এখন সময়:সকাল ৮:০৬- আজ: বৃহস্পতিবার-৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:সকাল ৮:০৬- আজ: বৃহস্পতিবার
৬ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-২১শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

আমার বন্ধু পলাশ

রোকন রেজা

পলাশ আমার ছেলেবেলার বন্ধু। একই গ্রামে, একই পাড়ায়, একই নদীর কোলের মধ্যে আমাদের বেড়ে ওঠা। আমাদের শৈশব-কৈশোর।

পলাশ পড়াশুনায় মোটেই ভাল ছিল না। ঠিকমতো স্কুলেই আসত না ও। কিন্তু তা সত্ত্বেও ওর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। কেন ওর সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার সঠিক কারণ আমি বলতে পারি না। হয়তো ওর দুরন্ত সাহসের কারণেই আমি ওকে মনে মনে পছন্দ করতাম।

পলাশ আমার নতুন কেনা সাইকেল নিয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়াত। রতনের সাদা-কালো ‘ডিয়ার’ ফুটবল নিয়ে সারাবিকেল খেলা করে বেড়াত। পলাশকে আমি এতটাই পছন্দ করতাম যে পরীক্ষার সময় ও আমার পাশে বসে আমার খাতা দেখে দেখে লিখত। তাতে আমার কখনই হিংসা বা রাগ হতো না। পলাশের মধ্যে হয়তো কিছু ঐশ্বরিক গুণ ছিল।

 

 

 

 

আমি বরাবরই পরীক্ষায় ভাল করতাম। ক্লাসে আমার রোল নম্বর সবসময়ই এক অথবা দুই হতো। আমার স্কুল শিক্ষক বাবা আমাকে বলতেন, দেখো-আমাদের সহায়-সম্পত্তি বলতে তেমন কিছুই নেই। লেখাপড়াই আমাদের সম্পদ। তাই ঐটেই ভাল করে করো। নইলে কিন্তু ভবিষ্যৎ অন্ধকার।

আমি অতসব বুঝতাম না। কিন্তু পড়াশুনাটা ঠিকমতোই করতাম। আর পলাশের তো স্কুল ভালোই লাগত না। ও স্কুল ফাঁকি দিয়ে সারাদিন মাঠে মাঠে গুটি খেলে বেড়াত। পাখি মেরে বেড়াত। মানুষের বাগানের কাঁচা আম, কাঁচা লিচু পেড়ে পেড়ে খেত। আর কোনো কোনোদিন সারা দুপুর ‘মাথাভাঙা’ নদীর কুলকুল পানিতে সাঁতার কেটে বেড়াত। ওকে শাসন করার মতো কেউ ছিল না। ওকে দেখার কেউ ছিল না।

পলাশের জন্মের দু’বছরের মাথায় ওর মা মারা যায়। পলাশ বড় হয় সৎ মা’য়ের কাছে। অনাদরে, অবহেলায় পলাশ আস্তে আস্তে হয়ে ওঠে উচ্ছৃঙ্খল, বেপরোয়া। সেইসময়ই পলাশ একদিন বাজারের এক দোকানের জানালা ভেঙে ৩০ হাজার টাকা চুরি করে কোথায় যেন উধাও হয়ে যায়। ওর বাপ ছিল ট্রাকের ড্রাইভার। ঠিকমতো বাড়ি আসত না সে। পলাশ স্কুল জীবনেই সিগারেট ধরেছিল।

ক্লাস নাইনে ওঠার পর আমি বিজ্ঞান বিভাগে চলে গেলাম। আমার পড়ার চাপ বেড়ে গেল অনেক। পলাশের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে লাগল  আমার। আমি এস এস সি’তে ভাল রেজাল্ট করে পাস করে গেলাম। পলাশের আর পরীক্ষা দেয়া হলো না। চুরির দায়ে সে তখন লাপাত্তা।

আমি শহরে এসে কলেজে ভর্তি হলাম। পলাশ কোথায় হারিয়ে গেল। বছরখানেক পরে শুনলাম পলাশ বিয়ে করেছে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী লুৎফর মিয়ার ছোট মেয়ে সম্পাকে। সম্পাকে জোর করে তুলে নিয়ে কোথায় আটকে রেখেছিল সে। অবশেষে বিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন লুৎফর মিয়া। তারপর লুৎফর মিয়ার জামাই পলাশ দোকান চুরির ৩০ হাজার টাকার ঝামেলা কিভাবে কিভাবে যেন মিটিয়ে ফেলেছিল।

আমি ইন্টার পাস করে ঢাকায় চলে এলাম। যখন গ্রামে যেতাম শুনতাম পলাশ নাকি এখন রাজনীতি করে। স্থানীয় নেতাদের সে এখন ডানহাত। পলাশের সাহসকে হয়তো রাজনীতিবিদরা কাজে লাগাচ্ছে। পলাশের সঙ্গে দেখা করার কিংবা কথা বলার কোনো ইচ্ছা আমার আর হতো না। নিজেকে ভাবতাম একটু উঁচুদরের কেউ। যতই হোক তখন আমি স্বনামধন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র।

গ্রামের মানুষেরা নানা রকমের সমস্যা নিয়ে পলাশের কাছে আসত। কারো বিধবাভাতা, কারো বয়স্কভাতা, কারো ভিজিএফ এর চাল কিংবা প্রতিবন্ধীভাতা। পলাশ স্থানীয় নেতাদের ম্যানেজ করে যথাসাধ্য সাহায্য করার চেষ্টা করত। পলাশ আস্তে আস্তে একজন জনপ্রিয় মানুষ হয়ে উঠেছিল। তারপর একদিন শুনলাম পলাশ জেলে। মার্ডার কেসের ১নং আসামি সে।

আমি তখন ঢাকার জীবনে ব্যস্ত। মাস্টার্স পাস করে টিউশনি করি আর চাকরি খুঁজে বেড়ায়। দুটো কোম্পানীতে খন্ডকালীন চাকরি করলাম কিছুদিন। তারপর কলেজের ‘প্রভাষক’ পদে নিবন্ধন পরীক্ষা দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

বছরখানিক পর যোগদানপত্র পেলাম শহরের পাশে মফস্বলের এক ডিগ্রী কলেজে। কলেজে যোগদান করতে গিয়ে শুনলাম কলেজের সভাপতি পলাশ চেয়ারম্যান। কথাটা শোনার পর আমার আনন্দ হওয়ার পরিবর্তে কেন জানি আমি ভেতরে ভেতরে কষ্ট পেতে লাগলাম। পলাশ আমার বাল্যবন্ধু। ওর সাফল্যে আমার তো আনন্দিত হবার কথা, গর্বিত হবার কথা! কিন্তু কোথায় যেন একটু বাধছিল আমার।

একদিন দেখা হলো পলাশের সাথে। অনেক বদলে গেছে পলাশ। ওর সাথে এখন সবসময় দু’চারজন অল্পবয়স্ক ছেলে থাকে। বডিগার্ড। এখন ওর অনেক ক্ষমতা! বলা যায় ওর কথাতেই উপজেলা চলে। ওর কথায় ওসি সাহেব আসামি ধরে আনেন। আবার ওর কথাতেই ওসি সাহেব আসামি ছেড়ে দেন।

রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবার সময় মানুষ যখন পলাশকে সালাম দেয়, পলাশের জন্য মানুষ যখন রাস্তা ছেড়ে দেয় তখন আমার মনে হয় পলাশ তার জীবনে ক্ষমতায় কিংবা টাকা-পয়সায় সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে গেছে। তখন আমার চিন্তা থমকে দাাঁড়ায়।  আমি তখন একধরনের গোঁলক ধাঁধা’য় পড়ে যায়।

পলাশ কলেজে ঢুকলে শিক্ষকরা উঠে দাঁড়ান। প্রিন্সিপাল স্যার চেয়ার ছেড়ে দেন। আমিও ওদের সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়। পলাশের সিগনেচারে শিক্ষকদের বেতন হয়। এতগুলো মানুষের সংসার চলে।

পলাশ আমার দিকে তাকিয়ে একটুখানি হাসে। তারপর ওর সেই হাসি আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে সমস্ত মুখে। পলাশ বলে, তোর সব খবরই আমি রাখি ফারুক। কিন্তু তুই-ই আমার কোনো খবর রাখিসনি।

সবার সামনে পলাশ আমাদের বন্ধুত্বকে স্বীকার করে নেয়। এতগুলো মানুষের সামনে আমাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করে। গর্বে আমার বুকটা ভরে যেতে থাকে। কিন্তু ও আর কথা বাড়ায় না। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি।

পলাশের কথা শুনে আমি লজ্জিত হই। তাইতো! ওর কোনো খবর তেমন করে তো আমি সত্যিই রাখিনি। ভাবতাম বাউন্ডেলে, বখাটে পলাশ।  দূরে দূরে রাখতাম নিজেকে। মনে মনে একধরনের ঘৃণা জন্মেছিল ওর প্রতি।

এখন বুঝি লেখাপড়া না শিখলেও কারো জীবন বরবাদ হয়ে যায় না। এত লেখাপড়া শিখে আমিই বা কী এমন করলাম! আমি এখন ছাপোষা এক মাস্টার। একঘেঁয়ে নিরানন্দ জীবন আমার। সমাজে আমার কী-ই বা মূল্য। আমার কথা কজনাই বা শোনে! অথচ লেখাপড়া না শিখেও পলাশের কত ক্ষমতা, কত প্রতিপত্তি। পলাশ চলে সিংহের মতো। আমরা চলি বেড়ালের মতো। পলাশের জন্য মানুষ চেয়ার ছেড়ে দেয়। পলাশ থাকে মঞ্চে, আমরা থাকি নিচে। পলাশের বক্তৃতা আমরা এখন শুনি।  একটি

 

রোকন রেজা, গল্পকার, পাবনা

আহমদ রফিক: ভাষাসৈনিক থেকে সাহিত্য-গবেষণার আলোকবর্তিকা

শাহেদ কায়েস   আহমদ রফিক (জন্ম: ১২ সেপ্টেম্বর ১৯২৯-মৃত্যু: ২ অক্টোবর ২০২৫) বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের ভুবনে আহমদ রফিক একটি উজ্জ্বল নাম। তিনি একাধারে

অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

আন্দরকিল্লা ডেক্স \ চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পাহাড়তলী, চট্টগ্রাম এর ম্যানেজিং ট্রাস্টি অধ্যাপক ডা. রবিউল হোসেনের আত্মজীবনী ‘প্লেজার অ্যান্ড পেইন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসব

ফেরা

সৈয়দা মাসুদা বনি   নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের কথা শোনা থাকলেও আদতেই সেটা কেমন জানা ছিল না রিশানের। এটাই তাহলে মৃত্যুর পরের জগৎ, সে ভাবে। সে ভাবতে

ফিরে যাওয়া

বিচিত্রা সেন   রুবা.. রুবা খবরদার, না খেয়ে এক পাও বাইরে দিবি না। মুশকিল হয়ে যাবে কিন্তু! মায়ের হুমকিতে অগত্যা রুবাকে দাঁড়াতেই হয়। মা যে

চিরহরিৎ বৃক্ষের গল্প

সুজন বড়ুয়া   ছাদে উঠে দেখি শানবাঁধানো উঁচু আসনে একা বসে আছেন হরিৎবরণ ঘোষাল। একটু অবাক হলাম। এ সময় তার ছাদে বসে থাকার কথা নয়।