মঈন চৌধুরী
মূলত ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন আর পর্তুগালের উপনিবেশ ছিল বিভিন্ন তৃতীয় বিশ্বের দেশ। উপনিবেশ থাকাকালে এই দেশগুলোর সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, মূল্যবোধ ইত্যাদি প্রচণ্ডভাবে বিনির্মিত/নবনির্মিত হয়। যা উত্তর-উপনিবেশবাদের আলোচ্য বিষয়। ব্রিটেনের উপনিবেশ থাকাকালে ইংরেজ সমাজ ও ইংরেজি ভাষা, সাহিত্য ইত্যাদি বাংলাদেশের বাঙ্গালদের মধ্যে কী কী পরিবর্তন এনেছে, তা আলোচনা করা যেতে পারে উত্তর-উপনিবেশবাদ বোঝার জন্য।
বাংলাদেশের বঙ্গাল সমাজ প্রথমত উত্তর-ভারত থেকে আগত আর্য ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে জাত-পাত-কেন্দ্রিক বিভাজনে বিভক্ত হয়ে অবস্থান করত। পরবর্তীকালে মুসলমান পাঠান ও মোগলদের উপনিবেশ হয়ে পড়ে বাংলাদেশ। এ সময় বাংলা ভাষায় ফারসি, আরবি ভাষা-শব্দের সংযোজন ভাষাকে গতিময় করে তোলে, যদিও তখন পর্যন্ত বাংলা ভাষায় সংস্কৃতের প্রভাবই ছিল বেশি। মুসলমান শাসন আমলে বাংলা সাহিত্য সৃষ্টির মতো সুযোগ বেশি এসেছিল, এ সত্যও আমরা উদ্ধার করতে পারি, কিন্তু সামাজিক চরিত্রের পতনও হয়েছিল এ সময়েই উল্লেখযোগ্যভাবে। সমাজ বিভক্ত হয়েছে জাত-পাত আর ধর্মকে কেন্দ্র করে, সমাজে অবস্থান করছিল শ্রেণী হিন্দু/অন্ত্যজ হিন্দু, হিন্দু/যবন, হিন্দু/ ম্লেচ্ছ, হিন্দু/নেড়ে, মুসলমান/মালাউন/ মুসলমান/নাছারা, মুসলমান/কাফের ইত্যাদির মতো যুগ্ম- বৈপরীত্য। একটি সমাজ যেহেতু জাত-পাত ও ধর্মকে কেন্দ্র করে বিভক্ত ছিল, সেহেতু স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের চিন্তা বঙ্গালদের মাঝে কখনো আসেনি, তারা সবসময় পরাধীন থেকে জাত-পাত নিয়েই ব্যস্ত থাকত বেশি। ইংরেজরা এসে বঙ্গাল হিন্দু-মুসলমানদের এই সংঘাতকে কাজে লাগল, উবারফব ধহফ ৎঁষব-নীতি প্রয়োগ করে তারা শাসন করল বাংলাদেশকে প্রায় ২০০ বছর।
আমাদের দেশের লোকজন সবসময় ‘সাদা চামড়ার’ ভক্ত। আর্য ফর্সা ব্রাহ্মণদের বঙ্গালরা শোষণ করার অধিকার প্রায় বিনা বাধাতেই দিয়েছিল। ‘ফর্সা’ সাহেবেরাও অনেক সময় দেবতার মতোই ছিল বঙ্গালদের তৎকালীন চেতনাকাঠামোতে। ফর্সা ‘সাহেব’দের মতো ধনী, বড়ো চাকরিজীবী বঙ্গালরাও ‘সাহেব’ হতে চাইল; চক্রবর্তী বাবু, মুখুজ্জ্যে বাবু, বাঁড়ুজ্যে বাবু, গোস্বামী বাবু, মিত্র বাবু, ইসলাম বাবু, সবাই ‘বাবু’, বাদ দিয়ে হয়ে গেলেন ‘সাহেব’। অফিসের কেরানী বাবুই রয়ে গেল। তখনকার বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, মিত্র, গোস্বামী ঠাকুর, চক্রবর্তী সাহেবরা, সাহেব হতে চাইলেও ইংরেজদের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে পারলেন না। বিলেতি মদ্যপান আর বাঈজি নাচিয়ে তাই তারা সৃষ্টি করলেন ‘বাবু সংস্কৃতি’র। সমাজে পরিবর্তন আসল অনেক, আদি বঙ্গাল সংস্কৃতি থেকে ক্রমাগতভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে ‘বাবু সংস্কৃতি’র ছায়াতে তৈরি হতে থাকল এক ধরনের সংস্কৃতি। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পণ্ডিতবৃন্দ ইংরেজ পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়ে কিছু বাংলা পুস্তক রচনা করলেন, যা আসলে ছিল দেব-ভাষা সংস্কৃতের কাছাকাছি। সংস্কৃত আর ইংরেজি ব্যাকরণ মিশিয়ে তৈরি হলো বাংলা ব্যাকরণ, যা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি বাংলা-ব্যাকরণ হিসেবে বিবেচ্য নয়।
ইংরেজি ভাষার প্রতিও সাধারণ মানুষ ও পণ্ডিতদের দুর্বলতা বাড়তে লাগল, তারা শিখতে চাইলেন ভাষাটি (অবশ্য মোল্লাদের কথায়/ফতোয়ায় মুসলমানরা নাসারাদের ভাষা শিখতে রাজি ছিলেন না)। প্রথমদিকে ‘গরু মানে পড়ি আর ষাঁড় মানে যঁংনধহফ ড়ভ পড়-িজাতীয় ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে বঙ্গালরাও এগুতে থাকলেও, পরবর্তীকালে ইংরেজি সাহিত্য আর দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হলেন আমাদের সাহিত্যিক/দার্শনিকবৃন্দ। আমাদের দর্শন থেকে হারিয়ে গেলেন পাণিনি, পতঞ্জলি, বদরায়ন, নাগেশ ভট্ট প্রমুখ, আমরা ভুলে গেলাম আউল-বাউল-সহজিয়া মতবাদ, আর আমাদের চিন্তা-চেতনায় বাসা বাঁধল দেকার্ত, শপেনহাওয়ার, হেগেল, মার্কস, রাসেল প্রমুখ। বাংলা সাহিত্যেও প্রভাব ফেলল পশ্চিমের কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও দার্শনিকবৃন্দ। আমরা যদি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস বিশ্লেষণ করি, তবে আমাদের কবিতা, উপন্যাস আর নাটকে পশ্চিমের স্বাক্ষর আবিষ্কার করতে পারব। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, আমরা যদি ইংরেজদের উপনিবেশ না হতাম, তাহলে আমাদের দর্শন ও সাহিত্য কেমন হতো? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে যদি আমরা আমাদের সাহিত্য, সমাজ ও দর্শনকে বিশ্লেষণ করি, তবে উপনিবেশবাদ নিয়ে আমাদের কিছু চিন্তাভাবনা করতে হবে।
মঈন চৌধুরী, শিল্পী, গবেষক ও প্রাবন্ধিক




