নিখিল রঞ্জন দাশ
“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি”—
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল একটি ফুটবল দল “স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল” হিসেবে যেটা পরিচিতি পেয়েছিল। এই দলটি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্নস্থানে প্রদর্শনী ফুটবল খেলায় অংশগ্রহণ করে। এটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধকালীন প্রথম ফুটবল দল।
ক্যালেন্ডারের পাতা ওল্টাতে চলে গেছে ৪৫টি বছর। ৫৬ বর্গমাইলের এই ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য যখন সব জনপদ রক্তাক্ত, বাংলাদেশের দামাল ছেলেদের একটি দল ফুটবলকে হাতিয়ার করে নেমে পড়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে। তবে তাদের যুদ্ধটা ছিল একটু ভিন্ন— অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতের বিভিন্ন শহরে ১৩টি প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছে। যা থেকে কয়েক লক্ষ টাকা অনুদান দেওয়া হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তহবিলে।
১৯৭১ সালের ২৫শে জুলাই দেশের ক্রীড়া জগতের ইতিহাস নিয়েছিল আশ্চর্য এক মোড়।
পশ্চিম বঙ্গের নদীয়া জেলার কৃষ্ণপুর, স্টেডিয়াম সাক্ষী হলো অনন্য এক ইতিহাসের- ভারতের মাটিতে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল প্রথম ম্যাচটি খেলে সেদিন, প্রতিপক্ষ নদীয়া জেলা ক্রীড়া সমিতি দল। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় ম্যাচের সংখ্যা কোথাও ১৩টি আবার কোথাও ১৬টি। সংখ্যাতত্ত্বের এই বিভ্রান্তির বাইরে বাংলাদেশ দলের জার্সিতে সেদিন প্রথম ম্যাচের ফুটবল দূতরা কে কে ছিলেন ছিলেন আমরা একটু জেনে নিই। প্রথম ম্যাচে ৪-২-৪ ছকে সাজানো হয়েছিল দলটি। গোলপোস্টে নূরন্নবী, রাইট ব্যাক বিমল কর, অধিনায়ক জাকারিয়া পিন্টু ও আইনুল হক, লেফ্ট ব্যাক আবদুল হাকিম, মাঝমাট কায়কোবাদ ও খোকন, রাইট উইং নওশোরুজ্জামান, দুই স্ট্রাইকার কাজী সালাউদ্দীন ও এনায়েতুর রহমান, লেফট উইংয়ে সহ-অধিনায়ক প্রতাপ শংকর হাজরা। সেদিন বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের জন্য নদীয়াবাসী শুভেচ্ছার লালকার্পেট বিছিয়ে দিয়েছিলেন ম্যাচের আগে। সিক্ত করলেন ভালোবাসায়। যদিও ব্যাপ্তিতে এটি নিছকই একটি ফুটবল ম্যাচ, যার চূড়ান্ত স্কোরলাইন ২-২ কিন্তু এর ঐতিহাসিক আবেদন বিশাল। কৃষ্ণনগর স্টেডিয়াম সেই ইতিহাসের স্বাক্ষী- যেখানে সোনার হরফে লেখা হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে ব্যাতিক্রমী এক ফুটবল দলের যাত্রা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের অন্দরে ওই দিনটি তৈরী করেছিল দেশের প্রতি খেলোয়াড়দের ভালোবাসার এক অবিশ্বাস্য মোহনা।
যদিও সরকারি প্রজ্ঞাপনে দলের খেলোয়াড় সংখ্যা ৩১ বলা হয়েছে তবে বিভিন্ন তথ্য থেকে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের খেলোয়াড় সংখ্যা ৩৫। সংগঠক ২৩জন, কোচ ও ম্যানেজার একজন করে। তবে খেলোয়াড়দের ১৮ জনই আজ স্মৃতির পাতায় ঠাঁই করে নিয়েছেন। বাকি ১৭ জন দেশে-বিদেশে নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। যদিও ১৩ জন সংগঠকের কেউ নেই। কোচ ননী বসাকও চলে গেছেন সেই কবে। তবে সংগঠকদের মধ্যে এখনো আছেন দলটির গর্বিত ম্যানেজার তানভীর মাযহার তান্না। ৫৪ বছরে কত কিছু বদলেছে— বদলায়নি শুধু তাদের বিজয়ের আনন্দ। সেই আনন্দের অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আজও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন-প্রতাপ শঙ্কর হাজরা, কাজী সালাউদ্দীন, এনায়েতুর রহমান খান, মোহাম্মদ কায়কোবাদ, শেখ আশরাফ আলীর মত বাকী সবাই। যদিও জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে তবুও সেদিনেই সেই অনুভূতি প্রকাশ করতে গিয়ে আত্মহারা হয়ে পড়েন বীর মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াবিদরা। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের এই কীর্তি তৈরী করেছেন দেশের প্রতি ভালোবাসার এক অবিশ্বাস্য দৃষ্টান্ত। তবে দুঃখের বিষয় হলো বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের দিনটি আজও উপেক্ষিত দিনটি নীরবে আসে নীরবে চলে যায়।
নিখিল রঞ্জন দাশ, ক্রীড়া সংগঠক ও ধারাভাষ্যকার




