জয়নুল টিটো
নাইলনের তাগা দড়িতে টান দিতেই সোলেমান বুইজবার পারে কিছু একটা ঘটতে চলিছে। দড়ি টানার সময় তার গোটা দেহখান বাইন মাছের মতোন ত্যাড়া ব্যাকা হয়েই আবার সটান করে ছেড়ে দেয়।
সোলেমানের লোমশ হাতের দু’খান তালুর চিকনা শিরা বেয়ে অতি পরিচিত গিরগির শিরশিরে অনুভূতিখানা মুহূর্তে মাথার চুলের গোড়া অবধি গিয়ে ঠেকে।
আরো সাত আটজন জোয়ান মরদ নাইলনের দড়ি ধরে টানছে। গিরগির আর শিরশিরে অনুভূতি যে তারাও টের পায়নি ঘটনাটা এমন না। বরং ভালোই বুঝতে পেরেছে তারা।
তবে এই বুঝতে পারার মাঝে বিস্তর ফারাক আছে। সোলেমানের বোঝাপড়া আর অন্যদের বোঝাপড়া এক নয়।
বোটের বাঁ দিকের পোড়া তেলমাখা তক্তায় পাছার একাংশ ঠেসে দিয়ে দড়ি টানতে গিয়ে প্রথম চিক্কুরটা পারে এবাদত আলি।
Ñ “কিছু কি টের পাও সুলেমান বাই?’’
সোলেমান কথা-টথা বলেনা। শুধু এবাদতের দিকে তেচরা করে ঘাড় বাঁকিয়ে পানের পিক ফেলার মতো করে মুচকি হাসে।
মাথার উপরে ভাতের ফেনার মতো টগবগা জোছনা। তার রূপালী ফেনা উছলে পড়ে পিছল খায় উথালি পাথালি ঢেউয়ে। এর কিঞ্চিত ছটা এসে লাগে ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে থাকা সোলেমানের উদোম পিঠে।
হাঙ্গরের পিঠের মতো তেজালো পিঠ সোলেমানের। বিহান রাতের চাঁন্দের আলোয় তার পিঠখান তলোয়ারের খাপের আদল নিয়ে চিকচিক করে।
বছর দুয়েকের ছোট এবাদত আলি নিদারুণ হিংসা নিয়ে চেয়ে থাকে সোলেমানের চকচকা পিঠে।
দড়ি টানতে গেলে সোলেমানের দুই বাহুর পেশি দরিয়ার ঢেউয়ের মতোন উছলে উঠে। ভরপুর চাঁন্দের আলোয় তার পেশির উঠা নামা ঠিকই ঠাহর করতে পারে এবাদত আলি।
ছোট বেলায় মরণ বাতজ্বর যদি তারে ঠাইসে না ধরতো তাইলে পরে তার তেচরা পাওখান টনটনা বাঁশের মতোন খাড়া থাইকবার পাইরতো।
এবাদত ভাবে। ওই একখান ঠেং ছাড়া বাদবাকি গা গতরে সোলেমানের চেয়ে সে কম কীসে?
বরং সোলেমানের নাক বোচা।
লোকে তাকে বর্মাইয়া সোলেমান বলে ডাকে। অথচ এবাদতের নাক ইলিশের পেটির মতোন ধারালো। চৌকা। কেবল হাঁটতে গেলে সামনের দিকে এক আধটু ধাক্কা মারা লাগে। এই যা…।
নইলে তার কমতি কোন দিকে? ভারী জিনিসপাতি তুলতে গেলে তার নিজের হাত পায়ের পেশিও বাইন মাছের মতোন মোচড়ান দিয়ে উঠে।
শুধু ডান পাও খান খানিক চিকনা!
আর এতেই বহদ্দারের বেটি শরীফার তারে ল্যাং মাইরে সোলেমানের ঘরে গিয়ে ওঠা লাগলো!
যাবার আগে চিরচেনা শরীফা তারে বলেছিল,
Ñ “আমারে মাফ কইরেন। বাপে কইছে লুলা মানজুরের লগে বিয়া দিবোনা।’’
কথাটা বলেই মাছ ধোয়ার চালুনি আর মাটির মালশাখান ডান হাতের তালুর ওপর উঁচা কইরে ধরে কোমর দুলিয়ে হন হন করে চলে যায় শরীফা।
ওই সময় এবাদতের মনে লয় কেউ একজন দশ সেরি ওজনের একখান চড় বসিয়ে দিয়েছে তার গালে।
এবাদত সেদিন অচানক চড় খাওয়ার বোবা অনুভূতি বুকে চেপে ইয়াতিমের মতো শরীফার চলে যাওয়া দেখেছে।
শরীফার হেঁটে যাওয়ার সময় মাছের চালুনি আর মালশা চুইয়ে চুইয়ে পানির চিকনা নহর বেয়ে বেয়ে যাচ্ছিল তার পেছন পথে।
এবাদতের কাছে তখন ওই চিকনা নহরকে ছুরির চকচকা ফলার মতোন মনে হচ্ছিল।
তার মনে হচ্ছিল কেউ জানি তার বুকের মাঝ বরাবর ছুরির চৌকা আগা চেপে ধরে টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছে।
সোলেমানের টনটনা পায়ের কাছে এবাদতের লুলা পাওখান সেদিনই আদতে বসান খেয়ে যায়।
ওই সময় এবাদতের মন চাইছিল তার লুলা পাওখান ধইরে আছড়ে মারতে ঝাউ গাছের গায়ে। যেভাবে সাগর পাড়ে বাচ্চা পোলাপাইন জালে আটকে যাওয়া সাঁপের লেঞ্জা ধরে হেঁচকা টানে আছড়ে মারে নৌকার গায়ে।
ব্যাপারখান ভালো করেই জানতো সোলেমান। বিয়ের পরদিন রসুর চা দোকানে কাঁচা মেহেন্দি রাঙা হাত এবাদতের কান্দের উপর রেখে সোলেমান বলেছিল,
Ñ “মাইন্ড খাইসনে এবাদত! শরীফা আমার ঘরে আছে মানে ধইরে ল তুর ঘরেই আছে। তুর যখন মুন চায়, যাবি, গপ্পোসপ্পো করবি। হে রে তুই আপনা বুইনের লাহান একিন করবি।’’
এরপর ধীরে ধীরে এবাদত স্বাভাবিক হতে শুরু করে। অবশ্য যতই স্বাভাবিক হউক না কেন, শরীফারে সে কোনদিন বোনের মতো জানতে পারেনি। বরং শরীফার চোখের দিকে তাকালেই তার কলিজার ভেতরে কেমন জানি আইর মাছে ঘাঁই দিয়ে উঠে।
সোলেমান খুব ধীরে ধীরে রশি টানছে। নৌকাটা বেশ বড়সড়। ইঞ্জিন নৌকা। শক্ত কাঠামোতে তৈরী এই নৌকায় শুধুমাত্র বড় মাছ ধরা হয়।
নৌকা যেমন জালও তেমন। একবার ফেললে মাইলখানেক বেড় দেয়া যায়। মাঝি জাইল্যা মিলে আট দশজনের মতো লোক হপ্তা দুয়েক সাগরে দিব্যি ভাসতে পারে।
যাবতীয় সরঞ্জামের বন্দোবস্ত নৌকাতেই করা আছে। নৌকার নিচের অংশে বরফ ঘর। পেছনের দিকে থাকার জায়গা।
নভেম্বরের এই সময়টাতে দরিয়া বেজায় শান্ত। ঢেউয়ে উথালি পাথালি নেই।
হালকা ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে। হাওয়ায় নৌকার পেছনের বাহারি পতাকা ঝোলানো খুঁটি তিরতির করে কাঁপে।
সোলেমানের হাতে ধরা নাইলনের দড়িতে কাঁপুনি আরো বাড়তে থাকে।
সোলেমান এবার নিজেই নৌকা ভাসিয়েছে। প্রতিবার অন্যের নৌকায় ভাড়ায় খাটতো সে।
এবার আট দশজন জাইল্যা সে নিজেই খাটিয়েছে। এই যে কামলা থেকে হঠাৎ করে মালিক বুনে যাওয়া! এসবই বলতে গেলে শরীফার বুদ্ধির জোরে।
বহদ্দারের বেটি শরীফার দেমাগ কিন্তু উঁচা। বাপের কাছ থেকে কোনো সুবিধা নিতে নারাজ। এমন কী ধার দেনা পর্যন্ত না।
শরীফা গেরস্থি মেয়ে। সোলেমানের দেয়া টাকা থেকে সে জমাজাতি করেছে। রাঁধতে গেলে আগে মুষ্টি চাল আলাদা করে রেখেছে। একসময় জমাজাতি মুঠো ভর্তি হয়ে ওঠলে সেটা সোলেমানের হাতে তুলে দিয়ে শরীফা বলেছিল,
Ñ “পরের কামলা আর কতদিন খাটপা? এই বার নিজে কিছু করবার পারো।’’
মুঠো ভর্তি টাকা পেয়েই সোলেমান আর দেরী করে নাই। সোজা চলে যায় সবুর মাঝির কাছে।
সবুর মাঝির বড় নৌকাখান এক সিজনের জন্য ভাড়া নিয়ে নেয় সে। সাথে জাল। জালের শর্ত আলাদা। যা মাছ উঠবে, খায় খরচা বাদে লাভের অর্ধেক পাবে সবুর মাঝি বাকি অর্ধেক সোলেমান।
নৌকার ভাড়া আলাদা। তবে দুজনেই গা গতরে খাটবে। এমন শর্তে দিন ক্ষণ ঠিক করে পাগলা ফকিরের দরগায় শিন্নি দিয়ে নৌকা ভাসায় তারা।
সেই থেকে মাঝি আর সোলেমান সাথে আরো আটজন জাইল্যা যুবক সাথে নিয়ে সাগরে ভাসছে তারা। তাও তিন দিন হতে চললো। সব ঠিকঠাক থাকলে সপ্তাহ শেষে তাদের ফেরার কথা।
সাগরের বেশ খানিক ভেতরে সোলেমানের নৌকা। আবছাদূরে বার্মা সীমানা। কিছু বয়া ভাসানো আছে ওদিকটাতে।
সোলেমান ভালো করেই জানে বয়ার ধার কাছে ঘেঁষা যাবে না। নাসাকা ধরে নিয়ে যাবে। তবুও জায়গাটা তার পছন্দ। পছন্দেরও কারণ আছে। জায়গাটা মোহনার মতো। কায়দা করে জাল ফেলতে পারলে ঢের মাছ পাওয়া যায়।
নাসাকা যে মাঝে সাঝে বাগড়া দেয় না তা কিন্তু না। সোলেমান কায়দা কানুন জানে।
এই সাগরে মাছ মারছে সে কম করে হলেও দেড় যুগ তো হবেই। সেই আট বছর বয়সে বাপের সাথে প্রথম দরিয়ায় নেমেছিল সে। আজ পর্যন্ত দরিয়া থেকে উঠা হয়নি তার।
মায়া!
নোনা জলের মায়ায় পেয়ে বসেছে তাকে।
দরিয়ার ঢেউ, বিশালতা তাকে বারে বার হাতছানি দিয়ে ডাকে,
Ñ “আয়, সোলেমান আয়… জলের বুকে আয়।’’
সোলেমানের কাছে সাগরের মায়া। দরিয়ার হু হু ডাক কলিজার গোড়া ধরে টানে। মাটিতে যে ক’দিন থাকতে হয় তাও শরীফার মায়ায়। নতুবা এই দরিয়ার বুকেই সে থেকে যেত বোধ করি।
দুই হাতের কব্জিতে গিরগির শিরশির বেড়েই চলেছে। সোলেমান মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যায়, জালে সোনাচাঁন বিঁধেছে।
সোনাচাঁনের কাঁপন সে বুঝতে পারে।
এই চান্নিপসর রাইতেও সোলেমানের কপালে চিকনা ঘাম দেয়। বাঁ হাতের কব্জির উল্টা পিঠে কপাল মুছতে মুছতে সে চিক্কুর পাড়ে,
Ñ “ ওই এবাদত! দড়ি নিচা কইরা জল ঘেইষে আস্তে আস্তে টান। ও সবুর বাই! নৌকার লগি এট্টু তেচরা কইরে দাও দেন।’’
বড়সড়ো জায়গা জুড়ে জাল ডুবিয়েছে সোলেমান। জাল ফেলার আগ মুহূর্তে বরাবরের মতোন দরিয়ার এককোষ জল জিভের আগায় লাগিয়ে পরখ করে নিয়েছিল সে।
এ কায়দা সে তার বাপের কাছ থেকে শিখেছে। তার বাপ আজগর আলি জাল ডুবানোর আগ দিয়ে এভাবে জিভের আগায় নোনা জল লাগিয়ে পরখ করে নিত।
আজগর আলি বুঝতে পারত ঠিক কোন জায়গাটাতে মাছের ঝাঁক ঘাপটি মেরে আছে।
সোলেমানও কায়দাটা জানে।
আজগর আলি একমাত্র তার ছেলেকেই শিখিয়ে দিয়ে গেছে দরিয়ার নোনা স্বাদের মজেজা।
সোলেমান জিভে নোনতা সোয়াদের আঁচ নিয়ে বুঝতে পেরেছিল জায়গাটাতে মাছের ঝাঁক আছে। সেমতে জাল ডুবিয়েছে সে।
এবাদত একমনে জালের দড়ি টেনে যাচ্ছে। আর গলা ছেড়ে গান ধরেছে,
Ñ “কেন পিরিতি বাড়াইলারে বন্ধু…ছেড়ে যাইবা যদি…।’’
এবাদতের যখন তখন গলা ছেড়ে এমুন গান ধরা সোলেমানের পছন্দ না। এ গানের মজা সে বোঝে। সোলেমানের বিরক্ত লাগে।
Ñ “হইছে, করিম হইতে হইবো না! জাল গোছা। বহুত কাম আছে।’’
এবাদত ঘাড় বাঁকিয়ে একখান মুচকি হাসে।
সে জানতো মাঝখানে তারে থামিয়ে দেবে সোলেমান। তবু সে ইচ্ছে করেই গান ধরে। এবাদত কথা ঘোরায়,
Ñ “সোনাচাঁন বিঁধেছে মনে লয়, সোলেমান বাই!’’
Ñ “হ তরে কইছে! সবজান্তা শমসের মিয়া!’’
সোলেমান একরাশ বিরক্তি নিয়ে মাথা ঝাঁকায়।
টিনের চৌচালা ঘরে এই মূহূর্তে কী করছে শরীফা, কে জানে?
কাদা মাটির চাকের মতোন বউ তার। কেমুন সহজ সরল মায়ার দলা। কত মায়া করে যে ভাত বাইড়ে দেয়, পাতে সালুন তুইলে দেয়!
চোখে চোখ পরলে তেচরা কইরে হাসে। তখন সোলেমানের মনে লয়, ভাত সালুন অমনি ফেইলে থুইয়ে কইলজার মইধ্যে ঢুকাইয়া লয় তারে।
আজ যদি সত্যি সত্যিই সোনাচাঁন বিঁধে! এইবার আর
বাজারঘাটায় নৌকা ভেড়াবে না সে। সোজা চলে যাবে অভয়মিত্র ঘাটে।
শহরে। সেখানে বড় বড় আড়তদারদের কাজ কারবার। এখানকার বাটপার বেপারীদের চেয়ে ওরা অনেক বেশি দাম দেয়।
সোলেমান মনে মনে ভাবে,
বেশ বড়সড় পাঁচখান সোনাচাঁন বিঁধলো জালে। পাঁচখানই মর্দা। একেকখান মণের কাছাকাছি।
সোজা অভয়মিত্র ঘাটে নিতে পারলি কম করে হলিও লাখ ছয়েক তো পাওয়া যাবেই!
গেল বছর তমিজ বহদ্দারের নৌকায় ভাড়ায় খেটেছিল সোলেমান। সেবার এমনই এক নভেম্বর মাসের রাইতে বহদ্দারের জালে গুইনে গুইনে আটখান সোনাচাঁন বিঁধেছিল।
তার মইধ্যে সাতখানই ছিল মর্দা।
তমিজ বহদ্দার জাতে মাতাল তালে ঠিক কিসিমের মানুষ। নৌকা আর কূলে ভেড়ায়নি। সোজা চলে যায় অভয়মিত্র ঘাটে। শহরে। সেবার তমিজ বহদ্দার সাড়ে সাত লাখ টাকা কামিয়েছিল।
সোলেমানের ভাবতে ভালো লাগে, সেও এবার পাঁচখান বেইচে যদি লাখ পাঁচেক কামাতে পারে তো! পরের খেপেই নতুন নৌকা নতুন জাল নামাতে পারবে।
একদম খাসা নিজের। সোলেমান নিজেরে বহদ্দার ভাবতে শুরু করে দেয়।
জাল প্রায়ই গুটিয়ে আনার জোগাড়।
সোলেমানের হাতের কব্জিতে গিরগির শিরশির কাঁপুনি আরো চেতা দিয়ে ওঠে। ঘাড়ের পেছনে সবুর মাঝির খসখসা হাতের ছোঁয়ায় তার খোয়াব ভাঙ্গে।
Ñ “ওই সুলেমান! সোনাচাঁন বিঁধছে মনে লয়! নৌকার পেছন ধরি যেরাম করি মোচড় মাইরলো!’’
মাঝির কথায় সোলেমান দড়ির টানে খানিক ঢিল দেয়। তেরচা করে মাঝির দিকে চায়। বাঁম হাতের উল্টো পিঠে কপালে ফিনকি দেয়া ঘাম মুছে। ভরা চাঁন্দের আলোয় সবুর মাঝির চুলহীন মাথার তালু চিকচিক করে।
Ñ “সেটাই জানি হয় মাঝি। আমারো মনে মনে সেরামই ধারণা। বুঝলা মাঝি! যদি সেরকম কিছু হয় তো! সোজা শহরের দিকে নৌকা ঘুরাবা কিন্তুক।’’
সবুর মাঝি মাথা ঝাঁকিয়ে সোলেমানের কান্দের ওপর থেকে হাতখান সরিয়ে দড়িতে হাত লাগায়।
তরতর করে ভাঁজে ভাঁজে জাল ওঠে আসছে নৌকায়। সোলেমান হিসেব কইষে দ্যাখে, এখন নভেম্বর মাসের শুরুর দিক।
গেল বারে সোনাচাঁন বিঁধেছিল এই নভেম্বর মাসেই। আজ যদি সত্য সত্যই সোনাচাঁন বিঁধে! তয় তার হিসেবখান জোয়ারের পানির লাহান তরতর কইরে মিলে যাবে।
নভেম্বর মাস মানেই সোলেমানের জালে সোনাচাঁন।
পাশ দিয়ে ভট্ ভট্ আওয়াজ তুলে ইঞ্জিন বোট পেরোয়।
বোট থেকে কে জানি চিক্কুর পারে,
Ñ “কিরে সুলেমান! এইবারও কাম সাইরে দিলি নাকি?’’
সোলেমান খেয়াল করে দেখে, আফজল মাঝির ছেলে নবী হোসেনের গলার আওয়াজ।
নবী হোসেন একসময় সোলেমানের সাথে অন্যের নৌকায় ভাড়ায় খাটতো। আজকাল তার নিজের একখান বোট হয়েছে। মাছ মারার টাকায় এই বোট নবী হোসেন যে জোরাতে পারেনি এ ব্যাপারে সোলেমান অনেকখানি নিশ্চিত। লোকে বলে মাছ মারার ছলে নবী হোসেন ওপার থেকে বড়ি টড়ি কি জানি চালান করতো!
ওসবেই বেশ পয়সাপাতি করেছে সে।
তারপর একদিন বলা কওয়া নেই অমনি হুট করে চোখে লাগার মতোন একখান ইঞ্জিন বোটের মালিক হয়ে যায় নবী হোসেন।
নবী হোসেনের চিক্কুরের জবাবে সোলেমান বলে ওঠে,
Ñ “মাবুদ জানে কী বাঁধিছে। তুই আমার জন্যি পারলি এট্টু দোয়া খায়ের করিস! মাথা তুইলে যেন খাড়াইতে পারি। তুর মতোন অমন পঙ্খিরাজ বোট বাঁইধবার না পারলিও জানি অন্ততপক্ষে একখান গুডগুডি কাঠের নৌকা যেন বাঁইধপার পারি।’’
নবী হোসেনের ফিরতি গলা আর শোনা যায় না।
নবী হোসেন ফিরতি কিছু বললেও সেটা ইঞ্জিনের ভট্ ভট্ আওয়াজ ডিঙিয়ে সোলেমানদের নৌকা অবধি পৌঁছুতে পারেনি।
সোলেমান সত্যি সত্যিই বিষম চিন্তায় পড়ে যায়।
সোনাচাঁন যদি না বিঁধে! তখন? কত আশা কইরে আছে সে।
বছর দু’য়েক আগে একবার তার মহাজনের নৌকায় এমন এক ধোঁকা খেয়ে তাজ্জব বুনে গিয়েছিল সোলেমান।
সেই রাতটাও ছিল এমন পূর্ণিমার।
জাল টানার সময় ভীষণ ভারী ঠেকছিল। সোলেমান ভেবেছিল বড়সড় মাছ বোধহয় আটকা পড়েছে। জালের শেষ মাথাটা নৌকায় টেনে তুলতেই মহাজন আর তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।
সেবার জালে উঠেছিল দুইখান বড়সড় তেলের ড্রাম। তাও তেল থাকলে না হয় কথা ছিল! খালি ড্রাম।
জলে কাদায় ভরা।
বলার মতো মাছ ওঠেছিল মোটে চারখান। ভোল মাছ। সেবার নৌকার তেলের খরচাও ওঠাতে পারেনি মহাজন। জাইল্যাদের মজুরী তো সার!
এবার এমনটি ঘটুক সোলেমান সেটা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে চায়না। নৌকার জাইল্যারা দড়ি প্রায় গুটিয়ে নিয়ে এসেছে।
জালের যে অংশটা ওপরে উঠার অপেক্ষায় সেটা গোলগাল হয়ে এসেছে। সোলেমান এই মুহূর্তে তার দুই হাতে শিরশিরে অনুভূতি আরো বেশি করে টের পেতে থাকে।
গায়ের সকল জোর এক করে জাল টানতে থাকে। তার উদোম গায়ের কালচে হাতের বাহুর পেশিগুলো জিওল মাছের মতোন খলবলিয়ে উঠে।
ভরা চাঁন্দের আলোয় ওপরে উঠে আসা জালের গায়ে আটকে থাকা পাঙ্গাস আর গুইজ্জা মাছের পেটিতে চাঁন্দের আলো পিছল খেতে থাকে।
এই মাছও খুব একটা কম বিঁধেনি!
কিন্তু সোলেমানের নজর ওদিকে নাই। সে একমনে জালের দড়ি টেনে চলে।
দড়ির শেষ মাথাটা জালের গোলগাল পুটলাসহ যেইনা নৌকায় উঠে আসে অমনি এবাদত আকাশ বাতাস এক করে চিক্কুর মেরে ওঠে..
Ñ “বাঁধিছেরে… বাঁধিছে…।
ও সুলেমান বাই! সোনাচাঁন বাঁধিছে তোমার জালে।’’
এবাদতের চিক্কুরে জাইল্যা কামলা সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে জালের গোলগাল দলাটার উপর।
তাদের প্রায় সবাই কোমরে পেঁচিয়ে রাখা মোবাইল বের করে উঁচিয়ে ধরে জালের দিকে। মুহুর্তে জোনাকি পোকার মতো একদলা আলো নেচে উঠে জালে দলা পেঁচিয়ে থাকা বড় সাইজের মাছগুলোর ওপর।
সোলেমান পরম কৃতজ্ঞতায় দু’হাত আকাশের দিকে উঁচিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে।
সবুর মাঝি পেছন থেকে তার কাঁধে হাত রাখে।
নভেম্বর মাসের চাঁন্দের ফকফকা আলোয় চিকচিক করে তাদের দু’জনের সুরত। সবুর মাঝি সোলেমানের হাত ধরে নৌকার পেছন দিকে পাটাতনে গিয়ে বসে।
Ñ “বুঝলি সুলেমান! আমি কিন্তুক ঠিক ঠিকই টের পাইছিলাম! যেইনা নৌকার পাদানিখান মোচড় মাইরলো সেই বেলাই আমার বুঝা শেষ। সোনাচাঁন ছাড়া এই কাম হইবারই পারেনা। ল…আল্লার নাম লইয়ে মাইঝ রাইতেই শহরের দিকে নৌকা ছাড়ি। সক্কাল সক্কাল আড়ত ধইরতে পাইরলে ভালো দাম পাওয়া যাইবেনে।’’
সোলেমান মাথা নাড়ে। দু’জনই জালের কাছে যায়। ততোক্ষণে জাইল্যাদের মাছ খামাল করা শেষ। তারা একপাশে মাছগুলান বিছিয়ে রেখে জাল গুটাতে লেগে যায়।
বেশ বড়সড় সাইজের দশ খান সোনাচাঁন শুয়ে আছে সোলেমানের সামনে। একেকখান কম কইরে হলেও কুড়ি কেজি তো হবেই!
এ যেন সোলেমানের ভবিষ্যৎ শুয়ে আছে পাটাতনে। আরো আট দশ খাঁচির মতো ছোট বড় মাছ পাওয়া গেছে এই খেপে।
সোলেমানের খাঁচির দিকে মন নেই। সে এক ধ্যানে চেয়ে থাকে কাৎ হয়ে শুয়ে থাকা মাছগুলোর দিকে। ভর পূর্ণিমার রূপালি আলো মাছগুলোর গা গতরে আছড়ে পড়ে ঝিলিক মারে।
সেই ঝিলিক মাছের পেটিতে ধাক্কা খেয়ে ঠিক ঠিকই পৌঁছে যায় সোলেমানের কলিজায়।
দুই.
অভয়মিত্র ঘাটে যখন নৌকার মাস্তুল এসে ঠেকলো তখন সুবহেসাদিক পেরিয়ে গেছে। আলো আঁধারি আর চোখে কেতুরডলা কুয়াশা ভেদ করে ততোক্ষণে আরো গোটা বিশেক নৌকা এসে ভিড়েছে ঘাটে।
ভিড় করা নৌকাগুলো ঘিরে ঘুরপাক খেতে থাকে গাঙচিল, মাছরাঙা, কাক আরো কত কী নাম না জানা পখ-পক্ষি!
সোলেমান নৌকার আগায় দাঁড়িয়ে চারপাশটা ভালো করে পরখ করে নেয়। নৌকার জাইল্যা কামলা ছেলেগুলো নিচের পাটাতন আলগা করে বরফ কুটুরি থেকে মাছগুলো বার করে খামাল করতে থাকে।
একটু পরেই যখন শরীরের লোম ঠাহর করার মতোন আলো জাগবে ঠিক তখনি মাছের খাঁচিগুলান আড়তে নিতে হবে। সবুর মাঝি সেই বন্দোবস্ত করতে আরো আধঘন্টা আগেই নৌকা ছেড়ে নেমে গেছে।
পূর্ব আকাশে আধসিদ্ধ ডিমের কুসুমের মতোন সূর্যের আভা দেখা যেতেই সোলেমানের নৌকার খাসা খাসা দশখান সোনাচাঁনকে ঘিরে জাফর সওদাগরের গদির সামনে শোরগোল শুরু হয়ে যায়।
জাফর সওদাগরের গদিতে সোলেমান এর আগেও বারকয়েক মাছ দিছিল। লোকটা কথা একটু বেশি বললেও ভালো দাম হাঁকাইতে পারে।
আধা ঘন্টারও কম সময়ের ভেতর সোলেমানের সোনাচাঁন নিলামে বিক্রি হয়ে গেল। তিন লাখ টাকায় হাঁক ডাক শুরু হইলেও শেষতক সাত লাখ কুড়িতে গিয়ে থামে।
সাত লাখ কুড়ি…এক…দুই…তিনে…জাফর সওদাগর গদিতে গিয়ে বসে। সবুর মাঝি বাদবাকী মাছ হাজার ত্রিশেক দামে বেচা বিক্রি করে ফিরে আসে।
জাফর সওদাগর তার কমিশন বুঝে নিয়ে বাদবাকী ক্যাশ সোলেমানকে বুঝিয়ে দেয়। সবুর মাঝি সোলেমানকে সাথে নিয়ে নৌকায় ফিরে আসে। জাইল্যা কামলাদের মজুরী বোনাস বুঝিয়ে দেয়। নৌকা নিয়ে চলে যেতে বলে তাদের।
তারা দুজন ঘাটের ধারে কাছে পরিচিত এক বোর্ডিংয়ে উঠে। আজকের দিনটা তারা দুজন জিরোবে। বিকেলে কিছু সদায়পাতি সেরে পরের দিন ফিরবে বলে ঠিক করে।
চাঁটগাঁ শহর সোলেমানের কাছে তেমন একটা পরিচিত নয়। তার দৌড় ওই সাগরপাড়ের ঘাট পর্যন্ত। এর আগে যতবার এসেছে ঘাটের আশপাশ আর বড়জোড় হকার মার্কেট পর্যন্ত। এই তার যাওয়া আসা।
সবুর মাঝি এক্ষেত্রে একটু বেশি পাকনা।
শহরের ঘাটে নৌকা ভিড়লেই কেমন যেন পাখা গজাতে শুরু করে তার। সোলেমান জানে লোকটার এক আধটু দোষ আছে।
পাড়ায় যাওয়ার দোষ।
সোলেমান একটু ঘুরিয়ে বলে আলুর দোষ। দ্বীপ ছেড়ে শহরে পা লাগলেই সবুর মাঝির ওই দোষ মাথাচড়া দিয়ে ওঠে।
আজও এর ব্যাতিক্রম হয়নি।
সাঁঝের বেলা শহর ঘুরে ঘুরে ফুটপাত থেকে তারা দুজন বেশ কেনাকাটা করে। বোর্ডিংয়ে ফেরার পথে কাছাকাছি জায়গায় সবুর মাঝি অচানক সোলেমানের হাতে সওদাপাতির গাট্টিবোচকা ধরিয়ে দিয়ে বলে,
Ñ “ধর। এগুলান লয়ে বোর্ডিংয়োত যা। আমার কাম আছে।’’
সোলেমান এ কামের মানে জানে।
কোন রা করেনা। ঠোঁটের কোণে একটা তেচরা হাসি দিয়ে সোজা হাঁটা ধরে বোর্ডিংয়ের দিকে।
মাছ মোকামের আশপাশে টিনের ছাউনির অনেকগুলো আলগা জুতের ঘর। এ ঘরগুলোতে অল্প টাকায় থাকা যায়। বোর্ডিং ঘর।
মাছের কারবারের লোকেরা পরম শান্তিতে রাত কাটাতে পারে এখানে। টাকা পয়সা আর মালের নিশ্চয়তা এখানকার ঐতিহ্য।
বোর্ডিংয়ের তক্তার বিছানায় শুয়ে সোলেমান ঠিক করে ফেলে ফিরে গিয়ে কী করবে। যাবার পথে টেকনাফ বাজারের পরিমল স্বর্ণাকারের দোকানে এট্টু ঢুঁ মারা লাগবেই।
এবার নৌকা ভাসানোর আগে হাতটান পড়েছিল তার। শরীফা বুঝতে পেরে নাকের বেশর আর কানের দু’খান দুল খুলে সোলেমানের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিল।
নাহ্! সোলেমান ওগুলো বেচে দেয়নি।
পরিমল স্বর্ণকারের কাছে বন্ধক দিয়ে কিছু টাকা নিয়েছিল। এত কম সময়ে বন্ধক ছাড়াতে পারবে সেটা ঘুনাক্ষরেও ভাবেনি।
উপরওয়ালা যখন মুখ তুলে চাইলেন, সোলেমান শরীফার জন্যে দু’খান সোনার চুড়িও নিয়ে যাবে বলে মনে মনে একিন করে।
তার ভাগের টাকা দিয়ে সকল দায়-দেনা শোধ বোধ করার পরেও হাতে যা থাকবে তা দিয়ে সোলেমান দিব্যি নিজের একখান বোট বাঁধবার সাহস করতেই পারে।
তিন.
বছর তিনেকের মধ্যে অনেক ঘটনায় ঘটে গেল। শরীফার কোল আলো করে মরদ ছেলে এসেছে। সোলেমান ছেলের নাম রেখেছে সোনামিয়া। সোনামিয়া সারা উঠান দৌড়ে বেড়াতে পারে।
পুরানো ভিটেয় রঙিন টিনের ছাউনি দেয়া শিলকড়ইয়ের গাঁথুনিতে আলগাজুতের ঘর উঠেছে সোলেমানের। নিজে একখান বোট আর জালের মালিক হতে পেরেছে।
এরি মধ্যেই সোলেমান আরো দুই দুইবার সোনাচাঁনের দান মেরেছে। একবার চারখান আরেকবারে তিন। তাও আবার সেই নভেম্বরে।
গোটা দ্বীপে এখন ব্যাপারখানা চাঁন্দের আলোর মতোন ফকফকা। নভেম্বর মাসেই সোলেমানের কপাল খোলে। তার জালে সোনাচাঁন আটকাবেই। একথা বিশ্বাস না করেই বা উপায় কী! এ পর্যন্ত যতবার ঘটনা ঘটেছে ওই নভেম্বরেই।
কথায় আছে এসব কথা নাকি বাতাসের আগে দৌড়ায়। সোলেমানের বেলায়ও এমনটাই ঘটেছে। দ্বীপ পেরিয়ে শহর বন্দর এমনকি গোটা দেশে ছড়িয়ে যায় তার কাহিনী।
দেখতে না দেখতে সোলেমানের আলগাজুতের ঘরের দাওয়া আর উঠানে অচেনা লোকের ভিড় বাড়ে। সাংবাদিক আর ইউটিউবার ছোকরাদের আনাগোনায় গমগম করে গোটা ঘরের চৌহদ্দি।
সবাই নভেম্বরের রহস্য জানতে চায় তার কাছে। সোলেমান বরাবরই একটাই জবাব দেয়,
Ñ “সবই মাওলার খেল’’।
সময় সবসময় কী আর ঐকিক নিয়মে চলে? একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি কী বারবার ঘটে?
সোলেমানের বেলায় সেটাই ঘটলো। পরের নভেম্বরে সাগরে নাও ভাসালো ঠিকই কিন্তু সোনাচাঁনের দেখা মিললো না।
লাখ টাকা খরচায় জাল ফেললেও মাছ মিললো মোটে হাজার পাঁচেকের। কামলা জাইল্যার খাইখরচা হিসেব করতে গেলে এ যাত্রায় সোলেমানের গচ্চা গেল সোয়া লাখের মতো।
তাও না হয় কাটায়ে উঠা যেত।
কিন্তু ঘটনা যা ঘটে গেল তার লোকসান পোষানো অত সহজ কম্ম নয়। সাগরে মধ্যখানেই তার বোটে জলডাকাত হানা দিলো। ডাকাত দল ভেবেছিল এবারো বুঝি সোলেমানের জালে সোনাচাঁন আটকালো বুঝি!
সে রাতও ছিল ভর পূর্ণিমার। সোলেমান দেখলো ডাকাত সর্দার মাছ না পেয়ে চরম খেপা খেপে গিয়ে তার এত কষ্টের জালখান নিয়ে গেল।
সোলেমানের কিছু বলার জো ছিল না। কিছু বললেই রাম দা’র এক কোপে তার ঘাড় গড়িয়ে পড়তো সাগরের বুকে। জলডাকাতের নৌকা যখন তার পাশ দিয়ে চলে গেল তখন তার মনে হলো ডাকাতরা তার জাল নয় বরং তার কলিজাটা হেঁচকা টানে চিড়ে নিয়ে গেছে।
নাহ্।
দ্বীপে ফিরে এসে সোলেমান কোনো মামলা মোকাদ্দমায় গেল টেল না। উপরন্তু জালহীন সোলেমান বেশ কিছুদিন জলের ধারে কাছেও গেল না। মনখারাপ করে শুয়ে বসে কাটালো ঘরে। দ্বীপের জেলেদের একটা প্রবণতা হলো তাদের তেমন কোন সঞ্চয় টঞ্চয় থাকেনা। বলা যায় এসবে তারা অভ্যস্তও নয়। যা আয় রোজগার হয় তা খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায় দাদন চক্রের দুষ্ঠুজালে। সোলেমানও সেই চক্রের চৌহদ্দি ডিঙাতে পারলো না। অতএব তার বিপাকে পড়তে সময় লাগলো না। সবুর মাঝি এক সকালে এসে তাকে আবার সাহস জোগালো।
Ñ “শুন সুলেমান! আমি তুরে জাল দিমুনে। তুই আবার জলে নাম। তুর হাতে মাওলার কৃপা আছে। তয় আমার দুইখান শর্ত তুকে মানা লাগবি। পরথম শর্ত, আসছে নভেম্বরে বোট ভাসাবি। আর দ্বিতীয় শর্ত হইলো, খেপে যা মাছ পাবি তার ভাগ হবি সমান সমান।’’
সোলেমান আড়চোখে তার ঘরের বেড়ায় ঝুলানো ক্যালেন্ডার দেখে। নভেম্বর আসতে আরো ছ’মাসের ব্যাপার।
সবুর মাঝির এই শর্তে সোলেমানের রাজি না হয়ে উপায় নেই।
সে কেবল মাথা নাড়ায়।
চার.
চারদিকে থৈ থৈ পানি। মাঝখানে সিঁথির তিলকের মতোন চিকনা দ্বীপ। গোটা দ্বীপে সবমিলে শ দেড়েক বাড়ি আর হাজারের মতোন বাসিন্দা। গেরস্থ ঘর বড়জোড় কুড়ি পঁচিশের
বেশি নয়।
সোলেমান ওই কাতারে কেবলই ঢুকেছিল অচানক ধাক্কা খেয়ে এখন পড়তির দিকে।
জাল নেইতো জলায় কাম কী?
এদিকে হাতের যৎসামান্য জমাজাতি যা ছিল তাও হাফিস হয়ে গেছে। কথায় আছে শুয়ে বসে খেলে রাজার গোলায়ও টান পড়ে। সে হিসেবে সোলেমানতো কোনকালেই রাজা ছিল না।
তার এত সাধের বোটখান মেরামতের অভাবে চ্যাংদোলা হয়ে পড়ে আছে খালপাড়ে। সংসারই চলেনা আবার বোটের মেরামত কী? বাজারঘাটার শামছু বেপারী জুত বুঝে সোলেমানকে একখান প্রস্তাব দিয়ে বসে।
Ñ “তুই চাইলে পরে কিছু দাদন দিবার পারি। নতুন কইরে জাল বাঁধবি আর বোটখান ঘইষে মাইজে আবার খাড়া করবার পারিস। তয় শর্ত থাকবি…’’
এতটুকু বলেই বেপারী রাস্তার কিনারে নিন্দাগাছের গোড়ায় দুই’পা এগিয়ে যায়। পিক করে পানের পিক ফেলে। পরনের লুঙ্গির কোণা টেনে গালের একধারে বেয়ে নামা লাল রস মোছে। আড়চোখে সোলেমানের দিকে চেয়ে বাদবাকী কথা শেষ করে।
Ñ “শ’য়ে কুড়ি টাকা। হপ্তা হিসেবে পরফিট দিয়া লাগবি। একবারেও দিয়া যাবিনি। তাইলে পরে আরো পাঁচ টাকা কইরে হিসেবের খাতায় যোগ হবি। আর ততদিন পর্যন্ত তুর আলগাজুতের ঘরখান আমার কাছে বন্ধক থাকবি কলাম।’’
সোলেমান কিছুই বলে না। হা করে চেয়ে থাকে।
নাহ্!
সোলেমান দাদন নেয়নি। শামছু ব্যাপারী জম্মের সুদখোর। তার পাল্লায় পড়ে অনেক জাইল্যার ভিটেঘর গেছে। সোলেমান এসবের ধারেকাছেও ঘেঁষবেনা। তারচে সবুর মাঝির প্রস্তাবটাই বেশি জুতের।
আরো মাস দুই পার হয়ে গেল। সোলেমানের কিছু দাদন নেয়াই লাগলো। শামছু বেপারীর চে তার কাছে লোকমান আড়তদারের দাদনই জুতের মনে হলো।
আড়তদারের শর্তে ঘর বন্ধকের কথা নেই। শুধু সিজনে যে মাছ পাবে সোলেমানের তা থেকে হাফ দেয়া লাগবে। আর বাদবাকী মাছ তার আড়তে বেচা লাগবে। এ থেকেই দাদনের টাকা আর লাভের অংশ শোধবোধ হয়ে যাবে।
নতুন জাল কেনা আর বোটের মেরামতে দাদনের টাকা নিমিষেই শেষ হয়ে গেল। সোলেমান নিয়ত করে নভেম্বরেই বোট ভাসাবে সাগরে।
এরি মধ্যে বদনা ফকিরের দরগায় শিন্নি মানত করে এসেছে শরীফা। দাদনের টাকা থেকে কিছু টাকা আগেভাগেই জাইল্যা আর মাঝিকে অগ্রিম দিয়ে বুক করে রেখেছে সোলেমান।
এটাই রেওয়াজ এখানকার। এখন শুধু দিনক্ষণ গুনার পালা।
আলগাজুতের ঘরটার পেছনের দিকের খিরকি মেলে দিলে সাগরের বুক দেখা যায়। সোলেমানের বিছানা ও ঘরে। আধশোয়া সোলেমান খিড়কি দিয়ে সাগরের বুক দেখে। শরীফা পাশে বসে একখিলি পান বাড়িয়ে দিয়ে বলে, Ñ“পোলাডার গা গতর কেমুন জানি মেদা মেদা লাগে। কিছুই খাতি পারে না। পেড মোচড়ান দেয়। একখান ডাক্তার দেখানো লাগে গো।’’
সোলেমান খিড়কি থেকে চোখ সরিয়ে তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা সোনামিয়ার কপালে হাত রাখে। শরীফার দিকে তাকায়।
Ñ “আর কডাদিন সবুর কর শরীফা। এবার সোনাচাঁন পালি পরে পোলাডারে আর তুরেও শহরের বড় ডাক্তার দেখামুনে। আমি কালই মাইজ ফকিরের কাছে সোনামিয়ারে লিয়ে যামুনে। ফকিরের বনাজি দাওয়ায় খুবই ওস্তকারি।’’
কথাগুলো বলেই সোলেমান আবার চোখ রাখে খিড়কি পেরিয়ে সাগরের বুকে। সন্ধ্যার এই সময়টা দ্বীপের লোকজনদের কাছে রাতই বলা চলে। বাজারঘাটের জটলা আড্ডা সবই রাত আটটার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। কেবলমাত্র মাছের জো থাকলে তখন মধ্যরাত অবধি গোটা দ্বীপ জেগে থাকে।
সোলেমান মনে মনে হিসেব করে। এবার যদি চার পাঁচখান সোনাচাঁন বাঁইধবার পারে, তাইলে পরে তার বেবাক দায়-দেনা শোধবোধ হয়ে যাবে। শরীফা আর পোলাডার ভালোমতোন চিকিৎসা করাতে পারবে।
সোনাচাঁন!
এই নাম সোলেমানের আদর করে দেয়া নাম। আসলে এই মাছের নাম পোপামাছ। দ্বীপের লোকজন বলে পোঁয়ামাছ। অনেক কিসিমের পোপামাছ ওঠে জালে। ছোট পোপা, মাইঝ্যা পোপা, ফুট পোপা, লাল পোপা, কালো পোপা আরো হরেকরকমের পোপামাছ।
সোলেমানের নজর ওসবে নেই। তার খোঁজ কালো ধাঁচের বড় পোপা। এ জাতের মাছ বড় হলে একেকটি সোয়া মণ ছাড়িয়ে যায়। সোলেমানের জালে সবচে বড় যে পোপাখান বিঁধেছিল সেটার ওজন ছিল একান্ন কেজি।
এই পোপার কদর বেশি। এ মাছের ফুলকা দিয়ে নাকি দামি ঔষধ বানায়। সোলেমান শুনেছে সে কথা। ব্যাপারীরা মাছ কেটে বেচাবিক্রী করে যে টাকা পায় তারচে ঢের বেশি পায় ফুলকা বেচে। ওই ফুলকা বিদেশ চলে যায়।
সোলেমানের অবশ্য অত চিন্তা ভাবনার কাজ নাই। তার একমাত্র চিন্তা হলো আসছে নভেম্বরে ছহিসালামতে বোটখান ভাসাতে পারলে হয়।
উপরওয়ালা তাকে খুব একটা বিমুখ করেনি। নভেম্বরে সোলেমানের জালে সোনাচাঁন বিঁধবে সেটা এতদঅঞ্চলের গা সওয়া।
আরো কিছুদিন পার হয়ে গেল। এরিমধ্যে সোলেমানের ধার-দেনা আরো বাড়লো। ছেলেটার হালহকিকত দিনকে দিন খারাপ হতে লাগলো। ঔষধ পথ্যে কিছুতেই কিছু হলোনা। সোনামিয়ার ছোট শরীরটা দিনকে দিন আরো ছোট হতে থাকলো।
এক ঝড়ের রাতে সোনামিয়ার অব¯হা বেজায় খারাপের দিকে গেল। বমি আর পাতলা পায়খানা কোনোমতেই বন্ধ করা যাচ্ছিলনা।
সোলেমান সোনামিয়ার ছোট্ট দেহখান পাঁজাকোলে দৌড়ে ঘাটের কিনারায় গেল। দমকা হাওয়ার ঝড়ের রাতে কোন নৌকা বোটই ওপাড়ে গেলনা।
যাবার উপায়ও নেই। সাগরে উত্তাল ঢেউ। সেই ঢেউ পাড়ি দেবার সাধ্য তক্তার নৌকার নেই। সোলেমান বুকে পাথর চেপে ঘরে ফিরে আসে।
সোনামিয়া চোখ নিভু নিভু করে অসহায়ভাবে শুয়ে আছে চৌকিতে। শরীফা মুখে আঁচল চেপে পাথর হয়ে বসে আছে। পোলাডার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। আর কটামাত্র দিন। ক’খান সোনাচাঁন। তারপর সোজা চলে যাবে শহরের বড় ক্লিনিক হাসপাতালে।
বাইরে প্রচ- ঝড়। দমকা বাতাসে নারিকেল গাছের আগা এসে বারি খায় আলগাজুতের ঘরের চালে। একেকটা বারি যেন শরীফার কলিজা গুদ্দায় গিয়ে গিয়ে লাগে। ঘরের সোলার বাতির পিনপিনে আলোয় সোনামিয়ার কচি ঠোঁট নড়ে ওঠে,
Ñ “বাজান! আমারে বড় ডাক্তারের কাছে নিবা না..?’’
সোলেমানের বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। ছেলের কপালে আলতো করে হাত রাখে।
Ñ “হ বাজান! নিমুনে। আর ক’খান দিন!’’
অতপর সোলেমানের চোখ সোনামিয়ার কচি মুখ থেকে সরে গিয়ে ঘরের বেড়ায় ঝুলতে থাকা ক্যালেন্ডারের ওপর গিয়ে থামে ।
নভেম্বর আসতে তখনো দিন পনের বাকী..
জয়নুল টিটো, কথাসাহিত্যিক