বাবুল সিদ্দিক
ফুলুকে বলা হয় বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানী। ব্রিটিশ গোয়েন্দারা বলত, ফুলু নাকি বিজ্ঞানী সদ্মবেশে বিপ্লবী। ফুলু নাকি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বিপ্লবীদের অস্ত্র কেনার টাকা দিতেন। ফুলুর দেশপ্রেম এতটাই প্রবল ছিল যে, ঢাকার একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, “স্যার পি,সি, রায়ের মত লোক যদি আধডজন থাকতেন, এতদিনে দেশ স্বাধীন হয়ে যেত।” ১৯১৯ ফুলুকে ব্রিটিশরা দিয়েছিলেন ‘ঈড়সঢ়ধহরড়হ ড়ভ ঃযব ওহফরধহ ঊসঢ়রৎব (ঈ.ও.ঊ) উপাধি। সেই বছরই কলকাতার টাউন হলে ‘রাইটার বিলের ‘বিরোধিতা করে গরজে উঠেছিলেন ফুলু, বলেছিলেন, “দেশের জন্য প্রয়োজন হলেন বিজ্ঞানীদের টেস্ট টিউব ছেড়ে গবেষণাগারের বাইরে আসতে হবে। বিজ্ঞানের গবেষণা অপেক্ষা করতে পারে, কিন্তু স্বরাজের জন্য সংগ্রাম অপেক্ষা করতে পারে না।”
প্রেসিডেন্টসি কলেজে ২৭ বৎসর পড়িয়েছেন স্যার প্রফুল্লচন্দ্র রায়। তিনি পড়াতেন বাংলা ভাষায়। নিচের দিকের ক্লাস নিতে ভালবাসতে ফুলু। বলতেন, “কুমোর যেমন কাদার ডেলাকে তার পছন্দ মতো আঁকার দিতে পারে, হাইস্কুল থেকে সদ্য কলেজে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের তেমনি সুন্দর ভাবে গড়ে তোলা যায়।”
তিনি সবসময় চাইতেন তার ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে ছাপিয়ে যাক।
বাংলা ভাষা তার অস্তিত্বের সাথে মিশে ছিল। তার বাচনভঙ্গি ছিল অসাধারণ যার দ্বারা তিনি ছাত্রদের মন জয় করে নিতেন সহজেই। তিনি সকল ক্ষেত্রেই ছিলেন উদারপন্থী।
আচার্য প্রফুল্ল রায় ছিলেন একজন প্রখ্যাত বাঙালি রসায়নবিদ, শিক্ষক, দার্শনিক ও কবি। তিনি ‘বেঙ্গল কেমিক্যালসের প্রতিষ্ঠাতা এবং মার্কারি নাইট্রেটের আবিষ্কারক। তিনি ভারতবর্ষে প্রথম শিল্প প্রতিষ্ঠানের স্হাপতি। ১৯০১ সালে তিনি ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল’ প্রতিষ্ঠা করেন।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন : প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তৎকালীন যশোর জেলার (পরবর্তীকালে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলা) রাডুলি-কটিপাড়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন, যা তখন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির( বর্তমান বাংলাদেশ) পূর্ব অংশের অন্তর্গত ছিল। তিনি ছিলেন হরিশ্চচন্দ্র রায় ও ভুবনমোহিনী দেবীর পুত্র। হরিশ্চন্দ্র ছিলেন স্থানীয় জমিদার। বনেদি পরিবারের সন্তান প্রফুল্লচন্দ্র ছেলেবেলা থেকেই সর্ববিষয়ে অত্যন্ত তুখোড় এবং প্রতুৎপন্নমতি ছিলেন।
তার লেখাপড়া শুরু হয় বাবার প্রতিষ্ঠিত এম. ই. স্কুলে। ১৮৭২ সালে তিনি কলকাতা বেতার স্কুলে ভর্তি হন। কিন্তু রক্ত-আমাশয় রোগের কারণে তার লেখাপড়ায় ব্যপক বিঘ্নের সৃষ্টি হয়। বাধ্য হয়ে তিনি নিজ গ্রামে ফিরে যান। গ্রামে থাকা এই সময়টায় তার জীবনে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তনে সাহায্য করেছিল। বাবার গ্রন্থাগারে প্রচুর বই পান তিনি এবং এ সকল বই পাঠে তার জ্ঞানমানসের বিকাশ সাধনে প্রভূত সাহায্য করে।
শিক্ষা জীবন : ১৮৭৪ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় কলকাতায় পুনরায় ফিরে অ্যালবারট স্কুলে ভর্তি হন। এই স্কুল থেকেই ১৮৭৮ সালে প্রবেশিকা প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটান কলেজ (বর্তমানে বিদ্যাসাগর কলেজ) ভর্তি হন। ১৮৮১ সালে সেখান থেকে কলেজ ফাইনাল তথা এফ, এ পরীক্ষায় (ইন্টারমেডিয়েট বা এইচ, এস, সি) দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে বি,এ, ক্লাসে ভর্তি হন। প্রেসিডেন্সি থেকে ‘গিলক্রিস্ট বৃত্তি নিয়ে তিনি স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করতে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বি, এস, সি পাশ করেন। পরবর্তীকালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়েই ডি, এস, সি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তার সেই গবেষণার বিষয় ছিল, ঈড়হলঁমধঃবফ ঝঁষঢ়যধঃবং ড়ভ ঈড়ঢ়ঢ়বৎ গধমহবংরঁস এৎড়ঁঢ় : অ ঝঃঁফু ড়ভ ওংড়সড়ৎঢ়যড়ঁং গরীঃঁৎবং ্ গড়ষবপঁষধৎ ঈড়সনরহধঃরড়হ. দুই বছরের কঠোর সাধনার পর তিনি এই গবেষণা সমাপ্ত করেন এবং পি. এইচ. ডি ও ডি. এস. সি ডিগ্রী লাভ করেন। এমন কি তার এই গবেষণা পত্রটি শ্রেষ্ঠ মনোনীত হওয়ায় তাকে ‘দহোপ’ প্রাইজে ভূষিত করা হয়। এডেনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন কালেই ১৮৮৫ সালে ‘সিপাহী বিদ্রোহের আগে ও পরে ভারত ‘(ওহফরধহ ইবভড়ৎব ধহফ অভঃবৎ ঝবঢ়ড়ু গঁঃরহু) এবং ভারত বিষয়ক বিভিন্ন নিবন্ধ লিখে ভারতবর্ষ, ইংল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রে ছেড়ে দেন।
কর্মজীবন :
ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঘুরে ১৮৮৮ সালে প্রফুল্লচন্দ্র রায় স্বদেশে প্রত্যাবতন করেন। দেশে ফিরে তিনি প্রেসিডেন্সী কলেজের সহকারী অধ্যাপক হিসাবে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় ২৮ বছর তিনি এই কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন।
পরবর্তীকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয় হতে মাসিক ৪০ টাকা নিতেন। ১৯২৬ সাল থেকে ১৯৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি নিজেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা দান করেন। অধ্যাপনায় তিনি একমাত্র বাংলা ব্যবহার করতেন।
অধ্যাপনাকালে তার প্রিয় বিষয় ছিল নিত্য নতুন গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। বাংগালিদের ব্যবসার প্রতি অনাগ্রহ পর্যবেক্ষণ করে ১৮৯২ সালে ৭০০ টাকা বিনিয়োগে ও নিজ উদ্যোগে, নিজের গবেষণাগারেই বেঙ্গল ক্যামিকাল কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। এবং পরবর্তীকালে ১৯০১ সালে তা কোলকাতার মানিকতলায় ৪৫ একর জমিতে স্থানান্তর করেন। তখন এর নাম নতুন নাম রাখা হয় ‘বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিকাল ওয়ারকস্ লিমিটেড’। খুলনা টেক্সটাইল মিলও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
গবেষণা ও অবদান : নিজের বাসভবনে দেশীয় ভেষজ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে তিনি তার গবেষণা কর্ম আরম্ভ করেন। তার এই গবেষণা স্থান থেকেই বেঙ্গল কেমিক্যাল কারখানার সৃষ্টি হয় যা ভারতবর্ষের শিল্পায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ার দিকে ভারতীয় উপমহাদেশের শিল্পায়নে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য।
১৮৯৫ সালে তিনি মার্কারি নাইট্রেট (মারকিউরাস নাইট্রাইড) আবিস্কার করেন যা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করে। এটি তার অন্যতম প্রধান আবিস্কার। তিনি তার সমগ্র জীবনে ১২টি যৌগিক লবণ এবং ৫টি থায়োএস্টার আবিষ্কার করেন।
সমবায়ের পুরোধা স্যার পি, সি , রায় নিজ জন্মভূমিতে একটি কো-অপরেটিভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৩ সালে তিনি তার পিতার নামে আর, কে, বি, কে হরিশ্চন্দ্র স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।
বাগেরহাট জেলায় ১৯১৮ সালে তিনি পি, সি, কলেজ নাম একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। যা বর্তমানে বাংলাদেশের শিক্ষা বিস্তারে বিশাল ভূমিকা রাখছে।
সন্মাননা :
শিক্ষাকতার জন্য তিনি সাধারণ্যে ‘আচার্য’ হিসারে আখ্যায়িত।
১৯১১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সদস্য হিসাবে তৃতীয়বারের মত ইংল্যান্ড যান এবং সেখান থেকেই সি, আই, ই – লাভ করেন।
১৯১১ সালে ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রী দেয়া হয়।
১৯৩৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে মহিশুর ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯১৯ সালে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘ নাইট ‘ উপাধি লাভ করেন।
বাবুল সিদ্দিক, প্রাবন্ধিক




