহতা এতো ব্যাপক ছিল চারদিকে আগুন জ্বলছে, প্রাণভয়ে পালাচ্ছে মানুষ, মায়ের কোল থেকে শিশুদের ছিনিয়ে ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে আগুনে। অসংখ্য মেয়েদের মারতে মারতে বিবস্ত্র অবস্থায় তুলে নেয়া হচ্ছে পাঞ্জাবিদের গাড়িতে। এ এক ভয়ঙ্কর সময়! যে সময় আমাদের জীবনে আর কখনো আসবে না। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিদ্যুৎবেগে ছড়িয়ে পড়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমাদের সীতাকুন্ড এলাকাটির প‚র্বে চন্দ্রনাথ পাহাড় আর পশ্চিমে বঙ্গোপসাগর। মাঝখানের ছোট্ট সমতট চট্টগ্রাম থেকে সীতাকুন্দের‚রত্ব ৩৬ কিলোমিটারের মত। তার বুক চিরে চলে গেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। দু’পাশে মানুষের বসবাস। ৭০’ এর নির্বাচনের পর থেকেই ছাত্র-জনতার ভেতর স্বাধীনতার সুপ্ত আকাক্সক্ষা জেগে ওঠে প্রবলভাবে। ২৫শে মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার আদেশ পাওয়ার পর তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা এস এম হাসান, আবুল কালাম আজাদ, জয়নাল, জাফর, শাহজাহান, ইউসুফ, কামাল, শফিউল আলম সহ অনেক ছাত্রনেতা তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম আর সিদ্দিকীর টয়োটা জিপে মাইক বেঁধে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার শুরু করেন। ❝প্রিয় দেশবাসী বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যার যা কিছু আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ুন❞ ২৬শে মার্চ সকালে ঘোষণাটি প্রচার করতে করতে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে উত্তর দিকে দক্ষিণ দিকে ছুটে চললেন তারা। তখন সীতাকুন্ড ডাকঘরে পোষ্ট মাষ্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন পীয‚ষ কান্তি ভট্টাচার্য। তিনি সিগন্যালার ছিলেন। কালুরঘাটে দেয়া জননেতা হান্নান সাহেবের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণাটি টেলিগ্রামের মাধ্যমে গ্রহণ করে তারা স্থানীয় নেতৃবৃন্দের হাতে হস্তান্তর করেন। ২৬শে মার্চ কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট হতে বিশাল এক কনভয় চট্টগ্রামের উদ্দেশে মার্চ করে। এই কনভয় ছোট ছোট বেরিক্যাড ডিঙিয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে যায়। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিরোধ করতে হালকা অস্ত্র, লাঠিসোটা, রড জোগাড় করতে থাকে। ছাত্রলীগ নেতা এস এম হাসান, সালাউদ্দিন,টিপু, তাহের হোসেন, নিজস্ব প্রযুক্তিতে বর্ণালী ক্লাবে মুক্তিকামী জনতাকে হাত বোমা তৈরি করে সরবরাহ করেন। দুপুর দু’টার দিকে পাকসেনারা সীতাকুন্ড এসে পৌঁছে। তারা শক্তি প্রদর্শন করতে গিয়ে শেখপাড়া আহমদ ডাক্তারের বাড়ির সামনে দুটো গরুকে গুলি করে। বাড়বকুÐ বাজারের কৃষক বাদশা মিয়াকে গুলি করে হত্যা করে। বাদশা মিয়া হলেন সীতাকুÐের প্রথম শহীদ। এরর কিছুক্ষণ পরেই একইভাবে মসজিদ্দা স্কুলের মেধাবী ছাত্র কামালকে হত্যা করে। ডাক্তার একলাছ উদ্দিন এর নেতৃত্বে ২৬শে মার্চ শুক্রবার বিভিন্ন জায়গায় আওয়ামী সমর্থিত লোকজন একত্রিত হতে থাকে।

২৫শে মার্চ এম এ হান্নান সাহেব এমন একটি ঘটনার প‚র্বাভাস দিয়েছিলেন। সীতাকুÐ বাজারে নেমে পাকসেনারা মাদ্রাসায় যায় এবং আলিয়া মাদ্রাসার মহাদ্দিস মওলানা ইউন‚সকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেন। পাকিস্তানের ফ্রন্ট ফোর্স এর সৈনিকদের পরনে কালো পোশাক মাথায় কালো স্কার্ফ, পায়ে কালো বুট কাঁধে গুলির বেল্ট ও হাতে লাইট মেশিনগান ছিলো। সন্ধ্যায় পাক সেনারা কুমিরা পৌঁছে। ইতিমধ্যে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শতাধিক ছেলে সাধারণ মানুষ যার যা কিছু আছে তা নিয়ে ট্রাকে করে মসজিদ্দা অবস্থান নেয়। এ সময় এ টি এম নিজাম উদ্দিন ও মোহাম্মদ ইউসুফ আলী সহ অষ্টম রেজিমেন্টের সদস্যরা ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভ‚ইয়ার নেতৃত্বে কুমিরার ঘোড়ামারা এলাকায় উপস্থিত হয়। এসময় সোয়াত থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র কুমিরা এলাকায় নিয়ে আসে বেঙ্গল রেজিমেন্টের কিছু সৈনিক। ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী অস্ত্র পরীক্ষা করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নেন। সবার মুখেই একটা ধ্বনি জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু। সুবেদার আলীর পেছনে হাজার হাজার মুক্তিকামী জনতা। রেকি করার জন্য স্কুটারে ন‚রুকে পাঠানো হয়। একটা ভেসপা মোটরসাইকেলে ক্যাপ্টেন সুবেদ আলী ভুইয়া, শেখ জেবল হোসেন, মতি ও ন‚রু পথপ্রদর্শক হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। তাদের মোটর সাইকেল ড্রাইভ করে বয়সে তরুণ মতি। সুবেদ আলী ভ‚ইয়া অপারেশন এর জন্য কুমিরা এলাকাটি বেছে নিলেন। ন‚রু ও মতি আবারো উত্তর দিকে গেলেন পাক বাহিনীর অবস্থান জানার জন্য। যাওয়ার সময় তারা পাক বাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হন। প্রাথমিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছ কেটে রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। পরিকল্পনা মতো সবাই যার যার অবস্থান থেকে অ্যামবুশ করে। সন্ধ্যায় শত্রæর উপর তাদের ফায়ার শুরু হয়। একশ দেড়শ জন সৈনিক নিয়ে মুক্তিকামী জনগণের সহায়তায় সেদিন মিলিটারি কনভয় রুখে দেয়। টানা এ যুদ্ধে বিশাল ক্ষয় ক্ষতি হয়। আক্রমণের তীব্রতায় তারা কিছুটা পিছু হটে পাহাড়ের দিকে যায়। এসময় সুবেদ আলী ভুঁইয়া, মতি ও নুরু টেলিফোনে উত্তর দিকে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। ২৭শে মার্চ সকাল দশটার দিকে কুমিরা পাহাড়ের অবস্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনীরা বাঙালি সৈনিকদের উদ্দেশে করে রকেট লাঞ্চার নিক্ষেপ করে। এসময় বাঙালী সৈন্যরাও তাদের দেশি অস্ত্র ব্যাবহার করে। আবুল বশর চৌধুরীর পায়ে আঘাত পান। ঘটনাস্থলে ফকরুল, বশর, মানিক, হিরু, মুকুট, সেলিম, বাহার, হাসান, বাদশা ও সোলেমান উপস্থিত ছিলেন। পরে তারা সমস্ত অস্ত্র গোলা বারুদ এলাকাবাসির কাছে বিলি করে দেন। সেদিন যাওয়ার সময় আরিফুল ইসলাম তার শিউলি পেট্রোল পাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিনা পয়সায় জ্বালানি তেল সহ পেট্রোল পাম্প টি উন্মুক্ত করে দেন। এদিকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কুমিরা যুদ্ধের সংবাদ নিয়ে যাওয়ার সময় পাক বাহিনীর গুলিতে হিরু ও ফকরুল শহীদ হন। কুমিরা যুদ্ধে পাক বাহিনীর বড় বিপর্যয় ঘটে। পাক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার মেজর জামিল সহ তাদের প্রায় দেড় শতাধিক সৈনিক প্রাণ হারায়। তারা অস্ত্র শস্ত্র ফেলে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। গ্রাম বাসিরাও পাক বাহিনীর উপর হামলা চালায়। অস্ত্র শস্ত্র সহ তাদের তিনটি গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। তাদের ফেলে যাওয়া কয়েক ট্রাক অস্ত্র বাড়বকুÐ ইউনিয়ন পরিষদ কমিউনিটি সেন্টারে এনে রাখে। এ যুদ্ধ ছিলো পাক বাহিনী ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম সম্মুখ যুদ্ধ। এ যুদ্ধে দশ পনেরো জনের মত বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্য আহত ও মৃত্যুবরণ করে তবে প্রথম যুদ্ধে পাক বাহিনী মুক্তি সেনাদের কাছে পরাজয় স্বীকার করে। পরে তারা দক্ষিণ দিকে সরে যায়।
এর পর পাঞ্জাবি সেনারা কুমিল্লা থেকে আরো ফোর্স নিয়ে আসে এবং এলাকাবাসির সাথে খন্ড খন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। পার্শ্ববর্তী সমস্ত গ্রাম এ যুদ্ধে জড়িয়ে যায়। এর পর ৫ এপ্রিল পাক জঙ্গি বিমানবাহিনী মহন্তের হাটে বোমা বিস্ফোরণ করে। আমি আমার নির্মল কাকার সাথে মাছ তরকারি কেনার জন্য হাটে যাই। তখন হঠাৎ করে মাথার উপর জেট বিমান চক্কর দিতে দেখি। মেশিন গান দিয়ে বিমান থেকে গুলি করা হয়। আমরা জীবন বাঁচানোর জন্য উবু হয়ে বাজারের ভেতর শুয়ে পরি। অনেকগুলো লোক আমাদের গায়ের উপর পড়ে যায়। আমরা নিজেদের গুলি বর্ষণ হওয়া পর্যন্ত আত্মরক্ষা করি। আমাদের শরীর এর উপর একজন গুলিবিদ্ধ হয়। তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন গুলির আঘাতে ১৫ থেকে ২০ জন নিরীহ জনগণ নিহত হয়। ৫ই এপ্রিল পাকিস্থানি সেনারা সীতাকুন্ড বাজার দখল করে নেয়। বাজারের সোবাহান ফকির, লক্ষীণি পাগলী আর মেহের আলীকে গুলি করে হত্যা করে। ১৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম কলেজ এর অধ্যাপক হারুনর রশীদকে ধরে এনে হত্যা করে। তিনি স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন এবং ৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থী অধ্যাপক শামসুর পক্ষে কাজ করেন। রাজাকাররা এই বিষয়টা জানতো তাই তাকে হত্যা করার জন্য বলা হয়েছিলো। সেই রাতেই আমরা চিন্তা করলাম এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। কারণ এখলাস, মামুন এবং এম আর সিদ্দিকি সাহেব আমাদের বাড়িতে আমার বাবা কাকাদের সাথে যুদ্ধের বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনা করতেন। সেই কারণেই আমাদের এ দোতলা বাড়িটি রাজাকারদের টার্গেট ছিলো। সেই রাতেই আমাদের গ্রামের আমিরাবাদ এলাকায় নামার বাজার থেকে মিরসরাই শুভপুর ব্রিজ সংলগ্ন ভুরভুইরা ঘাট হয়ে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আমবাগানে পৌঁছি। আমরা রামগড় এলাকায় এক রাত অবস্থান করি সেখানে ডাকঘরের ওভারসিয়ার বিশ্বনাথ কাকু কাধে করে আমার দাদুকে নদী পাড় করিয়ে দেয়। সীমান্ত পার হওয়ার সময় আমরা ইপিআর বাহিনীর টার্গেটে পড়ে যায়। ঘটনাটি ছিলো ভুল বোঝাবুঝি। সীমান্ত পথে আমাদের গাড়ি যখন ভারতে ঢুকছিলো তখন আমাদের গাড়ির হেডলাইট জ্বালানো ছিলো। নিয়ম হচ্ছে সীমান্ত পথে গাড়ি চলাচল করার সময় হেডলাইট মিট মিট করে জ্বলবে। আর পাক বাহিনীর গাড়ি হলে সরাসরি জ্বলে থাকবে। আমাদের ড্রাইভার বিষয়টা জানতো না এমতাবস্থায় ইপিআর আমাদেরকে শত্র ভেবে গুলি করে দিচ্ছিলো। এসময় চালক বিষয় টি বুঝতে পেরে গাড়ি থামিয়ে চিৎকার করতে থাকে এবং নিজেদেরকে বাঙালি শরণার্থী হিসেবে পরিচয় দেয়। একটা ভুলের জন্য সেদিন সবার প্রাণ চলে যেতে পারতো। নিশ্চিত মৃত্যু থেকে বাচাতে তারা মিস ফায়ার করে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে নেয়। ইপিআর এবং বি এস এফ সেনারা সীমান্ত নিরাপত্তায় ছিলেন। একজন বি এস এফ কমান্ডার আমাদেরকে জিজ্ঞেস করলেন আপনারা কেন দেশ ছাড়ছেন? আমরা তাদের জানালাম এখানে সংখ্যালঘু পরিবারদের জীবনের নিরাপত্তা আর নেই। তাই আমরা ভারত যাচ্ছি। প্রিয় জন্মভ‚মিকে ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট আমাদের চোখে মুখে দেখতে পেলেন তাই তিনি আমাদেরকে ইশারায় যেতে বললেন। বাংলাদেশ থেকে যেসব শরণার্থী ভারত গিয়েছিল তাদের আগরতলা তেলীমুড়া ক্যাম্পে থাকতে দেয় ভারত সরকার। আমরা সে ক্যাম্পে যাইনি আমরা ত্রিপুরা বর্ডার সংলগ্ন আম বাগান এলাকায় শ্রীনগর গ্রামে একটা মাটির ঘর ভাড়া নিয়ে অবস্থান করি। বর্ডার সংলগ্ন স্থানে বাসা নেওয়ার অন্যতম কারণ হলো।
দ্রুত যেন আমরা দেশের খবর জানতে পারি। সময় অসময়ে আমরা গায়ে কালি মেখে ছেঁড়া জামা কাপড় পরে পাকিস্থান বাজারে যেতাম বাজার করার জন্য। আমরা যখন ভারত গিয়েছি তখন আমাদেরকে এক কাপড়ে যেতে হয়। যাওয়ার সময় আমাদের হাঁস মুরগি গরু ছাগল সহ সব কিছু বড়ুয়া বাড়িতে রেখে যাই। বাবার হারমোনিয়ামটা নুরুল আমিন সাহেবকে দিয়ে যায়। সীমান্তে প্রায় প্রতিদিনই পাক বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ হতো। ওখানে থাকার একটাই উদ্দেশ্য শরণার্থীদের খবরাখবর জানা সামনের বাশবাগানে তাদের আশ্রয় দেয়া সাময়িক বিশ্রাম এর ব্যবস্থা করা কিছু জল গুড় মুড়ি খাওয়ানো। ঠাকুরমা প্রতিদিন বাশ বাগানের সামনে বসে থাকতেন আর যারা এদিক থেকে যেতো তাদের কাছে আত্মীয় স্বজনের খোঁজ নিতেন। প্রতিদিনই দলে দলে লোকজন সীমান্ত অতিক্রম করতেন। তাদের থেকে আমাদের পরিবারের আত্মীয় স্বজনদের খোঁজ খবর নিতাম। তেলীমুরা এলাকায় শতাধিক শরণার্থী পরিবার ছিলো শরণার্থী শিবিরে ভারত সরকার রেসন দিতো। তবে তা প্রয়োজন এর তুলনায় অপর্যাপ্ত ছিলো। ঘর ভাড়া করে থাকতাম বিধায় আমাদের রেসন কার্ড ও দেয়া হয়নি। আমরা অত্যন্ত টানাপোড়েন এর মধ্যে পড়ে যাই। বাধ্য হয়ে মনু বাজার চলে যাই। মনু বাজার হতে একরাতে আমরা মাগুড়ছড়া ক্যাম্পে যাই। এরপর আমরা তকুম্বা ক্যাম্পে যাই সেখানে আমাদের রেশন কার্ড হয় অর্থনৈতিক টানা পোড়েন চলছিলো প্রতিদিন দুর্গম পথ পেড়িয়ে কচু শাক, কচুর লতি, বাশকোড়ল, শাকসবজি তুলে আনতাম। ওগুলো দিয়ে অল্প চাউল দিয়ে মা ঘন্ট রান্না করতেন। আমরা লবন মেখে ভাত খেতাম। আমাদের হরিণা ক্যম্পের আশপাশেও থাকতে বলা হয়েছিলো আমরা যাইনি। আমরা প্রতক্ষ্যভাবে মুক্তিযুদ্ধ অংশ নিতে পারিনি কিন্তু যুদ্ধ না করেও যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যায় সেই বিষয়টি বাবা মৃণাল কান্তি ভট্টাচার্য তার ছাত্রদের বলতেন।। মুক্তিযোদ্ধাদের যোগাযোগ ছিলো আমাদের ক্যম্পে। এই যুদ্ধে উদবুদ্ধ করার জন্য বাবার নেতৃত্বে একটি শিল্পী গোষ্ঠী তৈরি হয়। শিল্পীদের মধ্যে আমার লাবণ্য পিসি, শিপ্রা, কল্যাণী, দিপা সরকার, নির্মল ভট্টাচার্য সহ অর্ধ শতাধিক শিল্পী নিয়ে জয় বাঙলা সংগঠন এর কার্যক্রম শুরু করেন।। সেই দলে বেহেলা বাদক ও নৃত্যশিল্পী ছিলো। আমি হাইল্লা জাইল্লা তাতীর বন্ধু মুজিব রহমান গানটি গাইতাম আর তবলা বাজাতাম। ত্রিপুরা এলাকায় শরণার্থী শিবির গুলোতে আমরা মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহ করতাম এবং মুক্তিযুদ্ধে সবাইকে সম্পৃক্ত করতাম। বোঝাতাম দেশের জন্য যুদ্ধ করা প্রাণ উৎসর্গ করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধে যাওয়া উত্তম সম্মানের কাজ। আমার পিসি লাবণ্য ভট্টাচার্য এবং স্বপ্না ভট্টাচার্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গীতি নকশা রচনা ও নির্দেশনা দিতেন। আমরা বিশেষ করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর বাঁধ ভেঙে দাও, কারার ঐ লোহ কপাট, শেকল পরার ছল এবং জাগরণ এর গানগুলো গাইতাম। আমাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এর মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে শত শত যুবক মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়। স্বাধীন হওয়ার পর আমরা একইভাবে দেশে একই কাজে সম্পৃক্ত হই। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে বহু শিল্পী আমাদের সাথে জড়ো হয়। তাদের মধ্যে সিরাজুল মোস্তফা, ফজলুল হক আবু, আহমেদ রাকিব গোর্কি, কেশব দাশ, মিরা দাশ,শিবানী দাশ এবং কল্যাণী দত্ত উল্লেখযোগ্য। বিজয়ের পর আমরা ওয়ার্ল্ড ফুড এর গাড়িতে সীতাকুÐ ফিরে আসি। বাড়ি বলতে কিছুই ছিলো না। শুধু ভিটেটা পড়ে ছিলো।। মাটিগুলোও ছিলো পোড়া। দু একটা কুকুর আমাদের দেখে এগিয়ে এলো। তখনো যুদ্ধ শেষ হয়নি আশপাশের গ্রামগুলোতে রাজাকারের উপস্থিতি টের পেয়ে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালাচ্ছে। এসময় নায়েক সফিউল আলম এর নেতৃত্বে রাজাকারদের ধরে এনে তাদের সীতাকুÐ আলিয়া মাদ্রাসায় দোষ বিচার করে শাস্তি দেওয়া হতো। সর্বমোট ৭৬৩ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তার মধ্যে ৪৮ জন শহীদ হন। চট্টগ্রামের শার্দ‚ল জননেতা এম এ আজিজ এর প্রিয়ভাজন ছিলেন এম আর সিদ্দিকী। এই কারণেই ডা. এখলাস এবং মানুনের নেতৃত্বে সীতাকুÐ আওয়ামী লীগের কার্যক্রম পরিচালিত হতো। সর্বশেষ ১২ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী কুমিরার উদ্দেশ্যে মার্চ করে মিত্রবাহিনীকে গেরিলা যোদ্ধারা রেকি করে ধারণা দিচ্ছিলো। মুক্তিবাহিনীর বড় ধরনের ক্যাম্প ছিলো বাশবাড়িয়া পাহাড়ে। একসাথে তিন সারি পাহাড়, ট্রাঙ্ক রোড ও নদী পথে হামলা চালায় মিত্রবাহিনী পাকিস্থানী সেনাদের উপর। টানা আড়াই দিন উভয় পক্ষে সশস্ত্র সম্মুখ যুদ্ধ হয়। জনগণ বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের শত শত সেনারা প্রাণ হারায়। মিত্র বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে পাক বাহিনীর এটিএম সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এ সকল যুদ্ধে বাঙালি ইপিয়ার ও রেজিমেন্টের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রচন্ড ভালোবাসা ও সমর্থন ছিলো। ১৭ই ডিসেম্বর এখানে পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

দেবাশিস ভট্টাচার্য, কথাসাহিত্যিক

আবির প্রকাশন

আপনি দেশে বা বিদেশে যেখানেই থাকুন না কেন- ঘরে বসেই গ্রন্থ প্রকাশ করতে পারেন অনলাইনে যোগাযোগের মাধ্যমে আবির প্রকাশন থেকে। আমরা বিগত আড়াই দশকে বিভিন্ন

গণতন্ত্রহীন রাজনীতির অনিবার্য পরিণতি

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বাঙালি চিরকালই বিদ্রোহী। ইতিহাসের কোনো পর্বে সে কোনো পরাধীনতাকে বেশি দিন মেনে নেয়নি। উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র দিল্লি থেকে দূরে হওয়ায় এবং সাড়ে

বিপ্লব যাতে বেহাত না হয় ( সম্পাদকীয় – আগস্ট ২০২৪)

জুলাই মাসের কোটাবিরোধী আন্দোলন শেষ পর্যন্ত আগস্টের ৬ তারিখে ১৫ বছর সরকারে থাকা আওয়ামী লীগের পতন ঘটিয়েছে। অভূতপূর্ব এই গণঅভ্যুত্থান ইতোপূর্বে ঘটিত গণ অভ্যুত্থানগুলোকে ছাড়িয়ে