আজিজুল হক : আজ আষাঢ়ের প্রথম দিন।
আজ আমাদের বিয়ের দশবছর পূর্ণ হলো। এতোদিনেও যে মেয়েটি আমাকে ছেড়ে যায়নি বলে আমি অবাক হয়েছি।
আমাকে ছেড়ে যাবার জন্য কমপক্ষে দশটি কারণ আছে। যেগুলো কোনো গবেষণা ছাড়াই একজন স্ত্রী বুঝতে পারে। অর্নিলা যে বোঝেনি এমন নয়। সে বুঝতে পেরেছিল। এবং তা ভালোভাবেই পেরেছিল। একজন নেশাগ্রস্ত ও মিথ্যাবাদী মানুষের সাথে কোন পরিশীলিত মানুষের সম্পর্ক এতোদিন টেকার কথা নয়। কোনভাবে শোভনীয়ও নয়। কিন্তু কী এক অদ্ভুত কারণে টিকে আছে তা আমি আজও আবিষ্কার করতে পারিনি।।
অর্নিলা আছে এটাই সত্যি কথা। বিয়ের পাঁচ দিনের মাথায় অবশ্য একবার তার বান্ধবীর বাসায় চলে গিয়েছিল কিন্তু ফিরে এসেছিল চারদিনের পর। ফিরে আসার পর আমার মনে হয়েছিল সে আমাকে খুন করে ছত্রিশ টুকরো করার প্রতিজ্ঞা করে এসেছে। সর্বান্তকরণে হতাশ হবার পর একজন স্ত্রীর জন্য এমন ভাবনা আমার জন্য খুব স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত সেরকম কোন কিছুর লক্ষণ আমার চোখে পড়েনি। এমন কি কোন বিশেষ পরিবর্তনও না। শুধু সামান্য একটু গম্ভীর হয়ে যাওয়া ছাড়া।
মেয়েটি এখন ঘুমোচ্ছে। একটা নরম বালিশ জড়িয়ে ধরে। যখন সে একা একা ঘুমায় এ বালিশ জড়িয়েই সে ঘুমায়। সে অর্ধেকটা উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। ঘুম গভীর। নিশ্বাস প্রশ্বাসের মিথস্ক্রিয়ায় তার পিঠ দুলছে প্রজাতির দুই ডানার মতো। একটা বিশাল ধপধপে সাদা প্রজাতির একজোড়া ডানা। যদিও এমন প্রজাপতি আমার কখনো দেখা হয়নি। তার পিঠের অনেকটা জায়গা অনাবৃত। সে অনাবৃত পিঠে চোখ রেখে আমি অনেকক্ষণ ধরে বসে আছি।
মানুষের খোলা পিঠ এতো সুন্দর হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। আসলে তা সেভাবে কখনো আমার চোখেই পড়েনি। যেনো হুট করে মেঘ সরে যাবার পর এক খন্ড নক্ষত্র খচিত আকাশ। সহসা জানান দিল ‘আমি আছি’ যার কথা ভুলেই গিয়েছিল লোকে। অথবা নজর এড়িয়ে ছিলো বহু মানুষের। এবং যাকে আরেক মেঘ এসে আবার আড়াল করে দিবে সহসা। এমন আষাঢ় দিনে। যখন মেঘেরা ছুটোছুটি করে কিশোরীর ব্যস্ততা নিয়ে।
একটা কার্টিস পেপারে তার ঘুম আর খোলা পিঠের এ অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটা স্কেচ করে নিয়েছি জলরং দিয়ে। ছিবিটি আঁকা শেষ হবার পর ছবির দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে আমার মনে হলো আমি একটা মৃত প্রজাপতির ছবি এঁকেছি। যেটি অনেকক্ষণ ধরে মরে উপুড় হয়ে আছে। যার রঙ শুধু সাদা নয়। হলুদ লাল নীল।
আষাঢ়ের প্রথম দিন হলেও আকাশে কোন মেঘ বৃষ্টি নেই। এমন কোন সম্ভাবনাও সারাদিনে আসবে বলে মনে হয় না। বাইরে ইলিশ পেটের মতো চকচকে রোদ। এমন অদ্ভুত সময়ে আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছেগুলোর অধিকাংশের কোনো কারণ থাকে না। বা থাকে যা আমার মতো অতি সাধারণ মানুষ ধরতে পারে না। আলমিরার উপর থেকে গিটারটা নামিয়ে নিই শব্দ না করে। ঘুমের মানুষকে কখনো জাগাতে নেই। ঘুম হলো পবিত্র জিনিস। গুন গুন করে শুরু করলাম “মোর ঘুমঘোরে এলে মনোহর নমো নম, নমো নম, নমো নম “। নজরুল কাকে নিয়ে গানটি গেয়েছিলেন আমার জানা নেই। কিন্তু এই মুহুর্তে গানটি আমি অর্নিলাকে মনে করে গাইছি। নমো নম অর্নিলা, নমো নম।
অর্নিলার সাথে আমার দেখা অনেক বছর আগে। তার এক বান্ধবীর বিয়ের অনুষ্ঠানের গায়ে হলুদের দিন। স্টেজ সহ পুরো ডেকোরেশনের কাজটি আমি করছিলাম। সে সময়ে এসব কাজে আমার বেশ নাম-ডাক ছিল। খুব সীমিত পরিসরের মধ্যে। ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট আমার মূল কাজ হলেও আমি সখ লালন করে এধরনের কাজগুলোও করতাম। তার বান্ধবীর বাসরঘর সাজিয়েছিলাম অনেক গুলো সাদা অর্কিড আর একবোতল জোনাকিপোকা দিয়ে। জোনাক পোকার আনার উদ্দেশ্য ছিলো ‘নতুন কিছু কর’। কারণ আমি তখন সবসময় নতুনত্ব নিয়ে ভাবতাম। মানুষ অবাক হতে পছন্দ করে। চায় কেউ তাকে চমকে দিক। এমনকিছু করুক যা তার ভাবনায় নেই। কেবল মৃত্যু ছাড়া।
সব লাইট অফ করে অন্ধকার ঘরে বোতল থেকে জোনাকিগুলো ছেড়ে দিয়েছিলাম। এমন একটা দৃশ্য দেখে সবাই অবাক হয়েছিল। উৎফুল্ল হয়েছিল।
কিন্তু অর্নিলা অবাক হবার পাশাপাশি কিছুটা ক্ষিপ্তও হয়েছিল। জোনাকির নিয়ন আলোয় সেটা স্পষ্টই আমার চোখে পড়েছিলো। অন্ধকার হাতড়ে কাছে এসে বললো, এতোগুলো জোনাকিকে শুধু শুধু কষ্ট দিলেন!
তবে এরপরই অনুরোধ করলো তার বিয়ের ঘরটা যেনো আমি-ই সাজিয়ে দিই। এমনভাবে বলছিল যেনো আগামী সপ্তাহেই তার বিয়ে। এবং আমাকে দিয়ে বাসরঘর সাজানোর জন্য তা আরও এগিয়ে নিয়ে আসছে। সবগুলো জোনাকি একসাথে আলো জ্বালিয়ে যেনো তার কথাকে সমর্থনও জানাল।
আমি তাকে আশ্বস্ত করেছিলাম, ‘দিবো। অবশ্যই দিবো’ বলে।
যদিও পরবর্তীতে তাকে দেয়া কথা আমি রাখতে পারিনি। কারণ তার বিয়ে তখনও ঠিক ছিলো না এবং ততোদিনে আমিও ওসব কাজ প্রায়ছেড়ে দিয়েছিলাম।
মানুষের সখ একসময় চলে যায় কিন্তু নেশা থেকে যায়। আমার সখের বশে করা অনেক নেশা একসময় সময়ের আড়ালে হারিয়ে যায়। তবে অন্য এক নেশা আমাকে পেয়ে বসে। তেমন এক নেশা অর্নিলাকেও। কোন কারণ ছাড়াই মেয়েটা আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে দেয়। অর্নিলা আমাকে ভালোবাসে সেরকম এক নেশায় পড়ার ঘোরে। আমার নেশাটা শুধু ভালোবাসায় নয়। অন্য কিছুতেও ছিলো। এবং তা ছিলো মারাত্মক ধরনের। হাতের কাছে যখন যা পেতাম আমি তাই নিতাম। কোনো বাদ বিচার করতাম না।
আমার সম্পর্কে এমন কিছু তার জানা ছিলো না। কারণ সে সেভাবে জানতে চাইতো না। আমি খুব ছোটোখাটো সত্যি কথা
গুলো বাসর ঘরের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে বলতাম। এবং সেগুলো সে পুরোপুরি সত্য বলে বিশ্বাস করতো। এবং বিশ্বাস করতো পরবর্তী সব রাত এমনই হবে। বাসর রাতের মতো। জ্বলজ্বলে।
যে বাসায় আমরা এখন থাকি ওটাকে সে আমাদের নিজেদের বাড়ি বলে জানতো। কীভাবে জানতো তা আমি জানি না। কথাটার ভেতর সামান্য সত্যতা ছিলো। তাই মিথ্যটা আমি তারকাছে পরিষ্কার করিনি। এ তিনতলা বাড়িটা আমার এক দূর সম্পর্কের খালার। উনি দুই ছেলে সহ বর্তমানে কানাডা থাকে। এ খালার বাসায় থেকে আমি পড়ালেখা করতাম।
ছাদের উপর তিনশো পঁয়ষট্টি বর্গফুটের একটা ঘর আমি তৈরি করেছি নিজের টাকায়। খালার সাথে আমার একটি লিখিত চুক্তিও আছে। আমি যতোদিন বেঁচে থাকবো আমি এর মালিক থাকবো।
মৃত্যুর পরের বিষয় নিয়ে আমরা কেউই কিছু নিশ্চতভাবে জানি না। আমার কোন উত্তরাধিকারও নাই। তাই আমার মৃত্যুর পরে এ ঘরের মালিকানা বিষয় নিয়ে চুক্তিতে কিছু লেখা হয়নি।
আষাঢ়ের এক দুপুরে ‘আষাঢ়বরণ উৎসব’ শেষে আমরা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে ফেলি। বাসায় ফিরে আসি রাত বারোটার পরে।
অর্ধেক মশারী টানানো এলোমেলো খাট আর খাটের সামনে থাকা ছোট একটুকরো খালি জায়গা। যেখানে চাপাচাপি করে বড়জোর চারজন বসতে পারে। এমন বিচ্ছিরি অবস্থা দেখে সে হতাশ হয়েছিল কি-না তা তার মুখ দেখে বোঝা যায়নি। এমনকি সবকিছু ঠিকঠাক মতো জানার পরেও। রাজ্যের ক্লান্তি নিয়ে সেদিন আমরা সেভাবেই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। জোনাকিপোকা আর সাদা অর্কিড। সেসব আমাদের স্বপ্নের ভেতরও আর কখনো আসেনি।
আমার রুমের লাগোয়া একটা বড় বারান্দা আছে। এ বারান্দাটা আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয়। এটাকে আমরা নাম দিয়েছি ‘হ্যাপি ব্যালকনি”। মন খারাপ নিয়ে বারান্দায় এসে বসার পর মন ভালো হয়নি এমন একটা সময়ের কথা আমরা কখনও মনে করতে পারি না। কেউই না।
অর্নিলার প্রজাপতি পিঠে স্পর্শ করে ওকে জাগাতে গিয়েও আমি হাত সরিয়ে নিই। কারণ আমি মনে করি ঘুম এক পবিত্র কাজ। ঘুমের ভেতর মানুষ পবিত্র আত্মাদের সাথে থাকে।
আমি এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে আমাদের ‘হ্যাপি ব্যালকনিতে’ গিয়ে বসি। সারারাতের ক্লান্তি আর অবসাদ কিছুক্ষণের ভেতর দূর হতে থাকে। আস্তে আস্তে। একটি জ্বলন্ত চিতা জ্বালানি শেষ করে নিভে যাবার মতো। বন্যার পানি একটু একটু সরে সবুজ ধানের উৎকীর্ণ পাতা উঁকি দেয়ার মতো।
বারান্দার পাশেই একটা কবরস্থান। এটা কোনো সাধারণ কবরস্থান নয়। কোন এক অভিজাত পরিবারের পারিবারিক কবরস্থান। সাইনবোর্ডে তেমনটাই লেখা আছে।
বিচিত্র সব সৌখিন গাছ দিয়ে কবরস্থানটি পরিপাটি করে সাজানো। সাইনবোর্ড না থাকলে এটা যে গোরস্থান তা বোঝার সাধ্য কারো ছিলো না। আমি এ ঘরে বসবাস করার পর এখন পর্যন্ত কাউকে এ গোরস্থানে কবর দিতে দেখিনি। আমরা কেউই না। এটাও ঠিক আমরা কেউ-ই সবসময় বারান্দায় বসে থাকি না। তবুও গোরস্তানের মালিকপক্ষের কাউকে কোনো একদিন জীবিত অবস্থায় দেখার আগ্রহ আমার বরাবরের মতো এখনো আছে।আমরা দুজনে ফুল খুব পছন্দ করি। কিন্তু আমাদের হ্যাপি ব্যালকনিতে কোনো ফুলের টব নেই। বারান্দার বাইরে এতো এতো সুন্দর ও বিচিত্র সব ফুল থাকায় টবের ফুলের প্রয়োজনীয়তার কথা আমাদের কারোরই কখনো মনে হয়নি। হতে পারে বারান্দা খালি থাকবে এটা আমরা মেনে নিয়েছিলাম।
গোরস্তানের বিচিত্র সব গাছের ভেতর একটা জারুল ও একটা ঝাঁকড়া কদম গাছও আছে। অদ্ভুত বিষয় হলো সাধারণত গ্রীষ্মকালে জারুল গাছে ফুল এলেও এ গাছটা ফুল ফোটে সারাবছর। কখনো বেশি কখনো কম।
মাটির নীচে থাকা মানুষের কর্মকা- নিয়ে আমাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। তবুও আমার অন্ধ অনুমান, ওই গাছের নিচে এমন কেউ আছে জারুলের পার্পল রঙের ফুল তার খুব পছন্দের। এবং সারা বছর ফুল ফোটানোর কাজটি সে লোকটিই করে থাকে। তার কাছে থাকা বিশেষ ক্ষমতাবলে।
লোকটা কি নিজে জারুল ফুল পছন্দ করতো? না-কি এমন কারো জন্য কাজটি সে করে যার এ ফুলটি খুব প্রিয়! এবং যে এখনো বেঁচে আছে।
আমার এমন অদ্ভুত ও হাস্যকর ধারণার পেছনে বিশেষ কোন কারণ ছিলো না। এমনকি আমি এটাও নিশ্চিত ছিলাম না ওই গাছটির নিচে আদৌ কারো কবর আছে কি-না!
তবুও এ অদ্ভুত বিষয়টি একদিন আমি অর্নিলাকে
বললাম। এমন কথা শুনে সে অনেকক্ষণ হাসলো। একসময় হাসি শেষ করে সে মাথা নাড়িয়ে আমার কথায় সে সম্মতি জানালো। এবং মুখে বললো ‘আমারও সেরকম ধারণা। কেন আমার এমন ধারণা একদিন তোমাকে আমি বলবো।’
তারপরও দুবছর কেটে গেছে। গোরস্তানের গাছগুলি আরও বড় ও নিবিড় হয়েছে। ঘন সবুজ পাতার ভেতর থেকে মাথা উঁচিয়ে জারুল ফুল ফোটে প্রতিদিন। রাতের পাখিদের ডানা ঝাপটানো আরও বাড়ে। আমিও নেশায় আরও বেশি ডুবে থাকি।
আমরা দুজনে জানতে ও জানাতে ভুলে যাই আমাদের দুজনের সে অন্ধ বিশ্বাসের কথা। অথবা সে তা সযতেœ এড়িয়ে যায়।
আমাদের কোন সন্তান নেই। সমস্যাটা আমারই। কাউন্টিং কম। মাঝেমধ্যে আমার খুব অবাক লাগে। মিলিয়ন মিলিয়ন প্রতিযোগীর ভেতর থেকে এই ক্ষুদ্র আমি এই হীন আমি এই লক্ষ্যহীন, নেশাগ্রস্ত এই আমি কীভাবে সবাইকে পেছনে ফেলে জয়ী হয়ে এ পৃথিবীতে এলাম!
উত্তর পাইনা। উত্তর মেলেনা।
আমার এ অক্ষমতার কথা অর্নিলা জানে। সে চাইলে মা হবার অন্য কারো কাছে জন্য চলে যেতে পারতো। সে চাইলে অন্য কোনোভাবে একটা ব্যবস্থা করতে পারতো। হলে তার এমন ইচ্ছায় আমি বিচলিত হতাম না। আমিও যে তাকে যেতে বলিনি তা নয়। বলেছি বছর বছর। আষাঢ় এলে বর্ষা এলে। অন্য সময়েও। যতোবার আমি তাকে চলে যেতে বলেছি ততোবার সে তার আর আমার নিয়তিকে তার আর আমার অদৃষ্টে স্থাপন করেছে। আমারটা না হয় মেনে নিলাম কিন্তু আমার অক্ষমতা আরেকজনের নিয়তি হবে কেন?
এমন প্রশ্নের উত্তর আমি যেমন জানি না সেও জানতে চায়নি।
একদিন সন্ধ্যা থেকে অধিক রাত অবধি আমরা আমাদের হ্যাপি ব্যালকনিতে বসেছিলাম। কোনো দুঃখ ভোলার জন্য নয়। রাতটাকে বুঝতে চাচ্ছিলাম একে অন্যকে বোঝার মতো করে। অন্ধকার এতো ঘন ছিল যে আমরা আর একে অন্যকে স্পষ্টভাবে চিনতে পারছিলাম না। আমরা হারিয়ে যেতে থাকলাম নিজ নিজ ছায়ার ভেতর। তবে একে অন্যের হৃদয়কে শুনতে পারছিলাম। অর্নিলা তার ও আমার ভুলে যাওয়া প্রসঙ্গটি তুলে আনলো। মাটির পুরু আস্তরে চাপা থাকা, জলের গভীরে লুকানো কোন প্রতœতাত্ত্বিক শহরের মতো। ইতিহাসে ডুবে যাওয়া সেই প্রথম জাহাজ ডাঙায় তুলে আনার মতো করে। অনেক অনেকদিন আগে ভুলে যাওয়া কোনো সঙ্গীতের মতো করে। প্রথমে আনন্দ নিয়ে আরপর গভীর অনুভূতি নিয়ে। “এই কবরস্থানের মাটির নিচে একজন আছে। যাকে আমি একসময় ভালোবাসতাম। তার নাম অনিকেত। তবে সে ঠিক জারুল গাছটির নিচে আছে কিনা তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না।”
সে বলছিলো অন্ধকারের সাথে মিলিয়ে যেতে যেতে।
“একসময় আমরা একসাথে পড়তাম। আমরা একে অন্যকে ভালোবাসতাম। প্রচ- রকমভাবে। একসময় সে চলে যায়। আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়তে। একশো বিশ ঘণ্টা আকাশে ওড়া শেষ হলে আমাদের বিয়ে হবার কথা ছিলো। তবে তার আগেই সে মারা যায়। উড়তে উড়তে। আকস্মিকভাবে।”
সে থামলো ওড়ে যাওয়া অন্ধকারগুলো একটা বারান্দার কোণে জমা হবার মতো করে। আরো কিছু হয়তো বলতে চেয়েছিল। কিন্তু সে আর বলতে পারেনি। তার কন্ঠ কথাগুলো আঁটকে দিচ্ছিলো। তার ভেজা গলায় কথাগুলো ডুবে যাচ্ছিলো। আস্তে আস্তে রাতের গভীরতা কমতে থাকলো। ভোরের আলোয় আমরা স্পষ্ট হতে লাগলাম। একে অন্যের কাছে।
মানুষ মরে গেলে ভালোবাসা কি মরে যায়? বেঁচে থাকলে কীভাবে তা অপরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করে?
এসব ভাবতে ভাবতে আমার চোখের পাতারা ভারি হয় আসে পাথরের মতো। খুব সকাল সকাল আমরা ঘুমাতে চলে যাই।
পিঠে অর্নিলার হাতের স্পর্শে আমি কিছুটা চমকে উঠি। বাইরে রোদের উৎসব চলছে যেনো। ফুলেভরা সাদা কদমগাছটিকে খুব অসহায় লাগছে। আষাঢ়ে বৃষ্টি নেই অথচ আগেভাগে ফুল ফুটিয়ে সে বসে আছে।
‘কখন এলে?’ বললো খুব অস্ফুট স্বরে।
প্রশ্নের মতো নয় তবে আমি জবাব দিলাম। ‘খুব ভোরে।’
‘আমাকে জাগালে না যে?’ এটা স্পষ্ট প্রশ্ন। যার উত্তরে একটা কৈফিয়তও দিতে হয়।
‘তুমি জানো আমি কারো ঘুম ভাঙাই না’ আমি বললাম ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকিয়ে। তাকে কদম গাছের মতো প্রস্ফুটিত দেখাচ্ছিল। তবে বৃষ্টিহীন বেদনার একটা ছায়াও ফাঁকফোকরর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল।
‘আমার ঘুমের ভেতর কখনো কোনোদিন ঘরে আগুন লাগলে তুমি আমাকে জাগাবে না। এটা আমার প্রায় মনে হয়’।
বলেই সে একটা দীর্ঘ দম নিল। ভাবলো। যেনো ইতিহাসের পাতা উল্টিয়ে সে তেমন একটা ঘটনা খুঁজে বের করতে চাচ্ছে।
‘তুমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে একটা মেয়ে ঘুমাচ্ছে ও পুড়ে যাচ্ছে।’
তেমন কোন ঘটনা খুঁজে পাবার বেদনা নিয়ে যেনো সে কথাটা বললো।
আমি কফির কাপ টেবিলে রেখে কাঁধের উপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে তার হাত স্পর্শ করলাম ও মুঠোবন্দি করলাম। একইসাথে উপলব্ধি করলাম কিছু ধরতে হলে আগে কিছু ছাড়তে হয়। আমি সম্ভবত কফির মগের মতো মামুলি জিনিসপত্র ছাড়া মূল্যবান কিছু কখনো ছাড়িনি। আমি অর্নিলার হাত শক্ত করে ধরে বললাম ‘এমন কখনো হবে না। ঘুম না ভাঙিয়েও আমি তোমাকে রক্ষা করবো। আগুনের উপর নিজেকে বিছিয়ে দিবো। নয়তো পাঁজাকোলা করে বাইরে নিয়ে যাবো।’
আমার কথায় সে আস্বস্ত হতে পারলো বলে মনে হলো। সে পাশে থাকা খালি চেয়ারটায় বসলো। আমি ভোরের আলোয় আঁকা তার ছবিটা তার হাতে দিয়ে বললাম, তুমি কি কখনো ধবধবে সাদা প্রজাপতি দেখছো।
‘দেখেছি বলে মনে করতে পারছি না, তবে আছে বলে অনুমান করি’
সে ছবি থেকে চোখ না সরিয়ে বললো। ছবির ভেতর একটা সাদা প্রজাপতি খোঁজার মতো করে সময় নিয়ে।
‘ছবিটি অসাধারণ হয়েছে। নিজেকে চিনতেই পারছি না’ সে বললো কিছুটা ভেবে নিয়ে ‘ অবশ্য নিজের পেছনের অংশ নিজের চোখ দিয়ে দেখা বেশ কঠিন কাজ। কারো অথবা কোনোকিছুর সাহায্য ছাড়া।’
‘তোমার ঘুমন্ত পিঠটাকে একটা ধবধবে সাদা প্রজাপতির মতো লাগছে। তোমার কি তেমন মনে হচ্ছে?’ আমি জানতে চাইলাম। ‘ সাদা কাগজে সাদা প্রজাপতি আঁকা কঠিন তাই কিছু রঙ ছড়ালাম।’
সে আমার দিকে তাকালো মিষ্টি করে। তারপর কবরস্থানের জারুল গাছের দিকে। গাছে ফুলের উৎসব লেগেছে যেনো।
সে ছবির প্রসঙ্গ বন্ধ করলো ছবিটিকে উল্টিয়ে রেখে। আমি তার পিঠে তাকালাম নিবিড়ভাবে।
‘আমাদের দুজনের মাঝে অন্য কেউ কি বাস করে? যাকে দেখা যায় না। কিন্তু আছে। প্রবলভাবে।’ কথাগুলো জিজ্ঞেস করলাম সঙ্গীতের মতো মোলায়েম করে। জিগ্যেস করলাম যা জানতে চাচ্ছিলাম দীর্ঘদিন ধরে।
মৃত প্রজাপতিটা হঠাৎ জেগে ওঠার মতো করে সে নড়ে ওঠলো।
‘থাকে হয়তো, দেখতে পাই না’ সে বললো আশপাশে কাউকে খোঁজার মতো চোখ ঘুরিয়ে।
‘আমাদের প্রতিটি মানুষের ভেতর অনেক মানুষ বাস করে। যে জীবন আমরা যাপন করি তা সবসময় নিজের নয়। অন্য কারো।’
কথাগুলো সে বললো। খুব জোরালোভাবে। প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা করে। তারপর উঠে দাঁড়ালো দীর্ঘক্ষণ শুয়ে থাকা কোনো আয়েশি বিড়ালের মতো।
আমি আবার তার হাত ধরলাম। হাত টেনে তাকে চেয়ারে বসালাম। ‘ ঠিক করেছি নেশা ছেড়ে দেবো। একদম। মিথ্যা কথা বলাও’ আমি বললাম দৃঢ়তা নিয়ে। ‘কালরাতে আমি সাভার যাইনি। মিথ্যা বলেছিলাম’
‘আমি জানি’ সে বললো।
‘ জানতে চাও কোথায় ছিলাম?’
‘ না, চাই না’
‘কেনো?’
‘ বলেছি না! আমরা প্রত্যেকে অনেক জীবন একসাথে নিজের ভেতর নিয়ে বাঁচি। ততোদিন। যতোদিন মৃত্যু এসে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে না দেয়।’
কথাগুলো শেষ করে অর্নিলা ভেতরে চলে গেলো। এবার আমিও তাকে যেতে দিলাম।
এই প্রথম। আমাদের হ্যাপি ব্যালকনিতে বসে আমাদের মন খারাপ হলো। সম্ভবত দুজনেরই।
আমি বসে আছি। বসে থাকবো। মন ভালো হবার আগ পর্যন্ত। ‘হ্যাপি ব্যালকনি’র নামটা আমি কোনভাবেই বদলাতে চাই না।
আজিজুল হক, গল্পকার ও কথাসাহিত্যিক