মুশফিক হোসাইন :
আমাদের শৈশবে যৌবনে এবং প্রবীণ সময়েও হাটে বাজারে তরই/তরুই সাতপোয়াতি নামের এই মজাদার সবজিটি দেখেছি বলে মনে পড়ে না। তরুই হচ্ছে পটলের মতো দেখতে ছোট আকারের ঝিঙ্গে। ঝিঙ্গের যেমন তীর বা খাঁজ থাকে তরই এর তীর ও খাঁজ নেই। বলা যায় না পটল, না ঝিঙে। অনেকেরই মনে করেন তরুই পটল ও ঝিঙ্গের একটি শঙ্কর প্রজাতি যা আমাদের কৌতুহলী কোন কৃষকের সৃষ্টি। এর ফলন বেশি এবং খেতে দারুন সুস্বাদু। এক থোকায় সাতটি করে ফলন হয়। তাই এর অপর নাম সাতপোয়াতি। গাছ দেখতে ঝিঙ্গের মতই। ফুল হলুদ অবিকল ঝিঙ্গে ফুলের মতো। বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে এরা বিভিন্ন নামে পরিচিত। যেমন হাতুন্টি, যুপি, শাকপাতি, সাতপাতি, তুরতুরি, ঝুপি ঝিঙ্গে, দেশি ঝিঙ্গে, হাতুতি এবং তরুই ইত্যাদি। যুপি ঝিঙ্গে, দেশি ঝিঙ্গে, তাতুতি এবং তরুই ইত্যাদি। সাম্প্রতিক সময়ে ময়মনসিংহ, রংপুর, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া, মাদারিপুর এবং ভারতের গুয়াহাটি, বীরভূমের হাটে বাজারে মাঝে মাঝে দেখা গেছে। তবে ব্যাপকভাবে নয়। আমার ধারণা বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও দেশের দক্ষিণাঞ্চলে এদের দেখা মেলে না।
তরই নিয়ে আমার উৎসাহের একটি ইতিহাস আছে। পাঠকের সাথে শেয়ার করা যাক। ১৯৯৮ সালের ঘটনা। আমার ছাদ বাগানের গ্রিল বেয়ে একটি লতানো উদ্ভিদ লকলকিয়ে বেড়ে উঠতে থাকে আমি চিনি না।
মালি কাম দারোয়ানের কাছে জানতে চাইলাম কী গাছ? সে জানালো বুঝতে পারছি না। আপনা আপনি উঠেছে। হয়ত পাখিদের মল থেকে পড়ে চারা গজিয়েছে। দেখতে মনে হয় ঝিঙ্গে। বুনো গাছ মনে করে বললামÑউপড়ে ফেলুন। কিন্তু সে তা করলো না বরঞ্চ যতœ করতে লাগলো। বুঝে নিলাম এর কারণ। মোহাং শফি ওরফে নাছিমার বাপ অত্যন্ত প্রকৃতি প্রেমিক। সে কোন গাছ কাটতে বা মারতে পছন্দ করেনা। চাষাবাদের হাত তার খুব ভাল। মরা বা আধমরা গাছগুলো তার যতেœর ছোঁয়ায় আবার বেঁচে উঠতে দেখেছি। ফুলের চেয়ে সবজি গাছ তার প্রিয়। কোমরে একটি দা গুঁজে রাখতো। কারো সাথে তেমন আলাপ করতো না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুকা আর গাড়িঘোড়া দেখা ছিল তার অবসর বিনোদন। সে অত্যন্ত মেজাজী ও বদরাগী প্রকৃতির। কোথাও সে ছ মাসের বেশি টেকেনি। ভাগ্যক্রমে আমার কাছে প্রায় বিশ বছর। শারীরিক অক্ষমতার কারণে বাড়ি চলে যাওয়ার এক বছরের মধ্যে মৃত্যু বরণ করেন। আল্লাহ তাকে জান্নাত দান করুন। সে ছির অত্যন্ত বিশ্বস্থ কর্মচারী। গাছটি ঝিঙ্গে নয় আবার পটল নয় এমনতরো। থোকা থেকে ফল এলো খেতে দারুন মজাদার প্রচুর ফল হয়। ইত্যবসরে আমি বগুড়া বদলি হয়ে চলে যাই। মেয়ে ও স্ত্রী এই সবজি খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে মেয়ে তার দাদু অর্থাৎ নাসিমার বাপকে বললো, দাদু এই সবজি আর খাব না।
হয়ত নাসিমার বাপের ভালোবাসায় আঘাত লেগেছিল, রাগে ক্ষোভে বীজ না রেখেই গাছটি উপড়ে ফেলে। যা ছিল তার স্বভাব বিরুদ্ধ। আমার বাগান থেকে হারিয়ে গেল অচেনা সুস্বাদু একটি সবজি প্রজাতি।
সেই অবধি গ্রামেগঞ্জে হাটে বাজারে তারে খুঁজে বেড়াই। নামও জানি না ছবিও রাখিনি। খুঁজতে খুঁজতে প্রায় ২২/২৩ বছর পর পেলাম। ২০০২২ সালের জব্বারের বলী খেলার মেলায়। দোকানি জানালো ঝিঙ্গে পটল। দুটো ঝিঙ্গে পটল বীজসহ কেনা হল ৮০ টাকায়। ফ্ল্যাটের বারান্দার টবে গোটা চারাটি বাকীগুলো ছাদ বাগানে। দুটোর মধ্যে একটি কোন বীজ পাওয়া যায়নি। অপক্ক বীজ ছিল তাতে। ফ্ল্যাটের টবে যে সবজি হয়েছিল তার পুরোটাই কাঠবিড়ালির পেটে। সে কিছু খায় বাকীটুকু নষ্ট করে। এবার ছাদ বাগান থেকে কিছু বীজ সংরক্ষণ করা হলো। ছাদ বাগানি বা চাষি যারা আগ্রহ করবেন তাদের দেয়া হবে। মজার ব্যাপার হলো তরাই গাছের যতœ আর্তি তেমন লাগেনা। ঝোপ ঝাড়ের ডাল বা গ্রিল বেয়ে বড় হয়ে উঠে এবং প্রচুর ফলন দেয়। আমাদের সীতাকুন্ড, মীরশ্বরাই এর সীম গাছের মতো। আমাদের এই সীম প্রজাতির দেশব্যাপী খ্যাতি আছে। এ সীমের যতœ কম ফলন বেশি।
ইতিপূর্বে ভারতের গুয়াহাটির অনুবাদক ও রাজনৈতিক কর্মী রুনা অধিকারী বাংলাদেশে সফরে এলে কথা প্রসঙ্গে আমাকে জানান তাদের ওখানে হাটেবাজারে এই সবজির বেশ কদর আছে। তবে সব সময় পাওয়া যায় না। সামাজিক মাধ্যমের একজন ফেবু বন্ধু জানান বীরভূমেও এই সবজির দেখা মেলে। এ থেকে এটা প্রতীয়মান যে, আবহমান কাল থেকে বাঙালি কৃষকেরা এটা চাষ করতেন। যার ফলনও ছিল প্রচুর। স্বাধীনতার পরবর্তী বাংলাদেশে কর্পোরেট হাউজগুলোর বিকাশ ঘটে। তাদের উচ্চ ফলনশীল (হাইব্রীড) ফসলের বীজ ও চারা আমাদের কৃষি বাজার দখল করে নেয়। তাদের প্রচারে আমাদের সহজ সরল কৃষক বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের কৃষির স্বকীয়তা ও নিজস্বতা। তরাই তেমনি একটি ফসল যা হারাতে বসেছে। বর্ষায় এর বীজ রোপন করা হয়ে থাকে। শরতের প্রথম থেকে এর ফুল ও ফল আসে।
চিংড়ি দিয়ে এর রান্না বেশ মজাদার। দূর্গাপুজোয় তরই দিয়ে পাকোড়া ভেজে অতিথি আপ্যায়নের তথ্যও পাওয়া যায়।
আমাদের কৃষকদের কাছ থেকে জানা যায়, হাইব্রীড ফসল উৎপাদন বেশি হয় সত্যি! তবে রোগ বালাইয়ে এরা টিকে থাকতে পারেনা। এ ছাড়াও হাইব্রীড শষ্য উৎপাদনে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়।
এতে করে আমাদের জমির উর্বরা শক্তি কমে যায়। পাশাপাশি বাস্তুতন্ত্রের অনুজীব, পশুপাখি এবং মৎস্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। দেশি ফসল অনেক বেশি টেকসই, রোগবালাই বান্ধব। সঠিক পরিচর্যা পেলে অনেক বেশি ফসল পাওয়া সম্ভব। অতএব আমাদের উচিত হবে পুঁজিবাদী কর্পোরেট হাউসগুলোকে প্রত্যাখ্যান করে দেশীয় বীজ ও কলাকৌশল রক্ষা করা। প্রত্যেক জাতির নিজস্ব একটি স্বকীয় ঐতিহ্য থাকে। আমাদের দেশি ফসলের ফলন বেশি স্বাদে, গন্ধেও অসাধারণ। উদাহরণত বলা যায় আমাদের কালিজিরা ধান, সীতাকুন্ডের সীম, কাঞ্চন নগরের পেয়ারা ইত্যাদি। তরাই আমাদের আদি ও অকৃত্রিম একটি ফসল। যা কর্পোরেট হাউজগুলোর প্রপাকা-ায় ও শোষণে হারিয়ে যেতে বসেছে।
তরাই সম্পর্কে সম্প্রতি প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রের দেলোয়ার জাহান একটি পোষ্ট সামাজিক মাধ্যমে দেন। তিনি তাকে দেশিয় ঝিঙ্গা বলেছেন। গুগলে সার্চ দিয়ে জানতে চেয়ে খুব একটা তথ্য পাইনি। আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ এ সম্পর্কে জানেন কিনা জানি না। আমাদের আছে কৃষি ভিত্তিক ফসলের গৌরবময় ইতিহাস। আমরা সে গৌরব গাঁথা বিস্মৃতি হতে চলেছি। আমাদের কৃষকরা আজ অবহেলিত। একটি স্বার্থন্বেষি চক্র এবং সিন্ডিকেট আমাদের কৃষি ঐতিহ্য ও ইতিহাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলছে। আসুন আমরা ঐতিহ্য ফিরে পেতে সাহসী হই। সর্বশেস মেসার্স পীতাম্বর শাহ পশারির ঐতিহ্যবাহী ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক কবিরাজ সাধন বাবু জানান কয়েক বছর আগে হাটহাজারীরর সরকার হাটে একবার এই সবজি বিক্রি হতে দেখেছেন। এই প্রথম চট্টগ্রামের কোন এলাকার তথ্য সংগ্রহ হল।
মুশফিক হোসাইন, কবি ও নিসর্গী