এখন সময়:সকাল ১১:০৫- আজ: শনিবার-২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

এখন সময়:সকাল ১১:০৫- আজ: শনিবার
২২শে নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ-৭ই অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ-হেমন্তকাল

ওকাকুরা, নিহোন বিজুৎসুইন এবং জাপান-বাংলা সম্পর্ক

প্রবীর বিকাশ সরকার

সূচনা: জাপানের গ্রাম্য এদো যুগের (১৬০৩-১৮৬৮) অবসান এবং আধুনিক মেইজি যুগের (১৮৬৮-১৯১২)সূচনা এই যুগসন্ধিক্ষণে এমন একজন মানুষের জন্ম হয় যাঁর চিন্তা, চেতনা, স্বপ্ন ও কর্মকাণ্ড তাঁর জীবিতকালেই কিংবদন্তির চরিত্র ধারণ করেছিল। তিনি সামুরাই বংশধর পরবর্তীকালে বণিকপুত্র জাপানের সর্বকালের প্রাতঃস্মরণীয় নমস্য মনীষী, শিল্পকলা আন্দোলনের পথিকৃৎ শিল্পাচার্য ওকাকুরা (কাকুজোও) তেনশিন (১৮৬৩-১৯১৩)। কৈশোরেই জন্মস্থান য়োকোহামা বন্দরনগরীর সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন প্রাচ্য পেরিয়ে প্রতীচ্য তথা আমেরিকা ও য়োরোপে যাবেন। তাঁর সেই স্বপ্ন সফল হয়েছিল।

ওকাকুরার অভিযাত্রা: শৈশবেই ওকাকুরার মেধার স্ফূরণ ঘটেছিল। য়োকোহামার এক মার্কিন নাগরিক জন বেলাগের (১৮৪২-১৯২০) ইংরেজি বিদ্যালয়ে শৈশবে এমনভাবে ইংরেজি ভাষা আয়ত্ব করেছিলেন যে মাতৃভাষাই ভুলে গিয়েছিলেন! একই সঙ্গে পারিবারিক বৌদ্ধমন্দিরে শিখেছিলেন চীনা ভাষা। ১৮৮০ সালে টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রবেশ করেন। সেখানে তিনি সঙ্গীত বিভাগের পরিচালক নিযুক্ত হন। ১৮৮৩ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রধান অভিজাত ব্যক্তিত্ব রাজনীতিবিদ ব্যারন কুকি রিউইচির (১৮৫২-১৯৩১) পরিকল্পনা অনুযায়ী জাপানের প্রাচীন, বিলীয়মান শিল্পকলা এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দির-স্থাপত্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও জরিপে অংশগ্রহণ করেন। এই কাজে নেমে তিনি অনুধাবন করেন এগুলো জাতির মহামূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ ও ঐতিহ্য, এগুলোকে সংরক্ষণ করা জরুরি। ক্রমশ দেশীয় শিল্পকলার প্রতি তাঁর গভীর আগ্রহ জন্মায়।

১৮৮৫ সালে নজরে পড়েন টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির অধ্যাপক আমেরিকার নাগরিক আর্নেস্ট ফেনোলসার (১৮৫৩-১৯০৮)। ফেনোলসা ছিলেন প্রাচ্য শিল্পকলার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ একজন অগ্রসর মানুষ, শিল্পকলার সমালোচক ও চিত্রশিল্পী। তিনি জাপানের বিলীয়মান শিল্পকলার ইতিহাস ও প্রত্নশিল্পকে পুনরুদ্ধারকল্পে আত্মনিয়োগ করেন। ওকাকুরা হন তাঁর সুযোগ্য সহযোগী। তাঁরা দুজনে মিলে “চিত্রকলা সংরক্ষণ সমিতি” প্রতিষ্ঠা করেন। ফলে জাপানে শিল্পকলার নবজাগরণ তথা রেনেসাঁ আন্দোলনের জন্ম হয়। বহু ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিলীয়মান চিত্রকলা, ভাস্কর্য, মন্দির-স্থাপত্য পুননির্মাণ এবং পুনরুদ্ধার করেন তাঁরা। তেনশিন অধ্যাপক ফেনোলসার সঙ্গে আমেরিকাসহ ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, স্পেন পরিভ্রমণ এবং সেসব দেশের শিল্পকলার জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এই ভ্রমণে তাঁর দিব্যদৃষ্টি খুলে যায়। পাশ্চাত্য শ্বেতাঙ্গ সভ্যতা ও দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তাঁর বিস্তর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়। ফিরে আসার পর ১৮৮৭ সালে জাপানের প্রথম চারুকলাবিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান “টোকিও বিজুৎসু গাক্কোও” বা “টোকিও ফাইন আর্ট স্কুল” (বর্তমানে টোকিও গেইজুৎসু দাইগাকু বা টোকিও চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখেন। পরের বছর ১৮৮৮ সালে “টোকিও ইম্পেরিয়াল জাদুঘর” বর্তমানে “টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়ামে”র শিল্পকলা বিভাগের প্রধান নিযুক্ত হন, ব্যারন কুকি রিউইচি যার কিউরেটর। ১৮৮৯ সালে তিনি তাঁর প্রধান পৃষ্ঠপোষক কুকি রিউইচি এবং প্রভাবশালী দৈনিক আসাহিশিম্বুন পত্রিকার সম্পাদকীয় কলাম লেখক কেনজোও তাকাহাশির (১৮৫৫-১৮৯৮) সঙ্গে জাপানের প্রথম শিল্পকলাবিষয়ক সাময়িকী “কোক্কা” বা “দেশীয় সৌরভ” প্রকাশ করেন। এই সাময়িকী

 

পরবর্তীকালে জাপানি এবং কলকাতাকেন্দ্রিক “ইয়ংবেঙ্গল” চিত্রশিল্পীদের আন্দোলন, চিন্তাবিনিময়কে বিশেষভাবে উৎসাহিত করে। তাতে প্রকাশিত হয় জাপানি তরুণ চিত্রশিল্পীদের পাশাপাশি শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭১-১৯৫১), সুরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (১৮৮৫-১৯০৯), নন্দলাল বসু (১৮৮২-১৯৬৬) প্রমুখের চিত্রকর্ম।

 

১৮৯০ সালে মাত্র ২৭ বছর বয়সে রাজকীয় শিল্পকলা একাডেমির বিচারক এবং “টোকিও বিজুৎসু গাক্কোও”র দ্বিতীয় অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন সরকার কর্তৃক। ১৮৯১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন “জাপান তরুণ চিত্রশিল্পী সংঘ”। ১৮৯৬ সালে “জাপান চিত্রকলা সমিতি”র সহযোগী পরিচালক নিযুক্ত হন। পাশাপাশি প্রাচীন শিন্তোও এবং বৌদ্ধমন্দির সংরক্ষণ কমিশনের সদস্য হওয়ার সুযোগও লাভ করেন। ১৮৯৮ সালে “ইম্পেরিয়াল জাদুঘরের ট্রাস্টি” সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৮৯-১৮৯৩ পর্যন্ত প্যারিস ও আমেরিকার শিকাগো আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে জাপানের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলাসামগ্রী তৈরিতে সহযোগিতা করেন। উল্লেখ্য যে, এইসব প্রদর্শনীতে তখন জাপানি ঐতিহ্যগত শিল্পকলার জনপ্রিয়তা ছিল ক্রমবর্ধমান। এই ঘটনাও ওকাকুরাকে শিল্পকলা গবেষণায় আগ্রহী করে তোলে। ধর্মীয় ইতিহাস পাঠের মধ্য দিয়ে তিনি জাপানের প্রতিমাবিদ্যা ও সংস্কৃতির উৎস “ভারতবর্ষ” বলে অনুভব করতে থাকেন। ক্রমশ আগ্রহী হয়ে ওঠেন ভারত ভ্রমণেও কিন্তু সেই সুযোগের জন্য তাঁকে দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতে হয়। তাঁর সবচে বড় অবদান একটি আধুনিক জাতির জন্য যথার্থ নতুন শিল্পকলার বিপ্লব ঘটানোর লক্ষ্যে “নিহোনগা” বা “ঐতিহ্যবাহী জাপানি চিত্রকলা”র বিকাশে তিনি য়োকোয়ামা তাইকান (১৮৬৮-১৯৫৮), হিশিদা শুনসোও (১৮৭৪-১৯১১), শিমোমুরা কানজান (১৮৭৩-১৯৩০), কিমুরা বুজান (১৮৭৬-১৯৪২), হাশিমোতো গাহোও (১৮৩৫-১৯০৮) প্রমুখ মেধাবী চিত্রশিল্পী তথা শিষ্যদেরকে গড়ে তুলেছিলেন, যাঁরা পরবর্তীকালে জাপানের প্রতিনিধিত্বশীল চিত্রশিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সুনাম অর্জন করেছিলেন। আজও জাপানি ঐতিহ্যবাহী চিত্রকলার জয়জয়কার সর্বত্র। জাপানি এই চিত্রকলার ধারায় ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে ওকাকুরার জীবিতকালেই ভারতীয় ধর্মীয় জীবনযাত্রা। যা এক অনন্যসাধারণ কর্মযজ্ঞ ও সমৃদ্ধ শিল্পকলার ইতিহাস। ওকাকুরা-শিষ্য য়োকোয়ামা তাইকান, হিশিদা শুনসোও, শিমোমুরা কানজান, কাৎসুতা শোওকিন (১৮৭৯-১৯৬৩), কাম্পো আরাই (১৮৭৮-১৯৪৫), ইমামুরা শিকোওসহ (১৮৮০-১৯১৬)  অনেক চিত্রশিল্পী ভারতীয় ধর্ম ও জনজীবনসংস্কৃতির চিত্র এঁকেছেন দারুণ নিপুণতার সঙ্গে। তাঁদের চিত্রকর্মে যেখানে দুদেশের রংরূপ আঙ্গিকের অভূতপূর্ব এক সংমিশ্রণও ঘটেছে যা বৃহত্তর বাঙালি বা ভারতীয়রা জানে না বললেই চলে। ওকাকুরা তেনশিনের কল্যাণেই “নিহোন বিজুৎসুইন” তথা “জাপান আর্ট ইনস্টিটিউটে”র ছাত্ররা যে রীতির সূচনা করে গেছেন তার পথ ধরে পরবর্তীকালে অনেক জাপানি চিত্রশিল্পী ভারতে ছুটে গেছেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রায় প্রভাবিত হয়েছেন।

রবীন্দ্র-ওকাকুরা সম্পর্ক: এহেন ওকাকুরা তেনশিনের সঙ্গে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৬৩-১৯৪১) গভীর সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ১৯০২ সালে ব্রিটিশ-ভারতের রাজধানী কলিকাতায়। তাঁরা এশিয়া তথা প্রাচ্যের আদর্শকে সমুন্নত রাখার জন্য যৌথভাবে চিন্তা করেছিলেন। “প্যান-এশিয়ানিজম” তথা “প্রাচ্যভ্রাতৃবাদে”র জনকই বলা যায় ওকাকুরা তেনশিনকে। প্রাচ্য তথা এশিয়া মহাদেশের দুই মহান সভ্যতা ভারত এবং চিনকে নিয়ে ওকাকুরা প্রাচ্যঐক্যের স্বপ্ন দেখেছিলেন, বলেছিলেন, “এশিয়া ইজ ওয়ান” রবীন্দ্রনাথ তাতে সমর্থন দিয়েছিলেন। চিনের সঙ্গে, জাপানের সঙ্গে গভীর ভাববিনিময় বন্ধনে আবদ্ধ হতে চেয়েছিলেন। বিশেষ করে, জাপানের আত্মশক্তি এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রবীন্দ্রনাথকে বিপুলভাবে আকৃষ্ট ও বিমুগ্ধ করেছিল। ওকাকুরার ভারত ভ্রমণের আগে সেই ১৯০১ সালেই রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্যের এই সবুজ সরস জীবনসমৃদ্ধ দেশটিকে স্বচক্ষে পর্যবেক্ষণ করার ইচ্ছে পোষণ করেছিলেন। তাঁর সেই গুপ্তসাধকে অদম্য লেলিহান করে তুলেছিলেন ওকাকুরা ভারতে গিয়ে। সেই যে শুরু হল “জাপান-বাংলা শিক্ষা-সাংস্কৃতিক ভাববিনিময়ে”র সম্পর্ক আজও তা বিদ্যমান। এই সম্পর্ক স্থাপনে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল ওকাকুরার “নিহোন বিজুৎসুইন”, এটা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৮৯৮ সালে বেসরকারিভাবে জাপানে প্রথম। কিন্তু নানা সমস্যার কারণে তা দ্রুত বন্ধ হয়ে গেলে পুনরায় তাঁর শিষ্যরা ১৯১৪ সালে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন একই জায়গা টোকিওর নিপ্পোরি শহরস্থ “ইয়ানাকা” মহল্লায়। পুনঃপ্রতিষ্ঠার শতবর্ষপূর্তি উদযাপিত হয়েছে ২০১৪ সালে। এই উপলক্ষে টোকিও মেট্রোপলিটান আর্ট মিউজিয়াম “সেইকি নো নিহোনগা” বা “শতবর্ষের জাপানি চিত্রকলা” নামে ১ জানুয়ারি থেকে ১ এপ্রিল পর্যন্ত ১২০টি বিশেষ চিত্রকর্ম প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল। এছাড়া অন্যান্য শহরেও অনুরূপ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই ১২০টি চিত্রকর্মের শিল্পীদের কতিপয় “নিহোন বিজুৎসুইনে”র সরাসরি ছাত্র আর বাকি জনেরা ওকাকুরার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ শিষ্য। এঁদের মধ্যে দুজন খ্যাতিশীর্ষ চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান ও হিশিদা শুনসোও ওকাকুরা তেনশিন কর্তৃক ১৯০৩ সালে ভারত তথা কলিকাতায় প্রেরিত হন এবং মাস তিনেক অবস্থান করেন মল্লিক পদবিধারী এক ব্যবসায়ীর গৃহে, পরবর্তীতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে। সেই সময় দুজন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬৭-১৯৩৮), নন্দলাল বসু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখের সঙ্গে ভাববিনিময় ও চারুকলার কলাকৌশল সম্পর্কে মতবিনিময় করেন। এঁদের ছাড়াও “নিহোন বিজুৎসুইনে”র ছাত্র চিত্রশিল্পী কাৎসুতা শোওকিন এবং ওকাকুরার ভাবশিষ্য কাম্পো আরাই ভারতে যান যথাক্রমে ১৯০৫ এবং ১৯১৬ সালে। দুজনেই কলিকাতা ও শান্তিনিকেতনে অবস্থান করেন দীর্ঘদিন। রবীন্দ্রনাথ ১৯১৬ সালে প্রথমবার জাপান ভ্রমণ করেন তখন চিত্রশিল্পী মুকুলচন্দ্র দেকে (১৮৯৫-১৯৮৯) সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। ১৯২৪ সালে তৃতীয়বার জাপান ভ্রমণকালে সঙ্গী হন শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। নন্দলাল বসুর পুত্র চিত্রশিল্পী বিশ্বরূপ বসুও জাপানে এসেছিলেন, অবস্থান করেছেন চার বছর। সেই সময় তাঁর তত্ত্বাবধান করেছেন নন্দলালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু চিত্রশিল্পী কাম্পো আরাই। এভাবে দুদেশের শিল্পীরা দুদেশে আসাযাওয়া করেছেন। আর শিল্পকলার এই ভাববিনিময়ের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাদর্শী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৪০ বছর কাল। কবিগুরু জাপানি চিত্রকলার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন বিধায় আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন শান্তিনিকেতনে ‘“নিহোনগা” তথা “ঐতিহ্যবাহী জাপানি চিত্রককলা”র পদ্ধতি, সংস্কৃতিকে ছড়িয়ে দিতে। তাই চেয়েছিলেন জাপানি মাস্টাররা আসুক, শিক্ষাবিনিময় করুক বাংলার নবীন শিক্ষার্থী এবং প্রবীণ শিল্পীদের সঙ্গে। এইভাবে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে জাপানের শিক্ষাকেন্দ্র তথা “জাপান ভবনে”র স্বপ্ন দেখেছিলেন, যা বাস্তবায়ন করতে এগিয়ে এসেছিলেন ওকাকুরার ভাবশিষ্য ভারতীয় দর্শনের পণ্ডিত টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.বিয়োদোও ৎসুশোও এবং জাপানশীর্ষ রবীন্দ্রগবেষক, বাংলা ভাষার পণ্ডিত ও বাঙালিপ্রেমী অধ্যাপক কাজুও আজুমা ১৯৯৪ সালে “নিপ্পন ভবন” নামে। “নিপ্পন” জাপান দেশটির প্রকৃত নাম।

 

দূরদর্শী পরিকল্পনা: কিন্তু কেন ওকাকুরা তেনশিন “নিহোন বিজুৎসুইন” তথা “জাপান আর্ট ইনস্টিটিউট” প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন? এই প্রশ্নটি স্বভাবতই এসে যায় যেখানে ইতোমধ্যে জাপানের প্রথম “টোকিও বিজুৎসু গাক্কোও” বা “টোকিও ফাইন আর্ট স্কুল” প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে সরকারিভাবে ১৮৮৭ সালে এবং তিনি ১৯৮৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে এর দ্বিতীয় অধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর আমলেই য়োকোয়ামা তাইকান, হিশিদা শুনসোও, শিমোমুরা কানজান প্রমুখ ছাত্ররা প্রথম স্নাতক হওয়ার গৌরব অর্জন করেন এবং এই বিদ্যালয়েরই শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ক্রমে এই প্রতিষ্ঠানে ১৮৯৬ সালে শুধু জাপানি নয়, পাশ্চাত্য চিত্রকলার রীতি-পদ্ধতিও শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হয়। ওকাকুরা পাশ্চাত্য চিত্রকলা তথা “য়োওগা”র চেয়ে “নিহোনগা”র প্রতি গুরুত্ব আরোপ করলে শুরু হয় প্রতিপক্ষ শিক্ষকদের সঙ্গে নীতি ও আদর্শগত দ্বন্দ্ব। ক্রমশ সেটা তীব্র আকার ধারণ করে। দীর্ঘকাল তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করে সফল হন তাঁরই এককালের শিষ্য এবং পাশ্চাত্য রীতির ডিজাইনিং প্রফেসর ফুকুইচি মাতাইচি (১৮৬২-১৯০৯)। এই ষড়যন্ত্রের পেছনে পাশ্চাত্যপন্থী প্রভাবশালী আমলারাও ইন্ধন জোগান যেমন, শিক্ষা মন্ত্রী সায়োনজি কিন্মোচি (১৮৪৯-১৯৪০), শিল্পী-শিক্ষক কোয়ামা শোওতারোও (১৮৫৭-১৯১৬), কুরোদা কিয়োয়েতেরু (১৮৬৬-১৯২৪) প্রমুখ। তাঁরা উক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটিকে ফেনোলসা-ওকাকুরার প্রবর্তিত নীতি ও পদ্ধতির পরিবর্তে পাশ্চাত্য রীতির শিল্পকলা শিক্ষার প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তাঁদের বিবেচনায় ঐতিহ্যবাহী জাপানি চিত্রকলা তখন অপাঙতেয় এবং আধুনিকতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কিন্তু ঐতিহ্যের যে কোনো বিকল্প হয় না শিল্পবোদ্ধা ওকাকুরা সেটা ভালো করেই জানতেন এবং এটাও জানতেন প্রাচ্যশিল্পকলায় প্রকৃতির যে বিপুল বৈচিত্র্য সেটা প্রতীচ্যের সভ্যতায় নেই। সুতরাং ঐতিহ্যগত শিল্পকলাকে ধরে রাখতে হবে এবং ক্রমাগত গবেষণা করে নতুন নতুন চিন্তাজাত পদ্ধতি সংযোজন করতে হবে। তবেই সেটা টেকসই এবং কালজয়ী হবে। বস্তুত, এই গবেষণার জন্যই “নিহোন বিজুৎসুইন”প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন ওকাকুরা পর্যাপ্ত অর্থকড়ি ছাড়াই। কথিত আছে যে, তিনি আমেরিকার অধিবাসী প্রভাবশালী চিকিৎসক, শিল্পকলার পৃষ্ঠপোষক ও সংগ্রাহক তাঁর বিশিষ্ট শুভাকাঙ্ক্ষী উইলিয়াম স্টারগিস বিগেলোর (১৮৫০-১৯২৬) কাছ থেকে একটি বড় অঙ্কের অর্থ সাহায্য নিয়েছিলেন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য। ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ওকাকুরার অনুধাবন যে মোটেই বিফলে যায়নি এর বড় প্রমাণই হচ্ছে প্রাচ্যরীতিতে আঙ্কিত “নিহোনগা” চিত্রসমূহ যা আজ দেশ-বিদেশে জনপ্রিয় এবং জাপানের মহামূল্যবান জাতীয় সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত। আজও যখন কোনো জাদুঘরে প্রদর্শনী হয় জাপানিরা হুমড়ি খেয়ে পড়েন দেখার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ১৮৯৮ সালেই ওকাকুরা তেনশিনকে “ইম্পেরিয়াল জাদুঘরের ট্রাস্টি” এবং “টোকিও ফাইন আর্ট স্কুলে”র অধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করা হয়। কারণ হিসেবে দেখানো হয় তাঁর অতিরিক্ত মাদকাসক্তি, স্নায়ুবৈকল্য, দায়দায়িত্বের প্রতি উদাসীন, অসঙ্গতিপূর্ণ আচার-আচরণ, পৃষ্ঠপোষক ব্যারন কুকি রিউইচির পত্নী হাৎসুকোর (১৮৬০-১৯৩১)সঙ্গে পরকীয়াঘটিত কেলেঙ্কারি ইত্যাদি। অবশ্য এই অভিযোগগুলোর কতিপয় একেবারে ভিত্তিহীন একথা বলা যাবে না। ফলে এই ঘটনাগুলো তাঁর ব্যক্তিত্বকে ক্রমশ অনুজ্জ্বল করে তুলছিল। কিন্তু ওকাকুরা ছিলেন চারিত্রিকভাবে উদার, একরোখা এবং চঞ্চলপ্রকৃতির মানুষ। ছিলেন একজন জাতীয়তাবাদী স্বাধীনচেতা, দিলখোলা, আধুনিক এবং আপদমস্তক রোমান্টিক মানুষ, তাই ক্ষুদ্রমনা মানুষের ক্ষুদ্রচিন্তা, আচার-আচরণকে কখনোই আমলে নেননি। তাই এসব কারণে মোটেই দমে যাননি তিনি। পদত্যাগ করার পর স্কুলের শিক্ষা অনুষদের ১৭জন সদস্য তাঁকে সমর্থন করে চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন অধ্যাপক, চিত্রশিল্পী, ভাস্কর, ডিজাইনার যেমন, য়োকোয়ামা তাইকান, হাশিমোতো গাহোও, শিমোমুরা কানজান, হিশিদা শুনসোও, ওকাবে কাকুইয়া (১৮৭৩-১৯১৮), তেরাসাকি কোওগিয়োও (১৮৬৬-১৯১৯) প্রমুখ, যাঁরা পরবর্তীকালে স্ব স্ব মেধা ও প্রতিভাবলে প্রভূত সুনাম অর্জন করেছিলেন দেশ-বিদেশে।

 

মহৎ লক্ষ্য: শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিনের দুটি লক্ষ্য ছিল “নিহোন বিজুৎসুইন” প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠার পেছনে। একটি হচ্ছে, হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, এবং অন্যটি হচ্ছে, শিল্পকলায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ যা স্কুলে নয় সম্ভব ইনস্টিটিউশনে। তাই “নিহোন বিজুৎসুইন” হচ্ছে জাপানের প্রথম আর্ট ইনস্টিটিউট। ১৮৮৯ সালে এটা প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তাঁকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছিল। কারণ একটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করার মতো বিপুল পুঁজি তাঁর কাছে আদৌ ছিল না। তাঁর সহধর্মিণী মোতোকোর (১৮৬৫-১৯২২) পরামর্শে ওকাকুরা তাঁর আমেরিকান বন্ধু চিকিৎসক এবং শিল্পকলার বিশিষ্ট সমঝদার যিনি ১৮৮২ সালে জাপান ভ্রমণ করতে এসে ওকাকুরার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়েছিলেন সেই উইলিয়াম স্টারগিস বিগেলোর কাছ থেকে দশ হাজার ডলার চাঁদা নিয়েছিলেন। তাছাড়া অন্যান্য প্রভাবশালী জাপানিরাও তাঁকে আর্থিক সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি তখন বসবাস করতেন রাজধানী টোকিওর প্রথম আধুনিক শহর “উয়েনো”র পার্শ্ববর্তী “ইয়ানাকা” উপশহরে। যা কিনা তাঁর আগের স্কুল “টোকিও আর্ট স্কুলে”র একেবারেই কাছে, এবং এখানেই তাঁর বাড়িতে তিনি ‘“বিজুৎসুইন” স্থাপন করেন চিত্রশিল্পী য়োকোয়ামা তাইকান, হাশিমোতো গাহোও, হিশিদা শুনসোও, শিমোমুরা কানজান প্রমুখকে নিয়ে। এই প্রতিষ্ঠানের আচার্য হিসেবে ওকাকুরার চিন্তা ও তত্ত্বাবধানে তাইকান ও হিশিদা কিছু নতুন ধারার চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন যেমন “মোওরোওতাই” যা কিনা অস্পষ্ট সূক্ষ্মরেখাযুক্ত তুলির টান বা ধোঁয়াশা। গুরুদেব ওকাকুরার নির্দেশে তাঁরা এই পদ্ধতিতে বাতাসেরও ছবি আঁকতে সক্ষম হয়েছিলেন।

 

অবিভক্ত বাংলার সঙ্গে সম্পর্ক: এই ইয়ানাকা শহরে বসেই তিনি লেখেন তাঁর প্রথম এবং কালজয়ী ইংরেজি গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি The Ideals of the East with special reference to the Art of Japan নামে ১৯০১ সালে। এই সময় তাঁর প্রতিষ্ঠানের ছাত্রী ছিলেন প্রভূত ধনী মার্কিন নাগরিক মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড (১৮৫৮-১৯৪৯), তিনি সেটা ওকাকুরার মুখে শোনেন এবং এই প্রবন্ধটিকে গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্য প্রস্তাব দেন। তখন পাশ্চাত্যের ধনীকন্যা মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড এবং তাঁর এক বান্ধবী শিল্পী মিস হেলেন হাইড (১৮৬৮-১৯১৯) জাপানে শিল্পকলার ওপর গবেষণা করার জন্য এসে ওকাকুরার কাছে শিক্ষালাভ করছিলেন। ওকাকুরা তাঁদের অনুরোধে সপ্তাহে একদিন শিল্পকলার ইতিহাস পড়াতেন। মিস ম্যাকলাউড ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দের (১৮৬৩-১৯০২) একনিষ্ঠ শিষ্যা। ১৮৯৫ সালে নিউইয়র্কে তিনি স্বামীজির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এসে তাঁর ভক্ত হয়ে পড়েন। স্বামীজির প্রধান শিষ্যা সিস্টার নিবেদিতা তথা আইরিশকন্যা এলিজাবেথ মার্গারেট নোবলেরও (১৮৬৭-১৯১১) বান্ধবী ছিলেন তিনি। মনে হয় মিস জোসেফিনের প্রস্তাবেই ওকাকুরা তেনশিন ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং তাঁর সঙ্গে জাহাজে চড়েন ১৯০১ সালের নভেম্বর মাসের ১২ তারিখে তাঁর এক তরুণ শিষ্য বৌদ্ধ পুরোহিত হোরি শিতোকুকে (১৮৭৬-১৯০৩) নিয়ে, যিনি হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তিনিকেতনস্থ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়ের প্রথম বিদেশি ছাত্র। ১৯০২ সালের ৬ই জানুয়ারি মাদ্রাজ হয়ে কলিকাতায় পৌঁছেন ওকাকুরা। অবশ্য যাওয়ার আগেই স্বামীজির সঙ্গে ওকাকুরার পত্রালাপ ঘটে। মিস জোসেফিনই যে এই সম্পর্ক স্থাপনের অনুঘটক তা আর না বললেও চলে। এর আগে আমেরিকার শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলনে একজন ভারতীয় তরুণ সনাতন ধর্মাবলম্বী সন্ন্যাসী নরেন্দ্রনাথ দত্ত সনাতন ধর্ম সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে বিশ্বখ্যাতি অর্জন করেছেন। উপাধি অর্জন করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ নামে। এই সংবাদ ওকাকুরা জাপানের গণমাধ্যমে পড়ে থাকবেন বলে ধারণা হয়। কারণ ওই সম্মেলনে জাপানের শিন্তোও ধর্মীয় প্রতিনিধিও বক্তৃতা করেছেন স্বদেশের ধর্ম সম্পর্কে। সেই সংবাদ জাপানের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু স্বামীজি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনেছিলেন স্বামীজি-শিষ্যা মিস জোসেফিনের কাছে বলে সহজেই অনুমেয়। এবং এই ঘটনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওকাকুরা জাপানের একদা প্রাচীন রাজধানী কিয়োতো নগরে অনুরূপ একটি প্রাচ্য ধর্ম সম্মেলন আয়োজনের চিন্তা করে স্বামী বিবেকানন্দকে অতিথি হিসেবে উপস্থিত হওয়ার জন্য চিঠি প্রেরণ করেন। জাপানে যাতায়াত ও অবস্থানসহ ৩০০ মার্কিন ডলারও পাঠিয়ে দেন। কিন্তু জবাবে স্বামীজি শারীরিক অসুস্থতার জন্য অপারগতা জানান। এই তথ্য জানা যায় মিস জোসেফিনের একটি চিঠি থেকে। এতে দমে গেলেন না ওকাকুরা। ভারতে যাওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলেন। সরকারের বিশেষ এক তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ করে মিস জোসেফিনের সঙ্গে ভারতের দিতে যাত্রা করলেন। কলিকাতায় পৌঁছে স্বামীজি বিবেকানন্দ, সিস্টার নিবেদিতা, ধীরামাতা মিসেস সারা সি বুল (১৮৫০-১৯১১), অরবিন্দ ঘোষ (১৮৭২-১৯৫০), রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭২-১৯৪০) প্রমুখের সঙ্গে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়। ভারতে তিনি প্রায় দশ মাস অবস্থান করেন এবং অধিকাংশ সময় আতিথ্যগ্রহণ করেন বিপ্লবী ও ব্যাংকার সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়িতে। ভগিনী নিবেদিতার তত্ত্বাবধানে সঙ্গে বহনকৃত পাণ্ডুলিপির সংযোজন ও সংশোধন করেন। ১৯০৩ সালে লন্ডনের জে.মারি কোম্পানি থেকে ুঞযব ওফবধষং ড়ভ ঃযব ঊধংঃ” নামে প্রকাশিত হয়। ভগিনী নিবেদিতা গ্রন্থের ভূমিকা লেখেন। কালজয়ী এই গ্রন্থটির সূচনা বাক্যটিই হচ্ছে বহুল আলোচিত ুঅংরধ রং ঙহব”, অর্থাৎ এশিয়া এক। কলিকাতায় অবস্থানকালে তিনি নিরপরাধ ভারতবাসীর ওপর অমানবিক, অমানুষিক অত্যাচার ও নিপীড়নের ইতিহাস জেনে গভীরভাবে ব্যথিত হন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি প্রকাশ্যেই সমর্থন জানিয়ে একটি বুলেটিনও প্রকাশ করার কথা জানা যায় তাঁর প্রিয় শিষ্য শিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের জীবনবৃত্তান্ত থেকে। এই বুলেটিন ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে পুড়িয়ে দেয় এবং ওকাকুরাকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করে ভারতত্যাগের জন্য। ওকাকুরা ভারতত্যাগে বাধ্য হলেও জ্বালিয়ে আসেন তরুণ প্রজণে¥র মধ্যে স্বাধীনতার আগুন। জাপানের অত্যন্ত উগ্র জাতীয়তাবাদী “গেনয়োওশা” সংস্থার মতো গুপ্ত রাজনৈতিক সংগঠন “অনুশীলন সমিতি” গঠনে উদ্বুদ্ধ করেন তরুণ বিপ্লবীদেরকে। স্বাধীনতার সেই উষ্ণ আগুন বুকের ভেতরে বহন করে জাপানে পালিয়ে এসে “গেনয়োওশা”র প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক উগ্র জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব গুরু তোওয়ামা মিৎসুরুর (১৮৫৫-১৯৪৪) কাছে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন ১৯১৫ সালে ২৯ বছর বয়সী তরুণ মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু (১৮৮৬-১৯৪৫), ১৯১৬ সালে জাপানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম ভ্রমণের পরিকল্পনাকে ভিত্তি করে কবিগুরুর সচিবের ছদ্মবেশে “পি এন টেগোর” তথা “প্রিয়নাথ ঠাকুর” নামে। বাকীটা তো ইতিহাস——ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে এবং স্বাধীনতা অর্জনে তাঁর ভূমিকা ও অবদান বিশ্ব ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। কাজেই দূরদর্শী ওকাকুরা তেনশিনের ভারত ভ্রমণ যে কতখানি তাৎপর্যপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী হয়েছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এক্ষেত্রে বলা যায় ওকাকুরা তেনশিনই ছিলেন ভারতীয় স্বাধীনতার প্রতি প্রথম জাপানি সমব্যথী সমর্থক। জাপান, চিন ও ভারতকে নিয়ে যিনি একটি ঐক্যবদ্ধ এশিয়া মহাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। জাপানে ফিরে এসে তিনি তাঁর দুই প্রধান শিষ্য তাইকান ও হিশিদাকে ভারতে পাঠান। ১৯০৫ সালে পাঠান বন্ধুবর রবীন্দ্রনাথের অনুরোধে জুদোও ক্রীড়াবিদ সানো জিননোসুকেকে (১৮৮২-১৯৩৮)।

ওকাকুরা-প্রিয়ম্বদা প্রণয়: বরাবরই অস্থির প্রকৃতির মানুষ ওকাকুরা তেনশিন দুই শিষ্য তাইকান ও হিশিদাকে ভারতে পাঠানোর পর নিজেও বন্ধুবর ডাঃ বিগেলোর আমন্ত্রণে আমেরিকার বোস্টন শহরে যান ১৯০৪ সালে। এই সালে লেখেন আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ গ্রন্থ ুঞযব অধিশবহরহম ড়ভ ঔধঢ়ধহ”, প্রকাশিত হয় নিউইয়র্কের সেঞ্চুরি কোস্পানি থেকে। এদিকে নিজের “নিহোন বিজুৎসুইন”প্রতিষ্ঠানটি নিদারুণ আর্থিক অনটনে পর্যবসিত হয়। উপায়ন্তর না দেখে ১৯০৫ সালে টোকিওর ইয়ানাকা থেকে বহুদূর ইবারাকি-প্রদেশের সমুদ্রতীরসংলগ্ন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অমরাবতী বলে খ্যাত “ইজুরা” নামক আধাশহর-আধাগ্রাম এক স্থানে স্থানান্তরিত করেন সহযোগী তাইকান, হিশিদা, কানজান এবং বুজানকে নিয়ে। এখানে চিত্রাঙ্কন ও গবেষণার কাজ করলেও বেশিদিন সচল থাকেনি এটা। ওকাকুরা জাপান-ভারত-আমেরিকা আসাযাওয়ার কারণে নজর দিতে ব্যর্থ হন। পরের বছর ১৯০৬ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় কালজয়ী অনন্যসাধারণ আধ্যাত্মিক গ্রন্থ ুঞযব ইড়ড়শ ড়ভ ঞবধ”, নিউইয়র্কের পুটনামস প্রকাশনা সংস্থা থেকে। ১৯০৮ সালে তাঁর দুই প্রিয় শিষ্য হাশিমোতো গাহোও এবং হিশিদা মৃত্যুবরণ করেন। তার আগেই শিমোমুরা কানজান চলে যান পুনরায় যেখানে ছিলেন সেই টোকিও আর্ট স্কুলে। ১৯১০ সালে “মিউজিয়াম অব ফাইন আর্টস বোস্টনে”র এশিয়ান বিভাগের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন প্রথম প্রাচ্যবাসী হিসেবে ওকাকুরা তেনশিন যা এক বিরল সম্মানজনক ঘটনা। এখানে কর্মরত অবস্থায় অসুস্থ হয়ে পড়লে ১৯১২ সালে জাপানে ফেরার পথে পুনরায় ভারতের বোম্বে বন্দরে বিরতি গ্রহণ করেন। সেখান থেকে কলিকাতায়। নতুন এবং অনন্য এক ইতিহাস রচনা করেন বাংলার মহিলা কবি প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (১৮৭১-১৯৪৫) সঙ্গে প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হয়ে। বাংলাদেশের পাবনা জেলার গুনাইগাছায় জন্ম সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীর (১৮৬৮-১৯৪৬) বোনঝি, রবীন্দ্রনাথের আত্মীয় এবং বিধবা চল্লিশোর্ধ বিদূষী সুন্দরী প্রিয়ম্বদার সঙ্গে তিনবার সাক্ষাৎ ঘটে ওকাকুরার। তাতেই পরস্পর নীরবে প্রণয়সুতোয় বাঁধা পড়েন। ফেরার পথে জাহাজ থেকে প্রথম দুটি চিঠি লেখেন ওকাকুরা প্রিয়ম্বদাকে। সেই চিঠির যথারীতি জবাব পান ওকাকুরা। প্রাপ্তি সংবাদসহ আবার চিঠি লেখেন। এভাবে অনেকগুলো চিঠি তাঁদের মধ্যে আদানপ্রদান হয়। গড়ে ওঠে নিষ্কাম প্রেম। ১৯১৩ সালে ওকাকুরা তেনশিন ইজুরার বাসভবনে মৃত্যুবরণ করেন আর তাঁর স্মৃতি বুকে ধারণ করে মৃত্যু পর্যন্ত কাটিয়ে দেন একাকী প্রিয়ম্বদা বন্দ্যোপাধ্যায়। ওকাকুরার মৃত্যুর পর প্রিয়ম্বদার চিঠিগুলো আবিষ্কৃত হয় তাঁর অনুজ ইংরেজি ভাষা বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদ ওকাকুরা য়োশিসাবুরোও (১৮৬৮-১৯৩৬) কর্তৃক। ব্যাপক সাড়া পড়ে যায় জাপানের সাহিত্য ও বুদ্ধিজীবী মহলে। বর্তমানে দুজনের চিঠিপত্রগুলো যথাক্রমে ইবারাকি-প্রদেশের তেনশিন স্মৃতিজাদুঘর এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত আছে।

 

ওকাকুরার মূল্যায়ন: ১৯১৩ সালে ওকাকুরা তেনশিনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ইজুরার নিহোন বিজুৎসুইন বন্ধ হয়ে যায়। পরের বছর ১৯১৪ সালে আবার ইয়ানাকা শহরে শিষ্যশীর্ষ শিল্পী য়োকোয়ামা তাইকানের নেতৃত্বে পুনরায় প্রতিষ্ঠানটি চালু করা হয় সরকারের সহযোগিতায় তবে শিক্ষাঙ্গন হিসেবে নয় গবেষণা ও চিত্রপ্রদর্শনীস্থল হিসেবে শিক্ষাগুরুর পবিত্র স্মৃতির সম্মানার্থে। ১৯১৬ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বন্ধু ওকাকুরার প্রতিষ্ঠিত “নিহোন বিজুৎসুইন” যার কথা জানতেন সেটা পরিদর্শনে আসেন ইয়ানাকা শহরে পাশ্ববর্তী উয়েনো শহরে অবস্থিত য়োকোয়ামা তাইকানের বাসভবনে প্রায় দশদিন আতিথ্যগ্রহণ করার শেষদিনে। এখানে তিনি “ফিলোসফি অব আর্ট” নামে একটি বক্তৃতা করেন। যদিও বা এখন এই স্থানে কোনো ভবনাদি নেই তবে কাছেই নতুন একটি ভবনে স্থানান্তরিত হয়েছে “নিহোন বিজুৎসুইন” সেখানে বছরে একবার বিখ্যাত চিত্রকর্মের প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। তবে তেনশিনের বাসভবন তথা নিহোন বিজুৎসুইনের স্থানটিকে স্থানীয় নগর প্রশাসন “তেনশিন কিনেন কোওয়েন” বা “তেনশিন স্মৃতি উদ্যান” নামকরণ করেছেন এবং ওকাকুরার স্বকৃত নকশাসম্বলিত ছয়কোণবিশিষ্ট কুঠুরি “রোকুকাকুদোও” যার মূলটি আছে ইজুরাতে তার একটি অনুরূপ এখানে স্থাপন করা হয়েছে। এই কুঠুরির ভেতরে রয়েছে ওকাকুরার একটি আবক্ষ সোনালি রঙের ভাস্কর্য। একমাত্র ইয়ানাকা বাৎসরিক উৎসবের সময় খুলে দেয়া হয় সাধারণের দর্শনের জন্য কুঠুরিটি।

 

কেইসেই রেলওয়ের “নিপ্পোরি” স্টেশনসংলগ্ন ইয়ানাকার পথ ধরে এঁকেবেঁকে হেঁটে গেলে চলে যাওয়া যায় তিরিশ মিনিটের মধ্যেই টোকিও চারুকলা বিশ্ববিদ্যালয় বা টোকিও গেইজুৎসু দাইগাকু তথা সেই আদি “টোকিও বিজুৎসু গাক্কোও”র ক্যাম্পাসে যে প্রতিষ্ঠান থেকে একদিন এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা-সদস্য ওকাকুরা তেনশিনকে অপসারণ করা হয়েছিল ১৮৯৮ সালে। আজ সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফটকের পাশেই স্থাপিত আছে দূরদর্শী মনীষী শিল্পচার্য প্যান-এশিয়ানিস্ট ওকাকুরা তেনশিনের একটি স্মারক ভাস্কর্য। “নিহোন বিজুৎসুইন”ও টিকে আছে তাঁর স্মৃতি বুকে ধারণ করে। জাপানের বৈচিত্র্যময় শিল্পকলার ইতিহাস, জাপান-বাংলা শিল্পসংস্কৃতির সেতুবন্ধন এবং সুদূরপ্রসারী ভারত-জাপান দ্বিপাক্ষিক রাজনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ওকাকুরা তেনশিনের এই প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা এক চিরস্থায়ী অধ্যায়। কেননা এই প্রতিষ্ঠানে যদি স্বামীজির শিষ্যা মিস জোসেফিন না আসতেন তাহলে ওকাকুরা কবে কলকাতায় যেতেন বা আদৌ যেতেন কিনা সেই প্রশ্নটি থেকেই যায়।

 

প্রবীর বিকাশ সরকার, জাপান প্রবাসী শিশুসাহিত্যিক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক

একজন রোমাঞ্চপ্রিয় মানুষ ও তাঁর তোলা কিছু দুর্লভ আলোকচিত্রের কথা

আলম খোরশেদ অনেকেই জানেন যে, প্রখ্যাত ফরাসি কল্পবিজ্ঞানলেখক জ্যুল ভের্ন এর কিংবদন্তিতুল্য গ্রন্থ ‘অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ’ অবলম্বনে ১৯৫৬ সালে হলিউডে একই নামে

প্রগতির পথে, জীবনের গান, সকল অশুভ শক্তির হবে অবসান” এই আহবানে উদীচী চট্টগ্রাম জেলা সংসদের ৫৭ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন

\ ভাস্কর ধর \ সাম্প্রদায়িক অপশক্তিকে প্রতিহত করার আহ্বানের মধ্য দিয়ে এবং প্রগতির লড়াইকে দৃঢ় করার দৃপ্ত শপথের মধ্য দিয়ে উদীচীর ৫৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। 

আমার বাবা কর্নেল তাহের

জয়া তাহের   আমাকে যখনই কেউ জিজ্ঞাসা করেন, কর্নেল তাহেরের মেয়ে হিসেবে আপনার অনুভূতি কি? আমার চোখের সামনে এক নিমেষেই ভেসে ওঠে ৪০ বছরের অসংখ্য

ছাগল-মাহাত্ম্য

ড. ইউসুফ ইকবাল ভূপৃষ্ঠের বঙ্গ-ভূভাগে দ্রুতবর্ধমান প্রাণিকুলের মধ্যে সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য প্রাণিটির নাম ছাগল। আমাদের একচুয়াল ও ভার্চুয়াল প্রতিবেশ-বাস্তব ও মেটাফোরিক পরিমণ্ডলে এর প্রভাব অপরিসীম। ছাগলের

সৈয়দ মনজুর কবির-এর অনুগল্প

শুধুই কলিজার টুকরা পারে   সম্প্রতিক সৃষ্টি হওয়া চরম বিপরীতমুখী দুই পরিবারের মাঝে একটি টানা বেড়ার আড়াল। শুধু ওপাশের আম গাছটির ছড়ানো লম্বা ডালটি চলে