এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৪৫- আজ: রবিবার-২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

এখন সময়:সন্ধ্যা ৬:৪৫- আজ: রবিবার
২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-শীতকাল

অন্তহীন সুড়ঙ্গ

সুজন বড়ুয়া

 

কবর থেকে বেরিয়ে মহিম অশরীরী রূপ নিল। সঙ্গে সঙ্গে গত কয়দিনের সব ঘটনা একে একে মনে পড়ে গেল তার।

ফার্স্ট সেমিস্টারের পর বিশ্ববিদ্যালয়ে আবার ক্লাস শুরু হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ফার্স্ট ইয়ার সেকেণ্ড সেমিস্টারের ছাত্র মহিম। নিয়মিত পুরোদমে ক্লাস চলছিল তাদের। এরই মধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হলো। ছাত্রদের দাবি সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে পূর্ব নির্ধারিত হারে কোটা সংরক্ষণ করা যাবে না। মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী-সহ সব কোটা কমিয়ে আনতে হবে। অবশ্য সরকার ২০১৮ সালে কোটা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল একবার। সেসময় সরকার কোটা বাতিলের নির্বাহী পরিপত্র জারি করে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তানরা হাইকোর্টে রিট করলে সরকারের পরিপত্র নাকচ করে দেয় হাইকোর্ট। এতে আবার পূর্বের কোটা হার বহাল হয়ে যায়। ছাত্রদের প্রবল আপত্তি এখানে। সরকার কোটা সংস্কারের বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে পাঠায়। আপিল বিভাগ শুনানির দিন বার বার পিছাতে থাকে। শেষে এক মাস পর অর্থাৎ আগস্ট মাসের সাত তারিখ আপিল শুনানির দিন ধার্য করে। সেই থেকে সরকার ছাত্রদের বলছে, কোটা সংস্কারের বিষয়টি আদালতেই নিষ্পত্তি হবে। আন্দোলন না করে ধৈর্য ধরো। কিন্তু ছাত্ররা এ বিষয়ে দীর্ঘসূত্রতা মানতে চায় না। তারা অপেক্ষা করতে নারাজ।

ছাত্ররা আন্দোলন জোরদার করতে থাকে। উদ্দেশ্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। কোটা সংস্কারের পক্ষে সভা সমাবেশ মিছিল স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ প্রকম্পিত হলো। ক্রমেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল রাজধানীর সব বিশ্ববিদ্যালয়ে। তারপর দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে। সবাই কোটা সংস্কার চায়।

শান্তিপূর্ণ আন্দোলন প্রথমে ক্লাস বর্জন, তারপর বিক্ষোভ থেকে অবরোধে রূপ নিল। কোটা আন্দোলনের ছাত্রনেতৃবৃন্দ দাবি পূরণের জন্য চার দিনের সময়সীমা বেঁধে দিল। প্রধানমন্ত্রী ছাত্রদের আশ্বাস দিয়ে বললেন, ধৈর্য ধরো, আদালতের রায়ে তোমাদের প্রত্যাশা পূরণ হবে, তোমরা ক্লাসে ফিরে যাও। কিন্তু ছাত্ররা বাংলা ব্লকেড—সড়ক অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচি দিল। প্রথমে ঢাকায়, তারপর সারাদেশে। রেলপথ অবরোধ করল, সর্বাত্মক অবরোধ শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্র নামধারী বহিরাগত লোকজনের আনাগোনা বেড়ে গেল। সব সময় লোকে গিজগিজ। গভীর রাত পর্যন্ত মিছিলে-স্লোগানে বিশ্ববিদ্যালয় তোলপাড়। পরিস্থিতি সংঘাতময় হয়ে উঠল। কর্তৃপক্ষ সন্ধ্যায় ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রাবাস ত্যাগের নির্দেশ দিল। পরদিন দুপুর বারোটার মধ্যে হল ত্যাগ করতে হবে।

মহিম জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র। কর্তৃপক্ষের হল ত্যাগের নির্দেশ শুনে রাতেই ব্যাগ-পত্র গুছিয়ে নিল সে। সকালেই রওনা হবে গ্রামের বাড়িতে। তার মতো অনেক ছাত্রই হল ছাড়ার জন্য তৈরি। কিন্তু সকালে দেখা গেল যারা হল ছেড়ে চলে যেতে চায় একদল লোক তাদের বাধা দিচ্ছে এবং হলে থেকে যাওয়ার জন্য বেশ জোর খাটাচ্ছে। তাদের ভাব-ভঙ্গি রীতিমতো মারমুখী। ছাত্রদের তারা কিছুতেই যেতে দেবে না। এমন বাধার মুখে অনেকের মতো মহিমও আটকে থাকল হলে। সময় গড়িয়ে গেল।

তখন সকাল এগারোটা। ছাত্রদের বিক্ষোভ সমাবেশ মিছিলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ বিস্ফোরণোন্মুখ। শুধু ছাত্র নয়, সমাবেশে মধ্য বয়সি শ্রোতা-দর্শকও ছড়িয়ে ছিঁটিয়ে আছে অগণন। মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছে কোটাবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারী ছাত্রনেতারা। উত্তপ্ত প্রাঙ্গণ স্লোগানে মুখর। ‘কোটা হার মানি না, মানব না।’

বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে টহলরত সশস্ত্র আইন শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী। হঠাৎ কী হলো, সভামঞ্চের পাশেই লেগে গেল হুড়োহুড়ি। রব উঠল ধর ধর, মার মার। সবাই অস্থির হয়ে উঠল কেমন। কেউ কেউ ছুটে গেল হুড়োহুড়ির উৎসমুখে। দিগি¦ক জ্ঞান হারিয়ে এলোমেলো ছুটল কেউ কেউ। সঙ্গে সঙ্গে শোনা গেল গুলির শব্দ। ঠা ঠা ট্রা ট্রা ঠুস ঠুস…। এলোপাথাড়ি গুলির শব্দে কেঁপে উঠল চারপাশ।

মিনিট পাঁচেক চলল এমন গোলাগুলি। সমাবেশ পণ্ড। ছাত্র-জনতা ছত্রভঙ্গ। সন্ত্রস্ত পায়ে কেউ কেউ দৌড়ে চলে যাচ্ছে দূরে। এরই মধ্যে দেখা গেল অপরাজেয় বাংলা ভাস্কর্যের সামনের রাস্তায় তাল হারিয়ে পড়ে যাচ্ছে একটি তরুণ ছেলে। তার বুক থেকে ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছে তাজা রক্ত। তার হাতে ধরা একটি মাঝারি মাপের ব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে কয়েকটি বই আর জামা-কাপড় ভরা। বোঝাই যায়— হল ছেড়ে বাড়ি যেতে চেয়েছিল সে, কিন্তু পারেনি। ছেলেটি আর কেউ নয়, তার নাম মহিম।

এর পরের কথা কিছুই জানে না মহিম। রাস্তায় পড়ে যাওয়ার পর তার নিথর দেহটিকে আগলে ধরে ছাত্ররা। নেতারা তৎপর হয় তার প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য। রিকশা ডেকে তাকে নিয়ে যেতে চায় ঢাকা মেডিক্যালে। কিন্তু বয়স্ক দু’একজন লোক বাদ সাধে, লাভ নেই, ছেলেটা মরে গেছে। এখন মেডিক্যালে নিলে ঝামেলা হবে। আইনের মারপ্যাঁচে পড়তে হবে। ময়নাতদন্ত, ডেথ সার্টিফিকেট, থানা-পুলিশ ইত্যাদি। তার চেয়ে বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতায় থাকুক, আমাদের কাজে লাগবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে মহিমের মৃতদেহটিকে তুলে আনা হলো সভামঞ্চে। মঞ্চ আবার ভরে উঠেছে। সভা-প্রাঙ্গণ আবার সরগরম। সবার মধ্যে উত্তেজনা চরমে। নেতারা মঞ্চ কাঁপিয়ে তুলেছে। একেক জনের ভাষণে বাচনে আগুন ঝরছে, … সরকারের অনমনীয়তার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ত ঝরল, তরুণ তাজা প্রাণ ঝরে গেল। এর দায় সরকারকেই নিতে হবে।…

মহিম কোটা সংস্কার আন্দোলনের শহিদ। মহিমের দু’একজন শোকার্ত সহপাঠী ঘুরঘুর করছে আশেপাশে। কেউ কেউ ফুল দিচ্ছে মহিমের লাশের ওপর। মিডিয়ার লোকজন হুমড়ি খেয়ে পড়েছে মঞ্চে। থেকে থেকে ক্লিক ক্লিক করে উঠছে সাংবাদিকদের ক্যামেরা। সরাসরি সম্প্রচারে ব্যস্ত টিভি রিপোর্টাররা। ছাত্র সমাজ শোকাচ্ছন্ন, কিন্তু প্রতিবাদে সোচ্চার। ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই, বিচার চাই।’ চলছে মিছিল স্লোগান সমাবেশ।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল নাগাদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সক্রিয় হলো। নিহত ছাত্র মহিমকে শনাক্ত করে কর্তৃপক্ষ। তার পুরো নাম— মহিম মঈন। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষের দি¦তীয় সেমিস্টারের ছাত্র। তার বাড়ি ব্রাহ্মবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার রতনপুর ইউনিয়নের ভিটিবিশাড়া গ্রামে। সে জহুরুল হক হলের আবাসিক ছাত্র। কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব দ্রুত মৃতদেহ সৎকার করা। সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদেই তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন মাঝারি ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী জানাজায় যোগ দিলেন। জানাজা শেষে অ্যাম্বুলেন্সে করে মহিমের মৃতদেহ তার গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো অবিলম্বে।

মহিমের মৃতদেহ যখন গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায় তখন রাত আটটা। বাড়িতে মা ছাড়া মহিমের আর কেউ ছিল না। বাবা আগেই মারা গেছেন। মহিমের বড় এক বোন। তার বিয়ে হয়েছে পাশের গ্রামে। মহিমদের খুব দরিদ্র পরিবার। কিন্তু মহিম ভালো ছাত্র ছিল। তাই স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের সাহায্য পেয়েছে সব সময়। টিউশনি করে সে পড়াশোনা চালিয়ে নিয়েছে নিয়মিত। ঢাকা শহরে গিয়েও সে টিউশনি করত। প্রতি মাসে মার জন্য কিছু কিছু টাকাও পাঠাত। আগে এর ওর বাড়িতে ছোটখাটো ফাইফরমাস খাটতেন মা। এখন অভাবে, বয়সের ভারে আর অসুস্থতায় শরীর অচল। ছেলের পাঠানো টাকাতেই মা কোনোমতে একা দিন কাটান গ্রামে।

মা মহিমের মৃত্যুর খবর জানতেন না। অ্যাম্বুলেন্স থেকে উঠানে মাহিমের লাশ নামানোর পর মা মূর্ছা গেলেন। তার জ্ঞান ফেরে অনেক রাতে। এরই মধ্যে পাশের গ্রাম থেকে বোন এসে আছড়ে পড়েছে ভাইয়ের মৃতদেহের ওপর। মা-মেয়ের আহাজারি-বিলাপে যেন ভারী হয়ে উঠল আকাশ। কে সান্ত্বনা দেবে কাকে! এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। তবু নিয়তির খেলায় বুকে পাষাণ বাঁধতে হয়। সুতরাং গভীর রাতে গ্রাম-সমাজের লোকেরা মহিমের লাশ কবরে নামায়, দাফন সম্পন্ন করে।

অশরীরী রূপ নেওয়ার পর প্রথমেই মাকে একবার দেখতে খুব ইচ্ছে হলো মহিমের। মহিম মুহূর্তে এসে দাঁড়ায় তাদের ঘরের সামনে। কারো পক্ষে তাকে দেখতে পাওয়ার সুযোগ নেই আর। সে পষ্ট দেখতে পাচ্ছে সবই। তাদের দোচালা কুঁড়েঘরটা দাঁড়িয়ে আছে নিষ্প্রাণ। ঘরের কোণের ঝাঁকড়া নারকেল গাছটা নিথর, যেন নড়াচড়া ভুলে গেছে আজ। খোলা বারান্দার একটি খুঁটিতে হেলান দিয়ে এলো চুলে নির্বাক বসে আছেন মা। মাকে ঘিরে আছেন বাড়ির চাচি-খালারা। তারা কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে। পাশে বিলাপ করে মাথা কুটছে  বড়ো বোন মর্জিনা, আমাদের এই সর্বনাশ কী করে হলো রে!…

মায়ের নির্বাক মূর্তি দেখে হঠাৎ কেঁপে ওঠে মহিম। মাকে এমন রূপে দেখতে হবে কোনোদিন ভাবেনি। মহিমের মনে পড়ে, ঢাকায় পাঠানোর সময় মা বলেছিলেন, ‘মন দিয়ে লেখাপড়া করিস বাবা, কোনো খারাপ কাজে যাবি না, গণ্ডগোলের ধারে কাছে থাকিস না।’ মহিম মনে মনে বলে, মা, আমি তোমার কথা মেনে চলেছি সব সময়, আমি কোনো খারাপ কাজে যাইনি, কারো সাথে ঝগড়া করিনি, কোনো বিবাদে জড়ায়নি। তবু এমন হলো কেন মা? আমার জন্য আজ তোমার এই মরমর দশা। আমি তো তোমাকে সুখী করার জন্য, হাসিখুশি দেখার জন্য ঢাকা গিয়েছিলাম। কিন্তু কেন মরতে হলো আমাকে? কেন? আমাকে তা জানতে হবে মা। আমি যাচ্ছি। তোমার এই অধম সন্তানকে ক্ষমা করে দিও।

কথা শেষ করতে করতে মহিমের মনে ভেসে ওঠে কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কারী ছাত্রনেতাদের ছবি। তারাই বলতে পারবে, আমার কেন এমন মৃত্যু হলো। —ভাবতে ভাবতে এবার ঢাকার দিকে রওনা হলো মহিম।

মহিম সমন্বয়কারী ছাত্রনেতাদের পেয়ে গেল ঠিক ঠিক। তারা পাঁচ জন গোল টেবিল বৈঠকে বসেছে। গভীর আলাপে মগ্ন। আগামী দিনের আন্দোলনের পরিকল্পনা-কৌশল নিয়ে কথা বলছে তারা। ঘরে একটি টিউব লাইট জ্বলছে, অনুজ্জ্বল আলো। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। জানালার একটি কপাট খানিকটা খোলা। সেই ফাঁক দিয়ে উঁকি দিল মহিম। অল্পক্ষণ পর লম্বা করে গলা খাঁকারি দিল একটি।

ওতেই কাজ হলো। ছাত্রনেতা গফুর গাউস নড়েচড়ে বসে এদিক ওদিক তাকায় একবার, কিরে, কার যেন গলা খাঁকারি শুনতে পেলাম! জানালার বাইরে কেউ এলো নাকি? দেখ তো, দেখ তো।

অন্যদেরও হকচকানো অবস্থা। নূরুল বিল্লাহ বলে ওঠে, আরে, আমারও তো তেমন মনে হলো। দেখি তো, বাইরে কেউ আছে নাকি?

— দেখে লাভ নেই,— এবার নিজেই কথা বলা শুরু করে মহিম, তোমরা ঠিকই শুনেছ, আমি এসেছি। কিন্তু আমাকে দেখতে পাবে না তোমরা।

এটুকু বলতেই ঘরের ভেতর হুড়োহুড়ি লেগে গেল হঠাৎ, উরে বাপরে, ভূত ভূত …।—বলেই একজন গড়িয়ে পড়ে আরেক জনের গায়ে। যেন পালাবারও পথ খুঁজে পাচ্ছে না সহসা।

তাদের অবস্থা দেখে মহিম ঝটপট বলে, আরে তোমরা ভয় পেয়ো না, ভয় পেয়ো না। আমি আমার পরিচয় দিচ্ছি। আমি মহিম মঈন। গতকাল সকাল সোয়া এগারোটার সময় আমি তোমাদের আন্দোলনে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছি। তোমরা আমাকে মনে করতে পারছ না?

এবার নাহিন আলম প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, এ যে দেখি জ্যান্ত ভূত। একদিন না যেতেই আস্ত ভূত হয়ে ফিরে এসেছে। পালাও পালাও।

— পালিও না, পালিয়ে তোমরা বাঁচবে না। আমার কথার জবাব তোমাদের দিতেই হবে।

ছাত্রনেতারা একটু যেন স্থির হলো এবার। সিদ্দিক জাফর সাহস নিয়ে জানালার দিকে তাকায়, কী জানতে চাও তুমি, বলো দেখি।

— তোমাদের আন্দোলনের জন্য আমাকে কেন মরতে হলো? তোমরা আমাকে কেন মারলে?

গফুর গাউস ঘুরে দাঁড়িয়ে বলে, শোনো, এ আন্দোলন শুধু আমাদের নয়, তোমারও আন্দোলন ছিল। কোটা সংস্কারের সুফল তুমিও পেতে।

— কোটায় আমার লাভ-ক্ষতি কিছুই ছিল না। আমি একজন সাধারণ ছাত্র, আমার কাজ লেখাপড়া করা, আমি মেধায় বিশ্বাসী। তবু আমি তোমাদের আন্দোলনের বিরোধিতা করিনি। কেন তোমরা আমাকে মারলে?

নূরুল বিল্লাহ বলে, বার বার তুমি আমাদের দোষ দিচ্ছ কেন, আমরা তোমাকে মারিনি। আমরা আন্দোলনের ডাক দিয়েছি। মারামারি আমাদের কাজ নয়।

— তা হলে কারা আমাকে মারল?

এবার নাহিন আলম একটু বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করে, ভাই, খামোখা তুমি আমাদের ওপর চটে আছো। আমরা মারামারি করি না। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দাবি আদায় করি। আমরা বক্তৃতা-স্লোগান স্মারকলিপি দিই— এই পর্যন্ত। মারামারি গোলাগুলি অস্ত্রবাজি এসব কারা করে আমরা জানি না, চিনি না। তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক নেই। তবে এমন দল নিশ্চয় আছে, তা না হলে কে তোমাকে মারল! তুমি তাদের খোঁজ করো ভাই। পেয়ে যাবে।

মহিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে মনে মনে ভাবে, এরা তো আমার মতোই ছাত্র, এরা কেন আমাকে মারতে যাবে! নিশ্চয় অন্যরা মেরেছে। ভাবতে ভাবতে মহিম সরে এলো সেখান থেকে, আচ্ছা, তবে যাই। হত্যাকারীকে আমার খুঁজে বের করতেই হবে।

মহিম ঘুরতে ঘুরতে এবার পেয়ে গেল ষণ্ডামার্কা তরুণ সেই দলকে, যারা হল ত্যাগ করতে চাইলে মহিমকে বাধা দিয়েছিল, ভয় দেখিয়েছিল। নীলক্ষেত বাবুপুরার দিকে একটি অন্ধকার ঘরে তারা ফূর্তিতে মেতে আছে। তাদের সামনে বাংলা মদের বোতল, ঝাল কিমা-চানাচুর, কারো হাতে পানাহারের গ্লাস, কারো হাতে গাঁজার চুরুট, কেউ গাঁজা পাকাচ্ছে। নেশায় চুর হয়ে আছে কেউ কেউ।

তাদের ঘরের দরজা খোলাই ছিল। দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দরজার কপাটে তিনটি টোকা দিল মহিম। তরুণদের সর্দার চুল্লুর নেশাটা গাঢ় হয়ে উঠেছিল। তবু ঢুলুঢুল ভঙ্গিতে চুল্লু বলে, কে রে, এত রাতে কে এলো আবার। কাউকে তো দেখা যায় না। চোখে তো সব ঝাপসা দেখি। এই, তোরা দেখিস নাকি কাউকে?

মহিম নিজেই কথা বলে ওঠে এবার, তোমরা আমাকে দেখতে পাবে না, আমি তোমাদের দেখছি।

সাচ্চু নেশার ঘোরে রাগ ঝাড়ে, এত রাতে ইয়ার্কি মারে কে? ভুঁড়ি একেবারে গালাইয়ে দিমু।

— তা আর পারবে না তোমরা। একজনকে কয়বার মারবে? গতকালই তো বেলা সোয়া এগারোটায় বিশ্ববিদ্যালয়ে  আমাকে একবার মেরেছ তোমরা। আমি সেই মহিম মঈন।

লাট্টু জড়ানো গলায় বলে, ওস্তাদ, এ তো দেখি ভূতের আসর। এবার আমাগো বাঁচাইব কে?

—আরে, থাম থাম, তোরা ভয় পাসনে।—চল্লু সবাইকে অভয় দিয়ে বলে, আমি দেখছি। এই ভূতের পো, কী চাও তুমি, বলো তো?

মহিম বলে, আমি জানতে চাই, আমাকে তোমরা কেন মারলে? আমার কী অপরাধ ছিল?

— না, তোমার কোনো অপরাধ ছিল না। কিন্তু নেতার সঙ্গে আমাদের কন্ট্রাক্ট ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড়ের মধ্য থেকে একজন ছাত্র মারব। দুর্ভাগ্যক্রমে তুমিই তার শিকার হলে। হয়তো আমাদের গুলিতে তোমার প্রাণ গেছে, তবু সেজন্য আমাদের তুমি দোষ দিতে পারো না। কারণ আমরা হত্যা করেছি অন্যের নির্দেশে। হত্যাকাণ্ড ঘটানো আমাদের পেশা। টাকার জন্য আমরা এই কাজ করি। সুতরাং তোমার আসল হত্যাকারী আমরা নই। তাই কেন তোমাকে হত্যা করা হয়েছে, যদি জানতে চাও, তার সঠিক জবাব আমাদের জানা নেই। নেতা তার জবাব দিতে পারেন।

— নেতা? কে তোমাদের নেতা?

— আমাদের নেতা জামীর চৌধুরী। গুলশানে থাকেন। গুলশান দুই নম্বর রোডের ৫১৫ নম্বর বাড়িটা তার। তুমি তার কাছে যেতে পারো।

মহিম আর কোনো কথা না বলে বেরিয়ে এলো তরুণদের আস্তানা থেকে।

নেতা জামীর চৌধুরীর বয়স মধ্য পঞ্চাশের কোঠায়। গুলশান দুই নম্বর রোডে সাত কাঠা জমির ওপর তার আলিসান আট তলা বাড়ি। এক সময় মনের মতো করে বানিয়ে ছিলেন বাড়িটা। তিন তলার দুটি ইউনিট মিলিয়ে থাকেন তিনি।

নেতার দল এখন ক্ষমতায় নেই। তাই সবদিকে একটু রাশ টেনে রয়েসয়ে পা ফেলেন। তবে চোখেমুখে স্বপ্ন অচিরেই ক্ষমতায় আসবে দল। দলের জন্য রাতদিন কাজ করেন নিরলস। ক্ষমতায় থাকার সময় কত আয়-উপার্জনের সুবিধা পেয়েছেন— তা তিনি এক মুহূর্তের জন্যও ভোলেন না। দলের কাজে যখন তখন খরচ করেন দুহাতে। যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের ফল দলের পক্ষে আনার জন্য তার একটি বড় ভূমিকা থাকেই। কোটা আন্দোলনেও তিনি তৎপর। আজও আন্দোলনের সার্বিক খোঁজ-খবর নিয়ে ঘুমাতে গেছেন অনেক রাতে।

নেতার বহুমূত্র রোগটা বেড়েছে ইদানীং। এ কারণে রাতে স্ত্রী তার সঙ্গে ঘুমাতে চায় না এখন। পাশের ঘরে ঘুমায়। কিন্তু তার কিশোর বয়সের ছেলেটা তাকে ছাড়া ঘুমায় না। ছেলেটার এক অভ্যাস রাতে বাপের গলা জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে। আজও ঘুমিয়েছে। গলার ওপর থেকে ছেলেটার হাত সরিয়ে ঘরের বাতি জ্বালান নেতা। তার ওয়াশরুমে যেতে হবে।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এক গ্লাস পানি খেলেন নেতা। হঠাৎ জানালার পর্দা দুলে উঠতে উঠতে ঘরের ভেতর একটি ছায়া যেন কেঁপে উঠল, আস্সালামু আলাইকুম।

আচমকা ঘরের মধ্যে একটি ছায়ামূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হলো নেতার। সেই সঙ্গে সালাম দেওয়ার শব্দ। দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে না তো? নেতা চোখ রগড়ে তাকাতে তাকাতে বলেন, কে?

— আমাকে চিনবেন? আমি মহিম মঈন।

— মহিম মঈন, মহিম মঈন, চেনা চেনা লাগছে তো।

— হ্যাঁ, নামটা টেলিভিশনে শুনে থাকতে পারেন। আমি গতকাল বেলা সোয়া এগারোটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা আন্দোলনের সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছি।

— মারা গিয়েছ, কিন্তু আবার কথা বলছ, এ কেমন ব্যাপার!— নেতা যেন মনে মনে প্রমাদ গোনেন। তবে শক্ত হয়ে দাঁড়ান তিনি। আমতা আমতা করে বলেন, তা, আমার কাছে কী চাও তুমি?

— আপনার কাছে জানতে এসেছি, আমি কেন এভাবে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলাম। আমি শুনেছি এ বিষয়ে আপনার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না।

—তুমি কেন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলে, আমার চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না—নেতা আপন মনে বিড় বিড় করেন খানিক। তারপর একটু চুপ থেকে বলেন, শোনো, এ সবকিছুর পেছনে রাজনীতি। তুমি মারা গেছ সেটা যেমন রাজনীতি, আমি বেঁচে আছি সেটাও রাজনীতি। দলের ওপর থেকে আমাকে বলা হয়েছিল, কালকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা লাশ চাই, লাশ ফেলতে হবে। লাশ না ফেললে আন্দোলন জমে না, রাজনীতি জমে ওঠে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লাশ ফেলতে পারলে সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার প্রভাব পড়বে, দেশ কেঁপে উঠবে। খোকা, আমি দুঃখিত, তুমি সেই লাশ হয়েছ, গুলিটা তোমার বুকে লেগেছে।

মহিমের গলা এবার ঈষৎ উত্তপ্ত, দলের ওপর থেকে মানে, কে বলেছে আপনাকে লাশ ফেলতে, আমাকে তার নাম বলুন। আমি তার কাছে যাব। গতকাল আমি না হয়ে আরেকজন লাশ হতে পারত। এভাবে দেশের শিক্ষাঙ্গনে কত ছাত্র লাশ হয়ে যাচ্ছে। এই লাশের রাজনীতি আর চলতে পারে না। এসব নোংরা খেলা বন্ধ করতে হবে। আপনি আমাকে বলুন, দলের ওপরের ব্যক্তিটি কে? আমি তার কাছে যাব।

— তা যে আমি বলতে পারব না খোকা। আমি যদি আজ তোমাকে তার নাম বলি, তা হলে কালকেই আমি নিজে লাশ হয়ে যাব, তোমার মতো চলতি পথে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাব। তবু আমার ওপরের ব্যক্তির নাম বলে আমি না হয় মারাই গেলাম। কিন্তু তার ওপরেও তো আরেকজন আছে, তার ওপরেও আরেকজন, তার ওপরেও…। এ বড় বিচিত্র গোলকধাঁধা খোকা। তুমি কয়জনের কাছে যাবে? তোমার মৃত্যুর জন্য তুমি মিছেমিছি আমাকে দায়ী করছ। তোমার হত্যাকাণ্ডের জন্য যদি আমিই শুধু দায়ী, তবে এত এত হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী কে বা কারা? এ সবই কি বিচ্ছিন্ন ঘটনা?

নেতার কথা শুনতে শুনতে মাথা ঝিমঝিম করে ওঠে মহিমের। মনে হচ্ছে তার সামনে এক অন্তহীন সুড়ঙ্গ। এই সুড়ঙ্গের শেষ কোথায় কে বলবে? ভাবতে ভাবতে মহিম বলে, ধ্যাৎ, এই দেশের রাজনীতির নিকুচি করি। এ যে রাজনীতির নামে ধ্বংসের সওদাগরি! এই ধ্বংসযজ্ঞ রোধ করে সাধ্য কার!—আপন মনে গজগজ করতে করতে নিজেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল মহিম।

ঘর থেকে ছায়ামূর্তি সরে যাওয়ার পর বিছানায় ফিরে এলেন নেতা। তার ঘুমন্ত ছেলেটার কপালের ওপর আলতো করে চুমো খেলেন একটা। মনে মনে বলেন, তোকে আমি এই দেশের কোনো কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াব না বাপ। বিদেশে পাঠিয়ে দেব।

 

সুজন বড়ুয়া, গল্পকার

আন্দরকিল্লা প্রকাশনার ২৮ বছর আগামীর পথ ধরে অনাদিকাল

রূপক বরন বড়ুয়া আমি মাসিক ‘আন্দরকিল্লা’ কাগজের নিয়মিত পাঠক। প্রতিবারের মতো হাতে নিলাম এবারের দৃষ্টিনন্দন প্রচ্ছদে ঢাকা জুলাই ২০২৫ সংখ্যা, হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখতেই

জলে জঙ্গলে (পর্ব-২)

মাসুদ আনোয়ার   ৬ ডিসেম্বর রাজশাহী বোর্ডের রেজাল্ট আউট হলো। আমি কুমিল্লা বোর্ডের পরীক্ষার্থী। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠলাম। যে কোনোদিন কুমিল্লা বোর্ডও ফল প্রকাশ

স্বপ্নে গড়া অবয়ব

সৈয়দ মনজুর কবির   মনটা যখনই কেমন অজনা বিষণ্নতায় ছেয়ে যায় তখনই কেয়া জানালার ধারে এই চেয়ারটাতে এসে বসে। আজ অবশ্য অন্য একটা কারণ আছে

অন্তহীন সুড়ঙ্গ

সুজন বড়ুয়া   কবর থেকে বেরিয়ে মহিম অশরীরী রূপ নিল। সঙ্গে সঙ্গে গত কয়দিনের সব ঘটনা একে একে মনে পড়ে গেল তার। ফার্স্ট সেমিস্টারের পর

রাত যখন খান খান হয়ে যায়…

মনি হায়দার   চোখ মেলে তাকায় সোাহেল হাসান। প্রথম দৃষ্টিতে সবকিছু অচেনা লাগে। কোথায় এলাম আমি? উঠে বসতেই মনে পড়ে গতরাতে অনেক ঝক্কি আর ঝামেলার