আনোয়ারুল হক
মুষ্ঠিবদ্ধ রক্তাক্ত বাম হাতটা বুকের কাছে লেপ্টে আছে কিশোরী মেয়েটির। হাঁপরের মতো ওঠানামা করছে বুক, উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটছে মর্জিনা রাতের অন্ধকারে শুধু সামনের দিকে। নিশুতি রাত। গ্রামের মানুষ এত রাতে দিকশূন্য একটি মেয়েকে যদি এই অবস্থায় কেউ দেখতো, তাহলে তাকে ভুতে ধরেছে বলে রটাতে বেশি দেরি করবে না। সারামুখে ও দুই হাতে, পড়নের শাড়িতে ছোপ ছোপ রক্তের গন্ধ তাকে যেন আরও পাগল করে দিয়েছে। গভীর রাতের দুই একটা নেড়ি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে মর্জিনার পিছু নিলেও পাল্লা দিতে না পেরে আধা রাস্তায় থেমে গেছে। সাঁই সাঁই বাতাস কাটছে যুবতীর আঁধার শরীর। তার ডুরে শাড়ির আঁচল ধুলায় লুটায়।
ছুটতে ছুটতে একটুও না থেমে দ্রুত হাতে উপজেলা থানার দরজা ঠেলে মর্জিনা ঘরের ভিতরে ঝড়ের বেগে ঢুকলো । বড় দারোগা বাবুর টেবিলের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ার আগে রাতজাগা, চোখলাল কর্তার টেবিলের ওপর বাম হাতের মুঠো থেকে কর্তিত বস্তুটা ফেললো মর্জিনা। পেট মোটা, থলথলে শরীরের থানার বড় কর্তা চোখের সামনে ভুত দেখার মতো লাফিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আর্তনাদ করে ওঠেন। ওসি সাহেব ডান হাতের তর্জনী দিয়ে নির্দেশ করেলেন টেবিলের ওপর আর তার বাম হাতে নিজের প্যান্টের জিপার খামচে ধরে বললেন,
-এ কি, এ কি, এটা কী ? এটা কী ?
আলুথালু পরিশ্রান্ত, উদভ্রান্ত নারী মর্জিনা জ্ঞান হারিয়ে পাকা মেঝেতে ঢলে পড়ার আগে পারলো,
-চেয়ারম্যানের পোলা মফিজ্যার ঐডা কাইট্টা ফালাইছি স্যার’- বলেই ঠাণ্ডা মাটিতে পড়ে চোখ বুজলো মেয়েটি। ততক্ষণে থানার বড় স্যারের স্তম্ভিত হুংকারে টেবিল ঘিরে মাঝারি, ছোট পুলিশের কর্তা, কাজে-অকাজে থানায় আসা নানা কিসিমের লোক সবাই তার চারপাশে ভিড় করে দেখলো, টেবিলের ওপর লবন দেয়া জোঁকের মতো নেতিয়ে পড়ে আছে ইঞ্চি দুয়েক লম্বা দণ্ডটি। গোড়ার দিকে লাল রক্ত কালচে হয়ে আছে।
দেখে কেন জানি বড় কর্তার মনে হলো, কুকড়ে যাওয়া শিশ্নটি অদ্ভুত বিষণ্ণ চোখে তার দিকে করুণ তাকিয়ে আছে। যার গোড়ার দিকে একদলা নিস্তেজ রক্ত খানিকটা গড়িয়ে থেমে গেছে টেবিলের ওপর, আর কোথা থেকে একটা বড় মাছি এসে ওটার ওপর ভনভন করে ঘুরছে।
দুই.
আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে মর্জিনা এদিক ওদিক তাকায়। এখনো সে গত একমাসের মতোই উদভ্রান্ত, দিশেহারা। কেমন একটা অসহায় ভাব তার চোখেমুখে। সরকারি উকিল তাকে অভয় দিলেও এতে ওর কোন ভাবান্তর হলো না। সে দেখে, কালো কোটপড়া একটা লোক খুবই দরদী স্বরে তাকে দেখিয়ে কাঠগড়ার ডান পাশে লালসালু কাপড় দিয়ে ঘেরা জায়গায় উঁচু একটা চেয়ারে বসা গম্ভীর গোমড়ামুখো মানুষটাকে কী যেন বললো।
তারপরেই মানুষটা হামনদিস্তার মতো একটা হাতুড়ি দিয়ে নিজের টেবিলের ওপর ধাম ধাম পিটুনি দিলো কয়েকবার।
এরপর উকিল মর্জিনার কাছে এসে নরম গলায় জানতে চাইলো,
-বলো মর্জিনা, কেন তুমি এমন কাজ করেছো, বলো, বলো, কেন করেছো ?
প্রশ্ন শুনে বিপর্যস্ত মর্জিনা উকিলের দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে রইলো। কী বলবে সে ?
টেবিলের ওপর হাতুড়ির ঘায়ে তার বুকের ভিতর উথাল পাথাল করে। কানের ভিতর শো শো শব্দ হয়, একটানা।
উকিলের প্রশ্ন কিছুই শুনতে পায় না সে।
তবুও মর্জিনা যেনো কিছু বলতে চায়। পারে না।
দেখে, কাঠগড়া থেকে কয়েক হাত দূরে সামনের দিকে একটা চেয়ারে বসা বৃদ্ধ চেয়ারম্যান কামরুল মিয়া তার দিকে ভীষণ চোখে তাকিয়ে আছে। এই চোখে কোন দয়া মায়া নাই।
বয়সী লাউয়ের ডাঁটার মতো যুবতী মর্জিনাকে উকিল তাড়া দেয়। আদালতের হল ভর্তি মানুষের সামনে মেয়েটির গলা শুকিয়ে কাঠ, সে বিড়বিড় করে কিছু বলে কিন্তু সেই বলা কথা সে নিজেই শুনতে পায় না।
ঘোলা চোখে দেখে সামনে, ঐ তো সেই লোক, যে কিনা গত বারো-তেরো বছর আগে তার নিষ্পাপ শরীরটাকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক রাতে নস্ট করে দেয়। তারপরে তো মর্জিনা ওর লালসার নাগালের মধ্যেই কাটিয়ে দিলো গত এক যুগ। আজ তার ছেলে লায়েক হয়েছে। বাপের মতো পোলারও এতদিন পরে লালসা মিটাতে আবার এই মর্জিনাই যেন ভাতের হাড়ি। খাবলা দিলেই খাওন যায়।
ভাবনার রশিতে টান পড়ে। উকিল আবার তাড়া দেয়, -মুখ খোলো মর্জিনা, কথা বলো।
মর্জিনা হা করে মুখ খুলে বুক ভরে বাতাস নেয়। দেখতে পায়, ধীরে ধীরে তিতাসের ঘোলা জলে একটা ছই তোলা নৌকা তীরের দিকে এগিয়ে আসছে। গা-গঞ্জের হাটে যাওয়া মানুষের ভীড়ে পাটাতনে বসে কৌতুহলি চোখে বারো-তেরো বছরের একটি মেয়ে নদী দেখে, আকাশ দেখে, সাদা উড়ে যাওয়া বক দেখতে দেখতে, ঢউয়ের দোলায় দুলতে দুলতে নবিগঞ্জ উপজেলা সদরের ঘাটে এসে নামে। তারপর ভীরু পায়ে সম্পর্কে খালা হয়, এমন পড়ন্ত বয়সীর হাত ধরে কামরান মিয়ার হেঁসেলে প্রবেশ করে সে।
অশিক্ষিত, গ্রাম্য হতদরিদ্র বটে সে, তারপরেও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে না ভেবে পারে না মেয়েটি, তার কি কোন স্বপ্ন ছিলো ? আবার ভাবে, কি জানি! ক্ষুধায় কাতর প্রতিদিন, অপুষ্টিতে ভোগা, পিলে হওয়া পেট, শীর্ণ চেহারা নিয়ে মর্জিনারা এ দেশে আজও এক মুঠো ভাত পেলে বেঁচে যায়। বানে, খরায় এরাই সবসময় আগে পর্যুদস্ত হয়। তাই বুঝি আর একবার মরে যাওয়ার আগে বেঁচে থাকার আশায় গাঙে ভাসে ওরা, পথের পাথর ভাঙে মর্জিনারা।
সেদিন থেকে খালার সাহায্যে কামরান মিয়ার ঘরে দুইবেলা ভাতের জোগান পেয়ে নির্জলা পুঁইয়ের ডগা জল পেলে যেমন লকলকিয়ে সবুজ হয়, মর্জিনার তাই হলো। গেরস্থালির কাজ সে আগেও জানতো। তার জন্যে ওর সারাদিনের খাটুনিতে কোন কষ্ট হতো না, কেবল রাতে ঘুমানোর সময় ওর মাকে মনে পড়তো। বাপের কথা মর্জিনার মনে নাই। গত বছর ভাঙনের সময় মায়ের ডাইরিয়া হয়। তিনদিনের মাথায় সেই মা ও শেষ। তারপর থেকে তার জীবন আজ এই বাড়ি, তো কাল সেই বাড়ি।
একলা মর্জিনার দিন যায় রাত আসে। কামরান মিয়ার বাড়িতে কামলা দিতে এসে ভাত-কাপড়-ঘুমের জায়গা পেয়ে সে ভাবতে শুরু করে, তার আর কোন কষ্ট নাই।
কিশোরী শরীর টবের যত্ন নেওয়া ফুল গাছের মতো পাতা মেলে। বড় হয়। গায়ে গতরে চোখে পড়ার মতো হয়ে ওঠে।
বাড়ির খাসমহলে তার আদর বাড়ে। আজকাল বড় গিন্নির খেদমতে মর্জিনা ছাড়া আর কোন কাজের মেয়ে মানুষের কদর নাই। এই সময় একবেলা কামরান মিয়ার চোখ পড়ে মর্জিনার ওপর। সে ঠারে ঠারে মেয়েটিকে দেখে। সকালে বিকালে উঠানে চেয়ারে বসে হুঁকা খায়, আকাশ দেখে আর ঘন ঘন মেয়েটিকে এ্টা ওটার ফরমাস করে। মুখের দিকে তাকিয়ে হাসে, মর্জিনা তাতে কিছু মনে করে না। বাপের মতো মানুষটার দয়ার শরীর মনে করে মনে মনে পুলকিত হয়।
মানুষের যায় দিন ভালো যায়। তারপর এক রাতে।
মর্জিনা যে ঘরে শোয় তার পাশের ঘরেই বড় গিন্নি ঘুমায়। তার তো সুখের শরীর। শুইলেই ঘুম, আর কোন হুঁশ থাকে না। আর সেও কাজের চাপে এতো ক্লান্ত থাকে যে, শোয়ার পরপরই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। কিন্তু কোন কোনদিন এপাশ ওপাশ করে, ঘুম আসে না। ঘুমায়, ঘুম ভাঙ্গে। তেমনি একদিন আধা ঘুমের মধ্যে কিছু বুঝে ওঠার আগেই চেয়ারম্যানের লালসার শিকার হয় সে। অসহায় মর্জিনা তখন কাঁদে, কিন্তু তার কান্নার শব্দে কারো ঘুম ভাঙ্গে না। এ যেনো ঘুমের বাড়ি। মরে গেছে সব। বুড়ো তাকে জড়িয়ে ধরে অভয় দেয়,
-কান্দিস্ না। আমি তোরে সব দিমু। তোর কোন ডর নাই। ওমম..
ধর্ষিতা মর্জিনা জলভরা চোখে হাতের তালুতে গালে লেগে থাকা লোকটার লালা মুছে। তারপর ধূর্ত শেয়াল লঘু পায়ে যেমন এসেছিলো তেমনি লঘু পায়ে কাটা দরজা গলে বের হয়ে যায়।
এভাবেই মর্জিনারা কিছু ভেবে ওঠার আগেই একদিন কামুকের ভোগের দখলে চলে যায়। ডুরে শাড়ি পরা এই মেয়েটিরও জীবন সেদিন থেকে রাতারাতি পাল্টে যায়। মাটির ওপরে তার চল ভারি হয়ে আসে। সেই রাতের পর থেকে প্রায় রাতেই লালসার শিকার হতে হতে মেয়েটি কিশোরি থেকে যুবতী হয়। মেয়েমানুষের জীবন, একদিন তার কাছে ডাল-ভাত হয়ে যায়।
তবুও কোন কোন রাতে ও একাকী কাঁদে, আহাজারি করে,
-এমন জীবন ক্যান দিলা মাবুদ ? মরতে চাইলাম, পারলাম না। মরতে ডর লাগে ক্যান ?
মর্জিনা সেদিন মরতে পারলো না বলে তারপর একদিন নতুন উৎপাত নেমে এলো জীবনে।
কামরান মিয়ার বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার লালসায় ভাটা পড়েছে। বড় ছেলে মফিজ এখন বাপের জায়গা নিতে চায়। সে পাত্তা না দিলে বাপের বেটার জেদ বাড়তে থাকে। কিন্তু কতদিন আর আটকে রাখা যায় ? নিজেকে কী করে বাঁচায় সে ?
সেদিন অনেক রাতে, চেয়ারম্যানের সুখের বাড়িতে সবাই তখন ঘুমিয়ে পানি হয়ে গেছে। মর্জিনার ঘরের বেড়া কাটে মফিজ। যুবতী টের পেয়ে মনে মনে তৈরি হয়। অন্ধকারে সরীসৃপ লঘু পায়ে এগিয়ে আসে। মৃদু স্বরে ডাকে,
-মর্জিনা, ডরাইস্ না, আমি মফিজ।
মর্জিনা ডরায় না। শরীরটাকে শক্ত করে বিছানায় উঠে বসে থাকে। চোখ সওয়া অন্ধকার কেটে গেলে মফিজ ওর গায়ে গা লাগিয়ে বসে মসৃণ পিঠে হাত রাখে। কোন বাধা না পেয়ে লালসা শরীর সাহসী হয়ে ওঠে। দ্রুত হাতে এগিয়ে যায় কামুক শেয়াল।
মর্জিনা তখন নিজের জীবনের পরিণতির কথা না ভেবে মফিজকে আরো কাছে টানে। আর তারপরেই কামুকের লালসার পর্দা ছিঁড়ে ওর তীব্র জান্তব চিৎকারে রাতের নিশুতি ভেঙে খান খান্ ।
তিন.
চোখের ওপর দিয়ে মর্জিনার জীবনের আদ্যপান্ত ভেসে যায়, সেইসাথে সেও কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের চোখের জলে ভাসে। সামনে চেয়ারে বসা দাঁড়িয়ে থাকা ঘর ভর্তি কোন মানুষের মুখ সে দেখে না।
উকিলের তাগাদা সত্ত্বেও সে মুখ খোলে না। কেবল মনে হয়, তার, চারপাশের ঐ চোখগুলি কোন মানুষের চোখ না, ঐগুলি লালসার, হায়েনার, ধর্ষকের চোখ। গোলগোল মজায় মজে যাওয়া চোখ।
এইসব দেখতে দেখতে মর্জিনা হাসে। মর্জিনা কাঁদে।
এতে একসময় আদালতের গুমোট বাতাস দোটানায় পড়ে থমকে থাকে।
বিচারকের হাতুড়ি টেবিলের ওপর উঠে আর নামে। তাতে চলমান কামুক সমাজের আদিম অন্ধকার কতদূরে ছিটকে পড়লো তা জানা যায় না। তবে, মর্জিনা ছাড়া যারা সেদিন আদালতে উপস্থিত ছিল তারা জেনেছে, ধর্ষিতার পাঁচ বছরের জেল হয়েছে।
আনোয়ারুল হক, শিক্ষাবিদ ও গল্পকার




